গোধূলির বিকেল লাল মেঘে ঢাকা। ঠিক যেন মৃদু বাতাসের আঁচল কেটে রঙের ছোঁয়াছুঁয়ি রোদ্দুর। ছাদের এক কোণে রেলিংয়ের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে উমাইয়া। বিষণ্ণ মেজাজে এভাবে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিল সে। ফোনটা বিছানায় রেখে এসেছে। রোদেলা ও জুবিয়া তাকে খুঁজে না পেলেই কল করবে একারণে সে মোবাইলটি সঙ্গে আনেনি। ঘরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না উমাইয়ার। একটু সন্ধ্যা নামলে উমাইয়া রেলিং থেকে নামলো তারপর আবছা অন্ধকারে একজন মানুষের উপস্থিতি টের পেল সে। সহসা ভ্রু কুঁচকে গেল তার। একটু উঁচু গলায় শুধল, 'আপনি কে?'
সাদাফ চুপচাপ এসে রেলিং ধরে দাঁড়ালো, উমাইয়া থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে। সাদাফ অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল,
'আপনি আমার উপর রেগে আছেন কেন, উমা?'
উমাইয়া অভিমানী কণ্ঠে বলল,
'আপনার পরিচয় আমার কাছে গোপন করেছেন কেন?'
সাদাফ ভ্রু তুলে উমাইয়ার মুখের দিকে তাকাল। জানতে চাইল সে,
'আমি কি গোপন করেছি?'
সাদাফের চোখে চোখ রাখল উমাইয়া। অতি অবলীলায় দুই চোখের মিলন ঘটল। উমাইয়া রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
'আপনি সেলেব্রিটি, একজন বিখ্যাত গায়ক। তবুও কেনো এই পুরোনো বাড়ির ফ্ল্যাট কিনেছেন?'
সাদাফ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল উমাইয়ার দিকে। সাদাফের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল, উমাইয়া এতক্ষণ কাঁদলো কেন? চিন্তায় কপালে চার ভাজ পড়ল তার। সাদাফ নিশ্চুপ। উমাইয়া বলল,
'আপনি কথা বলছেন না কেন?'
সাদাফ শান্ত গলায় বলল,
'আমি সাদাফ ক্যাসানো। আমার পরিবারের সবাই যখন মারা গেছে তখন আমি ইতালিতে একটি কনসার্টে ছিলাম। সেদিন ছিল আমাদের চতুর্থ কনসার্ট। আমরা খুব খুশি ছিলাম যে লোকেরা আমাদের চিনতে শুরু করেছে ও আমাদের ভালবাসতে শুরু করেছে। তখন অনেক রাত ছিল। পরেরদিন খবর পাই আমার বাড়িতে কোনোভাবে রাতে আগুন লাগে আর আগুনে পুড়ে সবাই মারা গেছে। তখন থেকে আমি এতিম। আমার বন্ধু সেহরিশ আর তূর্ণ ছাড়া আমার আর কেউ নেই।
বাবা দেশের অনেক জমি বিক্রি করে আমাকে ইতালি পাঠিয়েছিল। ভালো কলেজে পড়ার খরচও বেশি। যা বাবা অনেক চেষ্টা করে দিতে হিমশিম খেতো। তখন আমি একটা রেস্তোরাঁয় চাকরি নেই। তারপর সব ভালোই চলছিল। সেহরিশের সঙ্গে আমার গভীর বন্ধুত্ব। প্রায় রাতে ডেলিভারির সময় সেহরিশ আমার সঙ্গে যেতো। একরাতে ডেলিভারি করতে যাবো তখন সেহরিশ কে সঙ্গে নিয়ে যাই। হঠাৎ কাস্টমারের সঙ্গে আমাদের দন্দ হয় তারপর হুট করে কাস্টমারের গায়ে হাত তুলি। সেখানে তূর্ণ উপস্থিত ছিল। তূর্ণর সঙ্গে হোটেলে প্রথম দেখা। হোটেলের মালিক আমাদের এরেস্ট করিয়ে দেয়। পুলিশ মোটা অংকের জরিমানা করলেন। আমাদের কারো কাছে কোনো টাকা ছিল না। এমন সময় এক ভদ্রলোক আমাদের হয়ে জরিমানা দেন তারপর থানা থেকে সোজা তার বাসায় নিয়ে গেলেন। আমাদের খাবার ও আশ্রয় দেয়। তিনি ব্রাইট মিউজিক বায়েসিয়ান কোম্পানির মালিক। উনি আমাদের নিয়ে একটা সঙ্গীত দল গঠন করতে চান, আমি আর তূর্ণ প্রথমে তার প্রস্তাবে রাজি হইনি। কিন্তু সেহরিশ। সে হুট করে রাজি হয়ে যায়। তখন থেকে সে বিএম গ্রুপের লিডার। আমরা অনেক সংগ্রাম করে ছোট একটা ফ্যান ফলোয়িং গড়ে তুলি। চতুর্থ কনসার্টে গানের পাশাপাশি আমাদের পরিবেশিত গান ও নাচ রেকর্ড করে। তারপর থেকে আমাদের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমরা সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাই। সাফল্যের মাঝে পরিবার হারানোর বেদনা বুকে গেঁথে যায়।
সব কষ্ট বেদনা পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ আমাদের এখনও চেনে না। আপনি তাদের মধ্যে একজন যারা আমাদের সম্পর্কে কিছুই জানেন না বা আমাদের নামও শোনেননি। আপনার সাথে প্রথম দেখা নার্সারিতে। আপনাকে প্রথম দেখে আমি একটু ঘাবড়ে যাই। দু-তিনটা কথা বলার পর বুঝলাম বাইরের জগৎ সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই। তখন একটু স্বস্তি পাই। মূলত আমি এমন একজন জীবনসঙ্গী চেয়েছিলাম। যে আমাকে সাধারন মানুষের মতো চিনবে, জানবে ও ভালবাসবে। এবার দেশে আসার পর তূর্ণর সঙ্গে ওর ফ্ল্যাটে থাকি। আপনার বাড়ির ঠিকানা পেয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করি। তারপর দ্বিগুণ দামে ফ্ল্যাট কিনি। শুধু আপনার কাছাকাছি থাকার জন্য, একটু দেরিতে হলেও আমি আমার সম্পর্কে আপনাকে সব বলে দিতাম। কিন্তু তার আগে আপনি অন্য কোথা থেকে সত্যটা জেনে আমাকে ভুল বুঝলেন।' কথাটুকু বলে থামল সাদাফ। জোরে নিঃশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাল সে। তারপর আবার বলল,
'আমি আপনার প্রেমে পড়েছি। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাকে ভালবাসার জন্য আমি আপনাকে বাধ্য করব না। আমি সেহরিশের সাথে তার গ্রামে যাব। সেহরিশের বোন আরুশির বিয়ের জন্য। নিজের খেয়াল রাখবেন উমা।'
উমাইয়া বাকরুদ্ধ হয়ে রইল। সাদাফ ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। তারপর হঠাৎ থেমে গেল সে। সাদাফ ঘুরে এসে উমাইয়ার মুখোমুখি দাঁড়াল। অসহায় কণ্ঠে অনুরোধ করে আবারও বলল,
'উমা আপনি কি আমার হবেন?'
উমাইয়া কোন উত্তর দিল না, তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে গেল। রুমে এসে আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াতে লাগল। সাদাফের কথা বারবার মনে পড়ছে তার। সঙ্গে সঙ্গে আয়নার দিকে তাকাল সে। আচমকা বিস্ময়ে চমকে উঠল উমা। মূহুর্তে সাদাফের হাসিমাখা মুখটা আয়নায় ভেসে উঠল। সাদাফ উমাইয়ার দিকে তাকিয়ে খুশিতে হাসল যেন। রোদেলা বিছানায় বসে আছে। উমাইয়ার লজ্জা মাখা চেহারা পর্যবেক্ষণ করে শুধাল,
'তোর কি হয়েছে? আয়নায় কি দেখছিস?'
উমাইয়া মোহিত গলায় বলল,
'রোদ?'
'হুহ। বল।'
'আমরা সব সময় যাদের নিয়ে বেশি চিন্তা করি, যাদের কথা বেশি ভাবি তাদের মুখ কী হুটহাট আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে?'
রোদেলা সন্দেহের চোখে তাকাল। জিজ্ঞেস করলো,
'তোর চোখে কার মুখ ভাসছে?'
রোদেলার প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে উমাইয়া তড়িঘড়ি করে চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় চলে গেল। রোদেলা নিষ্পলক চোখে উমাইয়াকে যেতে দেখল তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে এলো। ড্রয়ার থেকে এক প্যাকেট খাবার বের করে জোজোর পাশে বসল। জোজোর খাদ্যের প্লেট ভরে খাবার দিয়ে বলল,
'একবারে সব খাবি না। রাতের জন্য কিছু সংরক্ষণ করে রাখবি। রাতে ক্ষুধা লাগলে খাবি। শুধু ঘেউ ঘেউ করে কারো ঘুম নষ্ট করবি না। মনে থাকবে?'
জুবিয়া ড্রয়িং রুম থেকে উঠে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর তূর্ণর দেওয়া উপহারের বাক্সটা নিয়ে বিছানায় বসল। দুদিন ধরে বাক্সটা ব্যাগের ভেতর ছিল। জুবিয়া এটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। আজ হঠাৎ ব্যাগ থেকে কলম বের করার সময় বাক্সটা হাতে ঘষা লাগল। জুবিয়া অনেকক্ষণ ধরে বক্সটা সামনে নিয়ে বসে আছে। একবার ভাবলো ফেলে দিবে তারপর মন পরিবর্তিত করলো কারো দেওয়া উপহার ফেলে দিতে নেই। এতে উপহার দেওয়া মানুষটাকে অসম্মান করা হয়। জুবিয়া একটু ঝুঁকে এসে বাক্সের উপরে মোড়ানো কাগজ খুলল। একটা লাল বাক্স। বাক্সের ভেতরে কিছু নোট। জুবিয়া মৃদু হেসে চিরকুটটা নিল। খুলে দেখল ছোট ছোট অক্ষরে লিখা,
'এই বাক্সের ভিতরে কি আছে জানতে চাও?'
জুবিয়া চিরকুটটা সরিয়ে বিছানায় রাখল। তারপর আরেকটি নোট তুলে নিল।
'এত সহজে তুমি জানতে পারবে না এর মধ্যে কী আছে।'
জুবিয়া মৃদু হাসল। তারপর আরও কিছু নোট খুলল সে,
'বাক্সের ভিতরে কী আছে জানতে চাইলে পরবর্তী নোট পড়ো।'
এভাবে চারটি নোট পড়া শেষ করে। শেষ চিরকুটটা হাতে নিয়ে বসল জুবিয়া। অনেক সংকোচ নিয়ে চিরকুটটা খুলল সে। শেষ চিরকুটে তূর্ণ ইতালীয় ভাষায় লিখেছে,
'আমোরে মিও!'
জুবিয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। এই শব্দের অর্থ কি? জুবিয়া বুঝতে পারল না।
.
.
.
চলবে....................................