চশমা ছাড়া চোখে তেমন কিছুই দেখতে পান না সাহানা খাতুন। হলুদের অনুষ্ঠান থেকে চলে যেতে উদ্যত হলো। বেশ কিছুক্ষণ একভাবে বসে থাকায় কোমরটা অল্প অল্প ব্যথা করছে। এই সময় ঘরে গিয়ে শরীর টানটান করে শুতে পারলে শান্তি মিলবে। লাঠি ভর করে হাঁটতে শুরু করলেন সাহানা। খানিকটা পথ আসার পর হঠাৎ সামনে দিয়ে কয়েকটা ছেলেপুলে দৌঁড়ে নাচ-গানের ওখানে ছুটে গেল। বাচ্চাদের ভেতর একজনের সঙ্গে ধাক্কা লাগার ফলে সাহানার চশমাটা খুলে নিচে পরে যায়। চোখে সব কিছু আবছা দেখতে পেল সাহানা। একটু ঝুঁকে বসে দু'হাতে চশমা খুঁজতে লাগল। কালো টি-শার্ট, কালো প্যান্ট পরহিত একজন পুরুষ লোক এইদিক দিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ সাহানাকে দেখল সে। জিজ্ঞেস করে বলল,
' দাদি নিচে কি করছ?'
সুহানা মাথা তুলে তাকালেন। চোখে স্পষ্ট না দেখলেও কণ্ঠের মালিককে চিনতে বিড়ম্বনা হলো না তার। সাহানা মৃদু গলায় বলল,
' আমার চশমাটা পইরা গেছে ফাতিন দাদুভাই। একটু খুঁইজা দেও। চশমা ছাড়া আমি সব অন্ধকার দেখি।'
সেহরিশ এদিক ওদিক বার দুয়েক নজর ফেলতেই চেয়ারের পায়ার কাছে চশমা দেখল, সাহানা চোখে চশমাটি পরলেন। এরপর কোমরে হাত গুঁজে কসরত করে উঠে দাঁড়ালেন। এবার স্পষ্ট হলো সেহরিশের মুখখানা। সাহানা বিগলিত হাসি হেসে বললেন,
' আমারে ধইরা একটু ঘরে দিয়া আইবা দাদু? এতটা পথ একলা যাওনের সাহস পাইতাছি না।'
সেহরিশ এই প্রশ্নের জবাব দিল না। দাদির দাত ধরে এক পা দু পা করে যেতে লাগল। ফুলের বাগিচা টুকু পেরিয়ে গেলেই চৌধুরী বাড়ির সদরদপ্তর। ফুল বাগিচার সামনে হুট করে দাঁড়িয়ে গেলেন সাহানা। বুক ভারী হয়ে আসলো তার। তিনি এক নজরে বাগানের গাছগুলো একবার দেখল, এরপর বললেন,
' ফাতিন?'
' জি দাদি?'
' ছোটোবেলার কথা তোমার মনে আছে দাদু?'
' অল্প অল্প মনে আছে দাদি।'
সাহানা প্রশস্ত হাসলেন। মনে হলো তিনি এমন উত্তর-ই আশা করছিল। সাহানা বাগিচার গাছগুলোর দিকে সেহরিশ কে তাকাতে বলে তিনি চুপ করে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতার রেশ কাটিয়ে উঠে বললেন,
' তোমার মনে আছে দাদু এই জায়গার কথা?'
সেহরিশের থেকে কোনো জবাব এলো না। একটু থেমে সুহানা ফের বললেন,
' এই জায়গায় তুমি হাইসা খেলা কইরা বড়ো হইছ। তখনকার সময়ে এই জায়গা ফাঁকা ছিল। হুদা একটা কদমফুল গাছ ছিল। তুমি সব সময় গাছটায় চড়তে চাইলে আমার আপা পেত্নীর ভয় দেখাইত। কি সুন্দর দিনকাল ছিল তখন? তাছাড়া দাদুভাই ছোটো বেলায় তুমি আমার ছাড়া কারো হাতে খাবার খাইতা না। এই জায়গাটায় খাওনের বাটি লইয়া কত তোমার পিছনে দৌঁড়াইছি।'
অতীত মনে করে কেঁদে উঠলেন সাহানা। সেহরিশ বলল,
' দাদি তোমাকে রুমে দিয়ে আসি, চলো।'
উমাইয়া মেহেদী দিয়ে শেষ করল। নড়তে চড়তে পারছে না পিঠ ব্যথা করছে। উমাইয়া অসহায় দৃষ্টিতে রোদেলার দিকে তাকাল, এইসময় স্টেজ থেকে নামা যাবে না। এখনই আবার হলুদ মাখানোর নিয়ম শুরু হবে। রোদেলা হেঁটে গেল জুবিয়ার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল ওঁ। জুবিয়া মাথা তুলে তাকাল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
' মেহেদী দিবি?'
রোদেলা টিউব মেহেদী পরে না৷ মেহেদী তে ওর এলার্জি আছে। টিউব মেহেদী হাতে ছোঁয়ালে চুলকনি শুরু হয়ে যায়। জুবিয়ার এহেন প্রশ্নে বিস্মিত হলো রোদেলা। অবাক কণ্ঠে বলল,
' আমি মেহেদী দেই না। এলার্জি আছে। ভুলে গেছিস?'
জুবিয়া বলল,
' বাটা মেহেদীও আছে। দিবি?'
রোদেলার হাত রাঙাতে ইচ্ছে করছে না। মানা করে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। সেহরিশ দাঁড়িয়ে থেকে একবার রোদেলা কে দেখল, মেহেদী তে কারো এলার্জি হয়? প্রথম বার শুনলো সে।
সাদাফ সেহরিশের উদ্দেশ্য বলল,
' আজও কালো পরছিস? তোর জন্য স্যুট রুমে রেখে ছিলাম।'
সেহরিশ দৃঢ় গলায় বলল,
' বিয়ে তোর, আমার না।'
.
.
রাত ন'টা বাজে। গ্রাম গঞ্জে রাত ন'টা মানে অনেক রাত। এই সময় লোকজন কাজকর্ম শেষ করে একটু বিশ্রামের জন্য ঘুমাতে যায়। অনন্য দিন হলে সকলে এতক্ষণে ঘুমিয়ে যেত। বিয়ের জন্য গত এক সপ্তাহ বাড়ির কেউ ঠিকঠাক মতন ঘুমাতে পারেন নি। আজ তো আরও পারবেন না। এরইমধ্যে বাড়ির ছোটোদের ক্ষুধা পেয়েছে। তারা খাবারের জন্য বায়না করছে। শফিকুল চৌধুরী খাবার পরিবেশন করার অনুমতি দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সকলে ব্রেক নিয়ে খাবার খেতে চলে গেল। যেখানে জায়গা পাচ্ছে সেখানে খাবার প্লেট নিয়ে বসে গেছে। দুজন ক্যাটারিং এর লোক বর-কনেদের জন্য খাবার নিয়ে আসলেন।
অপরিচিত মানুষের দেওয়া কোনো কিছু সেহরিশ খায় না। একজন লোক তার হাতে একটা প্লেট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। সেহরিশ একপলকে খাবারের আইটেম গুলোয় চোখ বুলিয়ে দেখল। প্রায় সব কিছু তার প্রিয় খাবার। তূর্ণ আলাদা করে প্লেট নেয়নি। ওঁ সাদাফের সঙ্গে ডালা থেকে খাচ্ছে। সেহরিশ হুট করে তূর্ণ কে ডেকে বলল,
' তূর্ণ হা কর।'
গোশতের একটা টুকরা তূর্ণর মুখে পুড়ে দিল সেহরিশ। তূর্ণ প্রায় ভুলতে বসেছে শেষ কবে সেহরিশ তাকে খাইয়ে দিয়েছে? হঠাৎ করে পুরোনো কিছু স্মৃতি মনে পরে গেল। তূর্ণ আহ্লাদিত বোধ করে বলল,
' হঠাৎ এত ভালোবেসে খাওয়াচ্ছিস?'
সেহরিশ স্মিত হাসল। বলল,
' খাবারে বিষ নেই তো? চেক করছিলাম।'
বিস্ময়াভিভূত তাকিয়ে রইল তূর্ণ। অকপটে বলল,
' বিষ? আমাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চাচ্ছিলি?'
সেহরিশ বলল,
' মরিস নি তো। তার মানে খাবারে বিষ নেই। আমি খেতে পারব।'
তূর্ণ দাঁত কটমট করতে লাগল। সহসা এক হাসির শব্দ শ্রবণাঙ্গে প্রবেশ করল। তূর্ণ ঘুরে তাকাল, জুবিয়া শব্দ করে হাসছে। তূর্ণ ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হেসে বিড়বিড় করে বলল,
' মায়াবী, মায়াবতী, মৃগনয়নী!'
হলুদ মাখানোর সময়। বাড়ির গুরুজনেরা এক এক করে চারজন বর কনেকে হলুদ ছুঁয়ে দিচ্ছেন, ক্যামেরা বন্দি হচ্ছে সুন্দর সুন্দর মূহুর্তগুলো। বিখ্যাত গায়ক সাদাফ কাসানোর বিয়ে সাংবাদিক ভিড় জমিয়েছেন চৌধুরী বাড়ির সামনে। একবার এসে হলুদের কিছু ছবি তুলেছেন ওনারা। এরপর আর সুযোগ হয়নি। সেহরিশ এসব নিয়ম দূর থেকে দেখতে লাগল। জুবিয়া ও রোদেলা একসাথে এসে উমাইয়া কে হলুদ মাখাতে লাগল৷
উমাইয়া বলল,
' অল্প করে মাখা। ভূত বানিয়ে দিস না।'
রোদেলা কুটিল হাসল। জুবিয়ার সঙ্গে বুদ্ধি করে মুখ পুরো মাখিয়ে তুললো হলুদের রঙে। উমাইয়া কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো ওদের উপর। দু'জন সর্বক্ষণ এমনটাই করে। যে জিনিসটা বারণ করবে। ওরা যেন ওটাই বেশি বেশি করে। উমাইয়া অভিমান করেছে দেখল রোদেলা। এরপর হাসিমাখা মুখে উমাকে একহাতে জড়িয়ে নিল।
লনের উত্তর দিকে লোকজন কম। সেখানে একটা চেয়ারে বসা সেহরিশ। রোদেলার প্রাণখোলা, প্রাণোচ্ছল হাসিমুখ টায় বেশ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল সেহরিশ। অকস্মাৎ রোদেলা এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগল। সেহরিশ এভাবে তাকিয়ে রইলে ওদের চোখে চোখ পরবে। রোদেলা দেখার পূর্বে অন্য দিকে ঘুরে তাকাল সেহরিশ। এরপর মাথা নিচু করে মুচকি হাসল।
.
.
ঘড়িতে সময় ১১:৫০মিনিট। কাঁচা হলুদ মাখানো শেষ হয়েছে প্রায় একঘন্টা হলো, শরীরের সঙ্গে লেগে থেকে শুঁকিয়ে গেছে। শরীর টনটন করছে। ফারিয়া বেগম এসে দু'বার ডেকে গেছেন। চারজনের গোসলের পর ওনারা সবাই শুতে যাবেন। আরুশির কাজিনরা উমাইয়া কে বলল একটা গান করার জন্য। উমাইয়া গান জানে না। সে-রকম ভাবে কখনো চর্চা করা হয়নি। উমাইয়া ইতস্তত করে বলল,
' আমি গান জানি না।'
সামনে থেকে সবাই বলল,
' এই যুগে গান জানে না। এমন মানুষ আছে নাকি? আরে ভাবী বলুন তো।'
উমাইয়া অসহায় দৃষ্টিতে জুবিয়ার দিকে তাকাল। জুবিয়া মৃদু হেসে বলল,
' কনের বদলে তার বান্ধবীরা গান গাইলে চলবে?'
কেউ আপত্তি করল না। জুবিয়া একগাল হাসল। এরপর বলল,
' রোদেলা খুব ভালা গান জানে।'
আচমকা নিজ নামটি শুনে আঁতকে উঠল রোদেলা। চট করে এগিয়ে গেল। জুবিয়ার হাত শক্ত করে ধরে বলল,
' এইসব তুই কি বলছিস?'
জুবিয়া বলল,
' আমরা মেয়ে পক্ষ রোদু। আমাদের কনের জন্য তোকে আজ গান গাইতে হবে। প্লিজ লক্ষীটি, না, করিস না।'
রোদেলার নিঃশ্বাস ভারী হলো। হাই-স্কুল ও কলেজে থাকতে শখ করে একটু আধটু গান গাইত সে। তাই বলে ওর গানের গলা তেমন সুন্দর নয়। রোদেলা দ্বিধা করতে লাগল। সেহরিশ স্টেজ থেকে একটু দূরে বসে আছে। রোদেলা গান গাইবে শুনে অনৈচ্ছিকভাবে সে তাকাল।
সাদাফ বলল,
' রোদেলা সংকোচ কোরো না। আমাদের বিশ্বাস তুমি ভালো গাইবে।'
রোদেলা কিয়ৎকাল মাইক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর চোখ দুটি বন্ধ করে নিল। তারপর খালি গলায় গান ধরল,
চোরাবালি মন তোমার
কেনো শুধু লুকিয়ে থাকো
একটু আড়াল হয়ে
আমায় দেখো..
চোরাবালি মন তোমার
কেনো শুধু লুকিয়ে থাকো
একটু আড়াল হয়ে
আমায় দেখো..
যদি কোনো চিত্র আঁকি
পৃথিবীর সবচেয়ে দামি
সে চিত্র-তে
তুমি পারফেক্টলি বসো।
কেনো লাগে শূন্য শূন্য বলো,
তোমায় ছাড়া এত
তুমি কি তা বলতে পারো...
কেনো লাগে শূন্য শূন্য বলো,
তোমায় ছাড়া এত
তুমি কি তা বলতে পারো...
রোদেলা গান শেষ করে স্টেজ থেকে দ্রুত নেমে গেল। সেহরিশ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, চারিদিকের করতালির শব্দ যেন তার কর্ণপাত হচ্ছে না। চারিদিক কেমন নিরব, থমথমে। সেহরিশের বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠল, চারদিকের নিরবতা ভেঙে একটা কণ্ঠ, এক সুর তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে এসে বাজতে লাগল,
' কেনো লাগে শূন্য শূন্য বলো,
তোমায় ছাড়া এত
তুমি কি তা বলতে পারো...'
সেহরিশ শ্বাস নিতে পারল না। দম বন্ধ হয়ে আসতেছে এমন অনুভব হতে লাগল। শীর্ণ পায়ে লন থেকে প্রস্থান করে রুমে চলে গেল। অন্ধকার রুমটাকে ভয়াবহ করে তুললো সে। অবশেষে জানালার পর্দাগুলো টেনে খুলে ফেলল। চুলগুলো অগোছালো ভাবে কপালে ছড়িয়ে আছে। সেহরিশ এলোমেলো ভাবে মেঝেতে বসল। তারপর ক্ষীণ সুরে শুধাল,
' আমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে? কেন হচ্ছে?'
.
.
.
চলবে.....................................