আশিয়ানা - পর্ব ০৮ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


জানালার ফাঁক গলে সকালের স্নিগ্ধ রোদ এসে পড়েছে মেঝের উপরে। রোদেলা জানালার কাঁচ ভেদ করে বাইরের দিকে তাকাল। সেখানে দেখতে পেল পথচারীরা পথে ভিড় করেছে। সকাল সকাল হাঁটাহাটি করছে তারা। রোদেলা তাদের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তারপর ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমের দিকে পা বাড়াল। স্নান সেরে কচুপাতা রঙের শাড়ি পরে বেরিয়ে আসলো। ঘণ্টা দুয়েক সময় নিয়ে রোদেলা নিজ হাতে সকালের নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখল। 

জুবিয়া ঘুম থেকে ওঠে। ভার্সিটি যাওয়ার জন্য একেবারে তৈরি হয়ে রুম থেকে বের হয়। ড্রয়িংরুমে এসে রোদেলাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
  'আজ ভার্সিটির প্রথম দিন। তুই কি শাড়ি পরে যাবি?'
  'হ্যাঁ, কেনো?'
উদাস দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রোদেলার দিকে তাকিয়ে রইল জুবিয়া। তারপর তার ইউনিফর্ম ঠিকঠাক করে রোদেলার সামনে দাঁড়াল। জুবিয়া শক্ত গলায় বলল,
  'পাঁচ মিনিট দিচ্ছি শাড়ি চেঞ্জ করে আয়।'
রোদেলা নরম গলায় বলল,
  'কামিজ পরব?'
জুবিয়া বলল,
  'শাড়ি-কামিজ ছাড়া আর কী আছে?'
রোদেলা বলল, 
  'আর কিছু নেই।'

জুবিয়া ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। গতমাসে কিছু টপস কিনেছিল সে। আলমারি থেকে বেশ কিছু টপস নিয়ে আসলো। সেগুলো সোফার উপরে রেখে রোদেলা কে সেখান থেকে একটা বেছে নিতে বলল। রোদেলা ভ্রু কুঁচকে কাপড়ের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল,
  'আমি এইসব পোশাক পরতে পারব না। কি ছোট ছোট পোশাক ছিঃ, আমি যদি এইসব পোশাক পরে বাইরে যাই, রাস্তার লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে। তার চেয়ে ভালো, আমি কামিজ পরে যাব।'

জুবিয়া বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল, 
  'ভার্সিটিতে কেউ তোর কথা জিজ্ঞেস করলে বলব, আমি তোকে চিনি না। শাড়ি পরে ভার্সিটিতে যাবি, সিনিয়ররা অনেক হাসাহাসি ও মজা করবে।'

রোদেলার মাথায় ঢুকলো না, হাসাহাসির কী আছে? যে পোশাকে শরীরের অংশ দেখা যাবে সে পোশাক না পরার জন্য অন্যরা কেন হাসবে? মানুষের জন্য নিজের পছন্দ পরিবর্তন করবে কেন? রোদেলা শাড়ি বদলে কামিজ পরে আসলো। রোদেলা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
  'উমাইয়া কোথায়? সকাল থেকে ওকে দেখিনি।'

জুবিয়া জুতা পরতে লাগল। এক পলক রোদেলার দিকে তাকাল। তারপর শান্ত গলায় বলল,
  'উমাইয়া সপ্তাহে চার দিন নার্সারিতে কাজ করে। সকালে যায় সন্ধ্যার পরে ফিরে। আমি আজ নতুন চাকরি খুঁজতে যেতাম। শুধু তোর জন্য ভার্সিটি যাচ্ছি।'
রোদেলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
  'কেন? আমার জন্য কেন?'
ফ্ল্যাটের দরজায় তালা মারল জুবিয়া। রোদেলার বোকা প্রশ্নে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
  'তুই এখানে নতুন। তুই কি একা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারবি? তুই কি এখানের রাস্তাঘাট ভালো করে চিনিস?'

রোদেলা ডানে-বামে মাথা নাড়ল। বলল,
  'চিনি না। তবে চিনিয়ে দিলে পরে ঠিক চিনব।'
জুবিয়া বলল,
  'তাই আমি তোর সাথে যাচ্ছি। তোকে সবকিছু চেনানোর জন্য। যদিও তুই যা বোকা একদিনে চিনবি বলে মনে হয় না।'

চার তলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে নিচতলায় নেমে আসলো। দারোয়ান জামাল ওদের আসতে দেখে কেঁচি গেটটা খুলে দিলেন। জুবিয়া রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে ডানে-বামে তাকাল। একটা খালি রিকশা আসতে দেখে জুবিয়া রিকশাওয়ালাকে ডাকলো। বলল, 
  'মামা, বাজারে যাবেন?'
  'হু, যামু। উঠেন।'

জুবিয়া রিকশায় উঠে বসল। তারপর এক হাত দিয়ে রিকশার হুট থেকে নামিয়ে দিল। রোদেলা রিকশায় উঠতে যাচ্ছিল তখন জোজোর কথা মনে পড়ল। রোদেলা ক্ষীণ স্বরে বলল,
  'জুবি, তুই আমাকে বাড়ির চাবিটা দে। আমি জোজোকে খাবার দিতে ভুলে গেছি।'

কয়েক ঘণ্টা পর চলে আসবে। এইটুকু সময়ের জন্য কিছুই হবে না। জুবিয়া রোদেলাকে উপরে যেতে নিষেধ করল। রোদেলা যতক্ষণ না আসবে ততক্ষণ জোজো না খেয়ে থাকবে। ভাবতে শরীরে কাঁটা ফুটলো যেন। রোদেলা চাবি নিয়ে ছুটে গেল। রিকশাওয়ালা বার দুয়েক ঘুরে জুবিয়ার দিকে তাকাল। জুবিয়া ক্ষীণ সুরে বলল,
  'ও তাড়াতাড়ি চলে আসবে। জাস্ট পাঁচ মিনিট।'


গাড়ি গ্রামের সীমানায় ঢোকার সাথে সাথে রাস্তার দুই পাশে সারি সারি আম, জাম, কাঠাল, লিচু, নারিকেল, সুপারি গাছ দেখতে পেল সাদাফ। গ্রামের কাঁচা রাস্তার দু'ধারে আকাশের দিকে উঁকি দেওয়া গাছের সারি সারি দৃশ্য দেখে সাদাফ চোখ থেকে সানগ্লাসটা সরিয়ে সিটে রাখল। জানালার কাঁচ নামিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যে ডুবে গেল। সাদাফ মনের মাধুরী মিশিয়ে গ্রামের দৃশ্যগুলো ছবির মতো দেখতে লাগলো। প্রকৃতির হাজারো ফুল শোভা পাচ্ছে গাছে গাছে, ঝোপ-ঝাড়, অসংখ্য প্রজাতির গাছ ও লতাপাতা। দূর আকাশে পাখি বিচরণ করছে। দূর থেকে একটু পর পর ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক কৃষক। ওমান তাকে দেখে হঠাৎ গাড়ি থামায়। গাড়ির দরজা খুলে দ্রুত বেরিয়ে পড়ল সে, কৃষককে ডেকে ওমান ইংরেজিতে কথা বলতে লাগল। ওমানের ইংরেজি বুঝতে পারলেন না কৃষক। সাদাফের কাছে লোকটিকে নিয়ে আসে ওমান।  
সাদাফের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পারেন, সাদাফ ভালো নার্সারির খোঁজ করছে। আগে দুই জায়গায় গিয়েছে সেখানে ভালো গাছ পায়নি। বৃদ্ধ কৃষক তর্জনী আঙুল দিয়ে রাস্তা চিহ্নিত করে বললেন,
  'ডানদিকের রাস্তায় সোজা যাও বাবা। একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে মুজিব মিয়ার নার্সারী। ওই বাগানে অনেক সুন্দর ও ভালো গাছ আছে।'

ওমান নার্সারির সামনে গাড়ি থামাল। গাড়ির আওয়াজ শুনে মুজিব মিয়া সড়কে আসলেন। ওমান তার সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে লাগল। মুজিব মিয়া একজন গ্রামের সহজসরল মানুষ, তিনি লেখাপড়ার তেমন সুযোগ পাননি। তাই ইংরেজি বোঝা তার পক্ষে অসম্ভব। আবেগ ও অভিজ্ঞতা থেকে তিনি তার খালি জায়গাটুকু জুড়ে নার্সারি গড়ে তোলেন। মুজিব মিয়া ওমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
  'দাঁড়াও বাবা। আমার এইখানে একজন মেয়ে কাজ করে সে খুব ভালো ইংরেজি জানে। আমি তাকে ডেকে নিয়ে আসি।'

সাদাফ গাড়ি থেকে নামল। পরনে কালো পোশাক, চোখে কালো সানগ্লাস, বলিষ্ঠ শরীর, সুদর্শন যুবককে দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে মুজিব মিয়া। সাদাফ নরম গলায় বলল, 
  'কাউকে চাচা ডাকতে হবে না। আমি বাংলা জানি।'

মুজিব মিয়ার সঙ্গে গাছ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করে সাদাফ নার্সারির ভেতরে প্রবেশ করে। নার্সারির একপাশ থেকে গাছ দেখা শুরু করল। যে গাছগুলি পছন্দ হবে সেগুলি তূর্ণর বাড়িতে নিয়ে যাবে সাদাফ৷ গ্রাম ও শহরের অনেক মানুষ আছে যারা কোনো দেশের সঙ্গীত তারকাদের চিনে না। এমনও ঘটনা আছে যে মানুষ নিজ দেশের তারকাদের-ই চিনে না ও জানে না। গ্রামের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ সাদাফকে চিনতে পারে নি। তাকে চিনতে না পারায় সাদাফের জন্য যেন ভালোই হলো। কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়া ঘুরাঘুরি করতে পারছে। নিঃসংকোচে গাছ বাছাই করতে লাগল। নার্সারির ঠিক মাঝখানে গোলাপের চারাগাছ, সবুজ রঙের গোলজামা পরিহিত একজন মেয়ে সেখানে বসে আছে। মেয়েটা গাছগুলোর ডাল ও পাতা কেটে ছাঁটাই করছে। সাদাফ দুইহাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে তার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। খানিক বাদে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
  'আপনি এটা কী করছেন?'

উমাইয়া ঘুরে তাকাল। একজন পুরুষ লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উমাইয়া অবাক হলো। বিব্রতকর অবস্থা কাটিয়ে বলল,
  'গাছের মরা ডাল ও পাতা ছাঁটাই করছি।'
সাদাফ জিজ্ঞেস করল,
  'কেন? কেটে কি লাভ?'
উমাইয়া তর্জনী আঙুল গাছগুলোর দিকে স্থির করে সাদাফের উদ্দেশ্য বলল,
  'গাছের সুস্বাস্থ্যের জন্য কয়েক মাস অন্তর ছাঁটাই করা প্রয়োজন। কয়েকটি শাখা কাটার পর সেই স্থানে নতুন শাখা গজায়। তারপর গাছে সুন্দর করে ফুল ফোটে।'

সাদাফ খুশি হয়ে বলল,
  'আপনি গাছপালা সম্পর্কে খুব সচেতন। গাছপালা সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন।'
উমাইয়া গাছের কাণ্ডে পানি ঢেলে বলল,
  'আমার বেশি না মোটামুটি ধারণা আছে। বাকিটা আমি চাচা মুজিবের কাছ থেকে পেয়েছি তিনিই আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে গাছের যত্ন নিতে হয়।'
সাদাফ চারদিকে তাকিয়ে বলল, 
  'আমি আপনাদের নার্সারী ঘুরে দেখলাম খুব সুন্দর পরিবেশ, বেশ পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন।'

সাদাফের দিকে তাকাল উমাইয়া। তারপর নিচু গলায় বলল,
  'আপনি কি গাছ কিনতে আসছেন? কোন গাছটি নিতে চান?'
সাদাফ শান্ত গলায় বলল,
  'হুম, ড্রয়িংরুম এবং বারান্দা সাজানোর জন্য উপযুক্ত গাছপালা যেগুলো আছে।'
উমাইয়া সোজা হয়ে দাঁড়াল। পশ্চিম দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
  'আমার সাথে আসুন। আপনি ওইদিকে আপনার প্রয়োজনীয় সমস্ত গাছপালা পাবেন।'
বেশ সময় নিয়ে কয়েকটি গাছ বাছাই করল সাদাফ। তারপর ফেরার সময় সাদাফ বুঝলো সে রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে কোন পথ দিয়ে এদিকটায় এসেছে? বেমালুম ভুলে গেছে। সাদাফ অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল উমাইয়ার দিকে। উমাইয়া হেসে বলল,
  'কোন সমস্যা নেই। আমি আপনাকে বের হওয়ার পথ দেখাচ্ছি। চলুন।'
সাদাফ মৃদু হেসে বলল,
  'ধন্যবাদ।'

সাদাফ উমাইয়ার পেছন পেছন হেঁটে যেতে লাগল। উমাইয়া গাছপালা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে সাদাফের সাথে অনেক কথা বলছে। মেয়েটির এই স্বভাবটা সাদাফের ভালো লাগল। ঠোঁট প্রসারিত করে কুটিল হাসল সে। উমাইয়া মৃদুস্বরে বলল,
  'হাঁটাচলা করার সময়, উভয় দিকে নজর রাখা উচিত। তাহলে আমরা কোন পথে এসেছি তা মনে রাখা খুব সহজ হয়ে যায়। প্রথম দিন আমি যখন এখানে আসি তখন আমিও হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমার এক মাস লেগেছে। নার্সারিতে কোথায় কী আছে তা মুখস্ত করতে। এখন আমি চোখ বন্ধ করে হাঁটতে পারি।'
সাদাফ মাথা নিচু করে কোমল সুরে বলল,
  'আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। আপনার প্রতিটি শব্দ আমাকে অদ্ভুতভাবে মুগ্ধ করছে।'
.
.
.
চলবে......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন