ঘড়ির কাটা তখন টিক টিক শব্দ করে ছুটছে। নিস্তব্ধ পরিবেশ। রিক্ততায় ভরপুর চারপাশ। সময় যাচ্ছে নীরবতায় আরহানের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অথচ কেউ কথা বলছে না। আরহানের বড্ড অবাক লাগল ব্যাপারখানায়। কারণ এমনটা খুব একটা ঘটে না– কেউ কল করেছে সে সাড়া দিয়েছে অথচ কেউ কথা বলছে না। আরহান আরো কিছু সময় চুপ থেকে বিস্ময় কণ্ঠে আবারও বলল,
“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
ফাবিহার টনক নড়ল। সে দ্রুত একখানা রুমাল নিয়ে তার ফোন চেপে ধরে ভরাট কণ্ঠে আওড়াল,
“ওলাইকুম আসসালাম।”
এতক্ষণ পর কারো কণ্ঠ শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল আরহান, “যাক শেষমেশ কথা বলেছেন। আমি তো ভাবলাম কেউ কল করে ফোন রেখে চলে গেছে।”
ফাবিহার তড়িৎ উত্তর,
“না ওইরকম কোনো ব্যাপার নেই।”
“আপনি কি নার্ভাস?”
“আসলে প্রথমবার এভাবে কাউকে কল করলাম তো। তাই একটু...”
“ব্যাপার না। আমি আহামরি কোনো ভয়ংকর মানুষ নই। আমার সাথে দ্বিধাহীন কথা বলাই যায়।”
“আমি চেষ্টা করছি।”
মৃদু হাসল আরহান। বলল,
“ঠিক আছে। কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন?”
“এই প্রশ্ন দুটোর উত্তর দেয়া কি খুব জরুরি?”
“খুব একটা জরুরি বলা যাবে না। তবে আমি যে মানুষটার সাথে কথা বলছি সে কোথা থেকে বলছে তা জানার অধিকার কি আমার নেই?”
“অবশ্যই আছে। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি না।”
“ভয় পাচ্ছেন নাকি– বাড়ি গিয়ে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলব।”
কথাটা বলে নিজেই চমকে উঠল আরহান। এই ধরনের কথা তো সে বলে না। আজ বলে ফেলল কি করে! আরহান খানিকটা বিব্রত নিয়ে বলল,
“দুঃখিত। কথাটা ওভাবে বলতে চাইনি।”
ফাবিহা কিছু মনে করল না। শান্তভাবেই জানাল,
“আমি কিছু মনে করিনি। আমরা অনেক সময়ই এমন অনেক কিছু নিজ অজান্তেই বলে ফেলি। ইট'স নরমাল।"
আরহান খুশি হলো। জানাল,
“ধন্যবাদ। আমাকে বোঝার জন্য। এবার বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“সাহায্য.."
দ্বিধায় পড়ল ফাবিহা। আরহান বলল,
“জি। কোনো গান শোনার অনুরোধ আছে কি?”
“জি আছে।”
“বলুন কি গান শুনবেন?”
ফাবিহা কিছু সময় চুপ থেকে বলল,
“দেহ পাশে কেউ কেঁদো না।”
গানের নাম শুনে আরহান কিছু আচ করে জানতে চাইল,
“আপনার কি মন খারাপ?”
“হঠাৎ এ প্রশ্ন!”
“না, এমনি মনে হলো।”
“ওইরকম কোনো ব্যাপার নেই।”
আরহান মেনে নিল। মৃদু হেসে জানাল,
“ঠিক আছে। আমাদের সঙ্গে থাকুন। খুব শীঘ্রই আপনার পছন্দের গানটা ছাড়া হবে।”
আরহান লাইন কেটে দিল। এরপর আরহানের আবার কল এল। ফাবিহা অনেকক্ষণ গানের জন্য অপেক্ষা করল। কিন্তু আরহান গান ছাড়ল না। ছেলেটার কি মনে নেই– অথবা ব্যস্ততায় ভুলে গেছে। এর কিছুক্ষণ পরই আরহানের জায়গায় অন্য কারো কণ্ঠ শোনা যায়। সে জানায়, ব্যক্তিগত কিছু জরুরি কাজের কারণে আরহান বেরিয়েছে। বাকিটা সময় আমি শফিক আপনের সঙ্গে আছি।– কথা শুনে ফাবিহার মন খারাপ হলো কিনা বোঝা গেল না। সে রেডিও থেকে বেরিয়ে এল।
••••••••••••
বিছানায় বসে আছে শান্ত। তার পা জ্বলছে। কিছুক্ষণ আগে ফুটন্ত গরম পানি তার ডান পায়ে পড়েছে। তৌহিদ পাশে বসে আছে। অনেকখানি লবন দিয়েছে পায়ে। যার দরুন যন্ত্রণায় ছটফট করছে শান্ত। কিন্তু প্রকাশ করছে না। তৌহিদ বলল,
“একটু সাবধানে কাজ করবি না।”
শান্ত কিছু বলে না। এরই মাঝে হন্তদন্ত হয়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ করল আরহান। ভয়ার্ত কণ্ঠে জানতে চাইল, “শান্তর কি হয়েছে?”
তৌহিদ ঘুরে তাকাল। অভিযোগ নিয়ে বলল,
“পায়ে গরম পানি পড়ে বিচ্ছিরি কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে।”
“খুব বেশি খারাপ অবস্থা হয়েছে নাকি।”
“তেমনটাই।"
“তাহলে চল দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।”
শান্ত মাথা নাড়ায়। হাতের ইশারায় দুজনকে শান্ত হতে বলে। আরহান গিয়ে বসল শান্তর বামপাশে। ডানপাশে তৌহিদ। আরহান নরম গলায় বলল,
“একটু সাবধানে কাজ করবি না।”
শান্ত হাত নাড়াচ্ছে তা দেখে আরহান বলল,
“সাবধানেই কাজ করছিলাম আচমকাই হাত ফসকে পাতিলটা পড়ে গেল। খুব বেশি বাজে অবস্থা হয়নি। তোরা চিন্তা করিস না।”
কথা শুনে তৌহিদ বলল,
“চিন্তা করব না। চল ডাক্তারের কাছে চল। কাছেই একটা ফার্মেসি আছে। ডাক্তারের কাছে না গেলেও ওখানে চল।”
শান্ত রাজি হলো না। আ আ শব্দ করে হাতের ইশারায় বোঝাল, “আরেহ কিছু হয়নি আমার।”
আরহানের এবার রাগ উঠল। সে আচমকাই কোলে তুলে নিল শান্তকে। শান্ত হতভম্ব। আরহান বলল,
“দেখ তো তৌহিদ, কাছে কোনো রিকশা পাস কিনা।”
তৌহিদ দেরি করল না। ট্রাউজার আর টিশার্ট পড়া অবস্থাতেই বেরিয়ে গেল। শান্তর মুখে অস্পষ্ট কিছু শব্দ বিরাজমান। হাতের ইশারায় বলা,
“আমার কিছু হয়নি।”
আরহান শুনল না। দ্রুত বেরিয়ে গেল রুম থেকে।'
হাতে ময়লার পলিথিন নিয়ে বাড়ির বাহিরে এসেছিল রাহেলা। আচমকাই আরহানের কোলে শান্তকে দেখে ছুটে গেল দ্রুত। এবং চিন্তিত স্বরে বলল, “কি হইছে ভাইজানের?”
আরহান জানাল,
“পা পুড়ে গেছে।”
“কি কন? ক্যামনে হইল?
“এসে বলব। আচ্ছা শোনো আমাদের ঘরের দরজায় তালা দেয়া নেই। তুমি একটু খেয়াল রেখো রাহেলা।”
রাহেলা মাথা ঝাকিয়ে জানাল,
“আইচ্ছা ভাইজান। আপনারা সাবধানে যাইয়েন।”
গেট থেকে বের হতেই রিকশা দেখা গেল। রিকশার পাশে তৌহিদ দাঁড়িয়ে। তিনজন একত্রে যাওয়া যাবে না। রিকশা ছোট। তৌহিদ বলল,
“তুই শান্তকে নিয়ে যা আমি পিছন পিছন আসছি।”
আরহানও আর বারণ করল না। শান্তকে রিকশা করে নিয়ে চলে গেল দ্রুত।
••••••••••••
অতিথি নিবাসের বাহিরে পায়চারি করছে রাহেলা। চিন্তা হচ্ছে তার। সেই কখন ভাইজানেরা গেছে এখনও খবর নেই। ঘড়িতে তখন আট'টা বাজে। রাতের আকাশে জোনাক দেখা যায়।'
পুরো বাড়িতে রাহেলা খুঁজে না পেয়ে ডাকছিল ফাবিহা। একটু উচ্চ আওয়াজেই কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল, “রাহেলা, এই রাহেলা।”
রাহেলা চমকে উঠল। বাহিরে দাঁড়িয়েই চেঁচিয়ে বলল, “আপা আমি বাহিরে।”
ফাবিহা তখন দরজার কাছে দাঁড়ান। সেই কখন শুনেছিল রাহেলা ময়লার পলিথিন নিয়ে বাহিরে এসেছে এখনও ঘরে আসেনি কেন! ফাবিহা আর না চেঁচিয়ে বাহিরে আসল। ঘরে রিনা বেগমের মাথা ধরায় নিজের রুমে শুয়ে আছেন। আহির আর মাসুদ উদ্দিন বাড়ি নেই। কোথায় যেন গেছেন। একসাথে নয় আলাদা আলাদা। ফাবিহা বাহিরে এসে দেখল রাহেলা অতিথি নিবাসের বাহিরে পায়চারি করছে। ফাবিহার কৌতুহলী চাহনি। মাথায় কয়েকটা প্রশ্ন। দ্রুত রাহেলার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি এখানে কি করছ রাহেলা?”
“পাহারা দেই আপা।”
“পাহারা দেও মানে?”
বিস্ময়ের প্রশ্ন ফাবিহার। রাহেলার সরল মনের উত্তর, “আরহান ভাইজানে খেয়াল রাখতে কইছে, তাই পাহারা দিতাছি আপা।”
রাহেলার অগোছালো কথা ঠিকভাবে বুঝতে ব্যর্থ হলো ফাবিহা। পুরোপুরি বুঝতে জানতে চাইল,
“আমি ঠিক মতো বুঝি নি। আরহান তোমায় কেন খেয়াল রাখতে বলবে– তারা কি বাড়ি নেই?”
এবার রাহেলা সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে ফাবিহা অবাক। তাহলে কি এই কারণেই তখন আরহান রেডিও এফএম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ফাবিহার আচমকাই কেন যেন ভালো লাগল। কেন লাগল বোঝা গেল না। তবে শান্তর জন্য খারাপ লাগছে।'
বাড়ির কালো গেটটার সামনে কিছু মানুষের পদধ্বনি পাওয়া যায়। সঙ্গে কণ্ঠ আসে আরহানের,
“দেখেছিস সঠিক সময়ে না নিয়ে গেলে কি হতো! সবসময় বেশি বুঝিস। কিছু হয়নি কিছু হয়নি বলতে বলতে কতকিছু হয়ে গেছে। এই পা সাড়তে দু'সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে।”
ফাবিহা আর রাহেলা তাকিয়ে আছে। এরই মাঝে গেট খুলে হাজির হলো আরহান, তৌহিদ আর তাদের মাঝখানে দু' কাঁধে হাত দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে শান্ত। শান্তকে আজ প্রথমই দেখল ফাবিহা। রাহেলার কথা মতো ছেলেটা সত্যিই সুদর্শন এবং চশমার কারণে আরো বেশি আর্কষণীয় লাগে। ফাবিহা চোখ সরিয়ে নিল।'
অন্যদিকে,
গেটের ভিতর ঢুকতে না ঢুকতে রাহেলা আর ফাবিহাকে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনজনই বেশ অবাক হলো। রাহেলা এগিয়ে গিয়ে বলল, “ভাইজানে কি ঠিক আছে?"
তৌহিদ উত্তর দিল,
“হুম।”
তৌহিদ একপলক দেখল ফাবিহাকে। এরপরই পাশ কাটিয়ে চলে গেল তারা। শান্ত জানতে চাইল, “মেয়েটা কে?”
আরহান বলল, “মাসুদ আঙ্কেলের মেয়ে।”
তৌহিদ হাল্কা হেঁসে আস্তে করে বলল, “আর রাহেলার পিসচেস ডাইনী।"
হেঁসে ফেলল তিনজন।'
ফাবিহা ভাবল। চলে যাবে। কিন্তু এভাবে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে! আবার তিন তিনটে ছেলের ঘরে যাওয়াটা কি উচিত হবে! বেশ দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ফাবিহা। হঠাৎ মাসুদ উদ্দিনের কণ্ঠ শোনা যায় তিনি মাত্রই এসেছেন। ফাবিহাকে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কৌতুহলী জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে মা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
ফাবিহা কিছু বলার আগেই রাহেলা বলল,
“আর কইয়েন না চাচা শান্ত ভাইজানে তার পা পুড়াইয়া ফালাইছে।”
অবাক হলেন মাসুদ উদ্দিন,
“পুড়িয়ে ফেলেছে মানে...”
কথাটা বলেই অতিথি নিবাসের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। ফাবিহাও আর দ্বিধায় না থেকে হেঁটে গেল। আর তার পিছু পিছু ছুটল রাহেলাও।
.
.
.
চলবে......................................................................