আশিয়ানা - পর্ব ০৯ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


রাস্তার পাশে রিকশার বেলে টুংটাং শব্দ করছে রিকশাচালক। পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে বাস আর ট্রাক। চারদিকে শীতল বাতাস বইছে, রাতের অন্ধকার শহরের আবছা আলোয় ভাবনার সুতো বুনছে তূর্ণ। অসেকের আচমকা ডাক তূর্ণর ভাবনার জগৎকে ভেঙে দিল। তূর্ণ এলোমেলো দৃষ্টিতে অসেকের দিকে তাকাল। অসেক শান্ত ভঙ্গিতে গাড়িতে উঠল। তূর্ণ সময় নষ্ট করল না। সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
  'ফুল নিয়ে এসেছ?'

অসেক তূর্ণর কাছে সাদা গোলাপের তোড়া ধরিয়ে দিল। তূর্ণর ঠোঁটে মৃদু হাসি সে ফুলের তোড়াটা হাতে রেখে সোজা হয়ে বসল। তারপর ঠোঁটের কাছে ফুলের তোড়াটা নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল,
  'মেয়েটির পছন্দ হবে তো?'

কার্ডে লেখা এড্রেসে এসে গাড়ি থামাল অসেক। পেছন দিকে ঘুরে তূর্ণর উদ্দেশ্য বলল,
  'স্যার, আমরা চলে আসছি। এই ভবনের দ্বিতীয় তলায় কাঙ্ক্ষিত সেই স্পাইসি চিকেন শপ।'

তূর্ণ নড়েচড়ে বসল। গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে শপের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল তূর্ণ। তারপর ফুলের তোড়ার মাঝখানে একটা ছোট নোট রেখে অসেকের হাতে দিল। তূর্ণ স্পষ্ট গলায় ইংরেজিতে বলল,
  'অসেক, সাবধানে তোড়াটা নিয়ে যাও, এটাকে তার মালিকের কাছে পৌঁছে দিয়ে তবে আসবে। আর খেয়াল রাখবে হাত থেকে যেন পড়ে না যায়।'

পাঁচ মিনিট পর ফিরে এল অসেক। বিরসমুখে বলল,
  'স্যার, জুবিয়া ম্যাম এখানে নেই। গতকাল রাতে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।'

অসেকের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তূর্ণ জিজ্ঞেস করল,
  'জুবিয়ার সাথে যোগাযোগ করার কোনো কন্টাক্ট নম্বর বা বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে?'

অসেক বলল,
  'আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, দোকানের মালিক বলল না। আমি তারপর আপনার কথা বললাম, মহিলা তখন হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল, মাহাবুব তূর্ণ! একজন সাধারণ ওয়েটারের খোঁজ করছে? তিনি বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না উল্টো হাসিঠাট্টা করে তাই আর কথা বলিনি।'

তূর্ণ দৃঢ় গলায় বলল,
  'মালিকের সাথে কথা বলো, যত টাকা লাগে দাও তবুও জুবিয়ার খোঁজ দিতে বল।'
অসেক ইতস্তত করে বলল, 
  'কিন্তু স্যার?'
তূর্ণ কড়া গলায় শুধল,
  'কিন্তু কি?'
অসেক সাবলীল ভাষায় বলল, 
  'তাকে খোঁজার কী দরকার স্যার? আপনার তো প্রতিদিন কত মেয়ের সাথে দেখা হয়। কখনো তো কাউকে খুঁজতে দেখিনি?'
তূর্ণ সহজভাবে বলল,
  'সে আমার হেল্প করেছে তাই প্রয়োজন আছে। তুমি বুঝবে না।'
অসেক বলল,
  'আমি ফুলের তোড়া মালিকের কাছে রেখে আসছি। তিনি জুবিয়া ম্যামের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
তূর্ণ গম্ভীরভাবে বলল, 
  'বাড়ি চলো।'

তূর্ণ কলিংবেল বাজানোর কিছুক্ষণের মধ্যে সাদাফ এসে দরজা খুলে দিল। নিজের ফ্ল্যাটের আচমকা পরিবর্তন দেখে তূর্ণ চমকে উঠল। ড্রয়িংরুম থেকে শুরু করে ঘর, বারান্দা সবখানে গাছ দিয়ে ভরে ফেলেছে সাদাফ। এত চারা দেখে তূর্ণর মনে হচ্ছে, সাদাফ নার্সারির সব গাছ তুলে নিয়ে আসছে। তূর্ণর কাছে তার ফ্ল্যাটটা এখন মস্ত এক নার্সারির মতো লাগছে। তূর্ণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ড্রয়িংরুম থেকে সোজা সাদাফের রুমে চলে আসে। সাদাফ গুনগুন করে গান গাচ্ছে ও গোলাপ গাছের টবে পানি দিচ্ছে।

তূর্ণ বিরক্ত গলায় বলল, 
  'আমার বাড়িতে গাছ দিয়ে জঙ্গল বানাচ্ছিস কেন? তোর নিজের বাড়ি নেই?'

সাদাফ চকিতদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
  'আমার বাড়ি? সে তো অনেক দূরে, আমার সেখানে একা থাকতে একটুও ভালো লাগবে না তাই তোর ফ্ল্যাটকে আমার থাকার মতো করে নিলাম। দেখ কত গাছ আছে, শ্বাস নিতে আর সমস্যা হবে না। চারদিকে শুধু অক্সিজেন আর অক্সিজেন।'

তূর্ণ কপালের চামড়াটা বিরক্তিতে একটু ভাজ ফেলল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, 
  'ডিনারের জন্য কি বানিয়েছিস? আমার ক্ষুধা লাগছে।'

সাদাফ সারা শরীরে ঘুরে তূর্ণর মুখের দিকে তাকাল। তূর্ণর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে গালভরা একটা হাসি দিয়ে সাদাফ বলল,
  'এসব করতে করতে সময় ফুরিয়ে গেছে তাই কিছুই বানাইনি।'
তূর্ণ রাগমিশ্রিত গলায় বলল, 
  'এখন খাবো কী?'
সাদাফ ঠাট্টার সুরে বলল,
  'গাছের পাতা খেয়ে নে।'

তূর্ণ রাগে ফুসফুস করতে লাগল। মিনিট দুয়েক পর হঠাৎ সাদাফের উদ্দেশ্য তূর্ণ কাতর স্বরে প্রশ্ন করল,
  'সেহরিশ কোথায়?'

সাদাফ খোলা আকাশ দেখতে বারান্দার কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। পুরো আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে। একটু পর হিমশীতল ঠান্ডা বাতাস বইতে লাগল। হুট করে পাঁচ-ছয়টি কুকুর তখন ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করে ওঠে। সাদাফ বারান্দার রেলিঙ ধরে দূর আকাশের দিকে তাকায়। ঘন কালো আকাশে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালো।

সাদাফ অস্ফুটস্বরে কেবল উচ্চারণ করে,
  'তোর মুখ দেখতে দেখতে ও বিরক্ত হয়ে গেছে তাই নিজের বাড়িতে চলে গেছে।'

তূর্ণ দ্রুত নিজের ঘরে ছুটে গেল। আলমারির কাভার্ড থেকে একটা ব্লেজার বের করে, গায়ে পরলো তারপর তাড়াতাড়ি করে সদরদরজার দিকে চলে গেল। তূর্ণ কিছু না বলেই বেরিয়ে গেছে তাই সাদাফ তার পিছু নিল।


মেঘনা সিটিতে সেহরিশের বিশাল বাড়ি। সেহরিশ নিজের জন্য কফি বানানোর জন্য কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ কলিংবেলটার শব্দ শুনে চিকিত তাকাল। একটু সময় নিয়ে দরজা খুলতেই সেহরিশ অবাক হয়ে গেল। তূর্ণ হঠাৎ সেহরিশের হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে বলল,
  'ওহ, আমার জন্য? থ্যাংক ইয়্যু।'
সেহরিশ চোয়াল শক্ত করল তারপর দরজা বন্ধ করে তূর্ণর দিকে তাকায়। শক্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে শুধল,
  'তোকে আমার বাড়ি আসার অনুমতি কে দিয়েছে?'

কথার মাঝখানে আবার কলিং বেলের আওয়াজ কানে এল। সেহরিশ ঠোঁট চেপে দরজা খুলে দিল। সাদাফ ওর তির্যক চোখ দুটোকে স্থির রেখে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
  'তূর্ণ আসছে?'
সেহরিশ রাগী গলায় ধমক দিয়ে বলল,
  'তোরা দুজন এখন আমার বাড়ি থেকে চলে যা।'
হঠাৎ আকাশ কুসুম কাঁপিয়ে মেঘেরা গর্জন করে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। সেহরিশ একটু ধমকের সুরে আবারও বলল, 
  'তোরা যাচ্ছিস না কেন?'
সাদাফ অবাক হয়ে বলল,
  'বৃষ্টি হচ্ছে। কিভাবে যাব? বৃষ্টি থামুক, চলে যাব।'

সেহরিশ রাগ চেপে বারান্দায় চলে গেল। মেঘের গর্জন, বৃষ্টি পড়ার শব্দ, বৃষ্টির জলে বারান্দার মেঝে কিছুটা ভিজে গেছে। সেহরিশের অবাধ্য চুল অগোছালো ভাবে কপালে পড়ে আছে। প্রবল বাতাসে মৃদু দুলছে। সেহরিশ বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল। বৃষ্টির ফোঁটা তাকে ছুঁয়ে দিতে লাগল। রাস্তার মোড়ে ল্যাম্পপোস্টের আলো একবার নিভে যাচ্ছে তো আবার জ্বলে ওঠছে। আবছা আলোয় সেহরিশ স্পষ্ট দেখতে পেল রাস্তার পাশে ওই আমগাছের নিচে একজন মহিলাকে। মহিলাটি গাছের নীচে ঘুরঘুর করছে। গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টি পরলেই সেখান থেকে সরে গিয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। সেহরিশ চোখ স্থির করল নামহীন অপরিচিত নারীর দিকে। সাদাফ এসে তার পাশে দাঁড়াল। সেহরিশের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাল।

সাদাফ প্রশ্ন করল,
  'কি দেখছিস?'
সেহরিশ জবাবে বলল,
  'গাছের নিচে ওই মহিলাকে দেখছিস? মনে হচ্ছে বৃষ্টির কারণে তিনি সেখানে আটকে আছেন। বৃষ্টিতে যেন ভিজে না যান তাই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গেছে। তাকে সাহায্য করা দরকার।'
সেহরিশ দ্রুত বারান্দা ছেড়ে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াল। উচ্চস্বরে জাবেদ কে ডেকে সেহরিশ জাবেদের হাতে একটা ছাতা ধরিয়ে দিল। সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
  'বাড়ির সামনে আমগাছের নিচে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে এই ছাতাটা দিয়ে এসো। আর তাকে বলিও, ওনার যদি ইচ্ছা হয়, সে বাড়ির নিচতলায় একটি ঘরে বসে বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে।'

সেহরিশ বারান্দায় ফিরে এল। সাদাফ সেহরিশের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
  'তাকে দেখতে বয়স্ক নারীর মতো লাগছে না। আনুমানিক বিশ, বাইশের যুবতী তার বেশি হবে না।'
সেহরিশ মৃদুস্বরে বলল,
  'বয়সে কি আসবে আর যাবে? মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট, বিপদগ্রস্ত লোকজনের সাহায্য করা।'

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এসময় একজন পুরুষ লোক এসে রোদেলার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। রোদেলা ভয় পেয়ে যায়। রোদেলা ভালো করে তাকিয়ে রইল জাবেদের মুখের দিকে। জাবেদ তর্জনী আঙুল দিয়ে তৃতীয় তলায় রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেহরিশকে দেখিয়ে বলল, 
  'উনি আমার স্যার। আপনি বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছেন দেখে উনি আপনার জন্য ছাতাটা পাঠিয়েছেন। আর স্যার বললেন আপনি চাইলে স্যারের বাসার নিচতলায় বসে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে পারেন।'

রোদেলা একটু অবাক হলো, তারপর সরু চোখে বারান্দার দিকে তাকাল। রোদেলা মৃদুস্বরে বলল,
  'আপনার স্যার ভীষণ ভালো লোক। আমার কথা ভেবে এই বৃষ্টিতে আমাকে সাহায্য করলেন। আজকাল মানুষ এসব করে না। আপনাকে আর আপনার স্যারকে অনেক ধন্যবাদ। যদি কখনো সম্ভব হয় আমি এই ঋণ শোধ করব।'
এই বলে রোদেলা থেমে গেল। একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল, 
  'আমার বন্ধু একটু সামনে এগিয়ে গেছে। ফিরে এসে আমাকে দেখতে না পেলে সে টেনশন করবে। আই এম স্যরি! আমি আপনার সাথে যেতে পারব না। আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে ওর আসার অপেক্ষা করতে হবে।'
জাবেদ মৃদুস্বরে বলল, 
  'আপনি যেভাবে ভালো মনে করেন।'
.
.
.
চলবে......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন