ভোর থেকেই তৌহিদ ব্যস্ত। আজ তার ভার্সিটির টিচার রূপে জয়েন হওয়ার প্রথম দিন। অনুভূতি ঠিক কতটা জোড়ালো বোঝা যাচ্ছে না। তবে খানিকটা নার্ভাস বলা চলে। যে ভার্সিটিতে সে পড়াশোনা করেছে সেই ভার্সিটিতেই চাকরি পাওয়াটা কতটা সুন্দর, কতটা যোগ্যতা সম্পন্ন কাজ তৌহিদ বুঝতে পারছে। তৌহিদের পুরোপুরি পড়াশোনা শেষ হয়েছে খুব একটা সময় হয়নি। সে পড়াশোনায় মারাত্মক ভালো। তাই তো এত বড় সম্মাননা। তৌহিদ জোরে শ্বাস ফেলল। রান্নাঘরে ব্রেকফাস্ট তৈরি করছিল শান্ত। সপ্তাহে দু'দিন করে রান্নার কাজ করে একেকজন। তবে বেশিরভাগ সময়ই শান্তই রান্না করে। শান্তর বাহিরে খুব একটা কাজ নেই। সে ঘরেই থাকে বেশির ভাগ সময়। বাহিরে বেশি থাকে আরহান আর এখন তো তৌহিদেরও বাহিরের থাকতে হবে। শান্তর এতে কোনো অভিযোগ নেই। রান্না করতে সে পছন্দ করে। তার রান্নার হাতও পোক্ত। সবচেয়ে বাজে রান্না করে আরহান। তবুও সে চেষ্টা করে। বেশির ভাগ সময় রান্নাটা শান্ত আর তৌহিদই করে। বাজার টাজার করাটা আবার আরহান সামলায়। এক্ষেত্রে সে বেশি পারদর্শী। আরহান বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। তখনই ফোনটা বাজল তার। এক প্রকার বিরক্ত হয়ে ফোনটা তুলল আরহান। বলল,
“হ্যালো, কে বলছেন?”
তখনই ওপরপাশ থেকে কে যেন বলে,
“কেমন আছেন?”
কণ্ঠ শুনেই কল আসার নাম্বারটা দেখল আরহান। এরই মাঝে অপরপাশের ব্যক্তিটি আবার বলল,
“কি হলো কথা বলছেন না কেন?”
আরহানের ছোট্ট উত্তর,
“আমি ঘুমাচ্ছি পরে ফোন করুন।”
কল কেটে গেল। কিছুক্ষণ পর আবারও ফোন বাজল। আরহান বিরক্ত হয়ে কল কেটে মোবাইল বন্ধ করে দিল। তৌহিদ তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল। আজ সাদা রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়েছে তৌহিদ। সিল্কি চুলগুলো সুন্দর মতো সাজানো। তৌহিদের ফেভারিট রঙ হলো সাদা। তাই স্পেশাল এই দিনটি সে সাদা রঙ দিয়েই শুরু করবে। তৌহিদ আয়নার দিকে তাকিয়েই আরহানকে বলল,
“কলটা কেটে দিলি?”
আরহানের ঘুম কেটে গেছে। সে বিরক্ত নিয়ে বলল,
“আর কি করব?”
“সিম পাল্টে ফেল।”
“কম তো পাল্টালাম না।”
তৌহিদ এবার এগিয়ে আসলো। আরহান ততক্ষণে শোয়া থেকে উঠে বসেছে। আচমকাই তার সবকিছু বিরক্ত লাগছে। তৌহিদ বলল,
“চিন্তা করিস না। আমরা তো চলেই এসেছি।”
আরহান কথা বলল না। তৌহিদ বলল,
“ভুলে যা। দেখবি এখন থেকে সব ভালো হবে।”
আরহান তাকাল তৌহিদের দিকে। মলিন কণ্ঠে বলল,
“বলছিস।”
“হুম।”
“আচ্ছা। কয়টায় বের হচ্ছিস?”
“এই আধঘন্টার মাঝে।”
“অলদা বেস্ট।”
মৃদু হাসল তৌহিদ। তখনই হাতে করে খাবার নিয়ে আসলো শান্ত। তৌহিদের সামনে খাবারের প্লেটটা রেখে হাতের ইশারা দেয়। তৌহিদ তা দেখে বলে, “খেয়ে নে আজ তোর পছন্দের রান্না করেছি।”
তৌহিদ মিষ্টি হেঁসে বলল,
“তুই এত ভালো ক্যান শান্ত।”
শান্ত মিষ্টি হাসে। জানায়,
“তোরা আছিস বলেই তো আমি ভালো আছি।”
আরহানও হাসল তখন। তাদের তিন বন্ধুর ছোট্ট জীবন খুবই সুন্দর। এই সুন্দর জীবনে কারো নজর না লাগুক। তৌহিদ খেতে নিল। আরহান তখনও চুপচাপ বসা। শান্ত হাতের ইশারা দেখাল। আরহান বলল, “মুখ ধুয়ে আসব– এক সাথে খাবি?”
মাথা নাড়ায় শান্ত। যার অর্থ, 'হ্যাঁ।'
আরহান শান্তের মাথা হাত বুলাল। বলল, “ঠিক আছে।”
আরহান বিছানা থেকে নামল। তৌহিদকে বলল,
“শোন, সাবধানে যাস। টাকা আছে সঙ্গে নাকি দিব?”
তৌহিদ খেতে খেতে উত্তর দিল, “আছে, লাগবে না।”
••••••••••••••
নিজের রুমের বারান্দায় বসে বই পড়ছে ফাবিহা। চিন্তা করেছে আজ সারাটা দিন বই পড়ে কাটিয়ে দিবে। ফাবিহার একজন পছন্দের লেখক হলো 'হাসান মাহবুব' যিনি বর্তমান সময়ের অনেক জনপ্রিয় একজন লেখক। ফাবিহা তার লেখা মোট দশটা বই পড়েছে। কাল বিকেলে এগারোতমটা হাতে পেয়েছে। ভেবেছিল কালই পড়া শুরু করবে কিন্তু হয়ে ওঠেনি। তাই ভাবছে আজ শেষ করবে। ৩৫০ পৃষ্ঠার একটা উপন্যাস। কাহিনিটি নব্বই দশকের। শুরুটা খুবই ইউনিক ফাবিহার ভালো লেগেছে। তবে এসবের মাঝে খারাপ লাগার বিষয়টা হলো। এই লেখককে কেউ চেনে না। সে তার ছবি প্রকাশ করেনি কোনো বইয়ে। এমনকি তার ফেসবুক প্রোফাইল, পেইজ কোথাও তার ছবি নেই। নামটাও বোধহয় আসল নয়। ফাবিহার তীব্র ইচ্ছে এই লেখকের সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু আধতেও এটা সম্ভব কিনা সে জানে না। কারণ ফাবিহার মন বলে এই লেখক কখনই পাবলিকের সামনে নিজেকে প্রকাশ করবে না। হুট করেই মন খারাপ হয়ে গেল তার। বইয়ের সাথে ভাগ্যত্রুমে একটা চিঠি পেয়েছে ফাবিহা। বইটি প্রি-বুকিং ছিল। লেখক বলেছিল যারা যারা প্রি-বুকিং করবে সবাইকে নিজ হাতের নামসহ চিঠি লিখবে। তাই ফাবিহাও একটা পেয়েছে। চিঠিতে লেখক লিখেছে–
প্রিয় ফাবিহা,
খুবই অল্প শব্দের একখানা চিঠি লিখছি। চিঠির শুরুতেই ভালোবাসা নিবেন। আশা করি আল্লাহর রহমতে ভালোই আছেন। আমার হাতের লেখা ওতটা ভালো নয়। এখন নিশ্চয়ই ভাবছেন লেখক মানুষের আবার হাতের লেখা খারাপ হয় নাকি। এই দেখুন আমার হয়। সে যাইহোক– আমার এবারের বইটা একটু ভিন্নরকম। অনেকটা পুরোনো জিনিসকে স্মৃতিতে আঁটকে রাখা মতো। আশা রাখি বইটি আপনাকে দারুণ কিছু অনুভূতি দিবে।'
কিছু কথা না বললেই নয় এই যে আমি আপনাকে চিনি না, আপনি আমাকে চেনেন না। অথচ আমরা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসি। আমার কাছে মনে হয় লেখক-পাঠক ভালোবাসাটা পৃথিবীর এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার একটি। এই যে আপনি আমাকে দেখেননি। অথচ আমার বইকে ভালোবাসছেন। আমাকে ভালোবাসছেন। এতে কি প্রমাণ হয় মানুষকে না দেখেও তাকে ভালোবাসা যায়। আমার কাছে অনেক চিঠি আসে, উপহার আসে। আমি আপনাদের আবেগ বুঝতে পারি। ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারি। আমাকে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষাটাও আমি বুঝতে পারি। আপনাদের একেকটা চিঠি আমার কাছে কোটি টাকার চেয়েও দামি। সবসময় ভালো থাকবেন। দোয়ায় বাঁচিয়ে রাখবেন। আল্লাহর রহমত সবসময় আপনার উপর বসিত হোক। আর হ্যাঁ,
'আমাকে দেখার তীব্র ইচ্ছা আপনার জনমভর থাকুক।'
ইতি-
আপনার লেখক
'হাসান মাহবুব'
চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরল ফাবিহা। এত বেশি ভালো লাগল তার। আবেগে চোখ ভেসে উঠেছে।'
'অতিথি নিবাস' থেকে কে যেন বের হলো। ফাবিহা তাকাল। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পড়া সুদর্শন যুবক। ছেলেটা যে আরহান নয় তা বুঝেছে। তাহলে কি তৌহিদ বা শান্তর মধ্যে একজন। ছেলেটা তার কালো জুতোর ফিতা বাঁধতে বাঁধতে আচমকাই এদিকে তাকাল। ফাবিহা চমকে উঠল। দুজনের চোখাচোখি হলো। তবে সময়টা খুবই নগন্য।'
অন্যদিকে তৌহিদ ফাবিহাকে দেখেই চোখ সরিয়ে নিল। শান্তস্বরে হেঁসে বলল,
“এই তাহলে রাহেলা বানুর পিনচেস ডায়না ও থুরি ডাইনী।”
হেঁসে ফেলল তৌহিদ। রাহেলা মেয়েটা আসলেই একটু পাগলাটে টাইপ। সহজ সরল। তবে মনটা বেশ ভালো। তৌহিদ আর দাঁড়াল না। একপলক নিজের হাত ঘড়িটা দেখে বেরিয়ে পড়ল নিজ গন্তব্যে।
••••••••••••••
বুকের সামনে ব্যাগ ঝুলিয়ে তুমুল বেগে ছুটছে মোহনা। এলাকার আশেপাশের মানুষ হা হয়ে দেখছে তাকে। মোহনার ক্লাস লেট হচ্ছে। তার ভার্সিটির ক্লাস শুরু হতে দশ মিনিট বাকি। রাতুল স্যারের ক্লাসটায় আজ দেরি করে গেলে তার খবর আছে। অথচ সেই তার আজও ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে। মোহনার একটা বাজে অভ্যাস হলো ঘড়িতে এলার্ম তো দেয় কিন্তু সকালে যখন এলার্ম বাজে তখন সে এলার্ম বন্ধ করে দিয়ে আবার ঘুমায়। সকালে মা যদি মুখের ওপর একমগ পানি না ঢালতো তবে তার খবর হয়ে গেছিল। কিন্তু তবুও মোহনার মনে হচ্ছে লেট হবে। দশ মিনিটে ভার্সিটি পৌঁছানো সম্ভব নয়। সে মনে মনে বলছে, “হে আল্লাহ, রাতুল স্যারে যে রিকশায় করে আসবে সেই রিকশার চাকাটা খারাপ করে দেও। আমি পৌঁছাই তারপর যেন উনি আসেন। না হলে সেই রোজকারের মতো ওনার লেকচার, না। প্লিজ আল্লাহ এবারের মতো বাঁচিয়ে দেও। কাল থেকে আমি তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠব। দরকার পড়লে রাতে ঘুমাবই না। প্লিজ এবারের মতো বাঁচি দেও।”
এসব বলে আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে ছুটছিল মোহনা। তখনই ঘটে গেল এক আকস্মিক ঘটনা। কারো সাথে আচমকাই ধাক্কা লেগে গেল তার। মোহনা বলল,
“আমি দুঃখিত। বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি।”
তৌহিদের চোখেমুখে তখন তীব্র রাগ। কারণ ধাক্কাটা তার সাথেই লেগেছে। তৌহিদ বলল,
“চোখ যদি আকাশের দিকে রেখে হাঁটেন তাহলে তো এমন ঘটনা ঘটবেই।”
মোহনা কি বলবে বুঝচ্ছে না। হাত ঘড়িটা দেখল। অলরেডি দু'মিনিট চলে গেছে। সে তড়িঘড়ি করে বলল, “শুনুন আমার না লেট হচ্ছে। একটা খবিশ স্যার আছেন ওনার ক্লাসে দ্রুত পৌঁছাতে হবে। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দিবেন। আবার দেখা হলে লেকচার দিয়েন। আমি আবারও সরি।”
এই বলে মোহনা ছুটে গেল। তৌহিদ তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। মেয়েটা কি বেয়াদব? নিজের স্যারকে খবিশ বলছে। তার স্টুডেন্ট হলে ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরে দিত। সকাল সকাল যত্তসব ঝামেলা। তৌহিদের মুডটাই একপ্রকার নষ্ট হয়ে গেল। তৌহিদ বিরক্তি নিয়ে রিকশা ডাকল, “এই মামা, যাবেন?”
••••••••••••••
সোফায় বসে চা খাচ্ছিলেন ফাবিহার মা রিনা বেগম। আচমকাই রাহেলা ছুট্টে এসে বলল,
“চাচি আপনার হাপপ্যান্ট আইছে?”
সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে চা গড়িয়ে পড়ল নিচে। আর পাশে বসা ফাবিহা উচ্চশব্দে হেঁসে উঠল।
.
.
.
চলবে.......................................................................