সূর্যের স্নিগ্ধ রোদ চারিদিক ছড়িয়ে আছে। ফাল্গুনের পলাশ ফুল গাছের ডালে ফুলের অপূর্ব উন্মাদনা। পাতাহীন ডালগুলো যেমন রক্তে ভরা, তেমনি গাছের তলা ফুলে ভরা। চকচকে লাল টিপানো ফুলের ডালে বসে থাকা বুলবুল এবং যুদ্ধবাজরা কিচিরমিচির করে চলেছে। সাদাফ আর উমাইয়া পাশাপাশি বসে আছে নির্মল প্রকৃতি আর বিস্তৃত দিগন্তের মাঠে। উমাইয়া ইতস্তত করছিল,
'আপনি আমাকে এখানে আসতে বলছেন কেন?'
সাদাফ নরম গলায় বলল,
'আপনাকে একবার দেখার জন্য।'
উমাইয়া বার দুয়েক চোখ পিটপিট করে সাদাফের দিকে উদাসীনভাবে তাকাল। কয়েকবার পলক ফেলে সাদাফ ওর দৃষ্টি উমাইয়ার দিক থেকে নামিয়ে পাতলা কণ্ঠে বলল,
'ওরকম ভাবে দেখবেন না, প্লিজ।'
উমাইয়া অস্ফুটস্বরে বলল,
'হুম? কোন রকম ভাবে?'
সাদাফ নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
'একটু আগে যেভাবে দেখছিলেন।'
'আমি স্বাভাবিক ভাবেই তাকিয়েছি।'
সাদাফ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
'আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। আপনার ওই চোখে এক অদ্ভুত মাদকতা আছে যা আমাকে খুব টানছে।'
উমাইয়া হুট করে বলল,
'আমি মনে হয় আপনি আমাকে ফলো করেন।'
সাদাফ নির্লিপ্ত কণ্ঠে শুধল,
'ফলো করলেও দোষ কোথায়?'
উমাইয়া দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। কিয়ৎক্ষণ পর বলল,
'একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে অবিবাহিত প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের পিছনে ঘুরাঘুরি অবশ্যই দোষের।'
সাদাফ ভারী নিঃশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাল। লহু কণ্ঠে বলল,
'আমি আপনার চরিত্রকে কলঙ্কিত করতে চাই না উমা। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।'
উমাইয়া হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল সে। পিছন ফিরে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
'সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আপনি কি এখানেই বসে থাকবেন?'
সাদাফ বসা থেকে উঠে উমাইয়ার দিকে এগিয়ে গেল। সাদাফ উমাইয়ার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
'মিস উমাইয়া, কবে আমার প্রেমে পড়বেন?'
উমাইয়া হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। উমাইয়া ভ্রুকুটি করল। অস্বস্তিকর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
'আপনি আমাকে ভালোবাসেন কেন?'
সাদাফ হাসিমুখে উমাইয়ার দিকে তাকাল। উমাইয়া যে এই প্রশ্ন করবে এটা তার বোধগম্যতার বাইরে ছিল। সাদাফের চোখে এখন উদ্বেগের ছাপ, গম্ভীর গলায় বলল,
'এমন নয় যে আপনার চেয়ে সুন্দরী বা লাবণ্যময়ী নারী আমি কখনো দেখিনি। কিন্তু আপনাকে দেখার পর মনের মধ্যে সুপ্ত উন্মাদনা তৈরি হয়েছে। সেই পাগলামি থেকে পরপর তিনবার আপনার নার্সারিতে গিয়েছি। আমি সবসময় একজন সহজসরল মেয়েকে জীবনসঙ্গী চেয়েছি। ঠিক আপনার মতো। আপনি সহজ কিন্তু অনন্য।'
উমাইয়া অবাক চোখে তাকিয়ে। অস্পষ্ট কণ্ঠে শুধল,
'আমি কেন?'
সাদাফের সরল স্বীকারোক্তি,
'ভালোবাসা সম্পূর্ণ মনের ওপর নির্ভরশীল, উমা। কার জীবনে আসবে কবে? কিভাবে আসবে? কাকে ভালোবাসবে? এটা শুধুমাত্র মন নির্ধারণ করে। মানুষ না।'
উমাইয়া নিচু কণ্ঠে বলল,
'আপনাকে আমি ঠিক করে চিনি না কয়েকদিনের দেখামাত্র, বিয়ে কিভাবে সম্ভব?'
সাদাফ দূর্লভ দৃষ্টিতে উমাইয়ার দিকে তাকিয়ে। তারপর দুই পা এগিয়ে এসে উমাইয়ার সামনে দাঁড়াল সাদাফ। উমাইয়া বিস্ময়ে চুপ হয়ে গেল। সাদাফ তার হাত রাখে উমাইয়ার মাথায়। সাদাফ উমাইয়ার উদ্দেশ্য ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
'চিন্তা করবেন না উমা। এই আদম আপনার সমস্ত দায়িত্ব বহন করতে প্রস্তুত।'
উমাইয়ার অস্থিরতা বাড়তে লাগল। তার চোখ সাদাফের মুখ থেকে নামিয়ে ফেলল সে। উমাইয়া দুই পা পিছিয়ে গিয়ে ফিচেল সুরে বলল,
'আমার কাছে আসবেন না মিস্টার কসাই।'
উমাইয়া চোখ সরু করে সাদাফের দিকে তাকাল। সাদাফ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। উমাইয়ার কথা শুনে সাদাফ বিস্ময়াভিভূত চমকে ওঠল। কপট রাগ দেখিয়ে চলে যেতে নিয়ে আবার ঘুরে এলো সাদাফ। উমাইয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। কোন কিছুর অপেক্ষা না করে সাদাফ উমাইয়ার হাত ধরে রাগী গলায় বলল,
'আমার নাম সাদাফ ক্যাসানো, কসাই না।'
উমাইয়া হাত সরিয়ে নিল। শ্লেষের স্বরে বলল,
'ক্যাসানো আর কসাই একই হলো।'
সাদাফ ঠোঁট চেপে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফিসফিস করে বলল,
'যেমন বাবা তেমন মেয়ে।'
দুজন মানুষ হেঁটে এদিকটায় আসছেন। রাস্তার পাশে উমাইয়া ও সাদাফকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুরুষ লোকটি হঠাৎ বলল,
'দেখ কী দিন এসেছে? মেয়েগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেদের সাথে প্রেম করে। পারিবারিক শিক্ষা নেই। বাবা-মা এমন মেয়েদের রাস্তায় ছেড়ে দেয় কেন?'
মহিলাটি এক নজরে তাকাল। সংক্ষেপে বললেন,
'তারা স্বামী-স্ত্রীও হতে পারে।'
লোকটা খ্যাক করে বলেন,
'তুমি এসবের কিছুই জানো না। সারাদিন ঘরের মধ্যেই থাকো। আমি এসব রোজ দেখি। বাইরের জগৎ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। বুঝতে পেরেছ?'
উমাইয়া লোকটির কথা স্পষ্ট শুনতে পেল। লোকটার কথা শুনে উমাইয়া দ্রুত হেঁটে চলে গেল। ধীরে ধীরে নিকষকালো আঁধারে ম্লান হয়ে যাচ্ছে যেন। সাদাফ চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। মৃদুস্বরে বলল,
'আপনি কি কোনদিন আমার বুকের ছটফটানি বুঝবেন না, উমা?'
রাতের নিস্তব্ধতায় নিশ্চল পায়ে হাঁটছে তূর্ণ। কিছুটা দূরে অবস্থিত ল্যাম্পপোস্ট দেখতে পেল। তূর্ণ একটা মোহনীয় হাসি দিয়ে এগিয়ে গেল। এক হাত প্যান্টের পকেটে রেখে অন্য হাতের ছোট ব্যাগটা জুবিয়ার দিকে এগিয়ে দিল। জুবিয়া ব্যাগের দিকে একবার তাকাল তারপর সাথে সাথে তূর্ণর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল। জিজ্ঞাসা করল,
'এটা কিসের?'
তূর্ণ ঝুঁকে পড়ল। সে জুবিয়ার হাত ধরে ব্যাগটা জুবিয়ার হাতে দিল। এরপর জুবিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে জুবিয়ার মুখের দিকে তাকাল। উত্তরে মিহি কণ্ঠে বলল, 'তোমার জন্য একটি ছোট উপহার। তুমি সেদিন আমাকে সাহায্য করেছিলে। তোমাকে থ্যাঙ্কিউ বলা হয়নি, তাই এই ছোট্ট উপহারটি তোমার জন্য।'
জুবিয়া সরাসরি তাকাল তূর্ণর দিকে। জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
'আমার জন্য?'
জুবিয়া এক হাতে ব্যাগটা ধরে অন্য হাতে খুলতে লাগল। তূর্ণ তৎক্ষণাৎ জুবিয়ার হাত ধরে অদ্ভুত কণ্ঠে বলল,
'এখন না। ব্যাগে রাখো। বাসায় গিয়ে একা দেখবে।'
জুবিয়া শুধল,
'উমাইয়া ও আপনার বন্ধু কোথায়? তারা কখন আসবে? আমরা তাদের থেকে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। তারা আমাদের খুঁজবে।'
তূর্ণ শ্লেষের সুরে বলল,
'ওরা খুঁজবে না। আর সাদাফ উমাইয়াকে পছন্দ করে, তাদের একান্ত কথাবার্তা শোনা আমাদের জন্য ঠিক নয়। তাই এদিকটায় চলে আসছি।'
জুবিয়া কথা বন্ধ করে দিল। সে ইতস্তত করে কাঁধের ব্যাগের চেইন খুলে বাক্সটা ব্যাগে রাখল। আশেপাশে গাছগাছালি প্রচুর মৃদু বাতাসে চুলগুলো অগোছালো ভাবে উড়তে লাগল। জুবিয়া সোজা হয়ে দাঁড়াল। চুলগুলো হাত খোঁপা করতে লাগল সে। তূর্ণ খেয়াল করে মুখ থেকে মাস্কটা একটু সরিয়ে মোহনীয় কণ্ঠে বলল,
'থাক না এভাবে। খোলা চুলে তোমাকে আজ অপূর্ব লাগছে।'
❐
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল রোদেলা। দরজা খুলে জুবিয়াকে দেখে ভ্রুকুটি করল। এক হাত কোমরে রেখে দৃঢ় স্বরে বলল,
'এখন কি আসার সময়? কয়টা বাজে দেখছিস? আরেকজন কোই?'
জুবিয়া তার কাঁধের ব্যাগটি সোফায় রেখে বসল। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে রোদেলাকে জিজ্ঞেস করল,
'উমাইয়া বাসায় আসেনি?'
'না।'
জুবিয়া হঠাৎ উঠে বসল। বিস্মিত কণ্ঠস্বরে বলল,
'এতক্ষণে তো চলে আসার কথা।'
তরকারি চুলায় বসানো। রোদেলা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,
'তোর উমার সাথে কথা হয়নি।'
জুবিয়া ব্যাগ থেকে বাটন ফোনটা বের করল। উমাইয়ার নাম্বারে কল দিল সে। একটি বাক্য শ্রবণ কেন্দ্রে পৌঁছাল,
'এই মুহূর্তে আপনার কাঙ্খিত নম্বরে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।'
জুবিয়া ফোন রেখে বলল,
'আমি তাকে শেষবার বিকেলে দেখেছিলাম।'
রোদেলা অবাক গলায় বলল,
'উমার কোনো বিপদ হয়নি তো?'
জুবিয়া সোফা থেকে উঠে রান্নাঘরে এলো। তর্জনী দিয়ে রোদেলার কপাল ছুঁয়ে বলল,
'হয়তো ফোনে চার্জ নেই তাই ওর ফোন বন্ধ। তুই টেনশন করিস না ও একটু পরেই চলে আসবে।'
.
.
.
চলবে....................................