পূর্ণিমা সন্ধ্যা - পর্ব ১১ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


-“বিয়ে যদি হয়, তবে বিয়ের পর আমরা দু'জন আলাদা থাকব। আপনি আপনার বাবার কাছে, আমি আমার মায়ের কাছে।”

অবিলম্বে ইফতি বলে উঠল, 
-“এ কী অলক্ষুণে কথা, অরু!”

হো হো শব্দে হেসে উঠল অরণী,
-“রসিকতা করলাম আপনার সাথে। আপনার ফিরতি চিঠি পাওয়ার পরই আমি আমার শর্তগুলো রাখব। এরপরেরটা আমাদের দু'জনের মিউচুয়াল ডিসিশন হবে। বোঝা গেল?”

ইফতি আগের চেয়েও বেশি অবাক হলো, থমথমে গলায় বলল,
-“রসিকতা! সিরিয়াসলি?”

অরণী আরেকদফা হাসল ইফতির প্রতিক্রিয়া দেখে, 
-“জি। আপনার এই বিস্মিত মুখটা দেখতে সুন্দর লাগে।”

এই অসম্ভব স্বস্তিদায়ক হাসিটাতে কী ছিল জানা নেই, তবে ইফতি অন্যত্র তাকাতে পারেনি আর। নিষ্পলক দেখে গেছে, যেন পলক ফেলাটাও দোষের দেখাবে। 

অরণী বেশ কিছুক্ষণ পর বলল,
-“চা ভালো বানাতে পারেন। ধন্যবাদ এর জন্য। এখন ঘুমোনো উচিত। আর একটু পরই ফজরের আজান দিয়ে দেবে।”
-“অথচ মনে হলো রাত শুরু হয়েছে একটু আগেই।”

অরণী চোখে হাসল,
-“আপনার সাথে আমার সময় ভালো কাটে।”
-“একই ব্যাপারটা আমার সাথেও ঘটে।”

সে রাতের আলাপণ ওখানটাতেই থেমেছিল। এর চারদিন পর ইফতির কাছ থেকে চিঠি এলো তার। ইফতি লিখেছে —

অরণী,
এক বছরের চেনাজানা, হুট করেই ভালোলাগা, পরে এক মধ্যরাতে ঘুমভাঙা চোখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে যখন তোমার ভাসা ভাসা মুখটা কল্পনা করলাম, ভীষণভাবে টের পেলাম—আমি তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। ভালো না বাসলে কেউ কাউকে অর্ধ-জাগ্রত অবস্থায় এতটা আপন ভাবে না। আমার কাছে ভালোবাসা মানে ভালো থাকা, ভালো রাখা। কাজেই, মন থেকে অবশিষ্ট সকল ভীতি মুছে ফেলো। আমি তোমাকে ভালো রাখব। 

তোমার ধারণা—সব পুরুষই এক হয়, তারা ঠকায়। যদি বলি একই ধারণা আমারও আছে মেয়েদের ক্ষেত্রে? আমিও তো ঠকেই এসেছি। প্রথমে মায়ের থেকে, এরপর প্রাক্তনের কাছে। 
সব মেয়েরা সয়ে থাকে না, অরু। কেউ কেউ নিজের সুখের আগে পেটের সন্তানকেও দেখে না, কেউ তো সাড়ে চার বছরের প্রেমিকের সাথে চিট করতেও দ্বিধা করে না। জীবন থেকে পাওয়া—ঠকে যাওয়ার ভয়ে যে পিছিয়ে গেছে, তার সামনেই স্বর্গ ছিল৷ কে জানে, হয়তো আমার সুখ তুমিই! স্রষ্টা যতটা নেন, তার চেয়েও চমকপ্রদ কিছু বহুগুণে ফিরিয়ে দেন। আমার চমকপ্রদ কিছু তুমি নও, এর গ্যারান্টি আমি কী করে দিই বলো? কাজেই আমার এগোতে ভয় নেই। তুমিও ভয় রেখো না।

তুমি চিঠির উত্তর চিঠিতে চেয়েছিলে। তো শোনো, তোমার সাড়ে পাঁচ পৃষ্ঠার চিঠির উত্তরে একটি বাক্য—আমি তোমাকে এখনও চাই, এরপরেও চাই, শেষ অবধি চাই। 

আমাদের একটাই জীবন, একটাই মরণ। একজীবন, একমরণ সবকিছুর জন্য কেবল তোমাকে চাই। ঘুমভাঙা সকালে তোমাকে পাশে চাই, বিকেলের চায়ের আড্ডায় মুগ্ধ নজরে তোমার ভীষণ শখের শ্রোতা হতে চাই, রাত-বিরেতে শহরের রাস্তায় ঘোরার জন্য তোমাকে চাই। আমার একটা আকাশ আছে আঁধারে আচ্ছন্ন। সেই আকাশের একমাত্র চাঁদ রূপে তোমাকে চাই। তোমার রাগ-অভিমানের দায়িত্ব নিতে চাই। তোমাকে নিজের করে চাই। তোমাকে নিজের দাবি করতে চাই। ভীষণভাবে তোমাকে চাই। শুধুই তোমাকে চাই। 
হয়তো তুমি, নয়তো অন্য কেউ নয়—এমন এক পর্যায়ে বসে আমি তোমার মুখের গাম্ভীর্যের কল্পনায় আরও একবার প্রেমে পড়ে গেলাম, তোমারই। কী সাংঘাতিক অবস্থা আমার! তুমি কি বুঝতে পারছ? এরপরও কোনো প্রশ্ন থাকলে সরাসরি কোরো। তোমার জন্য আছি, সবসময়। 

- ইফতেখার মাহমুদ

অরণী কতবার যে চিঠিটা পড়ল, তা হিসেব করার মতো নয়। সে থামছে, পড়ছে, আবার থামছে, শেষ হচ্ছে, শুরু থেকে ফের শুরু করছে। চিঠির প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ, আর শেষাংশের ওই ‘তোমাকে চাই’! অরণীর মনে হচ্ছে সে এক অন্যভুবনে আছে এখন। নয়তো এসবই বা কী হচ্ছে তার সাথে! বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম বাজছে তার। নিঃশ্বাসের বেগ ঘন হচ্ছে, এলোমেলো শ্বাস এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর চিঠিটা সে ডায়ারির ভাঁজে রাখল। উঠে পড়ল বারান্দা থেকে।

ফ্রিজ থেকে পানির বোতল নিয়ে রুমে আসতেই দেখল ওয়াশরুম থেকে আয়শা বেরোচ্ছে। মায়ের কাছে এগিয়ে গেল অরণী,
-“ঘুমোওনি?”

আয়শা কিঞ্চিৎ মাথা হেলে বলল,
-“ঘুম ভেঙে গেল।”
-“চা খাবে?”
-“আচ্ছা।”

অরণী দ্রুত দু-কাপ চা বানিয়ে মাকে নিয়ে ছাদের অংশটায় চলে গেল। আয়শা ওপরের সিঁড়িতে বসল, অরণী দু-সিঁড়ি নিচে বসল। এতক্ষণে অনেকটা শান্তি পাচ্ছে অরণী। চিঠিটা পড়ে কিছুক্ষণের জন্য অস্থিরতায় সবকিছু উলোটপালোট লাগছিল! শব্দ তো নয়, একেকটা যেন ধারালো তলোয়ার! 

আবারও যখন উত্তেজিত হয়ে উঠছিল অরণী, আয়শা বলে উঠল,
-“কেমন আছিস, মা?”

অরণী অপ্রস্তুত হলো। ফট করে তাকাল আয়শার দিকে। জোরপূর্বক হেসে বলল,
-“ভ্‌‌-ভালো আছি, মামনি। ত্‌-তুমি?”
-“ভালো আছি।”

আয়শা বেখেয়ালি হলো। দূরে কোথাও দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,
-“এবার বয়স কত যেন পড়ল তোর? ২১ না?”

অরণী শোধন করে বলল,
-“২৩ বছর, মামনি।”
-“কীসে পড়ছিস?”
-“এমবিএ করছি।”

কপাল কোঁচকাল আয়শা, অরণীর দিকে তাকাতেই কোঁচকানো কপাল শিথিল হলো তার। দ্বিধান্বিত গলায় শুধাল,
-“আসলেই?”
-“হ্যাঁ।”

অরণী বুঝতে পারল, তার মা তার ব্যাপারে ঠিকঠাক জানে না। সারাজীবন সংসার ধর্ম পালন করে আসা আয়শা সেভাবে অরণীর জীবন নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি কখনও। পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দিয়েছিল। অথচ, বেশিরভাগ বাঙালি মায়েরা ছাড় দেওয়া আর ছেড়ে দেওয়ার মাঝে তফাৎ করতে পারে না। কেউ কেউ সীমাবদ্ধতার গণ্ডী এঁকে দেয় ছোট্ট করে, কেউ তো ছেড়েই দেয়। 

অরণী হতাশাজনক শ্বাস ফেলল। আয়শা জিজ্ঞেস করল,
-“প্রেম করিস?”

ভড়কাল অরণী। এমন এক প্রশ্ন এই তেইশ বছরের জীবনে সে শুনতে পায়নি কখনও কারো কাছ থেকে। অথচ মা কি অনায়াসেই না করে ফেলল! অরণী থেমে থেমে উত্তর দিলো,
-“না, মামনি।”
-“মিথ্যে বলছিস?”
-“নাহ। তোমাকে মিথ্যে বলি না।”

ইফতির সাথে তার প্রেমের সূচনা এখনও হয়নি। কাজেই বলে লাভ নেই। তবুও অরণীর মনটা কেমন খচখচ করতে লাগল। বলা উচিত কি বিষয়টা?

আয়শা চায়ের কাপটা একপাশে রেখে বলল,
-“কাউকে পছন্দ হয়?”

এবার আর অস্বীকার করল না অরণী,
-“হুঁ।”
-“আমি চিনি?”
-“হ্যাঁ। ইফতি।”
-“ইফতি? কে?”

ভাবল আয়শা। পরক্ষণে শুধাল,
-“বাড়িওয়ালার ছেলে?”
-“হু।”
-“বিয়ে করবি ওকে?”
-“হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না, জানি না ঠিক।”
-“কেন জানিস না? ভালো ছেলে তো।”
-“হু, ভালো।”

আয়শা নরম হলো খুব, তাকিয়ে রইল অরণীর দিকে। অরণী নিজের মাথাটা আয়শার কোলে রেখে সামনে তাকিয়ে রইল। আয়শা ওর মাথায় চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল,
-“তোর মন কি চায়?”
-“মনের সাথে আমার সংযোগ নেই, মামনি। তাই সে কী চায়, জানতে কষ্ট হচ্ছে।”

খুব বুঝতে পারল, এমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আয়শা বলল,
-“ওও।”

আরও অনেকটা সময় কেটে গেল। চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়ার কারণে অরণী অসম্ভব শান্তি পাচ্ছে। সকল দুশ্চিন্তা আপাতত তার না-ই হয়ে গেছে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। মিষ্টি মোলায়েম বাতাসে চোখ দুটো লেগে আসতেই আয়শা বলা শুরু করল,
-“আমার জন্মের সময়ই আমার মা মারা যায়। ভাইয়া আর বাবা মিলে আমাকে বড়ো করে অনেক যত্নের সাথে। বুদ্ধি হওয়ার পর যতটুকু মনে আছে, আমি বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারেরই মেয়ে ছিলাম। সবকিছু চাওয়ার আগেই পেয়ে যেতাম। বাড়িতে তাহেরা নামে এক খালা ছিল, আমার দেখাশোনা করার জন্য। তাকে তাহুমা বলতাম ছোটবেলায়। খুব আদর করতেন আমাকে। আমাকে নিয়ে খেলতেন, গল্প বলতেন। রোজরাতে বাবা আমাকে আর ভাইয়াকে গান গাইয়ে ঘুম পাড়াতেন। মায়ের অভাব বুঝতাম না আমি। ভাইয়া আমার চেয়ে ছয় বছরের বড়ো ছিল। তাই বাবার মতোই আদর করত আমাকে। 
স্কুলে ভর্তি করে দিলো বাবা আমাকে। সকালে বাবা দিয়ে আসত আমাদের দুইজনকে। বিকেলে তাহুমা নিয়ে আসত। ছোটবেলা থেকেই বাবা আমাকে আর ভাইয়াকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতেন। প্রতি সাপ্তাহিক ছুটিতে আমাদের ঘোরাঘুরি হতো। কত কত জায়গায় যে ঘুরে বেরিয়েছি! 

আমার বয়স তখন ১২-১৩ বছর। বাবা ভাইয়াকে নিয়ে একটা কাজে বের হয়। তাহুমা আমার সাথেই থাকে সেদিন। রাতে প্রচণ্ড জ্বর আসে। বাবা কখনও আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও রাতে থাকত না। অথচ সেদিন ফিরলই না! শুধু সেদিন না, আর কখনই ফিরল না।

সকালে দুটো লাশ আসে। হাইওয়েতে কার এক্সিডেন্টে স্পটডেথ আমার বাবা আর ভাইয়ার...
.
.
.
চলবে.....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন