একজন মহিলা চিকেন শপের মালিক। নাম সিমলা খাতুন। মেজাজ খুব খিটখিটে। ওনার ব্যবহারে কোনো মাধুর্যতা নেই এজন্য কাস্টমার খুব কম আসতো। টাকা খরচ করে ভালো খাবার না পেলে আবার আসবে কেন? প্রায় সময় শপ ফাঁকা থাকতো। জুবিয়া এইখানে পার্ট টাইমের জব নেওয়ার পর মোটামুটি মানুষ আসা যাওয়া করে। আর এখন পুরো শপে লোকেদের জন্য দাঁড়াবার জায়গা নেই। কিচেনে দুজন শেফ আছে। ওনারা শুধু খাবার তৈরি করে তারপর বাকিটা জুবিয়া কে করতে হয়। কাস্টমারের সঙ্গে ভালো আচরণ ও সঠিক ভাবে খাবার পরিবেশ তার আচরণে মানুষ মুগ্ধ হয়ে বার বার আসেন। সন্ধ্যার দিকে ভিড় বাড়ে কাস্টমারের অর্ডার দিতে ও খাবার টেবিলে পৌঁছে দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় জুবিয়াকে। আজ জুবিয়া একটু দেরি করে আসছে। সিমলা খাতুন তার ওপর একটু রেগে আছেন।
জুবিয়া ট্রে-তে খাবার নিয়ে একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে এল। দুজন লোক পাশের টেবিলে বসা বেশ উঁচু গলায় ঝগড়া করছে। এক ভদ্রলোক হঠাৎ দাঁড়িয়ে যান তার কারণে জুবিয়ার হাতের ট্রে হাত থেকে উল্টে পড়ে যায়। কাঁচের প্লেট ও গ্লাস ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেছে। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ অভদ্র ভাষায় জুবিয়াকে বকাঝকা করতে লাগল। জুবিয়া বারবার ক্ষমা চাচ্ছে। সিমলা খাতুন এগিয়ে আসলেন। সিমলা খাতুনকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল জুবিয়া। সে মনে মনে হয় উনি তার পক্ষ নেবে। কিন্তু সিমলা খাতুন জুবিয়ার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে রইল। জুবিয়া হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক খাবারের বিল না দিয়েই দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সিমলা খাতুন আরও রেগে যান। বেশ কয়েকদিন ধরেই তিনি জুবিয়াকে লক্ষ্য করছেন জুবিয়াকে চাকরি থেকে বের করে দিতে চাচ্ছিলেন সিমলা খাতুন। এ সময় সেই ইচ্ছাটাকেই পূরণ করেন, তিনি জুবিয়াকে অব্যাহতি দেন। সিমলা রাগান্বিত ও দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
'তোমার আর কাজে আসার দরকার নেই। আমি নতুন পার্ট টাইমার খুঁজে নেবো। তুমি চলে যাওয়ার সময় অর্ধেক বোনাস নিয়ে যেও।'
জুবিয়ার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল নায। যেন সে আগে থেকেই জানত এমন কিছু ঘটবে। কিচেন থেকে ঘুরে এসে কাউন্টারে দাঁড়াল।
সময় 10:11 p.m মিনিট। চাঁদনী রাত আকাশে ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পূর্ণিমার মোটা চাঁদ উঠেছে। আলো-আঁধারির স্নিগ্ধ মিতালীতে ঝলমল করছে আলোর শহর। রাস্তা জুড়ে রিকশা, অটো, বড় গাড়ির হর্নের আওয়াজ। ফুটপাতে মানুষের ভিড়। জুবিয়া মাটির দিকে তাকাল। গলা শুকিয়ে গেছে। কাছেই একটা দোকান দেখে এগিয়ে গেল। ঠাণ্ডা জলের বোতল কিনে নিয়ে জুবিয়া শান্তভাবে হাঁটতে থাকে ফুটপাত ধরে। তার ব্যাগের ভেতর বাটন ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। বাম হাতে চেন খুলে ফোনটা বের করে দেখল, ইংরেজিতে ছোট অক্ষরে লেখা,
'হ্যাপিনেস।'
কল রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরল জুবিয়া। ওপাশ থেকে ফিসফিস কণ্ঠে উমাইয়া বলল,
'এই জুবি, তুই কোথায়? এখনো বাড়ি ফিরিসনি কেন?
জুবিয়া অনেক ভেবে বলল,
'আজ কী হলো? মনে হচ্ছে তুই আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত?'
'আমার চিন্তা করছি না। চিন্তিত বাড়িওয়ালা খালা।'
জুবিয়া অবাক কণ্ঠে বলল,
'মানে?'
'উনি আমাদের ড্রয়িংরুমে বসে আছে।'
'কেন? তার ঘরে কী পানি উঠছে?'
'ঠাট্টা করিস না। উনি তোর ওপর ভীষণ রেগে আছে। কয়টা বাজে ঘড়িতে দেখছিস?'
জুবিয়া ছোট্ট করে বলল,
'দেখছি। সাড়ে দশটা কাছাকাছি।'
'উনি বলছেন, মেয়ে মানুষের এত রাত অব্ধি বাহিরে কী কাজ? উনার বাড়িতে থেকে এসব অকাজ চলবে না। আমি একা ওনাকে সামলাতে পারছি না। তুই প্লিজ জলদি আয়।'
জুবিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,
'তিনি অকাজ বলতে কি বোঝাচ্ছেন? আমরা প্রতিমাসে ভাড়া দিয়ে থাকি। তার উল্টাপাল্টা কথা শোনার জন্য? এতগুলো ভাড়াটে আছে কখনো কারো পিছনে লাগে না। শুধু আমরাই কেন? আমি আসতেছি আজ একটা বিহিত করতেই ছাড়ব।'
❐
দরজার আওয়াজ শুনে কেঁপে উঠল তূর্ণ। সেহরিশের আগমন ঘটে মাত্র। ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছে তূর্ণ। সে ভালো করেই জানে এই মুহূর্তে তার ওপর দিয়ে প্রবল ঝড় বয়ে যাবে। সে চুপচাপ সোফায় বসে রইল সেহরিশের শান্ত দৃষ্টি দেখে তূর্ণর গলা প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করছে। ড্রয়িংরুম জুড়ে একটা ভয়ঙ্কর নীরবতা নেমে এল। সাদাফ নীরবতা ভেঙে বলল,
'সেহরিশ তুই তূর্ণর সাথে হিসেব নিকাশ শেষ কর। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।'
সেহরিশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদাফের দিকে তাকাল। জোরে এবং গম্ভীর কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল,
'ডাফার। ঝামেলা তৈরি করে এখন ঘুমাতে যাচ্ছিস? তোরা একটা ঝমঝম তৈরি করবি সেজন্যই আমি তোদের দুইজনকে আনতে চাইনি। বিশেষ করে এই স্টুপিটটা কে। ওকে আমার সামনে থেকে এক্ষুনি দূরে নিয়ে যা, না হলে খুব খারাপ হবে।'
সাদাফ ভারী গলায় বলল,
'ওর সাথে এভাবে কথা বলিস না। ছোট মানুষ ভুল করেছে।'
'ওহে ছোট মানুষ? আটাশ বছর চলছে।'
তূর্ণ মৃদুস্বরে বলল,
'আই এম স্যরি। আমি আসলে..'
'গেট আউট।' সেহরিশ উচ্চস্বরে বলল।
তূর্ণ বিড়বিড় করে বলল,
'আমি কি করেছি? এত সেইফ থাকার পরও যদি মেয়েরা আমাকে চিনে ফেলে, তাতে আমার কী দোষ?'
সেহরিশ কর্কশ গলায় বলল,
'তোর বাহিরে যাওয়া ই ভুল হয়েছে।'
সেহরিশ সাদাফের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি নিউজ চ্যানেলে এখনও তূর্ণর খবর নিয়ে গুঞ্জন চলছে। সেহরিশের ফোনে কল আসতে লাগল। সে ফোন সাইলেন্ট করে রাখে। তারপর বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়াল। সাদাফ কড়া করে কফি বানিয়ে এনেছে। রেলিংয়ের উপর কাপ দুটো রেখে সেহরিশের মুখের দিকে তাকাল। সেহরিশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর জড়তা কাটিয়ে বলল,
'তূর্ণ কোথায়?'
সাদাফ বলল,
'ওর ঘরে। সম্ভবত এখন ঘুমিয়ে পড়েছে।'
'ও কি ডিনার করেছে?'
সাদাফ স্মিথ হাসলো। বলল,
'তোর কী ওর জন্য বেশি চিন্তা হচ্ছে, তাহলে নিজে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।'
সেহরিশ জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। লহু কণ্ঠে বলল,
'তূর্ণর সাথে আমার সাথে প্রথম দেখা হয় যখন ওর বয়স ষোল। ওর বাচ্চা বাচ্চা মুখ দেখে ওর প্রতি অন্যরকম ভালোলাগা তৈরি হয়। সিদ্ধান্ত নিলাম, যত কঠিন সময়ই আসুক না কেন তূর্ণ সবসময় আমার পাশে থাকবে। তূর্ণর দুর্বোধ্য দৃষ্টি ও দ্রুত কথা বলার চেষ্টা আমাকে দারুণ আনন্দ দিত। সময় ও অনেকগুলি বছর কেটে গেল। কিন্তু তার স্বভাবে এখনো বাচ্চামো রয়েই গেছে। কখনও কখনও এমন অনেক কিছু ঘটে যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই দেশ থেকে এই সময় বের হওয়া কি খুব সহজ হবে? উঁহু হবে না। দেশের বড় বড় মানুষ, ও ভক্তরা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইবে। এসব সামলে কতদিনে ফিরবো? এক সপ্তাহ বা তারও বেশি? এটা ভাবতেই আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তূর্ণ কেন যে জ্ঞান করে কাজ করে না। এমন সময়ে কেনাকাটা করার জন্য শপিংমলে যাওয়ার কি দরকার ছিল?'
সাদাফ তার ডান হাত সেহরিশের কাঁধে রাখল। সাদাফ কিছু বলতে যাবে তখনই তূর্ণর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল সেহরিশ। বারান্দা থেকে ছুটে এসে তূর্ণর রুমের দরজায় টোকা দিল। ঘরের ভেতর থেকে কোনো শব্দ এল না। কান্নার শব্দ বেড়ে গেল। ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে চলে গেল ওরা। চারিদিকে অন্ধকার। আলোর বিন্দু মাত্র ঝলক নেই। তূর্ণর কান্নার আওয়াজ বাড়ছে। সেহরিশ অসহায়ভাবে ঘরের ভিতর তাকাল। পরিষ্কার কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তারপর নিশ্চল হায়ে হেঁটে বিছানার কাছে এল। অন্ধকারে তূর্ণকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর চাপা কণ্ঠে বলল,
'বাচ্চাদের মতো কাঁদছিস কেন? আমি কি তোকে বকা দিয়েছি? আর কান্না করিস না। কান্না থামা। কথা দিচ্ছি, আমি তোকে শপিং করাতে নিয়ে যাব। ঠিক আছে? আমি ও দেখব তুই কত কেনাকাটা করতে পারিস। এখন অন্তত থাম।'
তূর্ণ ভেজা গলায় বলল,
'থ্যাংক ইয়্যু।'
সাদাফ লাইট জ্বালিয়ে সেহরিশের দিকে এগিয়ে গেল। তখনই তূর্ণর কথা শুনতে পেল। কিছুক্ষণ পর সেহরিশ চলে গেল। তূর্ণর দিকে তাকিয়ে সাদাফ মিষ্টি হেসে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
'কি আছে তোর কান্নায়? সেহরিশের মনকে সবসময় গলিয়ে দেয় কীভাবে?'
তূর্ণ একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
'এ বিউটিফুল লাভ অফ ম্যাজিক।'
.
.
.
চলবে...................................