শাবিহা যখন খুব নীরবে কেঁদেকেটে বলেছিল,
‘যদি বলি আমি আমার চেয়ে বয়সে ছোটো কাউকে ভালোবাসি—তুমি কি আমার ওপর নারাজ হবে, ভাইয়া? উইল ইউ বি ডিজেপয়েন্টেড ইন্ মি?’
তখন তন্ময়ের ভ্রাতৃতুল্য হৃদয় কতটা অসহায় অনুভব করছিল —তা হয়তো-বা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। শাবিহা তার আদরের বোন। বড্ড স্নেহের। বলা যায়, তার হাতের তালুতে যত্নে বড়ো করা পুতুল। যার প্রত্যেকটি চাহিদা সে পূরণ করতে চেয়েছে, সম্ভব হলে করেছে। তাহলে ওর জীবনের এতো বড়ো কামনা-আকাঙ্ক্ষা কীভাবে পূরণ না করে থাকবে? যবে থেকে বুঝতে পেরেছে, জানতে পেরেছে— শাবিহা অয়নকে ভালোবাসে; তবে থেকেই তন্ময় শেয়ালের মতন চোখ রেখেছে অয়নের ওপর। ছেলেটার প্রত্যেকটা পদচারণ সম্পর্কে সে খোঁজখবর রেখেছে। অয়নকে সে ছোটো থেকে দেখে এসেছে, জেনে এসেছে। তারপরও কোথাও যেন এক অদেখা বাঁধা। অনিশ্চয়তা। তার অন্তর স্থির হতে পারছিল না। বারংবার মনে হচ্ছিল, যদি কিছু ছুটে যায়? যা দেখি তাই যে সঠিক এমন তো নয়। আমরা ততটুকুন দেখি যতটুকু আমাদের দেখানো হয়। এছাড়া আরেকটি অন্যতম কারণ, বয়সের ব্যবধান। শাবিহার বয়সের তুলনায় অয়ন কয়েক বছরের ছোটো। এটি স্বাভাবিক নয় আবার অস্বাভাবিকও বলা যায় না। ছেলে মানুষের নির্দিষ্ট একটি বয়স থাকে দায়িত্বভার কাঁধে নেয়ার। সেই দায়িত্বটুকু বোঝার ক্ষমতা কী অয়নের হয়েছে? এই এক জায়গাতেই তন্ময় দ্বিধা জালে আঁটক। কর্তব্যভার! শব্দটি সহজ। এর মানে ততটাই দুর্বোধ্য। ওতটুকু ছেলে সে। বয়স কম। জবলেস। গ্রাজুয়েশন শেষ করেনি। এমন কারো হাতে নিজের বোনের হাত কীভাবে তুলে দেবে? তাই সে অয়নকে আরও কাছ থেকে জানতে চেয়েছে। বুঝতে চেয়েছে, শাবিহার প্রতি অয়নের ভালোবাসা কতটুকু! কতটুকু ওর ভেতরের দায়িত্ববোধ।
ভাগ্যক্রমে তন্ময়ের সবরকম দুর্ভাবনা অয়ন আমোদেই মুছে দিতে পেরেছে। নিজেকে খোলা পৃষ্ঠার মতো খুলে দিয়েছে তার সম্মুখে। তন্ময়ের অনিশ্চয়তার চেয়েও দ্বিগুণ শক্তি, দৃঢ়তা, শ্রদ্ধা অয়নের ভালোবাসায়। তন্ময় মুগ্ধ। রুদ্ধ। সে মনেপ্রাণে সম্মান করে ছেলেটাকে। এতটুকু বয়সে তার কথায় নিজেকে প্রমাণ করেছে। তিন বছরের মাথাতেই সাফল্যতা অর্জন করে দেখিয়েছে। নিজের ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি দাঁড় করিয়েছে। ফ্ল্যাট কিনেছে, গাড়ি কিনেছে। তন্ময় নিজের বোনের জন্য চেয়েছিল এক দায়িত্ববান পুরুষ। যে সারাজীবন তার পুতুলকে পুতুলের মতো আগলে রাখবে। অয়ন তার চাওয়ার থেকেও ওপরে চলে এসেছে। অয়নের এই পরিশ্রম দেখে তার বাবা শাহজাহান মোস্তফাও নরম হয়েছেন। কোমল হয়ে এসেছে তার অন্তর, ব্যবহার। অবশ্য এখনো ওপরে-ওপরে ভদ্রলোক এক কাঠিন্য শ্বশুরের প্রতিচ্ছবি দেখাতে চাচ্ছেন। যা তন্ময় দুর্বোধ্য হেসে উড়িয়ে দেয়। দেয় অয়নও। ছেলেটা কমবয়সী হলেও বয়সের তুলনায় বেশ প্রাপ্তমনস্ক। কমবেশ সবকিছুই বুঝে নেয়। তার বোনকেই কী দারুণকায়দায় গুছিয়ে-বুঝিয়ে-মানিয়ে নিতে জানে!
আজকের, বলা চলে এখানকার বিষয়টার কথাই বলা যাক। কিছুক্ষণ আগেই অয়নের পরিবার বিদায় নিয়েছে। এসেছিল শাবিহার এংগেজমেন্ট রিং-এর সঠিক মাপ নিতে। ইতোমধ্যে ওদের বিয়ের তারিখ পর্যায়ক্রমে ছ'বার পরিবর্তন হয়েছে। সপ্তম বারে পাকাপোক্ত হলো। শুক্রবার আকদ হবে। দু'দিন পর অর্থাৎ সোমবার মেহেন্দি অনুষ্ঠান। মঙ্গলবার ফাঁকা রাখা হয়েছে বিশ্রামের জন্য। বুধবার গায়ে হলুদ। একই নিয়মে বৃহস্পতিবার ফাঁকা। শুক্রবার বিয়ের অনুষ্ঠান। মেহেন্দি অনুষ্ঠান বাদে বাকিসব সব অনুষ্ঠান ইনফিনিট কমিউনিটি সেন্টার-এ করা হবে। গত চারদিন যাবত তন্ময় এসব নিয়েই মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ত ছিল। এরচেয়েও বড়ো ব্যস্ততা যাচ্ছে বিয়ের কেনাকাটা নিয়ে। এতো-এতো শপিং করছে বাড়ির লোকজন! আজ একটু ফুরসত মিলেছে। এজনই রাত করে ছাঁদে উঠেছে। শীতকালীন রাতের সময়টা তন্ময় কেন যেন এমনিতেই পছন্দ করে। পছন্দ করার নির্দিষ্টতা কোনো কারণ খুঁজে পায় না।। তবে তার অন্তরের অভ্যন্তরে একটি বাসনা আছে। যেটি এসময়তে ওঁৎ পেতে রয়। আশকারা চায়। তন্ময় দিচ্ছে না। দিলে যে আহামরি কোনো সমস্যা হবে তা নয়। শীতের নীরব রাতে, নিভৃতে অরুকে বুকে জড়িয়ে ঘুমানোর ইচ্ছেটাকে কি সে বাসনা বলতে পারবে? হাত ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে সাতটা নয়ে। তন্ময় পশ্চিমের এক কোণেতে রেলিং ঠেসে দাঁড়িয়ে আপাতত। গলির মোড়ে কুকুর ঘেউঘেউ করছে। ও বাড়ির জয়নাল সাহেব দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছেন। তন্ময় সিলেট থেকে ফিরে সিগারেট খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে বলা যায়। বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় না পড়লে খাওয়াই হয় না। আকাশে দারুণ সুন্দর এক চাঁদ বসে আছে। শীতের তীব্রতা তখন আকাশচুম্বী। অরুকে দায়িত্ব দিয়ে এসেছে গরম-গরম এক মগ কফির। অরু উদগ্রীব চরণে কফি নিয়ে এযাত্রায় সহিসালামত ছাঁদে পৌঁছাতে পেরেছে। গায়ে ভারি সোয়েটার। মাথায় টুপি। দু'হাতে মোজা। পা জোড়াতে মোজা। নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকেঢুকে নিয়েছে। তন্ময়ের গম্ভীর কণ্ঠের সতর্কতা অবশেষে কাজে এসেছে। কাছাকাছি এসে অরু কুণ্ঠিত হাতে কফির মগ বাড়িয়ে দিলো। চোখমুখে অভিমানের আবছায়া। তন্ময় সাবলীলভাবেই মগটা নিলো। অরুর পানে চেয়ে থেকেই মগে চুমুক বসাল। টুপিতে ঢেকে থাকায় ওর মুখটা এইটুকুন দেখাচ্ছে। তন্ময়ের হাতের তালুও বোধহয় ওর মুখের চেয়ে বড়ো। চাঁদের আলোয় ঐন্দ্রজালিক মুখটা বিড়ালছানার মতো আদুরে লাগছে। আধবোঁচা নাকের ডগাটুকু রক্তিম। এবেলায় অরু ইতস্তত স্বরে বলে,
‘আমাকে যেই কারণে এতগুলো কথা শোনালেন তখন– সেই কারণ কি আপনি নিজে ফলো করছেন?’
তন্ময় মৃদু হেসে ডান ভ্রু তুলে শুধায়, ‘করছি না?’
অরু সাহস পায় সহসা,
‘করছেন না। পাতলা একটা জ্যাকেট পরে আছেন। ব্যস! এইটুকুতে কি শীত মানে? আপনি জানেন না, অন্যকে পরিবর্তন হতে বলার আগে নিজের পরিবর্তন হতে হয়?’
তন্ময় মগে চুমুক দিয়েছে সবেমাত্র, ‘তাই বুঝি?’
অরু অসন্তুষ্ট হলো। তার কথার কি দাম নেই? এতো অবহেলা কেন? অরু প্রত্যুত্তর দেবে ততক্ষণে আকস্মিক মৃদু পদচারণের ধ্বনি কর্ণপাত হয়। তন্ময়ের বোধগম্য হওয়ার পূর্বেই ছাঁদের নীরবতা ভেঙে অয়নের কণ্ঠস্বর শোনা যায়,
‘আমাকে বুঝবেন না আপনি? আমি ব্যস্ত কার জন্য বলুন? এভাবে এভয়েড করলে কীভাবে হবে? আমি তো আপনার কণ্ঠ না শুনে ঘুমাতে পারি না। কেন বোঝেন না, শাবিহা?’
অরুর মুখটা হা হয়ে এসেছে। ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে আছে বড়ো বড়ো চোখে। শাবিহা আর অয়নের অবয়ব স্পষ্ট। দুজনের মধ্যিখানে সামান্য ফাঁকা। অয়ন হয়তো-বা ছাঁদ টপকে এসেছে। গায়ে স্যুট পরনে। বেচারা অফিস ড্রেস পরিবর্তন করার সময়টুকুও পায়নি। তন্ময় এতক্ষণ রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবারে সটানদেহে দাঁড়ায়। নিজের অস্তিত্ব জানাতে উতলা হয়। কিন্তু অরু উতলা নয়। ও উতলা প্রেমিক-প্রেমিকার মান-অভিমানজনিত দ্বন্দ্ব দেখতে। তন্ময়ের শীতল হাতটা জাপ্টে ধরে। চোখের ইশারায় মুখ বন্ধ রাখার আকুল ইশারা দিয়ে ফের উৎসুক চোখে চেয়ে। আঁধারে অদূরের মানব অবয়ব দুটো তখন ছুঁইছুঁই প্রায়। শাবিহার গলার স্বরে এক আকাশ অভিমান,
‘সারাদিনে সময় হয় না? নাইস জোক্স। তুমি সোজাসুজি বলো তোমার ইচ্ছে নেই।’
অয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কণ্ঠস্বর নেমে আসে অনেকাংশে, 'কাছে এসেই দেখেন না! ছুঁয়েই নাহয় বুঝে নেন, আমার ভেতরে কতটা বাসনা।’
‘বাসনা না ছাই!’
অরুর মুখের অবস্থা তখন দারুণ হাস্যকর। হা হয়ে আসা তাজ্জব মুখখানা দেখে তন্ময় নিঃশব্দে হাসল। কফির মগটা ওর হাতে ধরিয়ে, ঢাকল ওর কান দুটো। এতে ছটফটিয়ে ওঠে মেয়েটা। ওদিকে এযাত্রায় অয়ন হয়তো-বা কারো অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরেছে। সে চাপাস্বরে বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘অনেক ঠান্ডা বাইরে। রুমে যান। আমি কল দিচ্ছি–প্লিজ ম্যাডাম রিসিভ করিয়েন, হুঁ?’
বলেই ছেলেটা একপ্রকার পালাল। হুলস্থল কাণ্ড। শাবিহা তখনো অবুঝ পাখি। এমন তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ার ছেলে তো অয়ন নয়! অনেক ঠান্ডা এরজন্য কী? অয়ন ওদের ছাঁদে পৌঁছে ফের ফিরে তাকাল। তুড়ি বাজাল। ইশারায় নিচে নামতে তাড়া দিলো। শাবিহা মানল অবশেষে। ছাঁদ থেকে নেমে গেল। শাবিহা যেতেই তন্ময় অরুর কান ছাড়ল। কফির মগটা নিলো। তখনো অরুর বড়ো চোখের চাহনি তন্ময়ের ওপর। এতে তন্ময় নির্বিকার। সাবলীলভাবে রেলিং-এ পিঠ এলিয়ে কফির মগে চুমুক বসাচ্ছে। কফি-টা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তাই চটপট মুখ ভরে একচুমুক নিতেই, অরু চোখজোড়া পিটপিট করে আফসোস স্বরে প্রশ্ন করে,
‘এতদ্রুত কথা বলা শেষ? আরেকটু বলতো। ভালোই তো লাগছিল।’
তন্ময় কেশে ওঠে সামান্য। কফিটুকুর সাথে গিলে নিলো ধেয়ে আসতে চাওয়া কৃত্রিম হাসিটুকু। থমথমে গলায় শুধানো ভঙ্গিতে বলে, ‘কী বললি?’
অরু ফাঁকা হাসে, ‘কই? কিছু না তো।’
তন্ময় হাত বাড়ায়। অরুর ললাট ছোঁয়। ঠান্ডা হয়ে আছে। নাকও টানছে ঘনঘন। শীতকালে ওর ঠান্ডা লাগাটা যেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাতের তালুতে যত্নসহকারে রাখলেও ফায়দা নেই যেন। তন্ময় বলে ওঠে,
‘নিচে নাম।’
অরু ইতস্তত করে বড্ড, ‘না। আরেকটু থাকব।’
‘নামতে বলেছি।’
অরুর মুখটা চুপসে এলো। ভোঁতা মুখে মিনিটখানেক ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকল একগুঁয়ে রমণীর মতন। এক পর্যায়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে–নাক ফুলিয়ে আওড়ে ওঠল,
‘শুধু ধমকাতেই জানেন। একটুও কাছে থাকতে দেন না। সিলেট থেকে আসার পর আপনি আমায় একটুও আদর করেন না। আমার আর আদরের দরকারও নেই, আপনাকেও দরকার নেই।’
কথাটুকু বলেই ছলছল নয়নে একপলক চেয়েই ছুটল। ছুটে যাওয়া রমণীর মৃদু গোঙানিও শোনা গেল। এই দৃশ্যটুকু একটা বাংলা নাটকের মতো মনে হলো তন্ময়ের কাছে। কথাবার্তা ক্লিয়ার না করেই ছুটতে হবে কেন? আশ্চর্য! ওপরপক্ষের তো প্রত্যুত্তর থাকতে পারে। তা শোনার প্রয়োজনবোধও নেই ওর। তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলল লম্বা করে। মেয়েটা যে কবে তাকে বুঝবে! সমসময় সবকিছু চাইলেই কী করা যায়? যায় না! তন্ময় বড়ো। তার কাঁধের দায়িত্বও অদৃশ্যভাবেই সুবিশাল। সব বিষয়ে ভেবেচিন্তে পা বাড়াতে হয়। এসব এই পুচকে মেয়েটাকে কে বোঝাবে? এখন এই মেয়েকে মানাতে কী-কী করতে হয়, আল্লাহই জানেন! এমনিতে আদুরে হলেও, অভিমান করে বসলে আর আদুরে রয় না। হয়ে যায় —তন্ময়ের হৃদয় পিটিয়ে-পিটিয়ে ভাঙার মিস্ত্রি। অবলীলায় তন্ময়ের হৃৎপিণ্ডকে পিষে ফেলার সামর্থ্য রাখে এবং তা বড্ড নিরালায়।
————
মাসব্যাপী বিয়ের কেনাকাটা করেও, বাড়ির লোকজনের যেন কেনাকাটার কোনো অন্ত নেই। আজ বৃহস্পতিবার রাতেও চার গাড়ি নিয়ে বেরুতে হয়েছে শপিং-এর উদ্দেশ্যে। তন্ময়কে এড়িয়ে গিয়ে অরু প্রথমেই তার বাবার গাড়িতে চড়ে বসেছে। আনোয়ার সাহেব মেয়ে বলতেই পাগল বলে কথা। ভদ্রলোক গদগদ ভঙ্গিতেই মেয়েকে পাশে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। আশ্চর্য! চাচ্চু কি ভুলে বসেছে তার একটিমাত্র মেয়ে জামাই আছে? তার কি উচিত ছিল না, অরুকে তন্ময়ের গাড়িতে তুলে দেয়া? তা না! তন্ময় গম্ভীরমুখে ড্রাইভিং-য়ে উঠে বসল। পাশেই মোস্তফা সাহেব উঠে বসলেন। পেছনেই ওহী সাহেব এবং শাবিহা-রুবি বসেছে। তাদের গাড়ির পাশ দিয়েই, আকাশ ড্রাইভ করে ইতোমধ্যে বেরিয়ে যাচ্ছে। তন্ময়ও গাড়ি স্টার্ট করল। তারা যাচ্ছে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে। আকদ এর কেনাকাটা হয়ে গেলেও, বিয়ের কেনাকাটার যেন অন্ত নেই। তন্ময় বারো দিন আগেই বন্ধুদের বলে রেখেছে। প্রত্যেক পরিবারে ডিজিটাল ম্যারেজ কার্ডও পাঠানো হয়েছে। আকদ এর একটা ড্রেসিং কোডও আছে। নীল-সাদার মধ্যে। সেই মোতাবেক ড্রেসও পাঠানোও হয়েছে। সেন্টারও নীল-সাদার কম্বিনেশন-এ সাজানো হচ্ছে। পোশাকও মিলিয়ে কেনা হয়েছে। শাবিহার জন্য শুভ্র রঙা গাউন। অত্যধিক গর্জিয়াছ। একইরকম ভাবে ম্যাচ করা অয়নের পাঞ্জাবি স্যাট। শুধু বুকপকেটের কোটি নীল। মেয়েযাত্রীদের আবার পরিপূর্ণ ড্রেসিং কোড নীল রঙা। শুভ্রত্ব যেন শুধুমাত্র বর-কনের জন্য।
অরুটা বোয়াল মাছের মত ছটফট করে পালিয়ে বেরাচ্ছে। শাড়ি দেখতে বসে যখন তন্ময় কাছাকাছি যেতে চাইল, বাঁদরটা চাচ্চুর পিছু গিয়ে লোকাল। যা পছন্দ হচ্ছে আনোয়ার সাহেবকে গিয়ে বলছে। অথচ তন্ময় ওর স্বামী। কেনাকাটা করে দেবার দায়িত্ব তো তার। তন্ময়ের ভোঁতা মুখটা পর্যায়ক্রমে গুরুগম্ভীর হতে থাকল। একপর্যায়ে আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। সবার সম্মুখে এগিয়ে গেল অরুর সামনে। অরু তখন মনোযোগ দিয়ে জামদানি শাড়ি দেখছে। আনোয়ার সাহেব কী বুঝলেন কে জানে! হেসে মেয়ের পাশ থেকে চলে এলেন। বড়ো ভাইয়ের কাছাকাছি গিয়েও ভদ্রলোক হাসছেন। তন্ময় যেন সেইদৃশ্য দেখল না। দেখল না বাচ্চাবুড়ো সকলের অগোচরে লুকিয়ে হাসার দৃশ্য। সে অরু পাশে বসল। অরুর ধরা শাড়িটা ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখে শুধাল,
‘পছন্দ হয়েছে?’
অরু আড়চোখে চেয়ে মুখ ভেঙাল। মুখে একটি শব্দও বলল না। দীপ্ত মুখ চেপে বলল,
‘অরুপি অভিমান করেছে মনে হচ্ছে।’
শাবিহাও সুরে সুর মেলাল, ‘ভাইয়া, অরুর কিন্তু ওই মেজেন্টা রঙের শাড়ি পছন্দ হয়েছে।’
শাড়ি দেখানো ভদ্রলোক শব্দ করে হেসে ফেলেন। এযাত্রায় ভালোভাবে দেখলেন পাশাপাশি বসা তন্ময়-অরুকে। দুজনকে এতো দারুণ দেখাচ্ছে পাশাপাশি যে গম্ভীরমুখের তিনিও হাসিমুখে শুধালেন,
‘বিয়ের কতদিন? দেখে তো মনে হচ্ছে নতুন বিয়ে হয়েছে।’
জবেদা বেগম মিষ্টি করে হাসেন। নিজেও একবার ছেলে-মেয়ে দুটোকে দেখে নেন। মনপ্রাণ জুড়িয়ে এলো। বলেন রয়েসয়ে,
‘ঘরোয়া ভাবে হয়েছে। অনুষ্ঠান করা বাকি।’
দীপ্ত চাপাস্বরে বলল, ‘আনুষ্ঠানিক বিয়ের পর আমি কিন্তু তন্ময় ভাইয়াকে ডাকব ভাইজিজু। অরুপি ডাকব আপুভাবি।’
.
.
.
চলবে.......................................