" ঈদের সাজে সজ্জিত ভদ্র পরিবারের দুই ফকির আমার কাছে হাত পাতছে! হোয়াট আ সিন!"
স্মরণের তীক্ষ্ণ কথায় থমথমে হয়ে দাঁড়ালো নীলিমা। তবে রাফার ভাবাবেগ খুব একটা পরিবর্তন হয়নি বলা চলে। নীলিমা ক্ষণেই হাত পিছিয়ে নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
" ঈদ সালামি পাওয়া আমাদের অধিকার। বুঝলেন?"
স্মরণ ভ্রু উঁচিয়ে বলিষ্ঠ হাত দুটো বুকের উপর আড়াআড়িভাবে রেখে শুধালো,
" অধিকার? কেমন টাইপের অধিকার শুনি?"
নীলিমা গলায় জোর দিয়ে বললো,
" কাজিনগত অধিকার।"
" কাজিনগত? কই এমন অধিকারের নাম তো শুনিনি আমি। এসব ঈদ সালামি পাওয়ার অধিকার থাকে বউয়ের। তুমি কি আমার বউ যে এত জোর গলায় অধিকার খাটাতে এসেছো?"
নীলিমা থতমত খেলো। আচমকাই লজ্জাবতী পাতার ন্যায় নুয়ে পড়লো সে। তবে ভাবখানা রাখলো দৃঢ়। স্মরণের এ তীর ছোঁড়া কথায় লজ্জায়, সংকোচে তার জবান বন্ধ হয়ে এলো। এখন না পারছে জোর গলায় এর প্রতিবাদ করতে, না পারছে সালামি চাইতে। রাফা নিজেও স্মরণের কথায় থতমত খেয়ে গিয়েছে। তবুও সে এসব কথাকে উপেক্ষা করে জোর গলায় ফের সালামি চাইলো। স্মরণ এবার আর দেরি করলো না৷ নীলিমাকে এহেন কথা বলে সে নিজেও খানিকটা লজ্জিত হয়েছে। মজা করতে করতে হুটহাট কিভাবে যে এসব বলে ফেললো!
স্মরণ মানিব্যাগের পকেট থেকে দুশো করে চারশ টাকা বের করে রাফার হাতে ধরিয়ে বললো,
" এই নাও, দুজনের ঈদ সালামি। "
রাফা টাকাটা নিয়েই নীলিমার হাত ধরে ছুট দিলো। পিছে স্মরণ হাফ ছেড়ে বাঁচলো। নিজের এই লাগামছুট কথার জন্য নিজের দু গালে চড় বসালো। বিড়বিড় করে নিজেকে বললো,
" এসব ছ্যাবলামি বন্ধ কর স্মরণ। লিমিটে থাক। শুধু শুধু নীলিমাকে ঘাঁটাতে যাস না। নাহয় পরে পুরোটাই ঘেঁটে ঘ হয়ে যাবে।"
এদিকে স্মরণের রুম থেকে বের হওয়া মাত্রই রাফা নীলিমার দিকে তাকিয়ে চরম বিস্ময়ে বললো,
" এই মাত্র কি হলো রে নীলু! স্মরণ ভাই তোকে ইনডিকেক্টলি বউ বললো!"
মিশ্র অনুভূতিতে আচ্ছাদিত নীলিমার মস্তিষ্কে স্মরণের কথাগুলো নাড়া দিচ্ছে। এমতাবস্থায় রাফার কথা শোনা মাত্র পরিবেশ হালকা করতে ব্যাপারটাকে ধুলোর ন্যায় উড়িয়ে দিয়ে বললো,
" কি যে বলিস তুই। কখন এমন বললো? তোর কি মনে হয় না তুই একটু অতিরিক্ত রসকষ মিশিয়ে উনার কথাগুলো বলিস না?"
রাফা ভেঙচি কেটে বললো,
" নাটক কম করো পিও। উনি একটু খোঁচালে তোর মনে যে লাড্ডু ফুটে এটা বেশ জানা আছে। নাহলে উনি ঐ কথা বলার পর তুই লজ্জায় চুপ হয়ে রইলি কেনো?"
নীলিমা তৎক্ষনাৎ নিজের দোষ ঢাকতে বললো,
" কই লজ্জায় চুপ হয়ে ছিলাম। মিথ্যে একটু কম বলিস। চল, আগে কিছু খেয়ে নেই। ঈদ সালামি তো আপাতত কালেক্ট করা শেষ। "
বলেই সে রাফার হাত ধরে রান্নাঘরে টেনে নিয়ে গেলো।
এদিকে টুকটাক সবার কাছ থেকেই রাফি ও পাখির ঈদ সালামি সংগ্রহ করা শেষ। এখন বাকি আছে মাহবুব ও স্মরণ। রাফি ও পাখি ছোট হওয়ায় বাড়ির একটা মানুষের কাছ থেকেও সালামি চাওয়া বাকি রাখেনি। যদিও মেয়েদের মধ্যে মানতাসা, রাফা ও নীলিমা বাকি আছে। দু ভাইবোন মিলে আলোচনা করছে যে এই তিনজনের কাছ টাকা চাইবে কি না। এই ভাবতে ভাবতে রাফি স্মরণের কাছে গেলো। স্মরণ রাফিকে দেখা মাত্রই বলে দিলো,
" সালামি চাইতে এসেছিস তাই না?"
রাফি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
" হ্যাঁ হ্যাঁ! তুমি কিভাবে বুঝলে স্মরণ ভাইয়া?"
স্মরণ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
" কিছুক্ষণ আগেই দুজন নিয়ে গেলো। "
বলেই সে মানিব্যাগ থেকে চকচকে ৫০টাকার একটা নোট দিয়ে ফের বললো,
" এই নে তোর ঈদ সালামি। "
টাকার পরিমাণ দেখে উচ্ছ্বসিত রাফির মুখখানা মুহূর্তেই চুপসে গেলো। চোখের ভুল ভেবে ফের নিশ্চিত হতে টাকাটা একটু নেড়েচেড়ে দেখলো। নাহ, ৫০টাকাই দিয়েছে স্মরণ। মুখমন্ডল জুড়ে দুঃখের কালো মেঘের ছায়া নামিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,
" মাত্র ৫০ টাকা! ১০০ টাকা দাও স্মরণ ভাইয়া।"
স্মরণ ঠোঁট কামড়ে বললো,
" এক কানের নিচে দিবো। যা দিয়েছি তাতেই খুশি থাক। এত টাকা দিয়ে কি করবি? ঈদগাহ থেকেই তো আমার পকেট অর্ধেক খালি করে দিয়েছিস। আর কি কেনা বাকি আছে?"
রাফি আর কিছু বললো না। হতাশা নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। তার জানা আছে, এখন হাজার ঘ্যানঘ্যান করলেও স্মরণ আর টাকা দিবে না। এর চেয়ে বরং মান সম্মান থাকতেই চলে যাওয়া উচিত।
------
নতুন মাড় দেয়া শাড়ির ভাঁজ খুলে গায়ে জড়িয়েছেন আসমানী বেগম। বাহাদুর শেখ মেঝেতে লাঠি ঠেকিয়ে বিছানায় বসে আছেন। এভাবে বসেই আসমানী বেগমকে তৈরী হতে দেখছেন। চোখেমুখে তাঁর একরাশ ভালোলাগা।
শাড়ি পরা শেষে মাথায় ঘোমটা টেনে আসমানী বেগম বাহাদুর শেখের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির প্রলেপ। এখনও পুরোনো দিনগুলোর মতো স্বামীকে মুগ্ধ করার চেষ্টা তাঁর মাঝে। বাহাদুর শেখ স্ত্রীর এ আচরণ সম্পর্কে অবগত। তাঁর 'দিল' এর এ আচরণ যেনো পুরোনো হয়েও পুরোনো হয় না কোনোদিন।
আসমানী বেগম মুচকি হেসে বললেন,
" ঈদ মুবারক।"
বাহাদুর শেখও বললেন 'ঈদ মুবারক'। এই বলে হাত বাড়িয়ে বালিশের নিচ থেকে চকচকে ৫০টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বললেন,
" তোমার জন্যে ঈদ বকশিস দিল। খুশি হইছো তো?"
আসমানী বেগম তৃপ্তিময় হাসি দিয়ে বললেন,
" তোমার বকশিসে খুশি না হইয়া যামু কই।"
বলেই তিনি পরম যত্নে টাকাটা ভাঁজ করে নতুন শাড়ীর আঁচলে ভাঁজ করে গিট দিয়ে রাখলেন।
-----------
দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষেই পুরো কাজিনমহল ঘুরতে বের হলো। গ্রামের এদিকে বিশ মিনিটের দূরত্বে একটা নদী আছে। সেখানেই ঘুরতে যাচ্ছে সবাই। প্রস্তাবটা দিয়েছে মাহবুব। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী বড় একটা নৌকা সম্পূর্ণটা ভাড়া করে নদী ঘুরবে সবাই। সেই অনুযায়ীই ছোটবড় সব কাজিন মিলে দুটো ভ্যান ভাড়া করে উঠে বসলো। প্রথম ভ্যানে সাজিদ, নওরীন, মাহবুব, মানতাসা ও রাফি। দ্বিতীয় ভ্যানে স্মরণ, নীলিমা, রাফা, সাদ ও পাখি চড়ে বসলো।
গ্রামের আধ ভাঙা, কাঁচাপাকা রাস্তা ধরে ভ্যান এগিয়ে চলছে। দুটো ভ্যানের দূরত্ব একেবারেই কম। কাছাকাছি থাকতে বলেছে সাজিদ। উদ্দেশ্য এ ভ্যান থেকে ও ভ্যানের চেঁচামেচি যেনো সব শোনা যায়।
কিছুদূর যাওয়ার পরই সাজিদ গলা ছেড়ে গান জুড়ে দেয়। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের সাথে স্মরণদের ভ্যানে সাজিদের গানের স্বর কিছুটা কম পৌঁছাচ্ছে। সাজিদের দেখাদেখি এরপর স্মরণও গান জুড়ে দিলো। তার গানের গলা বেশ স্পষ্ট ও কঠিন। তার পুরুষালী গমগমে কণ্ঠে ধীরলয়ের গানগুলো বেশ শ্রুতিমধুর শোনায়। কিশোরী নীলিমার স্মরণের প্রতি মুগ্ধ হওয়ার এটাও একটা কারণ ছিলো যে স্মরণের গানের গলা ভীষণ ভালো। নিজের কণ্ঠে নিজেই সুর তুলে গান গাওয়ার গুণ আছে তার।
ভ্যানের পিছনের দিকে বসা নীলিমার কর্ণকুহরে স্মরণের গানের গলা অতীতের স্মৃতিতে টেনে নিয়ে গেলো তাকে। এখনও মনে পড়ে ছোটবেলার সেই পাগলামির কথা। কোনো একবার কাজিন মহলের আড্ডায় স্মরণ তার এক বন্ধুর গিটার ধার করে এনেছিলো। চাঁদনী রাতে উঠোনে বসে গলা ছেড়ে 'ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু' গানটা গেয়েছিলো তখন। সে সময়ে স্মরণের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া নীলিমা নওরীনের অগোচরে তারই ফোনের সাউন্ড রেকর্ডারে স্মরণের গানটা রেকর্ড করেছিলো। সেই রেকর্ড করা গানটা ঢাকায় এসে লুকিয়ে লুকিয়ে কতবার যে শুনেছিলো তার ইয়ত্তা নেই। সকাল বিকাল নীলিমা স্মরণের গাওয়া গানটা শুনতো। পরে অবশ্য নওরীনের ফোন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেই অডিওটা আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ততদিনে নীলিমাকে রিজেক্ট করার ঘটনাও ঘটে গিয়েছিলো। এজন্য নীলিমা ওসব রেকর্ডকে আর পাত্তা দেয়নি। আজ এতগুলো বছর পর স্মরণের গান শুনে নীলিমা অতীতের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করছিলো।
দু চারজনের গান চলতে চলতে পুরো রাস্তাটুকু শেষ হলো। তারা সবাই ঘাঁটে এসে পৌঁছালো। এখানে এখনও নৌকার মাধ্যমে এপার ওপার পারাপার চলে। ফলে নৌকাভ্রমনের মতো বিষয়ের আয়োজন করা খুব একটা কঠিন কাজ না এদিকে।
ভ্যান থেকে নেমে স্মরণ ও সাজিদ টুকটাক চিপস ও কোমল পানীয়ের বোতল কিনতে দোকানে গেলো। আর বাকিরা ঘাঁটের দিকে এগুতে লাগলো। ঘাঁটে আগ থেকেই নৌকা ও মাঝি ঠিক করা আছে। মাহবুব নৌকায় মাঝিকে দেখে ওয়াকিং স্টিকে ভর দিয়ে আগে আগে চলে গেলো। পিছনে মেয়েরা সব এলো।
চিপসের প্যাকেট দুটো মানতাসা ও নওরীনের হাত দিয়ে ঘাঁট জুড়েই সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইলো। নীলিমা ও রাফা এক কোনে দাঁড়িয়ে টুকটাক গল্প করছে। রাফি রাফার ফোন দিয়ে আশেপাশের প্রকৃতির ছবি তুলছে। এরই মাঝে সব ঠিকঠাক হয়ে এলে মাহবুব সবাইকে নৌকায় উঠতে বলে। তার নির্দেশে সবাই ধীরে ধীরে এগিয়ে নৌকায় উঠতে লাগলো। রাফা আগেই এগিয়ে গিয়েছে পাখিকে নৌকায় উঠতে সাহায্য করতে। স্মরণ দাঁড়িয়ে আছে সবার পিছনে। এদিকে ঘাঁট থেকে নৌকায় উঠতে যদি অসুবিধা হয় তখন সে এগিয়ে যাবে।
একে একে সবাইকে নৌকায় উঠতে দেখে নীলিমাও এগিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু অকস্মাৎ পিছন থেকে ওড়নায় টান অনুভব করলো সে। পিছে ফিরে দেখলো একটা কাঁটা গাছের মাথায় তার ওড়নার কোনা আটকে গেছে। পছন্দের নতুন থ্রিপিসের ওড়নাটাকে এভাবে দূর্ঘটনায় পড়তে দেখে নীলিমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে সে ঘুরে গিয়ে ওড়নাটাকে উদ্ধার করতে তৎপর হলো। ঠিক এই সময়েই পিছন থেকে স্মরণ এগিয়ে এলো। সে নীলিমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। কখন নীলিমা নৌকায় উঠবে, তারপর সে নিজেও নৌকায় উঠবে।
স্মরণ এসেই নীলিমাকে জিজ্ঞেস করলো,
" কী? কিছু হয়েছে? "
নীলিমা উৎকণ্ঠিত স্বরে বললো,
" আমার ওড়না আটকে গিয়েছে স্মরণ ভাই। "
" আচ্ছা, দাঁড়াও। আমি খুলে দিচ্ছি এটা।"
বলেই সে আরেকটু এগিয়ে এসে কোমড় বাঁকিয়ে ঝুঁকে নীলিমার ওড়না ছড়িয়ে নিতে আরম্ভ করলো। নীলিমা পূর্বের ন্যায় বললো,
" একটু সাবধানে করবেন স্মরণ ভাই। ওড়নাটা আমার ভীষণ পছন্দের। "
স্মরণের সুক্ষ্ম দৃষ্টি এখনও ওড়নার কোনায়। এমতাবস্থায় নীলিমাকে আশ্বস্ত করতে সে বললো,
" চিন্তা করো না নীলিমা। একদম ঠিকঠাক হাতে পাবে ওড়নাটা।"
ওদিকে নৌকায় বসে সবাই স্মরণ ও নীলিমার অপেক্ষা করছে। নৌকা থেকে ওদিকটা একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফলস্বরূপ স্মরণ ও নীলিমার মধ্যে যা চলছে তার প্রত্যক্ষদর্শী হচ্ছে কাজিনমহলের সকলে। যার মধ্যে নওরীন, রাফা ও মাহবুব মিটিমিটি হাসছে। আর বাকিজনেরা হা হয়ে এমন পরিস্থিতি দেখছে। এ যেনো এক নায়ক নায়িকা পূর্ণ সুইট রোমান্টিক একটা মুভির সিন। ওদিকে রাফি অনবরত প্রকৃতির ছবি তোলার সাথে ফাঁকফোকর দিয়ে স্মরণ ও নীলিমার ছবিও তুলে নিচ্ছে। এটা অবশ্য রাফা তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে করতে বলেছে।
এক মিনিটের প্রচেষ্টায় স্মরণ অক্ষত অবস্থায় নীলিমার ওড়না উদ্ধার করতে সক্ষম হলো। এ দেখে নীলিমা হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো। স্বস্তি মিললো তার অন্তর জুড়ে।
স্মরণ ওড়নাটা ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে নীলিমার হাতে ওড়নাটা ধরিয়ে দিলো। কাজিনমহলের সকলে এই সিনেম্যাটিক মুহূর্তটুকুর সাক্ষী হওয়ার সাথে সাথে রাফির ক্যামেরাও দারুণ এ মুহূর্তটাকে ক্যামেরাবন্দী করে নিলো। ক্যামেরায় ধরা পড়লো স্মরণ ও নীলিমার নিঃশব্দ দৃষ্টি আলাপন ও ওড়নার কোনা ধরার মুহূর্তটুকু।
.
.
.
চলবে................................