প্রেমান্বেষা - পর্ব ১৬ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


স্মরণ ও নীলিমার মাঝে ঘটে যাওয়া মুহূর্তটুকু বেশ মজা নিয়ে উপভোগ করলো মাহবুব, নওরীন ও রাফা। রাফা বেশ মজায় মজায় আছে। এ নিয়ে আজ নীলিমাকে আচ্ছামতো খোঁচানো যাবে ভেবে। 

এদিকে স্মরণের কাছ থেকে ওড়না হাতে নিয়েই হুড়মুড় করে নৌকার কাছে চলে এলো নীলিমা। তার ঠিক পিছু পিছু স্মরণ এলো। ঘাঁট থেকে পা বাড়িয়ে রাফার সাহায্য নিয়ে নৌকায় উঠলো। পিছে স্মরণও উঠলো। সে বসে পড়ার সাথে সাথেই মাঝির উদ্দেশ্যে বললো,
" মাঝি ভাই, বৈঠা চালাও। ওপারের ঘাটে নিয়ে যেও। "
স্মরণের নির্দেশে মাঝি বৈঠা চালানো আরম্ভ করলো। 

শেষ দুপুরের মোলায়েম রোদ এসে সকলের চোখেমুখে আছড়ে পড়ছে। রোদের তেজ অবশ্য অন্যান্য দিনের চেয়ে খানিক কম। নৌকা এগিয়ে চলছে মাঝির বৈঠার ইশারায়। মৃদু ঢেউয়ের কলকল ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে নৌকার অভ্যন্তরীণ নিশ্চুপ পরিবেশটি। সকলেই নীরবে উপভোগ করছে গ্রামবাংলার এই অপার সৌন্দর্য। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক পাখি। শেষ বিকেলের মোলায়েম রোদ নদীর বুকে যেনো হীরের খন্ড ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই চিকচিক পানির প্রতিফলন এসে ছিটকে পড়ছে নীলিমার চোখেমুখে। শুভ্র রঙের থ্রিপিছ, মেটে রঙের হিজাব, সব মিলিয়ে এই পানির প্রতিফলনে নীলিমার সৌন্দর্য যেনো উপচে পড়ছে। স্মরণ ও নীলিমা বসেছে মুখোমুখি। স্মরণ যেখানে বসেছে সেখান থেকে নীলিমাকে স্পষ্ট দেখা যায়। স্মরণ চেয়েও নীলিমার ওপর হতে দৃষ্টি হটাতে পারছে না। তার নিষ্পলক দৃষ্টি বিচরণ করছে নীলিমার উপর। আজ নীলিমাকে কেনো যেনো একটু আলাদা দেখাচ্ছে, একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে। নীলিমার একটুখানি সৌন্দর্য স্মরণকে একটু একটু করে ভালোলাগার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অবাধ্য মন ও দৃষ্টিখানা একটা মেয়ের উপর স্থির হতে শুরু করেছে। 

নৌকা মাঝ নদীতে আসার পর স্মরণ আচানক খালি গলায় গান জুড়ে দিলো,
" ওরে নীল দরিয়া
আমায় দেরে দে ছাড়িয়া
বন্ধি হইয়া মনোয়া পাখি,হায়রে
কান্দে রইয়া রইয়া।
ওরে নীল দরিয়া
আমায় দেরে দে ছাড়িয়া
বন্ধি হইয়া মনোয়া পাখি,হায়রে
কান্দে রইয়া রইয়া।"
এ গানে সুর মিলালো সাজিদ ও মাহবুব। গান শেষে সাজিদ হঠাৎ করেই স্মরণকে জিজ্ঞেস করে বসলো,
" স্মরণ? বিয়ে-শাদির প্ল্যান কি?"

হঠাৎ এমন প্রশ্নে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেলো স্মরণ। যেহেতু নীলিমা ঠিক তার সামনে বসা, তাই সর্বপ্রথম তার দৃষ্টি চলে গেলো নীলিমার উপর। রোদের জন্য নীলিমা চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তবে তার চাহনি দেখেই স্মরণ বুঝে ফেললো, এ যেনো কিছুটা নীলিমার মনেরই প্রশ্ন। বাস্তবেই নীলিমা এ প্রশ্নের জবাব জানতে চাইছে। তবে কেনো জানতে চাইছে এ নিয়ে সে অনবগত। স্মরণের ব্যাপার নিয়ে সে মাথা ঘামাতে ইচ্ছুক না। তবুও কেনো যেনো স্মরণের এ ব্যাপারটা তার জানতে ইচ্ছে করছে। 

স্মরণ মৃদু শ্বাস ফেলে হাসলো। এবার সাজিদের দিকে চেয়ে বললো,
" আপাতত বিয়ের প্ল্যান নেই। আরোও দু এক বছর যাক। প্রোমোশন পাই তারপর বিয়ের চিন্তা। "

এ শুনে সাজিদ নীলিমার দিকে আড়চোখে চাইলো। যেনো সে অজানা হয়েও জানে সব। নীলিমা ও স্মরণের ব্যাপারটা সম্পর্কে সে অনবগত হলেও তাদের দুজনের হাবভাব দেখে সে কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছে। এবার আজ নওরীনের কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়ার পালা। 

সাজিদ ফের প্রশ্ন করলো,
" মেয়ে রেডি নাকি? প্রেমটেম আছে কিছু?"

নীলিমার বুকটা অকস্মাৎ ধ্বক করে উঠলো। স্মরণের কোনো পছন্দের মেয়ে আছে, এ চিন্তা হঠাৎ মস্তিষ্কে উদয় হলেও অদ্ভুত এক সংকোচ বুকটা চেপে আসে। নীলিমার অজান্তে সেই পুরোনো অনুভূতির পাতাগুলো ধুলো ঝেড়ে আবারও যে কবে থেকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে কে জানে। স্মরণ প্রেম সম্পর্কে শোনা মাত্রই বলে উঠে,
" না না সাজিদ ভাই, এমন কিছু নেই। আমি এসব প্রেম ভালোবাসায় কোনোদিন জড়াইনি। ক্লাস টেনে থাকতে একটা মেয়েকে একটু পছন্দ করতাম। কিন্তু কলেজে আসার পর সে পছন্দও শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে এসবে জড়াইনি। আসলে সময় হয়নি। পড়ালেখা চাকরি নিয়ে যে কত ব্যস্ত থাকি তা তো জানেননই। এজন্য মেয়েঘটিত ব্যাপার-স্যাপারে আমার হাত কম। "

স্মরণের কথা শোনার পর নীলিমার অন্তঃস্থলে এক মৃদু প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো। তার মনে পড়লো চিঠির ঐ কথাগুলো, যেখানে স্মরণ এ ব্যাপারে খানিকটা বলেছিলো। তবে তখন সত্য মনে হয়নি। আজ সরাসরি তার জবান হতে এ কথা শুনে কেনো যেনো সত্য মনে হচ্ছে। 

নীলিমা এক অদ্ভুত দোদুল্যমান পরিস্থিতি পড়েছে ক'দিন যাবত। পুনরায় স্মরণ তার মন-মস্তিষ্কে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এ সম্পর্কে কখনও সে অবগত, কখনও বা সে অনবগত। আবার কখনও সে সবটা জেনেও নিজেকে দূরে নেয়ার চেষ্টা করে। কখনও স্মরণে সে মুগ্ধ হয়, কখনও বা স্মরণকে সে দু চোখে দেখতে পারে না।

নৌকা ওপর পাড়ে পৌঁছালে সবাই নৌকা থেকে নেমে গেলো। ওপাড়ের ঘাঁটে গিয়ে সবাই মিলে বিকেলের নাস্তা সারলো। সিঙ্গারা, আলুর চপ ও গরম গরম চা দিয়ে বিকেলের নাস্তা করলো সবাই। এরপর কিছুক্ষণ এদিকটায় সময় কাটিয়ে সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ আগে নৌকায় চড়ে বসলো। এবার বাড়ি ফেরার পালা। ফিরতি পথে তারা সেই চিপস ও সফট ড্রিংকস খেলো, গান গাইলো, গল্প করলো। এভাবেই কাজিনমহলের ঈদের বিকেলটুকু কেটে গেলো।
বাড়ি ফিরে ঈদের জামা বদলাতে বদলাতে হঠাৎ কারেন্ট বাবাজি গায়েব হয়ে গেলো। ঈদের দিনও কারেন্ট যেতে দেখে বাড়ির প্রায় সবার মন মেজাজই বিগড়ে গেলো। প্রত্যেকে রুমেই একজন দায়িত্ব নিয়ে মোমবাতি বা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে গেলো। সর্বশেষ আলো জ্বালাতে এলো নীলিমা। রান্নাঘরে ঢুকে হাতড়ে হাতড়েও মোম বা হ্যারিকেন কিছুই খুঁজে পেলো না। ওদিকে ফোনে নেই চার্জ যে মোবাইলের টর্চ জ্বালাবে। তাই সে শেষমেশ রাফাকে ডাকতে উদ্যত হলো। কিন্তু তার ডাকার পূর্বেই রান্নাঘরে কাউকে টর্চ নিয়ে ঢুকতে দেখলো। ভাবলো রাফা এসেছে বোধহয়। নীলিমা না জেনেই বললো,
" এতক্ষণ লাগে টর্চ নিয়ে আসতে? তুই জানিস না আমি রান্নাঘরে?"

" জানি বলেই হয়তো আসলাম। "

হঠাৎ স্মরণের কণ্ঠস্বরে খানিক চমকে উঠলো নীলিমা। কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে বললো,
" স্মরণ ভাই আপনি! "

স্মরণ ততক্ষণে নীলিমার ঠিক সামনে চলে এসেছে। টর্চের তীব্র আলোর ঝলকানি পড়ছে নীলিমার চোখেমুখে। তাই হাত দিয়ে সে আলো ঠেকানোর চেষ্টা করছে। এ বুঝতেই স্মরণ দ্রুত টর্চের আলো অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,
" সরি সরি। আসলে মোম নিতে এসেছিলাম। ভেবেছি কেউ হয়তো দিয়ে যাবে।"

নীলিমা মৃদু হাসলো। বললো,
" আপনি বোধহয় খুব অলস। বাসায় কি করে খান তবে? নাকি সাদই সব করে?"
 এই বলে সে ঘুরে রান্নাঘরের তাকের উপর হাতড়াতে লাগলো। স্মরণও বাচ্চাদের মতো তার পিছু পিছু এসে নিজের উপর দেয়া আরোপটা ঝাড়তে উদ্যত হলো। বললো,
" মোটেও না। সাদ কোনো কাজই করে না। খালা এসে রান্না করে দিয়ে যায়। আর ঘর মুছা, কাপড় কেচে দিয়ে যায়। বাকি টুকটাক কাজ আমিই করি।"
বলেই সে নীলিমার দৃষ্টি অনুসরণ করে জিজ্ঞেস করলো,
" কি খুঁজছো?"

 নীলিমা তাকের উপর তখনও হাতড়াচ্ছে। এমতাবস্থায় বললো,
" মোম খুঁজছি। কোথায় যে গেলো। "

" আমি খুঁজে দিচ্ছি। একটু সরে দাঁড়াও দেখি।"
বলেই স্মরণ সামনের দিকে এগুলো। আর নীলিমা পাশে সরে দাঁড়ালো। উচ্চতা বেশি হওয়ায় টর্চের আলোয় তাক থেকে মোমবাতি খুঁজে বের করতে সক্ষম হলো সে। এই আলোয় নীলিমা নিচের কোনা থেকে হ্যারিকেনও বের করে নিলো। 

মোমবাতি ও হ্যারিকেন নিয়ে নীলিমা চুলোর সামনে দাঁড়ালো। এবার ম্যাচ খোঁজার পালা। ম্যাচ খুঁজতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি। টর্চের আলোতেই ম্যাচ পেয়ে গিয়েছে। নীলিমা ম্যাচে আগুন জ্বালাতে উদ্যত হলো। ঠিক এমন সময়েই স্মরণের ফোন গেলো বন্ধ হয়ে। চারপাশ মুহূর্তেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। স্মরণ অনুমানে বললো,
" আজ সারাদিন ফোনে চার্জ দিতে পারিনি। একদমই চার্জ ছিলো না ফোনে। এসে যা-ও একটু চার্জে দিয়েছিলাম,টর্চ জ্বালিয়ে সেটাও চলে গেলো। "

" আমার ফোনেও চার্জ নেই। সারাদিন ছবি তুলেই চার্জ শেষ।"
বলতে বলতে ম্যাচ আগুন জ্বেলে উঠলো। সেই আবছা হলদে আলোয় স্মরণ দ্রুত মোমবাতিটা নিয়ে নীলিমার দিকে এগিয়ে দিলো। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে হাওয়ার তোড় এসে আগুন নেভানোর পূর্বেই নীলিমা দ্রুত মোম জ্বালিয়ে দিলো। মুহূর্তেই সমস্ত রান্নাঘর মৃদু হলদে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। চারপাশ পূর্বের তুলনায় স্বচ্ছ হলো। তবে মোমবাতি জ্বলে উঠতে না উঠতেই আরেক হাওয়ার তোড় এসে আগুন নেভাতে উদ্যত হলো। এ দেখে ক্ষণেই নীলিমার সচেতন মস্তিষ্ক পুড়ে যাওয়া ম্যাচের কাঠি ফেলে দু হাতে সেই আলোকছটার ছুটে যাওয়া রুখতে বাঁধা দিলো। 

ওদিকে স্মরণ এক ধ্যানে মোমবাতি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সচক্ষে সাক্ষী হচ্ছে কিছু অপরূপ স্বর্গীয় মুহূর্তের। তার অপলক দৃষ্টি আবদ্ধ নীলিমার অতুলনীয় রূপে। হলদে-সোনালি আলো ছায়া নীলিমার অপর রূপের সাক্ষী হলো স্মরণ। শুনেছে, মোমের আলোয় মেয়েদের সৌন্দর্যের এক অপর রূপের সাক্ষী হওয়া যায়। স্মরণ আজ বোধহয় সেই অপর রূপের সাক্ষী হলো। এই রূপে মেয়েদেরকে সত্যিই মায়াবী দেখায়। নীলিমাকে দেখে সে সত্যটা মানতে বাধ্য হলো স্মরণ। তার নিষ্পলক রূদ্ধশ্বাস মুহূর্তটুকু নীলিমাকে দেখে কেটে গেলো। চারপাশে কি ঘটছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই তার। এখন সে চকোর রূপে চাঁদের আলো পান করার বদলে এক মায়াবিনীর মায়া ডুবে যাচ্ছে। 
আচ্ছা প্রেম কি হঠাৎ করেই দরজায় কড়া নাড়ে? হঠাৎ করেই কাউকে ভীষণ ভালো লেগে যায়? এমন হঠাৎ করে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তটুকু ঘটলে স্মরণ বোধহয় হঠাৎ করেই প্রেমে পড়লো। না জানিয়ে, না বুঝিয়ে হঠাৎ করেই তার জীবদ্দশার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতিটুকু তার হৃদয়ে স্থান করে নিলো। কি অদ্ভুত! 'হঠাৎ' শব্দটাই স্মরণকে আপাদমস্তক এলেমেলো করে দিয়ে গেলো। হঠাৎ করেই স্মরণ ধুম করে প্রেমে পিছলে পড়লো!
.
.
.
চলবে......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন