মেঘে ঢাকা চাঁদ, আলো আঁধারে ঢেকে, মন ভরে যায় তার রূপ দেখে। মাঝে মাঝে রোদেলা একা একা বসে আকাশের চাঁদ দেখে। রুমের সঙ্গে একটি বড় টেরেস এখান থেকে অনেকটা জায়গা স্পষ্ট দেখা যায়। রোদেলার মাঝে মাঝে খুব একা লাগে, মনে হয় এই প্রাসাদে সে একা। নিঃসঙ্গতা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। তখন তার দম বন্ধ হয়ে আসে যেনো। চারিদিক নিস্তব্ধ, ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যায় প্রতি মুহূর্তে হ্রদের স্বচ্ছ জল ধারে এসে ঘর্ষণ করে আবার ফিরে যায়।হ্রদের স্বচ্ছ জলে চাঁদের উজ্জ্বল আলো পরে চিকচিক করছে। রোদেলা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। প্রায়ই তার মামা, মামী, ছোট ভাই, বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ে। আর জোজো? কি করছে সে আজকাল?
এক সপ্তাহ ধরে কাউকে দেখে না। ফোনে ভিডিও কলে দেখে কী আর মন ভরে? তূর্ণর সলো অ্যালবাম এই সপ্তাহে প্রকাশিত হবে, যে কারণে সেহরিশ তার বেশিরভাগ সময় তূর্ণর সাথে কাটায়। রোদেলার মনের কোণে আরেকটি ঘটনা এসে উঁকি দিল। রোদেলার প্রায় মনে হয় সেহরিশ তাকে লুকিয়ে দেখে আর যখন সে তাকায় তখন সেহরিশ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। রোদেলা একটানা কয়েকটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। হতে পারে এটা তার মনের ভুল।
রাতের ঘড়ির কাঁটায় একটা বাজছে। সেহরিশ দরজা খুলে ঘরে ঢুকল। বারান্দায় এসে থামল সে। তারপর শান্ত গলায় বলল,
'রোদ।'
রোদেলা হঠাৎ সেহরিশের কণ্ঠ শুনে উঠে দাঁড়ালো। সেহরিশকে দেখে তার মনের সংশয়গুলো ছুটাছুটি করে আড়াল হতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল যেন। রোদেলা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল,
'আপনি কখন আসছেন?'
সেহরিশ তার স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিল,
'সবে মাত্র।'
রোদেলা জিজ্ঞেস করলো,
'আজ এত দেরি কেন?'
সেহরিশ রোদেলার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
'তুমি কি অপেক্ষা করছিলে?'
রোদেলা মাথা নাড়ল,
'জি।'
সেহরিশ একটু থেমে গম্ভীর গলায় বলল,
'একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নাও, বাইরে খুব ঠান্ডা।'
রোদেলা বলল,
'ঘরে চাদর? এখানে তো ঠান্ডা নেই।'
সেহরিশ বলল,
'আমরা বাইরে যাব।'
'এই সময় বাইরে?'
সেহরিশ প্রশস্ত গলায় বলল,
'হ্যাঁ, এই জায়গাটা খুব সুন্দর কিন্তু তুমি আসার পর থেকে সারাক্ষণ প্যালেসের ভেতরেই আছো। আমি প্রতিদিন সকালে রোমে যাই আর রাতে ফিরে আসি, আমার কাছে তোমাকে নিয়ে বাহিরে যাওয়ার সময় হয় না। তাই এখন আমি তোমাকে নিয়ে বের হবো।'
কথাটি বলে সেহরিশ কিছুক্ষণ থামল, একটা চাদর এনে রোদেলার চারপাশে জড়িয়ে দিয়ে আবার বলল,
'আমরা নৌকায় করে লেকের মাঝখানে যাব। সেখান থেকে চাঁদকে আরও সুন্দর দেখায়। তারপর একটা দ্বীপে যাবো। সেই দ্বীপে যাওয়ার জন্য সহজ জলপথ। এত গভীর রাতে পাহাড়ি রাস্তায় তোমাকে নিয়ে যাওয়াটা একটা ঝুঁকি হবে।'
রোদেলা নিচু গলায় বলল,
'আমার জন্য আপনাকে এত কিছু করতে হবে না। আপনি যা করেছেন তাই অনেক বেশি।'
সেহরিশ এক সেকেন্ড রোদেলার মুখের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল,
'আমি তোমার জন্য কিছুই করিনি রোদ, আমাকে কিছু করার সুযোগ দাও।'
রোদেলা মাথা নিচু করলো। জড়তা-সংকোচ ভেঙে হঠাৎ রোদেলার হাত স্পর্শ করলো সেহরিশ। সাথে সাথে কেঁপে উঠলো রোদেলা। সেহরিশ তার হাত ধরে দরজার দিকে হেঁটে এগিয়ে গেল। হাঁটার সময় প্রায় সেহরিশের মুখের দিকে তাকাল রোদেলা। লোকটাকে বাইরে থেকে যত শক্ত ও কঠোর মনে হয় ভিতর থেকে সে অনেক নরম।
সিঁড়ির পার ঘেঁষে একটা নৌকা দাঁড়িয়ে আছে। নৌকায় মাঝবয়সী এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশ রোদেলার হাত ধরে নৌকায় উঠতে সাহায্য করলো তারপর দুজনে মুখোমুখি বসল। রোদেলা চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল, তাদের নৌকা ছাড়াও লেকের পানিতে অনেকগুলো নৌকা ভাসছে। এরপর চাঁদের সৌন্দর্য এক ঝলক দেখে রোদেলা খুশিতে হেসে উঠল। একটু পর প্রবল বাতাসে কাঁপতে লাগল। চাদর পরেও রোদেলা বারবার কেঁপে ওঠছে। সামান্য ব্যাপারটা সেহরিশের চোখ এড়ায়নি সেহরিশ তার জ্যাকেটটা খুলে ফেলল তারপর হঠাৎ রোদেলার গায়ে জড়িয়ে দিল। রোদেলার মুখ, নাক, কান জড়তা আর লজ্জায় মূহুর্তে লাল হয়ে গেছে।
রোদেলা ঠান্ডা সইতে পারবে না ভেবে সেহরিশ নৌকা ঘুরিয়ে প্রাসাদে ফিরে গেল। সে রোদেলাকে নিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে যায়। রোদেলার অপরাধী বোধ বেড়ে যাচ্ছে, লোকটা অসম্ভব ভালো কিন্তু সে তার সাথে অন্যায় করছে সব দিক থেকে, বিবাহের বিশ দিন হতে চলল অথচ সেহরিশ ভুলবশত রোদেলার উপর তার স্বামীর অধিকার জাহির করার চেষ্টাও করেনি। উল্টো সবসময় তার পছন্দ-অপছন্দের দিকে কড়া নজর রাখে। রোদেলা গোপনে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল।
সেহরিশ দীর্ঘক্ষণ গোসল করে বেরিয়ে এলো। তার মাথা হঠাৎ ব্যাথা করছে। মাথায় পানি ঢালার পরও ব্যাথা বিন্দুমাত্র কমেনি। সেহরিশ মাথায় হাত রেখে সোফায় বসল। সেহরিশের ফ্লার্টেশন দেখে রোদেলা আর বিছানায় বসে থাকতে পারল না। সেহরিশের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
'কি হয়েছে এমন করছেন কেন?'
সেহরিশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
'মাথাটা একটু ব্যাথা করছে। তুমি টেনশন করো না ঠিক হয়ে যাবে। গিয়ে শুয়ে পড়ো।'
রোদেলা তার জায়গা থেকে নড়ল না। সেহরিশের পাশে বসল তারপর স্পষ্ট গলায় বলল,
'আমার কোলে মাথা রাখুন আমি টিপে দিচ্ছি।'
সেহরিশ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
'শিওর?'
রোদেলা নরম গলায় বলল।,
'হুম।'
সেহরিশ কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। রোদেলার নরম হাতের স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে তার। সেহরিশ জোর করে চোখ খুলে রেখেছে। রোদেলা ক্ষীণ গলায় বলল,
'আপনার এখানে ঘুমানোর দরকার নেই। আপনি বিছানায় শুতে পারেন।'
সেহরিশ বলল,
'তোমার সাথে? তোমার সমস্যা হবে না?'
রোদেলা নরম গলায় বলল,
'আমি আপনার স্ত্রী, আমার ওপর আপনার পূর্ণ অধিকার আছে। আমার কেন সমস্যা হবে?'
এটুকু কথা বলে রোদেলা থামল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল,
'আমি চাই আপনি আমাকে আপনার স্ত্রী হওয়ার অধিকার দিন। আমি আমৃত্যু আপনার সেবা করতে চাই। আপনি আমাকে আপনার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করুন।'
সেহরিশ উঠে বসল। রোদেলার অগোচরে সেহরিশ মনে মনে হাসল। তারপর রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলল,
'স্বামীর অধিকার চাও?'
রোদেলা মাথা নিচু করে ফেলল। একই ভাবে মাথা উপর নিচ ঝাঁকালো, ইশারায় বোঝালো সে অধিকার চায়। সেহরিশ গম্ভীর গলায় বলল,
'স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর, এতে রাগ-বিবাদ, ঝগড়া, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসার সমান ভাগ থাকে। সম্পর্ক কখনোই শুধু ভালোবাসায় টিকে থাকে না। ভালোবাসায় এই সব কিছু সামান্য হলেও থাকবে। একজন ব্যক্তি কখনই সম্পূর্ণরূপে অন্য ব্যক্তির মন মতো হতে পারে না। আমি কখনই চাইব না তুমি আমার মন মতো হও, তুমি যেমন সবসময় এমনই থাকবে। এটাই আমার একমাত্র ইচ্ছা। নিছক সৌন্দর্য দিয়ে পুরুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। যদি একজন নারীর মাঝে যত্ন, খুনসুটি এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিং এই তিনটি গুণ থাকে তবে সেই পুরুষটি ভাগ্যবান যে তার স্বামী। কারণ সে এমন একজন নারীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। এই তিনটি জিনিস প্রেম ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখে বছরের পর বছর এমনকি বার্ধক্য বা মৃত্যুর পরেও। রোদ, তুমি আমার স্ত্রী, এটা যতটা সত্য ততটাই সত্য আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি। এই গৌরবের জায়গা থেকে আমি সেই ঘন অন্ধকার রাতে কবুল বলার সাথে সাথেই তোমাকে আমার উপর সমস্ত অধিকার দিয়েছি। আমি তোমার রোদ! আমার উপর শুধু তোমার অধিকার।
আমি চেয়েছিলাম তুমি আমাকে তোমার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করো, আজ সেই দিন। সম্পূর্ণরূপে আমার হওয়ার জন্য, আমি সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী তোমার কাছে কৃতজ্ঞ রোদ।'
.
.
.
চলবে..................................