মা একদমই রাগ করলেন না। ঠাণ্ডা মাথায় এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় দরজাটাও টেনে দিয়ে গেলেন। রৈনীল এখনো কল কাটেনি। আমি জানিনা মা ওকে ঠিক কী বলবেন! আর রৈনীলের কাছেও আমি কতটা ছোট হয়ে যাবো ভাবতে পারছি না।
সারা রাত প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে এপাশ ওপাশ করে কাটালাম। বহুদিন পর একটা রাত এসেছে, যে রাতে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেললাম আমি। শেষবার কবে কেঁদেছি মনে নেই। রৈনীলের সঙ্গে যেদিন প্রথম দেখা হলো, এরপর থেকে আমার জীবনটা স্বপ্নের মতো কেটে যাচ্ছিলো। মা যদি একবার টের পেয়ে যান আমি রৈনীলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছি, তাহলে আমার কপালে বেশ দুঃখ আছে তা স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি।
পরদিন মা খুব গম্ভীর মুখ করে রাখলেন। আমি সকাল সকাল ভার্সিটিতে চলে এলাম। ফারাহ আমাকে খুঁজে বের করে জিজ্ঞেস করলো, 'মেসেজ রিপ্লাই কেন করছো না?'
'মা আমার ফোন নিয়ে রেখেছে।'
'ওহ শিট। তাহলে তো মহা বিপদে পড়েছো।'
'কিঞ্চিৎ।'
'ভদ্রলোকের নাম্বার জানা আছে? কিভাবে নাদির আহমেদের সঙ্গে দেখা করবো আমি বুঝতে পারছি না।'
আমি ব্যাগ থেকে খাতা বের করে রৈনীলের লিখে দেয়া নাম্বারটা খুঁজে বের করে ফারাহ'র সামনে ধরলাম। ফারাহ নাম্বারটা ফোনের ডায়াল লিস্টে রাখলো। আমার চোখে পানি চলে এসেছে। হঠাৎ ফারাহ'র হাত থেকে ওর ফোনটা নিয়ে আমি ডায়ালে গিয়ে রৈনীলকে কল দিলাম।
একবার রিং হতেই সে রিসিভ করে বললো, হ্যালো..
আমি চুপ করে আছি। আমার গলা ভিজে আসছে। কোনোমত নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করছি। সেইমুহুর্তে রৈনীল বললো, সরণী?
'হুম।'
'তুমি ঠিক আছো?'
আমার চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ফারাহ মুছে দিলো সেই অশ্রু। আমাকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে ফারাহ সরে গেলো আমার কাছ থেকে।
রৈনীল বললো, 'রাতে আন্টি তোমার মোবাইলটা নিয়ে গেছে, রাইট?'
'হুম।'
'ইশ, মন খারাপ কোরো না। আবার দিয়ে দেবে।'
'আমার মাকে আমি চিনি। আমাকে আর ফোন দেবে না।'
'কষ্ট পেও না। এতদিন তো তোমার কোনো ফোন ছিলোই না। এই কয়েকদিনে কি তুমি এডিক্টেড হয়ে গেছো?'
'না।'
'তাহলে তো সমস্যাই নেই। ফোন ছাড়া এভাবেই ভালো থাকবে। কয়েকদিন গেলে দেখবে ঠিকই দিয়ে দেবে।'
'দেবে না।'
'তাহলে ফোন ছাড়া থাকার অভ্যাস করো।'
'কিন্তু আপনার সঙ্গে কথা বলবো কিভাবে?'
কথাটা বলেই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। রৈনীল কি ওর প্রতি আমার অনুভূতিটা বুঝে ফেলবে! কিন্তু এই মুহুর্তে আমি অজান্তেই এটা বলে ফেলেছি। নিশ্চয়ই আমার আরও সচেতনভাবে কথা বলা দরকার ছিলো। ওপাশ থেকে রৈনীলের কোনো আওয়াজ না পেয়ে আমার বুকে ধকধকানি শুরু হয়ে গেছে।
আমি বললাম, 'বলতে চাচ্ছিলাম, আপনার সঙ্গে মাঝেমাঝে কথা বলা যেতো। ফোন না থাকলে তো সম্ভব না।'
'এটা কার ফোন?'
'ফারাহ'র। যে আজকে নাদির আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। ও ফোন দেবে আপনাকে।'
'ওকে। তুমি ওর ফোন থেকেই মাঝেমাঝে কল দিও যদি প্রয়োজন হয়।'
'প্রয়োজন! আমি কি শুধু প্রয়োজনেই কল দেই আপনাকে?'
রৈনীল কিছু বললো না। চুপ করে আছি আমি। আমার কান্না আরও বেড়ে গেছে। তবে গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
রৈনীল বললো, 'কয়েকদিন পরেই দেখবে তোমাকে ফোন ফেরত দিয়ে দেবে। তুমি শুধু বাসায় বোঝানোর চেষ্টা কোরো যে ফোন ছাড়া বাইরে বের হলে বাসার লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। আর যদি পারো সরাসরি মাকে সরি বলে দাও। আর বলো তুমি আর কক্ষনো এমন করবে না। লক্ষী মেয়ে হয়ে থাকবে।'
'আমি তো সবসময়ই লক্ষী মেয়ে। ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া একটা মেয়ের পারসোনাল ফোন থাকা কি এতটাই অযৌক্তিক?'
'রাত বিরেতে ফোনে কথা বলার জন্য কিন্তু তোমাকে ফোন কিনে দেয়নি।'
'আমার বয়সী একটা মেয়ে কি কারো সঙ্গে কথা বলতে পারবে না? আমার বন্ধু থাকতে পারেনা?'
'রাতে কেউ বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে না সরণী।'
'ঠিক আছে। তাহলে ধরে নিলাম আমি বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছি। কিন্তু আমার বয়সী একটা মেয়ের কি বয়ফ্রেন্ড থাকা অন্যায়?'
রৈনীল ফিক করে হেসে বলল, 'অন্যায় না। কিন্তু আমি তো তোমার বয়ফ্রেন্ডও নই। এখানেই সমস্যা। যাইহোক, মন খারাপ কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।'
'আপনি আমার ভেতরটা অনুভব করতে পারছেন না। আই এম সরি ফর ডিস্টার্বিং ইউ। ভালো থাকবেন।'
আমি রাগ করে কল কেটে দিলাম। দুহাতে চোখ মুছে স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। ফারাহ এসে আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো, এই মেয়ে। এভাবে কান্না কোরো না তো।
'আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।'
'আই নো। তুমি আমার ফোনটা নিয়ে যাও। বাসায় আমার এক্সট্রা ফোন আছে।'
'আমি ফোনের জন্য কাঁদছি না।'
'তাহলে!'
'রৈনীল কেন আমাকে বুঝতে পারছে না? সে আমাকে আমার মতো করে ফিল করেনা ফারাহ। ফোন দিয়ে আমি কি করবো? ওকে আর কল দেবোনা আমি। আমার ফোন নিয়ে নিয়েছে ভালোই হয়েছে। ওকে আর বিরক্ত করতে পারবো না।'
ফারাহ শুকনো হাসি দিয়ে বললো, 'তুমি এখনো বাচ্চাদের মতো। কি আদুরে...'
ফারাহ আমার গাল টেনে দিলো। আমি আবারও চোখ মুছলাম। আমার কষ্টটা কি ফারাহও অনুভব করছে না!
ফারাহ আমার চোখ দেখে বললো, জীবনে প্রথম এরকম কোনো অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় তাই বেশী ইমোশনাল হয়ে পড়েছো। চলো তোমাকে মন ভালো করা একটা আইসক্রিম খাওয়াই।
আইসক্রিম খেয়ে আমার মন ভালো হলোনা বটে, তবে ফারাহ'র অক্লান্ত চেষ্টায় বেশীক্ষণ মন খারাপ স্থায়ী হলোনা। আমি ওকে অনেক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলাম। এই জগতে ফারাহ একমাত্র বন্ধু আমার, আমার মন খুলে কথা বলার মানুষ, আমার সুখ দুঃখের সাথী। আমাকে বোঝার মতো সেই-ই একমাত্র ব্যক্তি।
সন্ধ্যায় মায়ের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছিলাম। মা বললেন, এজন্যই তোমাকে ফোন কিনে দিতে চাইনাই।
আমি গম্ভীর হয়ে মাথা নিচু করে রাখলাম। মা কথা চালিয়ে গেলেন, ওই ছেলে কে?
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম কিন্তু উত্তর দিলাম না। মা বললেন, ওকে আমি কল দিতে নিষেধ করেছি। আর যোগাযোগ করতেও মানা করেছি। তুমি ভার্সিটিতে গিয়ে কোনোভাবে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করবে না।
আমি আশ্চর্য হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে বিষণ্ণতা ঘিরে ধরলো আমায়। কই, রৈনীল তো তখন একবারও বললো না যে আমার মা ওকে কল দিতে নিষেধ করেছে! এ কারণেই কি সে আমার অনুভূতিকে উড়িয়ে দিচ্ছিলো?
আমি রুমে এসে বসলাম। তবে শান্ত থাকতে পারলাম না। শৈশব থেকেই এ ধরনের রেস্ট্রিকশন মেনেই বড় হয়েছি। এটা করতে পারবে না, ওটা করবে না, এদিকে তাকাবে না, ওটা খেও না, ওখানে যাবেনা..
কিন্তু আজই প্রথম আমার সীমাহীন কষ্ট হচ্ছে। আগে কখনো এতটা গভীর কষ্ট অনুভব করিনি। যতটা না ফোনের জন্য, তারচেয়ে হাজারগুণ বেশী রৈনীলের জন্য। আমি জানিনা ওর সঙ্গে আমার আদৌ কখনো আর যোগাযোগ হবে কিনা!
সারাটা রাত ছটফট করে কাটলো আমার। এত বেশী ব্যথায় কুঁকড়ে রইলাম যে, শেষ রাতে মাথার ভেতর তুমুল যন্ত্রণা হতে লাগলো। এলার্জির ওষুধ খেলে আমার ঘুম বেড়ে যায়। বেশ কয়েকটা এলার্জির ট্যাবলেট খেয়ে আমি শুয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাংলো পরদিন সন্ধ্যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া। আজ কপালে ভয়ংকর শনি আছে। এইসব পাগলামির জন্য মায়ের কাছে ছোট হতে হবে। না জানি কত কথা শুনতে হবে আমার!
কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটলো না। মা আমার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করলেন। রাতে খাবার টেবিলে বাবা বললেন, সরণীর ফোনটা দিয়ে দাও। কিন্তু মা সরণী, তুমি নাকি কার সাথে ফোনালাপ করো? এই বয়সে এসবে জড়াবে না। আশাকরি এ ধরনের আর কিছু শুনবো না।
খাওয়া শেষ করার পর মা নিঃশব্দে আমাকে ফোন ফেরত দিয়ে গেলেন। আমি ফোনটা ছুঁয়েও দেখলাম না। রাত বাড়লে ফোনটা নিয়ে একবার মেসেজ বক্স চেক করলাম। আবার রেখে দিলাম ওভাবেই। আমাকে সরাসরি ফোন ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে তবে কোনো ছেলের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। আশ্চর্য!
ঠিক কতদিন ফোনটা টেবিলের ওপর একই জায়গায় ওভাবেই পড়ে রইলো। একদিন দেখি ফোনের গ্লাসের ওপর ধুলা জমে গেছে। আমার হাসি পেলো বিষয়টা দেখে। মা সারাদিনে অনেকবার রুমে আসেন, উনিও নিশ্চয়ই দেখেছেন আমি ফোনটা ছুঁয়েও দেখছি না। ব্যাপারটা মজার মনে হচ্ছে আমার কাছে।
তবে বেশীদিন এভাবে থাকা গেলো না। একদিন বাবা বললেন, ক্লাস শেষ করে আমাকে কল দিও। সেদিন ফোনটা চার্জ দিয়ে সঙ্গে করে ভার্সিটিতে নিয়ে আসতে হলো। তবে ব্যাগের ভেতরই পড়ে রইলো সারাক্ষণ। ওই যন্ত্রটা আমার ছুঁয়েও দেখতে সাধ জাগলো না। কেবল বাবাকে একবার কল দেয়ার কাজে ব্যবহার করলাম।
মাঝখানে অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। নিজের পাগলামি গুলোকে আমি নিয়ন্ত্রণে এনেছি। মাঝেমাঝে ঘুম না এলে মনেমনে রৈনীলের সঙ্গে গল্প করি। এছাড়া খুব একটা ওকে নিয়ে ভাবতে চাই না। ওর ভাবনা আমার শুধু দুঃখই বাড়ায়। আমি শুধু আপন মনে ওর সঙ্গে গল্প করি, ওর সঙ্গে মনেমনে হেঁটে বেড়াই। একাকীত্বের সময়টাতে ওকে স্মরণ করি, কল্পনায় একসঙ্গে সুন্দর সময় কাটাই। তবে বাস্তবে ফিরে এলে সেই কল্পনাকে মুহুর্তেই দূরে সরিয়ে রাখি।
একদিন বাসায় ফিরে দেখি স্বাগতা আপু এসেছে। আমাকে বললো, ব্যাগে দুইটা জামা নে। আমার বাসায় থাকবি আজ। বারবিকিউ হবে।
'মা যাবে?'
'না। আমি মাকে বলেছি তোকে নিয়ে যাবো। বলেছে তোকে চোখে চোখে রাখতে। কিছু করেছিস নাকি?'
আমি স্বাগতা আপুর চোখের দিকে চেয়ে রইলাম। উত্তর নেই আমার। আপু আমার রুমে এসে ফিসফিস করে বললো, 'ভালো ড্রেস নে। কালকে ঘুরতে যাবো।'
আমি চোখ বড়বড় করে তাকালাম। আপু ফিসফিস করে বললো, 'তুই না গতবার বললি আবার গেলে তোকে নিয়ে যেতে? ভয় পাস না। আমি মমকে জানাবো না।'
আপু মুখ টিপে হাসলো। আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, যাবো কিনা। মা অনুমতি দিলেন। খুশিমনে ব্যাগে করে আমার সুন্দর একটা ড্রেস নিয়ে চলে এলাম আপুর সঙ্গে।
রাতে খাওয়ার টেবিলে আমি কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করলাম, 'কে কে যাবে?'
আপু যাদের নাম বললো, প্রত্যেকেই আমার চেনা। কিন্তু আমি জানিনা প্রকৃতি কী চায়! যারা যাচ্ছে তাদের মধ্যে রৈনীলও আছে। আমি বিব্রত বোধ করছি। উত্তেজনা কাজ করছে। একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে বিষণ্ণতা। এতদিন পরে দেখা হলে কেমন লাগবে আমার জানা নেই। কল্পনাতেই তো তাকে নিয়ে বেশ আছি আমি। কেন আবার বাস্তবে দেখা হতে হবে..!!
.
.
.
চলবে........................................................................