বহুল তর্কাতর্কির পর কনেপক্ষরা জানাল উনিশ হাজার পাঁচশত এক টাকার এক পয়সাও কম নিবে না। চারশত নিরানব্বই টাকা কমিয়েছে এটাই বরপক্ষদের বাপের ভাগ্য। মোহনা চোখ মুখ কুঁচকে ভাব নিয়ে বলল, “এবার ফটাফট টাকা বের করুন।”
আর দ্বিধা রাখল না কেউ। মুশফিক টাকা হাতে দিল মোহনার। টাকা পেয়ে মহা খুশি হলো সবাই। এরপরই আহিরকে মিষ্টি শরবত খাইয়ে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। মোহনা এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে। মুশফিক যাওয়ার পথে বলল, ‘রসের বিয়াইন।'
মোহনা তাকাল। খানিকটা হাসল। এর কিছুক্ষণ পরই মোহনার নজর গেল তৌহিদের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। মোহনার আচমকাই বুক কেঁপে উঠল, আশ্চর্য! এই লোকটার এখানেও চলে আসা লাগল। মোহনা দ্রুত ছুটে গেল ভিতরে। তৌহিদের ইচ্ছে করছে না ভিতরে যেতে। বেহুদা লাগছে সবকিছু। শান্ত হাত ধরল। বোঝাল, “কি হলো যাবি না?”
মাথা নাড়াল তৌহিদ। যার অর্থ, “যাবে।”
••••••••••••••
গিটার হাতে বাড়ির পিছনে বসে আছে আরহান। চোখে ক্লান্তি, মন জুড়ে প্রশান্তির ছোঁয়া। যদিও আনন্দিত হওয়ার মতো বিশেষ কিছু ঘটেনি তবুও তার আনন্দিত লাগছে। গিটারের টুং টুাং শব্দ হলো। আচমকাই চারপাশ কেমন বিষণ্ণ ঠেকল। কি আশ্চর্য! এই মাত্রই না আনন্দিত লাগছিল। আরহান জোরে নিশ্বাস ফেলে। মাধুর্য মেশানো ঠান্ডা কণ্ঠে গান ধরল—
“আমার সোনার ময়না পাখি
কোন দেশেতে গেলা উইড়া রে
দিয়া মোরে ফাঁকি রে
আমার সোনার ময়না পাখি।
সোনা বরণ পাখিরে আমার
কাজল বরণ আঁখি
দিবানিশি মন চায়রে
বাইন্ধা তরে রাখি রে
আমার সোনার ময়না পাখি।”
গাছের ডালে দুটো পাখি এসে বসল। আকাশটা মেঘলাময় হয়ে উঠল। বাতাস বইছে ছমছমে। আরহান চোখ বন্ধ করে আবারও গেয়ে উঠল গান।
“আমার সোনার ময়না পাখি”
দুপুরের খাবার দেয়ার জন্য আরহানের দরজায় খটখট আওয়াজ করল রাহেলা। কিন্তু দরজাটা খোলা থাকায় হাল্কা টোকাতেই সেটা খুলে গেল। রাহেলা শান্ত গলায় বলল,
“ভাইজান ঘরে আছেন?”
আরহান উত্তর দিল না। দ্বিতীয়বার ডাকের বেলায় নিজের কানে গানের শব্দ শুনতে পেল রাহেলা। সে কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেল ভিতরে। টিপটিপ পানে এগোচ্ছে সে। কিছুটা চোরের মতো। পিছনের বারান্দার দরজার কাছে আসতেই রাহেলার পা থেমে গেল। ইস! ভাইজানের কি সুন্দর কণ্ঠ! কি সুন্দর গান!'
মিনিট পাঁচ গান শুনতে শুনতেই কেটে গেল রাহেলার। সে খাবার হাতে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। গান থামল। গিটারের শব্দ থামল। রাহেলার ধ্যান ভাঙল। তবুও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মন খারাপ হয়ে গেছে। কেন হলো বুঝতে পারছে না। ভাইজানের গানের গলায় বিষাদ ছিল বুঝি। সে ধরতে পারে নি। রাহেলা এগিয়ে গেল। নীরব স্বরে প্রশ্ন করল, “ভাইজান আপনার কি মন খারাপ?”
ভূত দেখার মতো আচমকা চমকে উঠল আরহান। অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় পিছন ঘুরে দেখল রাহেলা দাঁড়িয়ে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে পুনরায় ঘুরে বসল। শান্ত গলায় বলল, “তুমি?”
রাহেলা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আপনার জন্য খাবার নিয়া আইছিলাম ভাইজান।“
আরহান খাবারের ট্রে টা দেখল। সামান্য ক্ষুধা লেগেছে তার। তবে এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। সে বলল, “টেবিলে রেখে যাও।”
রাহেলা সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ঢুকে খাবারটা টেবিলে রাখল। এরপর আবার ফিরে এসে আরহানের পাশ দিয়ে বসল। গালে হাত দিয়ে বলল,
“ভাইজান আপনে কি সুন্দার গান গান! গান হুইনা মনটা আমার ভইরা গেল।”
আরহান মৃদু হাসে। বলে,
“লুকিয়ে লুকিয়ে গান শুনেছ এটা কিন্তু অন্যায়।”
তড়িৎ উত্তর আসে রাহেলার,
“আপনে দরজা খুইলা গান গাইতে পারেন আর আমি দরজার আড়ালে দাঁড়াইয়া গান হুনবার পারি না।”
আরহান আবারও হাসল। ভাড়ি চমৎকার দেখাল সেই হাসি। রাহেলা বলল,
“হাসেন ক্যান ভাইজান?”
“তুমি কি জানো রাহেলা— তুমি খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে।”
সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি জানাল রাহেলা। অভিযোগ নিয়ে বলল,
“আপনে মিথ্যা কন ভাইজান। মানুষ আবার মিষ্টি হয় নাকি।”
“হয়তো তুমি জানো না।”
“ক্যামনে হয়। আমারে মিষ্টির নাহান গোল গোল ফরছা দেহায়।”
“মিষ্টি তো কালোও হয়।”
“কালাগুলান ভালা লাগে না ভাইজান।”
হেঁসে দেয় রাহেলা। আরহানও হাসে। রাহেলার চোখের মনি খানিকটা নীলচে। সচরাচর বিষয়টা নজরে আসে না। মাঝে মাঝে আসে। গায়ের গড়নও ফর্সা। তবে নিজের যত্ন নেয় না বিধায় কালচে দেখায়। আরহানের ধারণা এই মেয়ে কোনো উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম নিলে। মেয়ের বাবার খুব বেগ পেতে হতো। ওত পেতে থাকত— অগণিত পুরুষ মানুষ। রাহেলা বলল,
“ভাইজান একখান আবদার করি?”
আরহান চোখ সরিয়ে বলল,
“করো?”
“আরেকখান গান গাইবেন। হুনবার ইচ্ছে করে। গাইবেন?”
আরহান মৃদু হেঁসে বলল,
“অবশ্যই গাইব। সুন্দরী মেয়েদের আবদার আমি আবার ফেলতে পারি না।”
আরহানের কথা শুনে খুশিতে চোখ চকচক করে উঠল রাহেলার। উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“সত্যি গাইবেন ভাইজান?”
মাথা নাড়াল আরহান। বলল,
“হুম। বলো কি গান শুনবে?”
রাহেলা ফট করে বলল,
“ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়।”
••••••••••••
আকাশ জুড়ে বিছিয়ে ওঠা কালো মেঘগুলো তখন কেবল সরছে। আতঙ্কিত মানুষজন তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে। কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করেছেন ইতিমধ্যে। শান্ত আর তৌহিদ বসে আছে। স্টেজ থেকে বেশ খানিকটা দূরে চেয়ারের ওপর। তৌহিদের বিরক্তিতে বিরক্তিতে অবস্থা নাজেহাল। তার মনের মধ্যে চলছে শুধু, কখন এখান থেকে বের হবে। কিন্তু বের হওয়া আর হচ্ছে না। বাচ্চাদের চিৎকার, মহিলাদের তীব্র খোশগল্প, আর আশেপাশের ছেলেমেয়েদের ন্যাকামো সব মিলিয়ে খুবই বিচ্ছিরি একটা অনুভূতি। তৌহিদের পাশেই চুপটি করে বসে আছে শান্ত। তার হাতে ফোন। কারো সাথে বোধহয় চ্যাটিং করছে। শান্ত খুব একটা কারো সাথে কথা বলে না। তার ফেসবুক একাউন্ট, ফেসবুক পেইজে অগণিত মানুষের মেসেজে ভরপুর। কিন্তু ছুঁয়ে দেখা হয় না। শান্তর চিন্তা ভাবনায় হলো তার পাঠকদের কোনোরূপ কৌতূহল না দমানো। কেউ তার সম্পর্কে কিছু জানে না, হাসান মাহবুব কোথায় থাকে? কি করে? পড়াশোনা করে নাকি চাকরি করে? বিয়ে করেছে নাকি সিঙ্গেল? এই ধরনের টুকিটাকি প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে নেই। লেখক পরিচিতিতেও সেইভাবে নিজেকে প্রকাশ করেনি শান্ত। অনেকে হয়তো তাকে অহংকারী মনে করে। কিন্তু আধতেও শান্ত অহংকারী নয়। তার বড্ড ভয় হয়, ওই যে তার দূর্বলতা, কথা বলতে না পারার ছোট্ট আক্ষেপ সম্পর্কে কেউ না বুঝে যায়, কেউ না জেনে যায়। জেনে গেলে যে বিপদ। শান্তর ধারনা তার দূর্বলতা সম্পর্কে মানুষ জেনে গেলে এখনকার মতো কেউ তাকে ভালোবাসবে না। তার ভালোবাসার সংখ্যা কমবে। যদিও ধারণাটা মাঝে মাঝে ভুলও মনে হয়। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো শান্তর। হঠাৎ ইনবক্সের একটা মেসেজে চোখ আটকাল শান্তর। আইডির নাম আরিহা সিকদার। মেসেজটা দেখল শান্ত। অনেক লম্বা মেসেজ। শান্ত শেষ এক লাইন দেখল যেখানে মেয়েটি লিখেছে,
“লেখক সাহেব আপনাকে খুঁজতে আর পেতে হলে কি করতে হবে?”
কথা পড়ে হাসল শান্ত। মনে মনে ভাবল, আচ্ছা এই আইডির মালিক যদি জানে শান্তর বাকশক্তি নেই তখনও কি এই প্রশ্নটা করত? শান্তর মন বলছে করত না। জীবন কোনো সাহিত্য নয়। এখানে খুবই ক্ষুদ্র কিছু মানুষ আছে যারা হাজারও বাঁধা পেরিয়ে খামতি থাকা মানুষটাকে ভালোবাসতে পারে। ভালোবেসে জীবন সঙ্গী করতে পারে। পাশে থাকতে পারে। শান্তর মতে এই ক্ষুদ্র সংখ্যা খুবই কিঞ্চিৎ। যার একাংশে থাকে ভালোবাসা, অন্য অংশে থাকে স্বার্থ। স্বার্থহীন মানুষ পাওয়া কঠিন। নেই বললেও চলে। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষই স্বার্থের জন্য কাছে আসে। কারো স্বার্থটা থাকে ভালোবাসা। কারো স্বার্থটা থাকে নাম, যশ, খ্যাতি নয়তবা অর্থ-সম্পদ।"
শান্ত টাইপিং কি-বোর্ডে হাত রাখল। আচমকাই লিখে বসল,
“লেখককে খুঁজতে হলে, জানতে হবে।
পেতে হলে, বুঝতে হবে।”
এই জগতে মানুষকে জানা আর বোঝা খুবই কঠিন জিনিস আপনি পারবেন না।”
মেসেজ টাইপিং করে দেয়ার পরে শান্তর হুস ফিরল। এসব কি লিখে দিল শান্ত। রিমুভ করবে এরই মাঝে ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসলো,
“আপনি সুযোগ দিলে আমি পেরে দেখাব লেখক সাহেব।”
সঙ্গে সঙ্গে থমকে গেল শান্ত। হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল নিচে। তৌহিদ অবাক হয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”
শান্ত বলল না। তৌহিদ উঠে গিয়ে পানি আনল।
শান্ত ঠকঠক করে পানি গিলল। তৌহিদ আবার প্রশ্ন করল, “কি হয়েছে?”
শান্তর নিষ্পলক চাহনি। মাথা নাড়ানোর ছোট্ট উত্তর, “কিছু না।”
তৌহিদ চেয়ে রইল। কিছু তো একটা ঘটল মাত্র। তৌহিদ জোর করল না। জানাল, “ঠিক আছে।”
শান্তদের থেকে খানিকটা দূরে চেয়ারে বসা ছিল ফাবিহা আর অরিন। ফাবিহার দৃষ্টি বিয়ের মঞ্চে। আর অরিন, শান্তর আচমকার কান্ডটুকু খেয়াল করেছে সে। নাক ছিটকে উচ্চারণ করেছে শুধু, “বিরক্তিকর!”
.
.
.
চলবে......................................................................