আশিয়ানা - পর্ব ৬৬ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


সাত দিন কেটে গেল। তূর্ণর একক অ্যালবামের প্রকাশের তারিখ ইতিমধ্যেই চলে এসেছে। সেহরিশ তার বেশিরভাগ সময় রোমে কাটায়, তার হাতে ফ্রী সময় নেই বলা যায়। এখন বিকাল। ঘড়িতে সময় 5:49pm মিনিট। সূর্যের উষ্ণ আভা ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। প্রতিদিন এই সময়ে রোদেলা বারান্দায় এসে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়। সবুজ ঘাস ও মাটির ওপর নেমে আসে উষ্ণ রংধনু কিরণ। ইস্পাতের মতো চিকচিক করছে লেকের জল, একটা নৌকা জলে ভেসে আছে তীরের দিকে। ঢেউগুলো অলসভাবে ধূসর রঙের পাথরের উপর আছড়ে পড়ল, তারপর পিঠের উপর দিয়ে গড়িয়ে নেমে গেল। কাঁচের টুকরোর মতো স্বচ্ছ ও ছোটো ছোটো ঢেউ। পাহাড়ের নিচে কয়েক জাতের বাগান অনেক ধরনের ফুল ফুটে আছে।  

রোদেলার হঠাৎ মন খারাপ হলো, এত বড় প্রাসাদে একা থাকতে ভালো লাগছে না তার। ডোনা প্রায় এসে জিজ্ঞেস করে তার কিছু লাগবে কি না? রোদেলা নিবিড়ভাবে মাথা নাড়ে, যার অর্থ তার কিছু লাগবে না। ডোনা তখন তার মতো চলে যায়। একজন মানুষ এভাবে নিশ্চুপ কতদিন বাঁচতে পারে? মানুষ একা থাকতে পারে না, তাদের অন্য মানুষের সঙ্গ দরকার। অন্তত একটু কথা বলার জন্য। রোদেলা জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। হঠাৎ দুখানা শক্তপোক্ত হাত তাকে দুপাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো, হঠাৎ কারো স্পর্শে কেঁপে উঠল রোদেলা। সেহরিশ বুকখানার ওপর দিয়ে নেমে এসেছে একটা সাদা টি-শার্ট। তার উভয় হাতের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো। সেহরিশ রোদেলার উদ্দেশ্য নরম গলায় বলল, 
  'রোদ মাই ওয়াইফ।'
রোদেলা বলল, 
  'আপনি এসেছেন?'
সেহরিশ মৃদু হাসল। রোদেলার দিকে ফিরে বলল,
  'আমার মন তোমার জন্য কেমন করছিল তার জন্য সবকিছু ফেলে চলে আসছি।'
  'কিন্তু?'
সেহরিশ তার তর্জনী রোদেলার ঠোঁটে রেখে নরম গলায় বলল,
  'টেনশন করো না, সাদাফ আছে ওঁ সব সামলে নেবে। তাছাড়া, এটা তূর্ণর প্রথম একক অ্যালবাম না।'
সেহরিশ ভ্রুকুটি করলো। রোদেলার চুলে এক হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 
  'আজ চুল আঁচড়াওনি? কত অগোছালো হয়ে আছে।'
রোদেলা ইতস্তত করে বলল,
  'ইচ্ছে করেনি।'
সেহরিশ আগের চেয়ে নরম গলায় বলল। 
  'এসো, এখানে বসো আমি আঁচড়ে দিচ্ছি।'

রোদেলা অবাক হলো। সেহরিশ তার পা দুটো দুদিকে রেখে বসেছে বারান্দার চেয়ারটায়। তারপর চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে রোদেলার চুলের দিকে তাকাল। বাম হাতের মধ্যে চুল রেখে ডান হাত দিয়ে চিরুনি করতে লাগল। সেহরিশের থেকে একটু দূরে বসেছে রোদেলা তবুও চুলে একটা টান খায়নি সে। হাঁটু ভাজ করে বসে রোদেলা। অস্ফুট চোখে তাকাল আকাশের দিকে, তার মন সূর্যালোকিত মেঘের মতো গলে যাচ্ছে। রোদেলা মাথা নিচু করলো। সেহরিশ কত যত্ন করে তার চুল আঁচড়াচ্ছে, একরাশ প্রসন্নতা মন ও তার আত্মাকে ভরিয়ে দিচ্ছে। ভাঙা গলায় রোদেলা বলল,
  'শুনুন!'
সেহরিশ আস্তে করে জবাব দেয়,
  'শুনছি, বলো।'
রোদেলা ম্লান কণ্ঠে বলল, 
  'আমার এত যত্ন করেন কেন? এই যে কত যত্ন করে চুল আঁচড়ে বেণি করে দিচ্ছেন।'
সেহরিশ শান্ত কণ্ঠে বলল, 
  'আমি তোমার মধ্যে আমার সব সুখ খুঁজে পাই। তাই অকারণে তোমাকে স্পর্শ করার অজুহাত খুঁজতে থাকি।'
    
রোদেলা মাথা তুলে সেহরিশের দিকে তাকাল, প্রশ্ন করতে গিয়ে কি ভেবে ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলল। একটু পর অস্পষ্ট স্বরে বলল,
  'মাঝে মাঝে আপনাকে দেখে অবাক হই, পৃথিবীতে এতো মানুষ আছে তাহলে আমি কেন?'
সেহরিশ একটু থেমে বলল,
  'আমি জানি কিন্তু আমার কাছে তুমিই সেরা,
পৃথিবীর সবাই এই মনে জায়গা পায়নি, যা তুমি পেয়েছ।'

লেকের নীল জলে নীরবে ভাসছে বেশ কিছু নৌকা। মনে হচ্ছে এক টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। একটা স্থবির বাতাস পাহাড়ের চারপাশে ভাসছে। বাতাসে উর্বর মাটি আর শান্ত জলের গন্ধ ভেসে নাকে আসছে। লেকের স্বচ্ছ পানিতে পাহাড়ের ছায়া নরম হয়ে গেল। সেহরিশ নিঃশব্দে এগিয়ে এলো, রোদেলার পিঠে বুক চেপে দুই হাতে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে সেহরিশ তারপর কাঁধে থুতনি রাখল। সেহরিশ পানির দিকে তাকাল। দুই চোখেই তৃপ্তির সুখ। রোদেলার দিকে তাকিয়ে সেহরিশ মোহিত গলায় বলল, 
  'রোদ, তুমিই আমার একমাত্র সুখ।'

সেহরিশ রোদেলার কপালে আলতো করে চুমু দিল। তারপর দুই গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল,
  'আমরা এখন সাদাফের বাসায় যাব। উমাইয়া এখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, বন্ধু হিসেবে তোমার তার পাশে থাকা উচিত।'

রোদেলা ডান দিকে মাথা নাড়ল। যার অর্থ, ঠিক আছে। সেহরিশ মৃদু হেসে রোদেলার মাথায় হাত রেখে কোমল গলায় বলল, 
  'তোমার লাজুকটা একটু বেশি সুন্দর।'

রোদেলার কান মুহুর্তে লাল হয়ে গেল। নিচু গলায় বলল,
   'আপনি হয়তো দুই দিন খুব ব্যস্ত থাকবেন। আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি এই পুরো সময় উমাইয়ার সাথে থাকতে চাই।'

সেহরিশ রোদেলাকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, 
  'আমি তোমার সব সিদ্ধান্তকে সম্মান করি, কিন্তু তোমার আমার থেকে এক ইঞ্চি দূরে থাকাটা সহ্য করব না। এই বুকে মাথা রেখেছ, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এখানেই থাকবে। আমি তোমাকে আমার থেকে দূরে যেতে দেব না।'

সাদাফের বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে রোদেলা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করার চেষ্টা করছে। জামদানি শাড়ির কুঁচি বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রোদেলা আয়নায় নিজেকে দেখে হতাশ হলো। সেহরিশ বিছানা থেকে উঠে এলো। রোদেলার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করার চেষ্টা করে। রোদেলা নিচু গলায় বলল,
  'আপনি কি করছেন?'
  'কুঁচি ধরছি।'
  'আপনি শাড়ি ধরতে পারেন? আগে কখনও শাড়ি ধরেছেন?'
সেহরিশ রোদেলার দিকে এক পলক, দুই পলক তাকিয়ে বলল, 
  'না, আমি আগে ধরিনি। কিন্তু এখন ধরতে দোষ কি?'
সেহরিশ ভ্রুকুটি করলো। কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও সেহরিশ কুঁচি ঠিক করতে পারলো না। রোদেলা তার দিকে তাকিয়ে বলল,
  'আপনি পারবেন না, উঠুন। আমি করে নিচ্ছি।'
সেহরিশ বলল,
  'আমি পারব রোদ।'
রোদেলা হুট করে হেসে ফেলল।
 

সাদাফ বাসায় নেই। উমাইয়া বাড়িতে একা, বেল বাজানোর পর একজন মেইড দরজা খুলে দেয়। তিনি রোদেলাকে চিনে না কিন্তু সেহরিশকে দেখেই দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। সেহরিশ রোদেলাকে ড্রয়িংরুমে রেখে তারাহুরো করে চলে গেল। মেইড রোদেলাকে উমাইয়ার দরজার সামনে পৌঁছে দিয়ে সে নিচে নেমে গেল। রোদেলা দরজার ভিতরে উঁকি দিল। উমাইয়া বিছানায় সোজা হয়ে বসে আছে, রোদেলাকে দেখে উমাইয়া দ্রুত উঠে দাঁড়াল। রোদেলা তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো।

উমাইয়া আনন্দিত হয়ে বলল, 
  'তোর আসার এই সময় হলো? তুই ছাড়া আমার এখানে আর কে আছে? কতদিন পর তোকে দেখলাম।'
রোদেলা উত্তর দিল না। উমাইয়াকে ছেড়ে রোদেলা তড়িঘড়ি করে উমাইয়ার পেটে হাত রাখল তারপর নিচু স্বরে বলল, 
  'বাবু ছেলে নাকি মেয়ে?'

উমাইয়া জোরে হেসে উঠল। সে রোদেলার হাত ধরে বিছানায় বসে বলল,
  'এখনও দুই মাস হয়নি। এখন কিভাবে বলবো বাচ্চা কি হবে?'
রোদেলা মুচকি হেসে বলল,
  'আমরা খালা হবো। আমি কিন্তু সবার প্রথমে তাকে আমার কোলে নেব।'
উমাইয়া মুচকি হেসে বলল,
  'ঠিক আছে। এখন শান্ত হো। আর এখানে একা আসছিস নাকি বড় ভাই কোই?'
  'সে চলে গেছে, তূর্ণ ভাই কল করেছিল।'
  'আচ্ছা বোস। আমি তোর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছি।'
উমাইয়া উঠতে লাগল। এমন সময় রোদেলা উমাইয়ার হাত ধরে নরম গলায় বলল,
  'অনেক দিন হয়ে গেছে তোর সাথে গল্প করি না। আয়, একটু বোস, কিছু কথা বলি।'
উমাইয়া রোদেলার মাথায় হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল, 
  'কি হয়েছে রোদু? তোর মন খারাপ?'
রোদেলা বলল, 
  'তোদের কথা অনেক মনে পড়ে, আমার একা থাকতে ভালো লাগে না।'
উমাইয়া বলল,
  'সাদাফের মুখে শুনেছি বড় ভাইয়ের এখানে বাড়ি আছে, সে তোর থেকে এত দূরে থাকে কেন? তুই ভাইকে এখানে আসতে বল। তুই আমার কাছে থাকলে আমি তোর সাথে সবসময় দেখা করতে পারব।'
রোদেলা বলল, 
  'উনি যা চায় তাই হবে, উনি যেখানে থাকতে বলবে, আমি সেখানেই থাকব। আমি ওনার মুখের উপর কিছুই বলতে পারব না।'
.
.
.
চলবে...........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন