প্রেম-ভালোবাসা, জ্বলন্ত মন অথবা মনের ব্যাকুলতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম এক নিবিড়, দৃঢ় —গভীরতম ওষ্ঠদ্বয়ের চুম্বন। হৃদয়ের সব বোঝাপড়া মিটিয়ে নিতে এরচেয়ে আবেদনময়ী কোনো মাধ্যম জানা আছে বলে মনে হয় না। তন্ময় তো দীর্ঘ সময় শুধু এক চুমুতেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারবে। অবশ্য এখনকার চুমুর স্বাদ অনেকটাই পৃথক। দিব্যি তার মুখে সীমাহীন লিপস্টিক প্রবেশ করেছে। হয়তো-বা তার ঠোঁটের চারিপাশ ভরে আছে লিপস্টিকে। সে অনুভব করতে পারছে। ঘরে যাওয়ার পূর্বে ভালোভাবে মুছে নিতে হবে। তার পিতা ওরফে শাহজাহান মোস্তফা দেখে নিলে আর রক্ষে রবে না। গাড়ির সাথে আঁটকে রাখা অরুর দেহখানা ভয়ে এখনো জড়সড়। আনোয়ার সাহেবের হঠাৎ ডাকে ভীত হয়েছে বেশ।
হাড় কাঁপানো শীতল রাতের প্রাণিকুল ডাকছে মিহি স্বরে। সেই ডাকের সুর কর্ণগোচর হতেই গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। শিরশিরে অনুভূতি হয় শিরদাঁড়া বেয়ে। সুউচ্চ প্রাচীর ঘেঁষে ওঠা নারিকেল গাছটির মাথার ওপরে উজ্জ্বল চাঁদটা বসেছে। চাঁদের চতুর্দিক জুড়ে ছোটো-বড়ো নানাপ্রকার নক্ষত্রের বসতি। বহমান হাওয়ার স্পর্শ তুলতুলে নরম হলেও শীতের মাত্রা দ্বিগুণ ধাপে বাড়িয়ে দিচ্ছে। পার্কিং জায়গাটিতে চাঁদের জ্যোতি পড়েও যেন পড়ছেনা। কেমন নিশীথনিবিড় সবটা। চাঁদের সবটুকু নিঙড়ানো জ্যোতি যেন বাগানের দূর্বাঘাসে লুটোপুটি খাচ্ছে। সেথায় একনজর চাইল তন্ময়। আনোয়ার সাহেব সেই পর্যন্ত এসেই ফিরে গিয়েছেন। কী ভেবেছেন কে জানে? হয়তো-বা তাদের অস্তিত্ব বুঝে নিয়েছেন!
আঁধারেও তন্ময় ঠিক দেখল প্রেয়সীর ছলছল চোখের চাহনি। টলমলে রক্তিম আঁখিজোড়াতে— কাছ থেকে, নিগূঢ়ভাবে চেয়ে সে দু’গাল ভরে হাসল। হাসির ছন্দে কাঁপল তার পুরুষোচিত শক্তপোক্ত বুক। সেই বুকে পিষে থাকা ছোটোখাটো শরীরটিও যেন কম্পন অনুভব করল। সাধারণত তন্ময়কে এভাবে হাসতে দেখা যায় না। দেখা গেলেও কয়েকবার— সেই কয়েকটিবার হাতের আঙুল দ্বারা গুণে ফেলা সম্ভব। তার এই জীবন্ত হাসি মোস্তফা সাহেব খুব করে ভালোবাসেন। ছেলেকে হাস্যোজ্জ্বল দেখতে চাওয়া তার সরল মনের কথাগুলো একদিন আকস্মিক; অপ্রস্তুত তন্ময় আড়াল হতে শুনেও ফেলেছিল। অবশ্য শুনেই যে জানতে হবে এমন নয়। সম্মুখীন মানুষটির চোখমুখ, আদল, আচরণ দেখলেই বুঝে নেয়া যায় তার মনের কথা। যেমন এইযে তার অরু! ওর গভীর চোখের ড্যাবড্যাব করে তাকানোই সব বলে দেয় তাকে। ওর মুখের আদল বলে দেয় ওর মনের কথা। চোখজোড়া জানিয়ে দেয় ওর আকাশসম মুগ্ধতার কথা। বুঝিয়ে দেয়, ও মোহিত তার প্রতি। ডুবতে বসেছে তার প্রণয়ের নদীতে। তন্ময় দু'ভ্রু দারুণ কায়দায় দুলিয়ে দুষ্টুমির সুরে প্রশ্ন করে,
‘কাঁদছিস কেন?’
অরু চূড়ান্ত আশ্চর্য হয়। এহেন প্রশ্নটি যেন সে আশা করেনি। নাক ফুলেফেঁপে ওঠে। রাগিত গলায় পাল্টা শুধিয়ে বসে তৎক্ষণাৎ, ‘আপনি আমার হাত মুষড়ে ধরেছেন। কেন?’
তন্ময় তখনো ওর মসৃণ হাত দুটো পিঠে বেঁকিয়ে ধরেই রেখেছিল। এবারে বাঁধন দৃঢ় করল। আরও গাঢ়; গভীর আলিঙ্গনে এনে —বেশ সাবলীল স্বরে স্বীকারোক্তি করে,
‘ব্যথা দিতে।’
এমন প্রত্যুত্তর আশা করেনি বলেই হয়তো-বা অরুর চোখজোড়া বড়োবড়ো হয়ে আসে। আহত হয়। ব্যথিত তবে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
‘কেন?’
‘ইচ্ছে করল।’ তন্ময়ের কণ্ঠের সুর বেশ নির্বিকার। যেন হাত মুষড়ে ধরাটা নিত্যদিনের কার্যক্রম। এমন হেলদোল বিহীন প্রত্যুত্তর শুনে অরুর আশ্চর্যের মাত্রা বাড়ল,
‘আমি সত্যিই ব্যথা পাচ্ছি হাতে।’ অরু থেমে গিয়ে ফের বলল, ‘সত্যি।’
তন্ময় নিশ্চুপ রইল অনেকক্ষণ। সুগভীর দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে রইল সরল মুখপানে। অরু হাঁসফাঁস করে চলেছে। হাত দুটো ছুটিয়ে নেবার জন্য আকুল। কিছুক্ষণের মধ্যে ও ঠিক কয়বার পলক ফেলল, তন্ময় নির্দ্বিধায় গুণে-গুণে বলে দিতে পারবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিথিল করল হাতের বাঁধনময় বন্ধন। তবে ছাড়ল না। মাথাটা আরেক ধাপ ঝুঁকিয়ে ফেলল অনায়াসে। নিজ বক্ষপিঞ্জরের দিক ইশারা করে আনমনা ভাবেই জানাল,
‘আমিও তো ব্যথা পাচ্ছি। এইতো এইখানে।’
অরুর মুখের পরিবর্তন ঘটে মুহূর্তেই। ভুলে বসে পূর্বের সব। চোখে ভীড়ে কেমন এক অদ্ভুতুড়ে চিন্তিত ব্যাকুলতা। উদগ্রীব কণ্ঠের সুর, ‘কী হয়েছে? কীভাবে ব্যথা পেয়েছেন? দেখি!’
যেন তন্ময়ের বুক ব্যথাটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু, আকুল হওয়ার মতন কিছু। এইমুহূর্তে অরুকে আর বাচ্চাটে– নির্বোধ মেয়েটি বলে মনে হলো না। দায়িত্ব নিয়ে আদর-সোহাগ এবং যত্ন দেবার মতো প্রাপ্তযুবতী বলেই মনে হলো। শিথিল করায় হাতজোড়া ছাড়িয়েই তন্ময়ের বুকপকেটের দিকটা ছুঁয়ে দিলো অরু। ফের উতলা গলায় শুধাল দুর্ভাবনাগ্রস্ত মনে,
‘বলেন না! কী হলো? ব্যথা পেলেন কীভাবে? কিছুই তো বলেন না। তন্ময় ভাই!!’
তন্ময় আলতোভাবে বুক ছুঁয়ে দেয়া হাতের ওপর হাত রাখল। কাতর চোখে চেয়ে বিভোর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করল সে, ‘ব্যথা সেরে গেছে। তোর হাতে কি জাদু আছে? নাকি মুখে?’
অরু বিরক্ত হয়। মুখটা ভোঁতা হয়ে আসে তার। রাগ করে বসে মুহূর্তেই, ‘এইসব ব্যাপারে মজা করবেন না একদম।’
‘করব না।’ তন্ময় বাধ্য পুরুষের মতন আপসেই প্রত্যুত্তর করল। এতে যেন অরু সন্তুষ্ট বিড়াল। জাপটে ধরল তন্ময়ের সুগঠিত কোমর। মাথাটা বুকে চেপে আওড়াল,
‘আজ কতগুলো মেয়েরা আপনায় ড্যাবড্যাব করে দেখছিল। কলি আপুও। হাহ! অন্যের জামাই কেন দেখবে? বিয়ে করে নিজের জামাই দেখুক। আমি পারলে আপনার গলায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিতাম। লেখা থাকতো, ‘এই মানুষটা বুকড শাহজাহান আরাবির জন্য। তাকানো নিষেধ।’
তন্ময় শব্দ করেই হাসল। অরুর গাল টেনে ধরল, ‘সাইনবোর্ড লাগবে কেন? তুই কোলে উঠে থাকলেই তো হয়। সবাই জেনে যাবে। নোটিশ লাগবে না।’
অরুকে ফিসফিস করতে শোনা গেল,
‘আমি এতো নির্লজ্জ কীভাবে হব!’
‘আদর করি না বলে তো ঠিক অভিমান করে এড়িয়ে বেড়াচ্ছিলি। আবার আদর করলেও নড়াচড়া করে বেড়াস। পালাই পালাই করিস। হুঁ?’
অরু তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল, ‘ছাড়ুন। সবাই কী ভাববে? বাবা খুঁজেও গেলেন একবার।’ বলেই অরু যেতে উতলা হলো। তন্ময় দ্রুত হাত ধরে ফেলল,
‘চুপচাপ দাঁড়া।’
কোনোদিকেই খেয়াল থাকে না মেয়েটার। তন্ময় ওর ওড়নার শেষাংশ হাতের মুঠোয় নিয়ে ব্যস্ত হলো নিজের ঠোঁটের বহিরাংশ মুছতে। লাল টকটকে লিপস্টিক স্টেইন! আদতেও উঠবে? তন্ময়ের মন সংকীর্ণ হলো মুহূর্তেই। পুরোপুরিভাবে উঠবে বলে মনে হচ্ছে না! কয়েকবার ঘষামাজা করেছে সে। তবুও লালচে আভা ছড়িয়ে আছে। এক দেখাতেই যা বোঝার বুঝে নেবে সবাই। এক্সপ্লেনেশন দেবার প্রয়োজন পড়বে না। এখন লিভিংরুমে কেউ না থাকলেই হয়! সবাই যেন নিজেদের রুমে সুগভীর তন্দ্রায় নিবিষ্ট হয়। ভাগ্যক্রমে তন্ময় নিরাশ হয়নি। বাড়ির ভেতরটা নীরব। ক্লান্ত সবাই নিজেদের রুমে চলে গিয়েছে ইতোমধ্যে। লিভিংরুম ফাঁকা। অরু লাজুক মুখে ওড়না চেপে ছুটেছে নিজের রুমের দিকে।
আজকাল আর তন্ময় নিজের রুমের দরজা লক করে রাখে না। ইচ্ছে হয় না। সম্ভবত তখন ভোর। অনুভব করল খুব আলতোভাবেই একটি উত্তাপ দেহ তার কম্ফোর্টারের ভেতরে ঢুকে পড়েছে অনায়াসে। তার সাথে লেপ্টে শুয়েছে। আধ ঘুমের মধ্যেও তন্ময় এই শীর্ণ দেহের অস্তিত্ব চেনে। খুব করে জানে। এই শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গে তার শিলমোহর রাখা। কীভাবে না চিনবে? আদুরে ভঙ্গিতেই দু’হাতে অরুকে নিজের উন্মুক্ত বুকে জাপটে নিলো। ঘুমন্ত চোখে কোনোরকমে চাইল— রুম অন্ধকার। আঁধারেতে অরুর স্নিগ্ধ মুখের দেখা মিলল না। নিস্তব্ধতা ভেঙে কর্ণগোচর হলো অরুর মৃদু শ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্বনি। তন্ময় গভীর স্বরে শুধাল,
‘ঘুমাসনি কেন? ক'টা বাজে?’
অরু আরও নিবিড় —গভীরভাবে ঢুকল তন্ময়ের বক্ষস্থলে, ‘ঘুম ভেঙে গেছে। দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম আপনি আমার জন্য কাঁদছেন। তাই চলে এলাম।’
তন্ময় মৃদু স্বরে হাসল ঘুমন্ত কণ্ঠে, ‘আমি নাকি তুই? হুঁ?’
‘আপনি আমি একই তো।’
— — —
বাড়িতে বিয়ের আমেজ। হৈ-হুল্লোড় লেগেই আছে। তবে তন্ময় বসে থাকতে পারছে না। নিত্যদিন সে অফিসে ছুটছে। মোস্তফা সাহেব গতকালও বলেছেন, ক'দিন অফিসের কাজটা বাড়িতে সেরে ফেলতে। তবে তা তন্ময় মান্য করতে পারছে না। সম্ভব হচ্ছে না! বিয়ের ঝামেলাটা মিটিয়েই তার ঢাকার বাইরে যেতে হবে। কাজের সূত্রে। বিষয়টা অরু জানলে বেশ হাইপার হবে। সঙ্গে যেতে ঝামেলা করবে। তাই সম্প্রতি বিষয়টা চাপা রেখেছে। আজও সে সাতসকালে এসে পৌঁছেছে অফিসে। চারটা মিটিং শেষ করে যখন ছয়তলায়— নিজের সুবিশাল চ্যাম্বারে এসে বসল, তখন ঘড়ির কাঁটা দুটো বিশে। এখনো তার লাঞ্চ করা হয়নি। করার সম্ভবনা দেখাও যাচ্ছে না। বাড়িতে ফিরতে হবে সন্ধ্যার মধ্যে। আজ শাবিহার ঘরোয়া মেহেদি অনুষ্ঠান। পকেটে লিস্ট আছে বেশ কিছু জিনিসপাতির। এসব কিনে ফেলতে হবে সন্ধ্যার পূর্বে। বাড়ির দুয়ার পেরুতেইহবে মাগরিবের আজান পড়তেই।
ট্রান্সপারেন্ট থাই গ্লাস ভেদ করে দুপুরের রোদ্দুর ছুঁয়েছে অফিস ফ্লোরে। ম্যানেজার সুমন টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফাইল হাতে। তার অস্তিত্ব যেন শূন্যে। তার হাতে চারটা পাতলাটে ফাইল। চারটাই সে আলগোছে রাখল তন্ময়ের সামনে। ইতোমধ্যে তন্ময় ব্যস্ত চোখে দেখছে নীল রঙা ফাইল-টা। ভ্রু'দ্বয়ের মধ্যিখানে গুণে-গুণে চারটে ভাঁজ পড়েছে। ম্যানেজার সুমন চোখমুখ বুজে ফেলেন জানাশোনা ভঙ্গিতে। তৎক্ষণাৎ তন্ময়ের গুরুগম্ভীর ধমক পড়ল,
‘একটা বারো পৃষ্ঠার ফাইলে এতগুলো বানান ভুল। প্রুফরিড কি বসে বসে আমি করব? টিম রাখা হয়েছে কি ঘাস খেতে? আপনারা ঘাস খান। আমি বসে প্রুফরিড করি.. নাকি?’
ম্যানেজার সুমন ফাইলটা দ্রুত হাতে তুলে নিলেন। লাঞ্চ বক্সটা এগিয়ে দিলেন সযত্নে, ‘স্যার, লাঞ্চ করে নিন।’
‘পরে করব। আপনি করে নিন গিয়ে।’
তন্ময় না চেয়েই আদেশ ছুঁড়ল। পকেটে তার একান্তগত ফোনটা ভাইব্রেট হয়ে চলেছে সমানে। ম্যানেজার সুমন বেরোতেই স্মার্টফোন খানা বের করল সে। হোয়াটঅ্যাপের নোটিফিকেশন দিয়ে ভরতি লকস্ক্রিন। অরু সহস্র মেসেজ করে রেখেছে। শেষের ভয়েজ রেকর্ড শুনতেই তার গম্ভীরমুখ নরম হয়ে আসে দৃশ্যমান রূপে। ঠোঁটের কোণে এসে জমে মৃদু হাসির রেখা। তার জীবনের সব অশান্তি, ক্লান্তি যেন ওর সামনে হারিয়ে যায়।
.
.
.
চলবে.............................................