অতিথি নিবাস - পর্ব ১৫ - তানজিল মীম - ধারাবাহিক গল্প


ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে মোহনা তৌহিদের দিকে। তৌহিদও তাকানো। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। মোহনা কি করবে বুঝতে পারছে না! জীবনে এমন বিস্ময়কর মুহূর্ত তার কখনো আসেনি। কল্পনারও অধিনে ছিল তৌহিদের স্যারের সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে। সাউন্ড বক্সের আওয়াজ তখন থেমে এসেছে। গানের শেষে নাচ থামিয়ে সবাই দিল এক চিৎকার। মোহনা লাফিয়ে উঠল। বুকে ফুঁ দিল দ্রুত। রাহেলা বলল, “আপা আপনে কি জোশ নাচেন? ছো বুটিফুল!”

মোহনা রাহেলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
 “কি বললে?”
 “বুটিফুল।”

মোহনার কথাটা বুঝতে কিছু সময় লাগল। এরপরই বলল,
 “ওটা বুটিফুল না বিউটিফুল।”
 “ওই একই হলো।”

মোহনা চুপ হয়ে গেল। রাহেলার ডাক পড়ল। নিচ থেকে রিনা বেগম ডাকছেন। রাহেলা মোহনাকে 'আইতাছি' বলে চলে গেল। মোহনার ঘোর তখনও কাটেনি। কিছুক্ষণ পর পর তৌহিদকে দেখছে। লোকটা এখনও তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কি অদ্ভুত! এত তাকিয়ে থাকার কি আছে!'

 গায়ে কালো রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়ে ছাঁদঘরে হাজির হলো আরহান। ভিতরে ঢুকতেই সর্বপ্রথম নজরে আসলো ফাবিহাকে। ফাবিহাও দেখল তাকে। চোখাচোখি হলো দুজনের। তবে আরহানের সাজটা ভালো লাগেনি। গায়ে হলুদে কেউ এভাবে আসে। কোথায় হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে আসবে তা না! কেমন যেন বেমানান ঠেকল ফাবিহার। 

আরহান পুরো জায়গায় চোখ বুলিয়ে এগিয়ে গেল তৌহিদ আর শান্তর কাছে। তাকে দেখে দুজনেই কপাল কুঁচকাল। এসব কি পড়ে এসেছে আরহান? তৌহিদ বলল, “এসব কি?”

আরহান অবাক হয়ে বলল,
 “কি?
 “কালো শার্ট পড়ে এসেছিস কেন?”
 “তোকে তো বললামই আমি এখান থেকে সোজা স্টুডিও যাব।”
 “তাই বলে গায়ে হলুদে এভাবে আসবি?”

আরহান এ'কথার উত্তর দিল না। পকেট থেকে অতিথি নিবাসের চাবিটা বের করে। শান্তর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি এখানে থাকতে আসিনি। আমার হাতে সময় নেই। আমার নয়টায় স্টুডিও থাকতে হবে এখন বাজে আটটা চল্লিশ। আর এখান থেকে স্টুডিও প্রায় দেড় ঘন্টার রাস্তা। এমনিতেই দশ মিনিট লেট হচ্ছে। তোরা থাক আমি গেলাম।”

তৌহিদকে কিছু বলার সুযোগ দিল না আরহান। চলে যাচ্ছিল। হঠাৎই শুনতে পেল। ফাবিহা অরিনকে বলছে,
 “তুই কি এভাবেই বসে থাকবি? আরে বাবা কি হয়েছে না বললে বুঝব কি করে?”

অরিন অনেকক্ষণ পর মুখ খুলল। বলল,
 “একটা ছেলে আমাকে বাজে কথা বলেছে।”

ফাবিহা যেন অবাক না হয়ে পারে না। বাড়িতে কে বাজে কথা বলবে অরিনকে। ফাবিহা বলল, 
 “কে বলেছে বাজে কথা?”

অরিন বলল না। সেই মুহূর্তে অরিনের পাশে এসে বসল আরহান। ভাড়ি কণ্ঠে শুধাল,
 “বাজে মানুষের কাজই হলো বাজে কথা বলা। তাই বলে এত সুন্দর একটা সময়ে মুখ গোমড়া করে বসে থাকাটা বেমানান না।”

অরিন চমকে পাশ ফিরে তাকায়। ফাবিহাও তাকায়। আরহান একগাল হেঁসে বলে,
 “হাই আমি আরহান।”

অরিনও উত্তর দেয় পর পর,
 “আমি অরিন।”
 “সুন্দর নাম। দেখুন ভাইয়ের বিয়ে তো আর রোজ রোজ হবে না। মন খারাপ করে বসে থাকবেন না। এখানে সবাই কাছের মানুষ। আমরা তিনজন হয়তো বাহিরের। তবুও বলছি মন খারাপ করবেন না। কেউ বাজে কথা বললেই তো আপনি বাজে হয়ে যাচ্ছেন না। তাই না। তাই বলছি মন খারাপ করবেন না। এনজয় করুন সময়টা। যদিও আমি অপরিচিত মানুষ তবুও বললাম আসলে সুন্দরী মেয়েরা যদি রাগ করে বসে থাকে আমার বড্ড খারাপ লাগে।'

হেঁসে ফেলে অরিন। বলে,
“মজা করছেন?”
 “এমা মজা করব কেন? আপনি কি মজা করার মতো মানুষ নাকি। আচ্ছা চললাম ভালো থাকবেন।”

আরহান উঠে দাঁড়াল। আর সঙ্গে সঙ্গেই অরিন বলল, “আপনি থাকবেন না?”

আরহান আবার বসল। হাল্কা হেঁসে বলল,
 “থাকতে তো ইচ্ছে করছে। সুন্দরী মেয়েদের রেখে কার দূরে থাকতে ইচ্ছে করে বলুন। কিন্তু উপায় নেই। আমার কাজ আছে।”

শেষ কথাগুলোর পিঠে ফাবিহার দিকে তাকাল আরহান। ফাবিহাও তাকিয়ে ছিল আরহানের দিকে আচমকা তাকানোতে কিছুটা থতমত খেল সে।”

আরহান উঠে দাঁড়াল। বলল,
 “তাহলে আর কি ভালো থাকুন। এনজয় করুন।”

আরহান চলে গেল। অরিন তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। কেন যেন আরহানের কথা শুনে তার মনটা ভালো হয়ে গেল। মন খারাপেরা আচমকাই দূরে চলে গেল। অরিন বলল, “চল নাচব।”

ফাবিহা বলে, “তোর মাথা খারাপ আমি নাচতে পারি তুই যা আমি আছি।”

অরিন জোর করল না। চলে গেল। ফাবিহার মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। কেন হলো ধরতে পারছে না।

••••••••••••

আজকে সময়টা বড্ড মায়াময়। কেমন যেন মনে হয় চারপাশটা বড়ই মায়াময়। এমন অদ্ভুত কিছু মনে হওয়ার কারণটা আমি আদতেও খুঁজে পাই না। তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে চারপাশটা বড্ড মায়াময়। হ্যালো গাইস। আসসালামু আলাইকুম। আমি আর.জে আরহান। আপনারা শুনছেন রেডিও তরঙ্গ নাইনটি টু পয়েন্ট টু রেডিও এফএম। আজকে আসতে একটু দেরি হলো। কেউ আবার রাগ করেননি তো। আসলে বাড়িতে বিয়ে বিয়ে গন্ধ নেমেছে। সেই গন্ধ ছাড়িয়ে আসতে আমার একটু দেরি হলো। তাই কথা না বাড়িয়ে শুরু করে দিচ্ছে আমার আজকের আলাপন 'প্রেম নিয়ে কথাকথি।' অনেকে নিশ্চয়ই ভাবছেন রাত ন'টা দশের সময় কপ এসেছে প্রেম নিয়ে কথাকথি করতে। সিঙ্গেল পারশন আবার কি করে প্রেম নিয়ে কথাকথি করে।”

খানিকটা হাসির শব্দ শোনা যায় মাইক্রোফোনে। আরহান তার ভাড়ি কণ্ঠে আরো বলে,
  “আপনারা সরাসরি আমাকে ফোন করতে পারেন 82904 এই নম্বরে। এছাড়া আমাদের ফেসবুক পেইজে নক করতে পারেন, কমেন্ট করতে পারেন লাইভ শোয়ের কমেন্ট বক্সে যত খুশি তত। আজকের শুরুটা একটা গান দিয়ে করি। গানের নাম, 'মিলন হবে কত দিনে?' গানটা শেষ হলেই আমি ফিরছি আপনাদের গানের অনুরোধ শুনতে,ও কথোপকথন করতে।”

মাইক্রোফোন থেকে সরে আসলো আরহান। গান ছাড়ল পরপরই। এরপরই চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। খুব দ্রুত দ্রুত ছুটে আসায় বড্ড ক্লান্ত ঠেকছে। ঘুম ঘুম লাগছে খানিকটা।

•••••••••••

ছাদ থেকে নিচে নেমে আসলো তৌহিদ আর শান্ত এসব আর ভালো লাগছে না। এখন বাড়ির মানুষ থাকুক। তারা বরং ঘরে গিয়ে ঘুমাক। শান্তর ঘুম ঘুম লাগছে। সকালে ঠিক মতো ঘুম হয়নি। কাল রাতে অনেক্ক্ষণ বই পড়েছিল শান্ত। মোহনারা বিশ মিনিট থাকবে বলে এসেও যেতে পারল না একঘন্টাতেও। তৌহিদের সামনে গিয়ে কথা বলার সাহস পায়নি মোহনা। পিছে স্যার যদি রাগারাগি করে। যেভাবে ঢ্যাং ঢ্যাং করে নাচছিল। ছিঃ মানসম্মান আর কিছু রইল না। যদিও এসব ক্ষেত্রে তার মানসম্মান আরো আগেই খোয়া গেছে।'

রবিন তার চাচাকে বলল,
 “এবার বোধহয় আমাদের যাওয়া উচিত।”

চাচাও বললেন,
 “হুম তোরা দাঁড়া আমি মাসুদ উদ্দিনের সাথে কথা বলে আসি।”
 ”আচ্ছা।”

এরপরই মোহনাকে খুঁজতে লাগল রবিন।'

বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল মোহনা। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যাওয়া। না জানি কখন তৌহিদ স্যার তাকে ধরে পেটাতে শুরু করে। সেই নাচের পর থেকেই মোহনা এক প্রকার পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। খালি মনে হয় এই বুঝি স্যার ডেকে নিয়ে থাপ্পড় চোপার মেরে দিল। আতঙ্ক নিয়েই একপ্রকার দাড়িয়ে আছে মোহনা। হঠাৎই কারো এদিকে আসার পদধ্বনি পাওয়া যায়। মোহনা লাফিয়ে ওঠে। তৌহিদের স্যার কণ্ঠ। মোহনা দ্রুত বাড়ির পিছন দিকে দৌড়ে যায়।'

অন্যদিকে,
শান্তর গলায় হাত দিয়ে হাঁটছে তৌহিদ। বলছে,
 “বুঝচ্ছিস ভাবছি বিয়ে-শাদি করে ফেলব।”

শান্ত চোখ বড় বড় করে তাকায়। আচমকা তৌহিদ এগুলো কি বলে! তৌহিদ আরো বলে,
 “এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আজীবন সিঙ্গেল থাকব নাকি।”

শান্ত হাত নাড়ায়। তৌহিদ তা দেখে বলে,
 “কাকে বিয়ে করব?”

উপর-নিচে মাথা নাড়ায় শান্ত। তৌহিদ বলে,
 “করব করব শীঘ্রই কাউকে করে ফেলব।”

বলতে বলতে অতিথি নিবাস ঢুকে পড়ল তৌহিদ আর শান্ত। ওরা যেতেই আড়াল থেকে বের হলো মোহনা। মনটা খারাপ হলো। কেন যেন স্যারের বিয়ের কথা শুনে তার খারাপ লাগছে। না লুকিয়ে থাকাটা ভুল হয়েছে তার উচিত ছিল স্যারের সামনে গিয়ে কথা বলা। বড় আফসোস লাগল মনে। ফোনটা বাজল সেই মুহূর্তে মোহনা ধরার বদলে দিল কেটে।

••••••••••••

 “হ্যালো কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন?”
বেশ ভাড়ি কণ্ঠে শুধাল আরহান। অপাশ থেকে বলল কেউ, “আপনি খুব খারাপ আরহান।”

সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল আরহান। এই ধরনের কথা এর আগে কেউ বলেনি। আরহান হতভম্ব কণ্ঠে বলল, “কে বলছেন আপনি?”

সঙ্গে সঙ্গে কলটা কেটে গেল। আরহান বিভ্রান্তে পড়ল। মনে মনে বলল, “ব্যাপারটা কি হলো?”
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp