বসন্তের প্রথম পূর্ণিমা। রাত বাড়ার একপর্যায়ে আকাশের চাঁদটি উজ্জ্বল সাদা রং ধারণ করলো। পূর্ণিমার চাঁদের রাতে গাছ ফুলে ফুলে ভরে উঠে অপরূপ সৌন্দর্য্য। ঘুটঘুটে আঁধারের জালে ধরা পড়ে ঝকঝকে রৌপ্যকান্তি। ভারী আশ্চর্যের দৃষ্টিতে ওই চাঁদের বিচিত্র রূপের দিকে তাকিয়ে আছে রোদেলা। মৃদু বাতাসে খোলা চুলগুলো দুলছে যেন। চাঁদের স্নিগ্ধ থেকে ও স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। সেহরিশ আপ্লূত হয়ে আছে তার মূল আকর্ষণ পাশে দাঁড়ানো রোদেলা। হাত দুটো পেছন দিকে নিয়ে শক্তভাবে মুঠো বদ্ধ করেছে। মেরুদণ্ড টানটান করে রোদেলাকে অবলোকন করছে দীর্ঘসময়। জ্যোৎস্না রাতে বিমোহিত হয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী রোদেলাকে ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছা লালন করছে সে অনেকক্ষণ থেকে। অবুঝ মন বলছে বহুবার, 'হাত তুলে ছুঁয়ে দাও, সে আমার চাঁদ।'
পূর্ণিমার চাঁদ। খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে চাঁদের কিরণ গায়ে মাখছে রোদেলা। সেহরিশ সামনে দৃষ্টি ফেলল মাথা তুলে আকাশটা একপলক দেখে কাশি দিয়ে শুক্ল গলা পরিস্কার করে স্পষ্ট ও কোমল গলায় বলল,
'The moon is beautiful, isn’t it?'
রোদেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল,
'উম্ম।'
সেহরিশ সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেলল। তারপর রোদেলার মুখের দিকে তাকিয়ে চমৎকারভাবে হাসলো। রোদেলা কিছু ভেবে সেহরিশের দিকে তাকাল। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
'বাবার সাথে কথা বলবেন?'
সেহরিশ তৎক্ষণাৎ জবাব দিল,
'হ্যাঁ। বলব।'
একটু পর সেহরিশ রুমে এলো। রোদেলা তার পিছু পিছু এসে হঠাৎ বলল,
'অনেক রাত হয়ে গেছে। আপনি কি এখন ঘুমাবেন?'
সেহরিশ বিছানার একপাশে বসে ল্যাপটপটা হাতে নিল। তারপর দৃঢ়ভাবে বলল,
'আমি দেরি করে ঘুমাবো। কিছু কাজ আছে। তুমি শুয়ে পড়ো।'
রোদেলা খাটের দিকে তাকিয়ে আছে। জোরে শ্বাস নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,
'আপনার কি ক্ষুধা লাগছে কিছু খেতে চান? আমি কি আপনার জন্য কিছু বানিয়ে আনবো?'
সেহরিশ ভ্রুকুটি করল। রোদেলার দিকে তাকিয়ে শুধল,
'তুমি বানাবে?'
'হ্যাঁ। আপনি আর আমি ছাড়া আর কেউ জেগে নেই। তাছাড়া আপনি রাতে ঠিকমতো খাবার খাননি এখন নিশ্চয় ক্ষুধার্ত?'
'ঠিক আছে, যাও। জলদি ফিরে এসো।'
রোদেলা জিজ্ঞেস করল,
'কী খাবেন? আমি কি বানাবো?'
সেহরিশ সহজভাবে বলল,
'তুমি যা চাও বানাও। তোমার হাতের সব খাবারই সুস্বাদু।'
রোদেলা রান্নাঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। অল্প সময়ে কি বানাবে? চিন্তায় বিহ্বল। মিনিট দশ পর পরম যত্নে খাবার তৈরি করতে লাগল। সময়ের দিকে তার খেয়াল নেই বললেই চলে। সেহরিশ একবার ফোনের দিকে তাকাল। রোদেলা গেছে ত্রিশ মিনিট হয়ে গেছে। এখনো ফিরে এলো না। সেহরিশ ল্যাপটপ রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সিঁড়িতে এসে দেখল আশেপাশের সব আলো জ্বলছে। ঠোঁট ঘুরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল সেহরিশ। রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। রোদেলা কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সে কাজ শেষ করতে চাচ্ছে, তত দেরি হচ্ছে যেন। সেহরিশ দরজার দিকে হেলান দিয়ে মৃদু হাসল। ঢাকনাটা খুব গরম, রোদেলা হঠাৎ গরম ঢাকনাটা ধরতে ছিটকে উঠল। সেহরিশ তাত্ক্ষণিক এগিয়ে এলো। সে রোদেলার হাত ধরে বেসিনে নামিয়ে আনলো। হাতে ঠাণ্ডা পানি পড়তেই রোদেলা কেঁপে ওঠে।
সেহরিশ কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
'রান্না করার এত অভিজ্ঞতা থাকার পর তারপরও হাত পোড়ালে কীভাবে? তোমার খেয়াল কোথায় ছিল?'
রোদেলা সেহরিশের দিকে তাকাল। সে সাথে সাথে মাথা নিচু করে নিচু গলায় বলল,
'আমার তেমন লাগেনি। আপনি আমার হাত ছাড়ুন।'
সেহরিশ তার হাত শক্ত করে ধরে গ্যাসের দিকে এলো। গ্যাস বন্ধ করার পর রোদেলার হাত ধরে রান্নাঘর বেরিয়ে সদরদরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। রোদেলা নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল,
'এত রাতে আমরা কোথায় যাচ্ছি?'
সেহরিশ রোদেলার দিকে তাকাল। গম্ভীর গলায় বলল,
'হাসপাতালে।'
রোদেলার পা হঠাৎ থেমে গেল। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে যেন এখুনি বেরিয়ে আসবে। অকপটে জিজ্ঞেস করল,
'হাত সামান্য লাল হয়েছে। এর জন্য হাসপাতালে যেতে হবে না। মলম লাগালেই হবে।'
সেহরিশ সোজা রোদেলার দিকে মুখ করে দাঁড়াল। রোদেলা দুই পা পিছিয়ে গেল সহসা মাথা তুলে দেখল সেহরিশ তার দিকে দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেহরিশ দৃঢ় ও গম্ভীর গলায় বলল,
'তোমার কোনো কিছুই সামান্য নয়।'
সেহরিশ একটু ঝুঁকে পড়ল। লোকটাকে প্রথমবার এত কাছে দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলল রোদেলা। শরীরে শুরু হলো ভয়ানক কাঁপুনি। সেহরিশ রোদেলার বন্ধুর চোখের পাতার দিকে তাকাল। তারপর বার দুয়েক চোখের পলক ফেলে হাসল। সেহরিশ আরও এক পা এগোল রোদেলার অনেক কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। রোদেলা হঠাৎ চোখ খুলে তাকাল সেহরিশকে এত কাছ থেকে দেখে সে হতবাক। সেহরিশ নরম গম্ভীর গলায় বলল,
'মাই বিউটিফুল ওয়াইফ! তুমি কি ভয় পাচ্ছ?'
রোদেলা এদিক ওদিক নিবিড়ভাবে মাথা নাড়ল। তারপর কোমল স্বরে বলল,
'না।'
সেহরিশ মৃদু হেসে বলল,
'কিন্তু আমি এখান থেকে তোমার হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি।'
রোদেলা জড়োসড়ো হয়ে এক হাতে শাড়ি খামলে ধরল। গলা শুকিয়ে গেছে তার। কপালে জমেছে ঘামের ফোঁটা, সেহরিশ অপ্রত্যাশিতভাবে রোদেলার কপাল স্পর্শ করল। টিস্যু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিল। রোদেলা আবার কেঁপে উঠল। শরীরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল তার। রোদেলা সেহরিশকে থামাতে চায় কিন্তু পারছে না। সেহরিশ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
'তুমি ঠিক আছো রোদ?'
রোদেলার ফর্সা গালদুটো লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কোনরকমে মাথা নেড়ে বলল,
'আমি ঠিক আছি।'
রোদেলা সেহরিশকে জিজ্ঞেস করতে চাইল, সে এখন রুমে যেতে পারবে কিনা? কিন্তু লজ্জার কারণে আর জিজ্ঞেস করতে পারলো না। রোদেলা সেহরিশের পাতলা ঠোঁটের দিকে তাকাল। গোলাপি ঠোঁট, আর গালে ছোট্ট ছোট্ট গোঁফ। সুদর্শন, সুঠামদেহি পুরুষের মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না রোদেলা। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলল। হঠাৎ কেমন লাগছে ওর? সেহরিশ ব্যাপারটা খেয়াল করে বলল,
'তুমি কি দেখছ রোদ?'
রোদেলা ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
'আমি রুমে যাব।'
সেহরিশ দুষ্টু হেসে বলল,
'তুমি ঘামছ কেন? আমি তো কিছুই করিনি।'
রোদেলার চোখ পিটপিট করছে। একটু পর সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সেহরিশ এক হাতে রোদেলার কব্জি ধরে অন্য হাতে দরজা খুলল। সে হঠাৎ চোখ তুলে পাশে দাঁড়ানো রোদেলার দিকে তাকাল। রোদেলা ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে বলল,
'আপনার তো ক্ষুধা লাগছিল। আর আমি আপনার জন্য খাবার বানাতে পারলাম না।'
সেহরিশ বলল,
'আমার এখন আর ক্ষুধা নেই।'
রোদেলাকে বিছানায় বসিয়ে সেহরিশ তার পায়ের কাছে বসল। সেহেরি রোদেলার হাতের গাঢ় লাল অংশে মলম লাগাতে শুরু করে। রোদেলা মৃদু কেঁপে উঠল। মলম লাগানোর পরপর হাত জ্বলতে শুরু করেছে। চিন্তাশীল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সেহরিশ,
'ব্যাথা করে?'
রোদেলা নরম গলায় বলল,
'না।'
রোদেলা মনোমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেহরিশ কে দেখতে লাগল। আবহাওয়া হঠাৎ বদলে গিয়েছে। ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রোদেলা সেহরিশের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা ম্লান কণ্ঠে বলল,
'বারান্দায় যাবেন?'
'এখন?'
'হুম।'
'বৃষ্টি পড়ছে ভিজে যাবে।'
রোদেলা মন্ত্রমুগ্ধভাবে বলল,
'ভিজবো না। বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখব।'
সেহরিশ বারান্দায় এসে রোদেলার পাশে দাঁড়াল। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। আজকে কেমন বিরক্ত হচ্ছে না সেহরিশ। আশ্চর্যজনক ভাবে বৃষ্টির ফোঁটা তার ভালো লাগছে। সবই আগের মতই আছে, মেঘ-বৃষ্টি, বৃষ্টিরফোঁটা, তবে আজ হঠাৎ করে ভালো লাগছে কেন শুধুই কী রোদ পাশে আছে তাই? সেহরিশ একবার ভাবল। তারপর সঙ্গে সঙ্গে রোদেলার দিকে চোখ রাখল সে। রোদেলার মুখে আর গলায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়েছে। চোখ বন্ধ করে রোদেলা আকাশের দিকে মুখোমুখি হয়ে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা অনুভব করছে। সেহরিশ রোদেলার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল দৃশ্যটি ভালো লাগল তার। সেহরিশের মনে হলো সে রোদেলার জন্য সবকিছু ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। সেহরিশ ফিসফিস করে বলল,
'আচ্ছা, আমি যদি তোমাকে একবার ছুঁয়ে দেই, তাতে কি তোমার খুব ক্ষতি হবে?'
সেহরিশ গিয়ে রোদেলার পাশে দাঁড়াল। রোদেলা হঠাৎ খেয়াল করল সেহরিশ তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রোদেলা জিজ্ঞেস করল,
'তাকিয়ে আছেন কেন? ওভাবে কি দেখছেন?'
জোরে নিঃশ্বাস ফেলল সেহরিশ কাতর স্বরে বলল,
'তোমাকে দেখি।'
.
.
.
চলবে....................................