শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৭১ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


‘ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছিস যে— পড়াশোনা নেই?’ 

তন্ময় ল্যাপটপ স্ক্রিনে চেয়ে থেকেই শুধাল। কণ্ঠের সুরে অনুভব করা যাচ্ছে একটুকরো সহায়হীনতার হদিস। ডিভানে ক্লান্ত শরীর আধশোয়া হয়ে এলানো। মোজা পরিহিত ডান পায়ের ওপর বাম পা-টা অলস ভঙ্গিতে আছে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অফিস ওয়্যার। ফর্মাল থ্রিপিস স্যুট। ক্লান্ত চোখদুটি তখনো ব্যস্ত ল্যাপটপ স্ক্রিনে। একটা গুরুত্বপূর্ণ ইমেইল পড়ছে। মাঝেমধ্যে কি-বোর্ড চাপা হাতের কনুইতে গুটিয়ে রাখা শার্টের হাতা দুটো। নিত্যকার গম্ভীরমুখো তাকে কাজকর্মের সময়তে চূড়ান্ত রকমের গম্ভীর লাগে দেখতে। অরু বুঝি সেই গম্ভীরমুখে তাকাতেই কুণ্ঠিতবোধ করল? গলার স্বর ভীত শোনালেও চঞ্চলতা সবসময়ের মতন বিরাজমান। ফিসফিস করে বলা আওড়ানো প্রত্যুত্তর খানা মৃদু স্বরের হলেও তন্ময় সু'স্পষ্ট শুনল,

‘আজ মেহেদি আর্টিস্ট আসবে। মেহেদি পরব —নাচব, গাইব, সারারাত জাগব। আনন্দ করব। এখন কি পড়ার সময়? সবাই কি আপনার মতন রসকষহীন নাকি? শুধু পড়া আর পড়া! বিয়ে বাড়িতে কোনো পড়াশোনা নেই। কেউ করে না। আর কাজ তো কখনোই না। কেউই করে না।’

কয়েকটি বাক্যতেই বিবৃতি দিলো অনেক বিষয় নিয়েই। 
প্রথমত বিয়ে বাড়ি এটি এবং আজ মেহেন্দি অনুষ্ঠান। মহারানি ভিক্টোরিয়া মেহেদি পরবে, গাইবে –নাচবে। এবং তন্ময় কেন কাজ করছে এই বিষয়তেই অত্যন্ত বিরক্ত। বুদ্ধিমান তন্ময়ের ছোটোখাটোর বিবৃতির সারমর্ম বুঝতে সময়ের প্রয়োজন হলো না। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি একপলক ল্যাপটপ স্ক্রিন ছেড়ে অরুর পানে রাখল। কারচুপির কাজ করা সবুজ রঙা কামিজ পরেছে। সিল্কের ওড়নাটা গলায় ঝুলানো। ফরসা নগ্ন পা'জোড়া ফ্লোর ছুঁয়ে আছে। ঠিক তার ডানপাশেতেই হাঁটছে মেয়েটা। এমন কনকনে ঠান্ডা ফ্লোরে নগ্ন পায়ে হেঁটে কী বোঝাতে চায়? কিছুক্ষণ পূর্বের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা এখন ভোঁতা করে রেখেছে। তন্ময় ফের ল্যাপটপ স্ক্রিনে দৃষ্টি ফেলে। অসহায় স্বরে বলে,

‘ফাঁকিবাজ! পড়াশোনার কথা বললেই যত ছুঁতো! গায়ে জ্যাকেট নেই। পায়ে মোজা—জুতো কিছু নেই। কেনো?’

অরুর মিনমিনে জবাব, ‘আমার ইচ্ছে। এমনিতেও আপনি ব্যস্ত মানুষ। আমার জুতো ছাড়া পা দুটো দেখার সময় কই?’ 

তন্ময় তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ফেলল অরুর নগ্ন পা দুটোতে। বাম পায়ে একটি রুপালি পায়েল পরে আছে। নিখুঁত আকার। পারফেকশন! দারুণ মানিয়েছে। আনমনাই হাসল তন্ময়। সে একান্ত আন্দাজে কিনেছিল ফিরবার পথে। এতটা দারুণ মাপ মতো হবে তা ভাবেনি। পাশে তাকিয়ে দেখল তার অফিস ব্যাগটা নেই। কখন নিয়েছে কে জানে? অরু আকুল কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘এনেছেন অথচ দেননি কেন?’

এহেন প্রশ্নে তন্ময়ের অসহায়ত্ব যেন কয়েকগুণে বাড়ল, ‘সময় দিয়েছিস?’

অরু ঘড়ির কাঁটা ধরে গুণে-গুণে সময় বলল, ‘আপনি এসেছেন দশ মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড হয়েছে।’

তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এসময়ে কলিং বাজল। অরু উতলা হয়ে ছুটতে চাইল দরজা খুলতে। তন্ময় বাঁধ সাধল সঙ্গে সঙ্গেই,

‘জুতো পরে নে।’

অরু বাধ্য মেয়ের মতন জুতো পরল। তবে তার আগেই দীপ্ত সিঁড়ি ভেঙে ছুটে এসেছে দরজা খুলতে। ইতোমধ্যে সকলেই জানে এসময় মেহেদি আর্টিস্টদের আসার কথা আছে। এসেছেও বোধহয়! তন্ময় কোট, ল্যাপটপ হাতে উঠে দাঁড়াল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নিয়েই দেখল শাবিহা, রুবিও নামছে ত্বরান্বিত। ওরাও সবুজ রঙের আউটফিট পরেছে। ইতোমধ্যে ভেতরে প্রবেশ করেছে একজন মেহেন্দি আর্টিস্ট। তার সাথে দু'জন অ্যাসিস্ট্যান্ট আর্টিস্টও এসেছে। মূলত মেহেন্দি অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল বাগিচায়। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানাচ্ছে— বৃষ্টি হবে সাতটার পরপর। সকাল দিকে অবশ্য ত্রিশ পার্সেন্ট দেখিয়েছিল। তাই তন্ময় বিষয়টায় গুরুত্ব দেয়নি। বিশ, ত্রিশ পার্সেন্টিজে বৃষ্টি তেমন একটা হয় না। অথচ বিকেল দিকে আবহাওয়ায় দেখাচ্ছে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা পঁচানব্বই পার্সেন্ট! তাই শেষমুহূর্তে লিভিংরুমের সোফাসেট সরিয়ে আয়োজন করা হয়েছে মেহেন্দি অনুষ্ঠান। তন্ময় ঘরে ফিরে ল্যাপটপ টেবিলে রাখল। কোট হেঙারে ঝুলিয়ে টাই খুলতে নিয়ে বারান্দায় এলো। বাগিচার বাতিগুলো জ্বলছে।
দেখা যাচ্ছে একেকটি ফুল— গাছ। শীতল হাওয়ার স্পর্শে তারা দুলছে। অপেক্ষা করছে হয়তো-বা বৃষ্টির। গুমোট আবহাওয়া প্রকৃতির বুকে। কালো মেঘের আকাশ নির্ঘুম। রাতজাগা চোখের মতন কালচে। হঠাৎ বজ্র পতনের তীব্র ধ্বনিতে মুখরিত হলো চতুর্দিক। তন্ময়ের হাতের উল্টোপিঠে এসে পড়ল এক ফোঁটা বৃষ্টির জল। কনকনে ঠান্ডা সেই জলের ঘনিষ্ঠ স্পর্শ। তন্ময় দাঁড়িয়ে থাকল অনেকটা সময়। ঝুম বৃষ্টি হতে সময় লাগল না। একমুহূর্তেই পরিপূর্ণ তাকে ভিজিয়ে দিলো।

সেলফোন বেজে চলেছে ক্রমান্বয়ে। গোসল শেষ করে তন্ময় আলসে ভাবেই বেরোল বাথরুম ছেড়ে। সুগঠিত কোমরে সফেদ তোয়ালে প্যাঁচিয়ে বেরিয়েছে সে। হাতেও শীর্ণ সফেদ তোয়ালে– সেটি দিয়ে মাথা মুছে নিচ্ছে অগোছালো ভঙ্গিমায়। সেমুহূর্তে বাজতে থাকা রিংটোন থেমে গেল। সেকেন্ড না গড়াতেই পুনরায় বেজে উঠল। এযাত্রায় সাইড টেবিল থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিলো তন্ময়। স্ক্রিনে ভাসছে মাহিনের নাম। তন্ময়ের কল রিসিভ করে কানে তুলতে দেরি— মাহিনের চ্যাঁচিয়ে উঠতে বিন্দুমাত্র দেরি হলো না,

‘দোস্ত, রিয়ানের কিছু একটা কর। প্লিজ! প্লিজ লাগে!’

বন্ধুর শোচনীয় কণ্ঠের বিপরীতে তন্ময় দুর্দান্ত নির্বাকার থাকল। স্পিকারে দিয়ে ফোনটা টেবিলে রাখল। কাবার্ড হাতড়াতে নিয়েই সাবলীল গলায় শুধাল,

‘কী হয়েছে?’

মাহিনের কণ্ঠজুড়ে হতাশা, ‘ও ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গেছে! হারপিক খেতে যাচ্ছিল। আমি কোনোরকমে বাঁচিয়েছি।’

ফোনের ওপর পাশ থেকে এবেলায় রিয়ানের অত্যন্ত বিরক্তে জর্জরিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল। হাপিত্যেশ করে উঠল সে,

 ‘তুই থামবি? প্লিজ?’

‘আমি কী মিথ্যে বলছি? তুই নিজের মুখে বল।’ মাহিনের দৃঢ়তম স্বরের প্রত্যুত্তর। 

‘নিজের মুখে নিজের বালের কথা বলব? শালা তুই চুপ থাক। আমার অভিশাপ নিস না।’ রিয়ান অতিষ্ঠ গলায় বলতেই, মাহিন পাল্টা প্রত্যুত্তর ছুঁড়ল,
‘তোর অভিশাপে আমার কী বাল হয় দেখতে চাই! তোর বুকের মধ্যে পাটা থাকলে মা র অভিশাপ।’

বাম হাত ঢোকাল ইব্রাহিম, ‘বুকের পাটা থেকে থাকলে মা র অভিশাপ। আমরা আছি সাক্ষী হিসেবে।’

তন্ময় যেন ওদের ঝগড়ুটে আলাপ শুনেও শুনছে না। সে আপনমনেই কালো রঙের টি-শার্ট দেহে পরে নিয়েছে। শুভ্রনীল ট্রাউজার পরে এগুল টেবিলে দিকে। রিয়ান তখন অসহ্য হয়ে উঠেছে। কণ্ঠ কাঁদোকাঁদো হয়ে গিয়েছে,

‘জ্বালাস না। এমনিতেই শুহানি কন্টাক্ট করছে না। বলে গেছে এবারে সত্যিকারের ব্রেকাপ!’

তন্ময় ফোন তুলে নিলো হাতে। স্পিকার সরিয়ে কানে চেপে বলল, ‘এমন সত্যিকারের ব্রেকাপ মাসে চারটা হয় তোদের। এবার নাহয় পাঁচটা হলো। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমা।’

মাহিনের উচ্চকণ্ঠের হাসি শোনা গেল। সৈয়দও যেন এইমুহূর্তে না হেসে পারল না। তাদের চাপা হাসির গুঞ্জনে রিয়ান ত্যক্তবিরক্ত! সবগুলো বদমাইশ নিশ্চয়ই মাহিনের বাসায়! সৈয়দ আওয়াজ তুলল এযাত্রায়,

‘এই তন্ময়! তুই আয় না! বাসায় কী করিস?’

তন্ময়ের জবাব দেবার প্রয়োজন পড়ল না। ইব্রাহিম উদাস গলায় বলে বসল, 

‘আজ শাবিহার ঘরোয়া মেহেদি অনুষ্ঠান। মেয়েমানুষ সব মেহেদি পরছে। ও আর বেরোতে পারবে নাকি? ওর বাচ্চা বউ দু'হাতে মেহেদি পরে এসেই ওকে খুঁজবে। যা দোস্ত তুই বউ সামাল দে।’ 

মাহিন অসন্তুষ্ট গলায় ফোড়ন কাটল, ‘তুই এতো ভালোভাবে জানিস কীভাবে?’ 

সৈয়দ দানবীয় ভঙ্গিতে হাসল, ‘তন্ময়কে জিজ্ঞাসা কর।’ কথাটুকু বলেই কল কেটে দিয়েছে ত্বরান্বিত। তন্ময়কে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগটুকু পর্যন্ত দেয়নি। তন্ময় হেসে ফেলল নিঃশব্দে। ইব্রাহিম ভুল বলেনি কিন্তু! অরু একঘণ্টার মধ্যে নিশ্চিত হাজির হবে মেহেদি পরে। অবশ্য সে অপেক্ষাতেও আছে। 

— — —

বারান্দার চার হাত দূরেই বুকশেল্ফে। বুকশেল্ফের সামনে ইজি চেয়ার আর টেবিল রাখা। অফিসের কাজ গুলো প্রায়সময় এখানেই সেরে নেয় তন্ময়। আজও ব্যতিক্রম নয়। দেওয়াল ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে সাতটা পঞ্চাশে। আটটা বাজতে চলল বলে। কফির মগ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। কফিটা মিনিটখানেক পূর্বেই দিয়ে গিয়েছে দীপ্ত। ডান হাতের পাশেই ফ্যাশন ম্যাগাজিন রাখা। ম্যাগাজিনটা অরুর পছন্দের। প্রায়শই বসে বসে দেখবে। আজ সকালেও বড়ো বড়ো চোখে মডেলিং করা ছেলে গুলোকে দেখছিল। এতো দেখার কী আছে? তন্ময় মুহূর্তেই ম্যাগাজিনটা ড্রয়ারে লক করে ফেলল। থাকবেও না দেখতেও পাবে না। বারান্দা থেকে ভেসে আসছে অঝোর ধারাময় বৃষ্টির রিমঝিম ধ্বনি। অনেকক্ষণ ধরেই বিরতিহীন বৃষ্টি ঝরছে। সারারাত বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা আছে। এসময়ে অরু বেহিসাবি পদচারণে ঘরে ঢুকল। কিচেন এপ্রোন পরিহিত তার ডান হাতে কাচের প্লেট। প্লেট খানা তন্ময়ের সম্মুখে রেখে গর্বিত কণ্ঠে বলল,

‘তন্ময় ভাই, টেস্ট করে দেখুন তো কেমন হয়েছে!’ 

তন্ময় আশ্চর্য চোখে অরুর মেহেদি বিহীন হাত দুটো দেখল। একপলক দেখল প্লেটের নতুন রেসিপি ফলো করে বানানো পাস্তার ডিশ। হতবাক কণ্ঠে প্রশ্ন বেরোল তার মুখ দিয়ে, 

‘মেহেদি পরিসনি যে?’

অরু টেবিলে হেলান দিয়ে তরতর করে বলে গেল, ‘শাবিহা আপুকে দু'জন আর্টিস্ট মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছেন। অন্যজন রুবি আপুকে। আমি সেই সুযোগে এই রেসিপিটা করেছি বড়ো মার সাহায্যে। খেয়ে দেখুন কেমন হয়েছে!’

অগত্যা তন্ময় কাঁটাচামচ তুলে নিলো অরুর প্রত্যাশিত জ্বলজ্বলে চোখের সামনে। অরু তৎক্ষণাৎ মাথাটা আরও নুইয়ে আনলো। তন্ময়ের মুখের একেকটি ভাবভঙ্গি পড়তে ব্যাকুল। তন্ময় অল্প একটু প্রথমে মুখে নেয়। অরুকে বিশ্বাস নেই। দেখা গেল খাবার লবণাক্ত। পূর্বেও অতিরিক্ত লবণ দিয়ে খাবার নষ্ট করার ওর ভালোরকমের রেকর্ড আছে। নির্বিকার মুখে খেয়েই সন্তুষ্ট হলো তন্ময়। ভালোই হয়েছে। তাই ত্বরিত জানাল,

‘ভালো হয়েছে।’

অরু হতাশ হয়। ম্লান গলায় শুধায়, ‘শুধু ভালো?’

তন্ময় ভেবেচিন্তে ফের বলে, ’খুব ভালো হয়েছে খেতে।’

এবারে অরু খানিক সন্তুষ্টা হয়। গদগদ গলায় জানায়, ‘তাই না? চাচ্চু খেয়ে বলেছেন আমার রান্নার কাছে বড়ো বড়ো রেস্টুরেন্ট ফেইল।’ 

তন্ময় আরেক চামচ মুখে নিয়ে খাচ্ছিল। এ-কথায় থতমত খেতেই—খাবার তালুতে ওঠে। কেশে উঠল সমানে। অরুও ভড়কে গিয়েছে। এমন প্রতিক্রিয়া আশা করেনি বোধহয়। আতঙ্কিত সে দ্রুত পানির গ্লাস এনে ধরেছে। তন্ময় ইতোমধ্যে শান্ত হয়েছে। পানির গ্লাস হাতে নিয়েছে তবে পান করেনি। কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে চোখ খুলে নির্বিকার ভাবে বলল,

‘হুঁ, ঠিক বলেছে বাবা।’

অরু কিছুটা সংকোচবোধ করল বুঝি? হাপিত্যেশ করল বেশ। হাঁসফাঁস করে আলগোছে বেরিয়ে গেল। তন্ময় কপালে আঙুল ঘেঁষে হেসে উঠল। অরুর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ খানা চোখের সামনে ভাসতেই– তার ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হচ্ছে! এই বুকবাঁধা আনন্দের জোয়ার, প্রাণোচ্ছল হাসি সবই তো এই একটা পাগলকে ঘিরে। নাহয় এভাবে তন্ময়কে কে হাসাতে পারে? কেইবা তাকে এতো নিয়মে মিষ্টিময় বিরক্ত করে?

আটটার পরপর বৃষ্টি থেমেছিল। রাত দশটার পর ফের নামে ঝুম বৃষ্টি। এখনো নেমে চলেছে অনবরত। তন্ময় ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। ল্যাপটপ বন্ধ করল। ফোনটা তুলে নিলো হাতে। অরুর মেহেদি দেয়া কী হয়নি? মেয়েটা সেই যে গেল আর এলো না! কেনো? এগারোটা প্রায় বাজতে চলেছে যে! তন্ময় টনটন করা কপালে আঙুল ঘষে রুম ছেড়ে বেরুল। করিডোরের রেলিং ছুঁয়ে নিচে তাকাল। লিভিংরুমে সবাই দিব্যি উল্লাসে মত্ত। অরুকে দেখা গেল পূর্বদিকে। দু’হাতে মেহেদি দিয়ে বসে আছে। গানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গান গাইছে, হাসছে —এমনকি হাসতে হাসতে শাবিহার গায়ের ওপর পড়ে যাচ্ছে। তন্ময় সেই দৃশ্যের কিছু ছবি তুলে ফেলল। অস্পষ্ট শোনা গেল রুবির কণ্ঠ,

‘কীরে অরু! বসে আছিস কেন? যা ভাইয়াকে দেখিয়ে আয়।’

আনোয়ার সাহেব টেলিভিশনে সংবাদ দেখছিলেন। তিনিও সুরে সুর মেলালেন, ‘যাও মামণি, ভাই–’ এখানে এসেই ভদ্রলোক থেমে গেলেন। সবসময়ের মতন বলতে নিচ্ছিলেন, ‘ভাইয়াকে দেখিয়ে এসো।’ তবে এখন তো ভাইয়া আর ভাইয়া নেই। হয়ে গিয়েছে ছাইয়া। তিনি গলা পরিষ্কার করে ফের বললেন, ‘তন্ময়কে দেখিয়ে এসো। যাও।’

মোস্তফা সাহেবের তীব্র দ্বিমত, ‘দেখানোর কী আছে এখানে?’

ওহী সাহেবের সন্দিহান জিজ্ঞাসা, ‘দেখালে কী হবে– ভাইয়া?’

ছোটো ভাইয়ের এরূপ জিজ্ঞাসায় অসন্তুষ্ট হলেন মোস্তফা সাহেব। জবেদা বেগম বেশ উৎফুল্লতার সঙ্গেই বলেন, ‘কী আছে, কী হবে —এসব বাদ। অরু দ্রুত যা।’

জয়তুন বেগমও মেয়ের তালে তাল মেলালেন, ‘আমার নাতিডারে দেখাইয়া আসো। হেয় বহুত পছন্দ করব। যাও যাও।’

অরু বুজুর্গদের আদুরে আহ্লাদের সম্মুখে বাধ্য মেয়ের মতন উঠে দাঁড়ায়। তন্ময় মিচকে দুষ্টুর ন্যায় নিজের রুমে ফিরে আসে সন্তর্পণে। যেন এসব আনন্দের সহিত উপভোগ করা পুরুষটি সে নয়। খুব আরামকরে ফের বসে চেয়ারে। একটি ফাইল সাবলীল ভাবে মেলে ধরে চোখের সামনে। অরু আসে অনেকটা সময় নিয়ে। দুয়ারপানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তন্ময়ের অ্যাটেনশন না পেয়ে ঘরে ঢোকে। টেবিলের কাছাকাছি পৌঁছে গলা খাঁকারি দিয়ে কাশে। জানাশোনা ভঙ্গিতে হাত দুটো দেখানোর পঁয়তারা করে যাচ্ছে। তন্ময় এবারে ফাইল রেখে চোখ তুলে চায়। অরু মুহূর্তেই হাত দুটো মেলে দেয়। তন্ময় হাসিটুকু গিলে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

‘এতক্ষণ তো আসতে চাচ্ছিলি না!’

অরু হতবিহ্বল হয়। তোতলানো গলায় আওড়ায়, 

‘আপনি নিচে এসেছিলেন?’
‘এখান থেকেই শুনলাম। যা জোরসে কথাবার্তা হচ্ছে!’ 

অরু মুহূর্তেই চুপসে যায়। হাত দুটো আরও এগিয়ে দেয়। তন্ময় দেখে নিগূঢ় দৃষ্টিতে। খুব সাধারণ একটি ডিজাইন করা হয়েছে ডান হাতে। ডিজাইনের মধ্যিখানের তালুর একাংশে খুব সুন্দর করে টি+এ লেখা ইংরেজিতে। বাম হাতের ডিজাইনের মধ্যে ছোটো করে ইংরেজিতে শুধু তন্ময় লেখা। তন্ময় সেই নাম খানা অনেকটা সময় দেখল। বুকের কোথায় যেন সুড়সুড়ি অনুভূতির সংমিশ্রণ অনুভাব হলো। সেই অনুভূতির স্রোতে গা ভাসাতে মন মরিয়া। তন্ময় উঠে দাঁড়িয়। নাম দুটো দেখেনি এমন হাবভাবে বলে,

‘সুন্দর হয়েছে।’

অরু পুনরায় হাত দুটো মেলে ধরে তন্ময় দু’চোখের সামনে ‘আর কিছু দেখছেন না? হুঁ? মধ্যের ডিজানটা দেখুন। কী চমৎকার তাই না?’

তন্ময় উদাসীন যেন, ‘চমৎকার। সুন্দর ডিজাইন।’

‘ভালোভাবে দেখুন না। এইযে ডিজাইনের মধ্যে দেখুন। ছোটো করে আরও ডিজাইন করা। দেখুন।’ অরুর কণ্ঠে আকাশসম আকুলতা। দৃষ্টি জুড়ে চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা। তন্ময় আর নির্বিকার রইতে পারে না। স্মিত হেসে ফেলে। ওর মেহেদি শুঁকিয়ে আসা হাতটা সে আলতোভাবে ধরে। চোখের সামনে তুলে বুড়ো আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয় তাদের একত্রিত নাম অক্ষরের ওপর। অরু চটে যায় মুহূর্তেই,

‘দেখেও না দেখার ভাণ করছিলেন?’ বলেই হাতটা ছাড়ানোর তীব্র প্রচেষ্টা। তন্ময় চটজলদি ওর অভিমানী দু'হাত নিজের পুরুষালি হাতে গুছিয়ে নেয়। অরু বাঁকাচোখেতে চেয়ে আদেশ ছুঁড়ে,

‘আপনার হাতেও লিখতে হবে আমার নাম। আসুন আমি লিখে দিই।’

অরু টেবিল থেকে বলপেন আনল। তন্ময়কে বসিয়ে সেও পাশে বসল। বেশ মনোযোগ দিয়ে তন্ময়ের রুক্ষ ডান হাতের তালুতে নিজের নামটা লিখে ফেলল। একটি ছোটো লাভ আঁকতেও ভুলল না। বারান্দা থেকে তখন ভেসে আসছে বৃষ্টির ধ্বনি। ঠান্ডা, শীতল হাওয়ারা। একগুচ্ছ ফুলেদের ঘ্রাণ। 
.
.
.
চলবে...................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন