আশিয়ানা - পর্ব ৫৭ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


আকাশে দিশাহীন সাদা মেঘ উড়ছে। হালকা হালকা দক্ষিণা বাতাস। সকাল মাত্র নয়টা। রোদেলা সবে স্নান সেরে বেরিয়েছে। একটা সাদা শাড়ি পরা। চুলগুলো কোমর পর্যন্ত লম্বা। চুল থেকে পানি পড়ে মেঝে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। রোদেলা ঘুরে ফিরে তাকায়। চোখের সামনে সুন্দর সুঠামদেহী সেহরিশ দাঁড়িয়ে আছে। প্রশস্ত বুক-পিঠের আস্তরণ সহ একটি কালো টি-শার্ট। সেহরিশ এগিয়ে গেল। রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলল, 
  'তোমার পাসপোর্ট এবং টিকিট নাও, দুই দিন পর আমাদের ফ্লাইট, তুমি যা নিতে চাও গুছিয়ে নাও।'
রোদেলা ইতস্তত করলে সেহরিশের ভ্রু কুঁচকে গেল। সে বলল, 
  'কিছু বলতে চাও?'
  'জি।'
  'কি?'
  'জোজো। আমি তাকে অনেক দিন দেখিনি, আমার মামি তাকে পছন্দ করেন না। ঠিকমত খেতে দিচ্ছে কি না? আমি তাকে নিয়ে চিন্তিত।'
সেহরিশ বলল, 
  'জোজো ভালো আছে। সে এখন চৌধুরী বাড়িতে আছে। সেখানে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর জোজো একা নয়, তার সাথে আরেকটি কুকুর আছে।'
রোদেলা বলল, 
  'ওঁরা চৌধুরী বাড়িতে কিভাবে গেল?'
দৃঢ়ভাবে বলল সেহরিশ,
  'সে তোমার বন্ধু, তাকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য।'
রোদেলা চুপ করে আছে। সেহরিশ চাপা গলায় বলল,
  'মামা-মামিকে দেখতে চাও? তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তুমি তাদের দেখতে চাও।'
  'মামি যদি আমার সাথে কথা না বলে বা আমাকে অপমান করে?'
সেহরিশ ঠোঁটে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
  'তুমি এখন ওই গ্রামের চার-পাঁচটা মেয়ের মতো সাধারণ নও। চৌধুরী বাড়ির পুত্রবধূ ও সেহরিশ ফাতিন চৌধুরীর স্ত্রী, আমার সামনে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার সাহস কার আছে?'

রোদেলা ঠোঁট চেপে ধরে হাসল। সে হঠাৎ খুশি বোধ করছে। কিন্তু এর কারণ কী? মামা বাড়ি যাবে এজন্য না-কি সেহরিশ তার পক্ষে কথা বলেছে সেজন্য? 
দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল সেহরিশ,
  'তৈরি হও। কিছুক্ষণের মধ্যে সিরাজগঞ্জ যাব, ফিরে এসে কাপড় গুছিয়ে নিও।'

রৌদ্রোজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরেছে রোদেলা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধল। সিঁড়ির কাছে আসার পর সেহরিশ চিৎকার করে বলল, 
  'সাবধান, পড়ে যাবে।'
রোদেলা সিঁড়ি দিয়ে নামল। 
সেহরিশ বলল,
  'যাও গাড়িতে বসো। আমি আসছি।'
 
গ্রামের রাস্তায় গাড়ি চলছে। রোদেলার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। কেন এমন লাগছে? মনে হচ্ছে আজ বহু বছর পর গ্রামে যাচ্ছে। বুক ধড়ফড় করছে উত্তেজনায়। রোদেলাকে দেখে এগিয়ে আসে ছোটো ছেলে মেয়ে গুলো। আপু আপু বলে কোমর জড়িয়ে ধরে।

উঠোনে বসে আছে পুতুল। হঠাৎ বাচ্চাদের আওয়াজ শুনে তিনি উঁকি দিতে এলেন। রোদেলাকে দেখে সে একটু হাসল। শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নিল। সেহরিশ প্রথমবারের মতো মামার বাড়িতে এসেছে। খাবারের জন্য ফল ও অনেক কিছু আনছে। দুজন গার্ড গাড়ি থেকে প্যাকেটগুলো নামিয়ে ভেতরে নিয়ে যান। আর দু'জন প্রহরী বন্দুক নিয়ে সেহরিশকে ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলার চাচাতো ভাই বন্দে গেছে, রোদেলার আসার কথা শুনে বাড়ি ছুটে গেল। রোদেলা তার ছোট ভাই সামিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
  'কেমন আছিস ভাই? আমাকে তো ভুলে গেছিস।'
  'আমি কি তোমাকে ভুলতে পারি? আমি তোমাকে সব সময় মনে করি। তুমি কোথায় গিয়েছিলে?'
  'সে তোর বড় ভাই। সালাম দে।'
সামির কৌতূহল তৃপ্ত করে সেহরিশ কে জিজ্ঞেস করল,
  'তুমি গান গাও? একটা গান করো?'
সেহরিশ হতভম্ব হয়ে গেল। সে হাসতে চেষ্টা করে বলল, 
  'কাছে এসো।' সামির এল। সেহরিশ মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
  'আমি তোমার জন্য অনেক মজা এবং গাড়ি নিয়ে এসেছি। ওখানে রাখা আছে, দেখে নাও।'
সামির ছুটে গেল। রোদেলা বলল,
  'এখন বলার কি দরকার ছিল?'
  'আমি ওর জন্য নিয়ে এসেছি। এখন বলা বা পরে বলা একই কথা।'
  'এক না। এখন সে সেই জিনিস নিয়েই পড়ে থাকবে।'
  'সে তার নিজের জিনিস নিয়ে থাকবে। আমি এখানে সমস্যা দেখতে পারছি না। তুমি অতিরিক্ত চিন্তা করছ। তার বয়স কত? আট বা নয় বছর এই বয়সে খেলাধুলা না করে কী করবে?'

পুতুল বেগম, মেয়ে ও জামাইকে ভালো সমাদর করছেন। ওরা আসার আগে বলে আসলে ভালো খাবার রান্না করতো হঠাৎ ওরা চলে এলো। এখন কি করবেন? বুঝতে পারছেন না পুতুল বেগম সহসা ঠাণ্ডা পানি দিয়ে শরবত বানিয়ে নিয়ে এলেন। গাছ থেকে তাজা ডালিম ফল ছিঁড়ে, বীজগুলি তুলে একটি পাত্রে করে সামনে দেয়। ফ্রিজে মাংস আছে, বালতিতে ভিজিয়ে রাখল। বরফ ছুটলে রান্না চাপাবেন।

রোদেলা চিন্তিত গলায় বলল, 
  'সে কি আমার মামি?'
সেহরিশ ভ্রুকুটি করল। বলল,
  'হ্যাঁ। কেন? চিনতে পারছ না?'
রোদেলা একটা সহজ স্বীকারোক্তি দিল,
  'না। মামি অনেক বদলে গেছে। কিভাবে?'
সেহরিশ মৃদু হেসে বলল,
  'মানুষ পরিবর্তনশীল। তারা বদলাতে সময় নেয় না, কিছু পরিবর্তন হয় ভালোর জন্য আর কিছু খারাপের জন্য।'
রোদেলা ভ্রুকুটি করল। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
  'মামি কি জন্য হয়েছে?'
সেহরিশ পুতুল বেগমের দিকে তাকাল, সে কাজ করছেন। সেহরিশ বলল,
  'ভালোর জন্য, মনে হয়।'
রোদেলা হাফ ছেড়ে দিল। বলল,
  'যেহেতু আপনি বলেছেন, তাহলে ঠিকই বলেছেন।'
  'আমার উপর এত বিশ্বাস?'
প্রশ্ন শুনে থমকে গেল রোদেলা। সেহরিশের দিকে তাকিয়ে দেখল সে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রোদেলা একটা শুঁকনো ঢোক গিলে বলল, 
  'আপনাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। আপনার উপস্থিতি আমাকে প্রশস্তি দেয়। মন বলে, আমি শুধু আপনার কাছেই নিরাপদ।'
সেহরিশ চোখ বন্ধ করে হাসল। ওর হাসি দেখে রোদেলা মুচকি হাসল।

বিকেলে রওনা হওয়ার কথা থাকলেও ওঁরা আজ গাজীপুরে ফিরতে পারেনি। বিকেলে মাসুদ মিয়া বাড়িতে এসে মেয়ে ও জামাইকে দেখে খুশি হন। সম্বিত হারান, কি রেখে কি করবেন উত্তেজনায়। সেহরিশের আগমন শুনে বাড়ির সামনে ভিড় জমান অসংখ্য ভক্ত। গার্ডদের রক্ষায় কেউ বাড়িতে প্রবেশ করতে পারেনি। রাত ৮টায় চৌধুরী বাড়িতে চলে আসলো ওরা। যাওয়ার আগে সেহরিশ তার মাকে দেখতে চায়। রোদেলা অনেকক্ষণ জোজোর সঙ্গে বসে গল্প করল। জোজো এখানে খুব ভালো আছে। তার শরীরের ওজন বেড়েছে। জোজো কে নিয়ে আর কোন চিন্তা নেই। রাত দশটার দিকে ঘরের ভেতরে এল রোদেলা । ড্রয়িংরুমে একা বসে আছেন শফিকুল চৌধুরী। রোদেলা গিয়ে তার পাশে বসল। 
  'বাবা, আপনার কি হয়েছে?'
শফিকুল চৌধুরী রোদেলার দিকে তাকাননি। শান্ত গলায় বললেন,
  'দুদিন পর ছেলে চলে যাবে। দেশে এসে তিন মাস থাকল, আমার চোখের সামনে থেকেও সে একবারও আমাকে বাবা বলে ডাকেনি।'
শফিকুল চৌধুরীর চোখ ভিজে গেল। চোখের জল লুকানোর জন্য হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে চলে গেল।

সেহরিশ রুমে ঢুকল। রোদেলা ঘরে নেই। সে তাকে খুঁজতে বারান্দায় এসেছে। রোদেলা উদাস চোখে তারার আকাশের দিকে তাকায়, সেহরিশ একবার আকাশের দিকে তাকায় আবার রোদেলার দিকে ফিরে। সেহরিশ চোখ সরু করে বলল,
  'চাঁদের মতো সুন্দর স্বামীকে রেখে দূর আকাশে কী দেখছ?'
রোদেলা তার দিকে তাকাতে আগ্রহ পেল না। সে উদাস ও সরল কণ্ঠে বলল, 
  'আপনি এমন কেন?'
সেহরিশ উদগ্রীব হয়ে বলল,
  'কেমন?'

 প্রশ্ন শুনে রোদেলা থমকে গেল। খুব নিবিড়ভাবে সেহরিশের দিকে তাকাল। কপালের চুলগুলো এক হাত দিয়ে কানের পেছনে গুঁজে রেখে আছে। তারপর বলল,
  'বুঝেন না কারো মনের কথা। এত বছর ধরে কেউ আপনার জন্য কষ্ট করছে, আপনি তা দেখছেন না।'
  'কে কষ্ট করছে?'
রোদেলা হালকা করে হাসতে চেষ্টা করল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, 
  'আপনার বাবা। আপনি দেশে ফিরেছেন কিন্তু বুড়ো লোকটার সাথে কোনো কথা বলেন নি। সে কি কষ্ট পায় না?' বলে থামল রোদেলা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল, 
  'আপনার বাবা আছে তাই আপনি তার মূল্য বোঝেন না। আমার বাবা-মা নেই। বাবা-মা না থাকার কষ্ট ও যন্ত্রণা আমি বুঝি। আমি কিছু চাইব, দিবেন?'
সেহরিশের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রোদেলা। সেহরিশ ভ্রুকুটি করল। 
  'বলো।'
  'কাল আমরা যখন গ্রাম ছেড়ে যাব, যাওয়ার আগে বাবার সঙ্গে কথা বলবেন, বাবা বলে একবার ডাকবেন। এই প্রথম আপনার কাছে কিছু চাইছি, খালি হাতে ফিরিয়ে দিবেন না।'
শান্ত গলায় বলল সেহরিশ,
  'তুমি আগেও একবার চেয়েছিলে এটা প্রথমবার নয়।'
সেহরিশের মুখে চাঁদের আলো পড়ে। চাঁদের আলোয় চকচক করছে ওর ধবধবে ফর্সা শরীর, রোদেলা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করল,
  'কি?'
  'জোজো।'
রোদেলা অবাক গলায় বলল, 
  'জোজোকে?'
সেহরিশ মুখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। ভ্রু নাচিয়ে নরম গলায় বলল,
  'মনে নেই? আমি জোজোকে দুই দিনের জন্য আমার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম, প্রথম রাতে তুমি সাদাফকে নিয়ে আমার বাসায় গিয়ে প্রথমবারের মতো জোজোকে চাইলে।'
.
.
.
চলবে....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন