উত্তর দিকে গ্লাস দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাসে পর্দাগুলো সামান্য দুলছে, আকাশে বিশাল এক চাঁদ। গ্লাস গলে এক চিলতে জ্যোৎস্নার রজনী এসে আছড়ে পড়ল মেঝের উপর, ছোট ছোট করে পা ফেলে এখানটায় এসে দাঁড়াল রোদেলা। তার লম্বা কেশ থেকে টুপটুপ করে পানি পরছে মেঝেতে, সহসা আকাশের দিকে তাকাতেই প্রথমে নজরে এলো একফালি চাঁদ। সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নিল রোদেলা। মনে হচ্ছে তার এই রাতের সাক্ষী সে চাঁদ তাকে দেখে হাসিতে লুটিয়ে পড়ছে সে। ইশশ, কি লজ্জা! রোদেলা দু-হাতে মুখটা আড়াল করে ফেলল, এই লজ্জা রাখা মুখ সে আর চাঁদকে দেখাতে চায় না। হঠাৎ কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করলো সে। দু'টো হাত আচমকা তার উন্মুক্ত পিঠে নড়াচড়া করছে। একটু পর রোদেলা টের পেল সেহরিশ নিজ হাতে তার ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে দিচ্ছে। সেহরিশ নরম গলায় বলল,
'ভেজা চুল খুলে রেখেছ কেন? শাড়ির অনেকটা পেছন দিক থেকে ভিজে গেছে। চেঞ্জ করে নাও, ঠান্ডা লাগবে।'
রোদেলা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো,
'আপনি এখনো ঘুমাননি?'
সেহরিশ সোজাসাপটা উত্তর দিল,
'তোমার বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। তোমাকে ছাড়া ঘুম আসবে না।'
রোদেলা খানিকটা লজ্জা পেল। রোদেলা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল। একহাতে জানালার পর্দা টেনে দিতে লাগল। সেহরিশ জিজ্ঞেস করলো,
'বাহিরে এতো সুন্দর জ্যোৎস্না ফুটেছে দেখেছো পর্দা দিয়ে ঢেকে দিচ্ছো কেন?'
রোদেলা নিচু গলায় বলল,
'আমার লজ্জা করছে।'
'কেনো?'
রোদেলা তার দুই আঙুলে পর্দার এক কোণা পেঁচাতে লাগল। তারপর পূর্বের ন্যায় নিচু বলল,
'আমার মনে হচ্ছে চাঁদ আমাদের দেখছে আর আমাদের এইসময় ভাবে দেখে ও অনেক হাসছে তাই আমার লজ্জা করছে।'
সেহরিশ হেসে উঠল। তার হাসির আওয়াজ রোদেলার কানে পৌঁছালো। চট করে মাথা তুলে তাকাল রোদেলা, এক নজর স্বামী নামক মানুষটার অমায়িক হাসিটা দেখল সে। সেহরিশ ঠোঁট চেপে একটু হাসল তারপর বলল,
'চাঁদ আমাদের দেখে হাসি তামাশা করবে কেন? সে তো হিংসে করছে, আমার কাছে তার চেয়ে সুন্দর, অপরূপ রোদ যে রয়েছে। চাঁদের রোদের প্রয়োজন হয় তবেই না সে জ্যোৎস্না নিয়ে উঠতে পারে কিন্তু রোদের চাঁদের আলোর প্রয়োজন নেই। তুমি নিজেই রোদ সূর্যের উজ্জ্বল আলোকরশ্মি।'
রোদেলা কি বলবে? ভেবে পেল না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে অপলকভাবে তাকিয়ে রইল সেহরিশের দিকে। সেহরিশ অনেকক্ষণ চুপ থাকল তারপর হুট করে বলল,
'আমি কখনো কিছু হারানোর ভয় পাইনি। কিন্তু আজকাল তোমাকে হারানোর ভয় আমাকে তারা করে। তোমাকে হারানোর ভয় সব সময় লেগে থাকে।' বলে থামল সেহরিশ তারপর ভারী নিঃশ্বাস ফেলে আবারও বলল, 'রোদ?'
রোদেলা এলোমেলো কণ্ঠে জবাব দিল,
'হুম।'
সেহরিশ আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। দু-হাতে রোদেলার হাত শক্ত করে ধরলো সে। রোদেলার হাতখানা তার গালে রেখে নরম গলায় বলল,
'এখন মনে হয় তোমাকে ছাড়া আমি এক মূহুর্তও থাকতে পারব না। আমার সারাক্ষণ তোমাকে চাই। তুমি আমার জীবনের প্রথম নারী নও রোদ, কিশোর জীবনে একবার প্রেম এসেছিল তারপর আর ভাবিনি আমার জীবনে দ্বিতীয় কোনো নারী আসবে। আমার ভাবার সীমানা অতিরিক্ত করে তুমি এসেছো আর আমার জীবনের সবটা দখল করে নিয়েছ। আমি একটু একটু করে তোমার মাঝে পুরোটা ডুবে গেছি। রোদ?'
সেহরিশের শেষ ডাকে রোদেলা লহু কণ্ঠে বলল,
’হুহ।'
সেহরিশ আলতোভাবে রোদেলার হাত তার গালে ঘষে নিয়ে কাতর গলায় বলল,
'তুমি পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকবে আমি তোমাকে খুঁজে নেব। শুধু আমায় কখনো ছেড়ে যেও না। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।'
রোদেলা এগিয়ে এলো। সেহরিশ কে মিশিয়ে নিল নিজের সঙ্গে। খানিকক্ষণ এভাবে চুপ থাকল সে। সেহরিশ বলল, 'তোমাকে কোমোতে রেখে আমার রোমে থাকাটা আমার ভীষণ যন্ত্রণা দিতো বারবার মনে হতো তুমি ঠিক আছো তো? সারাদিনে হাজার বার ডোনা কে কল করে তোমার খোঁজ নিয়েছি, কোথায় আছো? কি করছ? ওখানে সব ঠিক আছে তো? তোমার সুরক্ষার জন্য তোমাকে আমার কাছাকাছি থাকতে হবে। এজন্য আজ থেকে আমরা এই বাড়িতেই থাকব। আশা করি তোমার এখানে সমস্যা হবে না। তুমি টেনশন করো না তোমার আশেপাশে সারাক্ষণ লোক থাকবে। আর আমি তো আছি!'
রোদেলা আলতোভাবে সেহরিশের পিঠে হাত রাখল। তারপর উপর নিচ হাত নেড়ে বলল,
'আপনি শান্ত হন। আমি কোথাও যাচ্ছি না। আপনার আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি আপনার সঙ্গে আছি আর থাকব।'
সেহরিশ হালকা হাসল। তারপর প্রফুল্ল গলায় বলল,
'আমার সঙ্গে বুড়ো হবে? বৃদ্ধ বয়সে দুজন এক সঙ্গে এই শহরের অলিগলিতে হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াবো।'
রোদেলা বলল,
'হুম।'
রোদেলা বিমূঢ় হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
'আপনার এই বাড়ি কী গ্লাস দিয়ে তৈরি?'
সেহরিশ তর্জনী আঙুল দিয়ে কপাল চুলকে জিজ্ঞেস করলো,
'মানে?'
'যেদিকে তাকাচ্ছি সব দিকে শুধু গ্লাস। এভাবে তো মানুষ আমাদের দেখবে আমরা কখন কি করছি।'
সেহরিশ মৃদু হেসে বলল,
'মানুষ দেখবে না। কারণ এই গ্লাস বাহির থেকে ভেতরের কিছু দেখা যায় না আর ভেতর থেকে বাহিরের সব কিছু দেখা যায়। তোমাকে আমি দিনে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাব। আশা করি এখানে তুমি হারিয়ে যাবে না।'
রোদেলা অকপটে বলে ওঠে,
'মানুষের বাড়ি হয় আর আপনার বাড়ি তো নয় যেনো আস্ত এক ভুলভুলাইয়া।'
সেহরিশ অবাক হলো পরোক্ষণে সশব্দে হেসে উঠল।
রোদেলার ভেজা চুল থেকে পানি ঝরা বন্ধ হয়ে গেছে। তোয়ালেটা খুলে চুলগুলো হালকা ঝেরে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল সে। শাড়ি পেছন থেকে ভালোই ভিজেছে চিপচিপে ভাব আসছে একটা। শাড়ি চেঞ্জ করতে হবে। আলস্যে শরীর চলছে। একপলক ঘড়িতে সময় দেখল রাত তিনটা ছুঁইছুঁই! ঘুমে শরীর ঢলে পড়ছে তার ওপর আবার ক্ষুধাও পেয়েছে। সেহরিশ রুমে নেই। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে শাড়ি চেঞ্জ করার কথা ভাবলো রোদেলা। আলমিরা থেকে একটা শাড়ি বের করে পরতে যাবে সে মূহুর্তে সেহরিশ রুমে এলো। তার হাতে একটা ট্রে ওর মধ্যে রয়েছে কিছু শুঁকনো খাবার। রোদেলা কিছু জিজ্ঞেস করার আগে সেহরিশ বলল,
'অনেক রাত হয়েছে ঘুমানোর আগে কিছু খেয়ে ঘুমাও।'
রোদেলা মাথা ডানে-বামে দুলিয়ে শাড়ি নিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়াল। সেহরিশ হাতের ট্রেটা টেবিলের ওপর রেখে সোফায় বসল। রোদেলাকে যেতে দেখে হঠাৎ বলল,
'কোথায় যাচ্ছ?'
রোদেলা ঘুরে সরু চোখে তাকাল। তারপর বলল,
'শাড়ি চেঞ্জ করার জন্য বাথরুমে যাচ্ছি।'
সেহরিশ খানিকটা নড়েচড়ে বসল। ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে বলল,
'এখানেই চেঞ্জ করো আমি একটু দেখি।'
সেহরিশের কথার অর্থ রোদেলার বুঝতে কিছুটা সময় লাগল সহসা তার কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। লজ্জায় নাক, মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। সেহরিশ কুটিল হাসলো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
'এখানে দাঁড়াও আমি শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছি।'
রোদেলা দুপা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
'না না আমি পরে নেবো। আপনি বরং ফ্রেশ হয়ে আসুন। তারপর একসাথে খাবার খাবো।'
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
'ঠিক আছে। তাহলে তুমি রুমে চেঞ্জ করো আমি স্নানে যাচ্ছি।'
রোদেলা শাড়ি চেঞ্জ করে হাতে-হাতে খাবার বেড়ে সোফায় বসল। এরইমধ্যে সেহরিশ বেরিয়ে এলো রোদেলার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো সে। ভেজা তোয়ালে চেয়ারে রেখে এগোল। রোদেলার পাশাপাশি বসে তারপর নরম গলায় বলল,
'আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোমাকে।'
রোদেলা আমতা আমতা করে বলল,
'আমি নিজে খেতে পারব।'
সেহরিশ তার তর্জনী আঙুল রোদেলার ওষ্ঠদ্বয়ে রেখে বলল,
'হুঁশশ, আমি বলেছি আমি খাইয়ে দেব।'
তাত্ক্ষণিক রোদেলা মাথা নিচু করে ফেলল। সেহরিশ খাবার খাওয়ানো শেষ করে ট্রে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ট্রে রান্নাঘরে রেখে ফিরে এসে দেখল রোদেলা বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সেহরিশ ডান থেকে বামে মাথা নেড়ে বলল,
'কাল থেকে তোমাকে একটুও জাগিয়ে রাখব না।'
রুমের লাইটগুলো অফ করে রোদেলার কাছাকাছি এলে সেহরিশ। খাটের একপাশে বসে রোদেলার ঘুমন্ত মুখটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এভাবে কাটলো এক মিনিট তারপর দুই মিনিট তারপর অনেকটা সময়। সেহরিশ মুচকি হেসে রোদেলার দিকে ধীরে ধীরে ঝুঁকে এলো। তারপর হাতখানা রাখল রোদেলার নরম গালে শুঁকনো ওষ্ঠাধর ছুঁয়ে আলতো ভাবে রোদেলার কপোলে চুমু খেল সেহরিশ।
.
.
.
চলবে...........................................