রাগান্বিত বেশে বিছানায় বসে আছে আরহান। পাশেই শান্ত বসা। সে তার চোখের চশমা খুলে টেবিলে রেখেছে। এখনও ফর্সা গালটায় পাঁচ আঙুলের দাগ স্পর্শ। কি পরিমান জোরে থাপ্পড় মেরেছিল গালে! আরহান শান্তর দিকে ঘুরে তাকাল। শান্ত মাথা নুইয়ে আছে। আরহান শান্তর গালে হাল্কা স্পর্শ করতেই সে চমকে উঠল। ছ্যাঁত করে উঠল বুঝি। আরহান কাতর কণ্ঠে শুধায়,
“জ্বলছে খুব?”
শান্ত মাথা নাড়ায়। যার অর্থ, 'না।'
“মিথ্যে বলছিস?”
বিতৃষ্ণা ভরা কণ্ঠে জানাল আরহান। শান্ত কিছু বলল না। তৌহিদ এগিয়ে আসল তখন। নিজের রুমে গিয়েছিল সে। ড্রয়ার খুলে মলম নিয়ে আসল। গালটা কেটে গেছে। তৌহিদ দ্রুত মলম এগিয়ে দিয়ে বলল, “নে, শান্তকে লাগিয়ে দে।”
আরহান দেরি করল না। দ্রুত মলম লাগাতে ব্যস্ত হলো। শান্ত তার দুই বন্ধুর দিকে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে। দুজনের চোখেই অস্থিরতার ছোঁয়া। বোধহয় সে তাদের ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সামান্য গালটাই তো কেটেছে এত অস্থির হওয়ার কি আছে! শান্ত মলিন হাসল। মনে মনে তার খুব আনন্দ লাগছে। তৌহিদ অবাক হয়ে বলল, “তুই হাসছিস কেন?”
শান্তের চোখ জোড়ায় তখন প্রশান্তির রেশ। ঠোঁট জুড়ে মলিনতার হাসি। সে মাথা নাড়িয়ে আওড়ায়, “কিছুই না।”
••••••••••••
রাত তখন গভীর! ঝুম ঝুম শব্দে বাহিরে বর্ষণ নেমেছে। আচমকা বর্ষণ। ঘন কালো মেঘে ঢেকেছে প্রকৃতি। তীব্র বায়ুতে বালু জমেছে ভূরি ভূরি। অরিন এসে দাঁড়াল বারান্দার সামনে। তার এত দুঃখ লাগছে। নিজেকে বড্ড অপরাধী ঠেকছে। কিভাবে এতবড় ভুলটা করে বসল সে! অরিনের ইচ্ছে করছে নিজের গালে নিজেই ঠাস করে দুটো থাপ্পড় মারতে। খামোখা কয়েকদিন যাবৎ একটা ছেলেকে ঘৃণা করে আসছিল। কাল যে করেই হোক শান্তর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। পরশু অরিন চলে যাবে। যদি ক্ষমা না চাইতে পারে তাহলে কিছুতেই শান্তি পাবে না। ভুল যেহেতু করেছে ক্ষমা তো চাইতেই হবে সেটা যে করেই হোক। অরিন বৃষ্টির পানিতে হাত ভেজাল। বৃষ্টির ঠান্ডা পানির স্পর্শে তার সর্বাঙ্গ যেন শীতল হয়ে উঠল। খাঁড়া দিয়ে উঠল হাতের পশম। কিছু ভালো লাগছে না। চেঁচিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাঁদা যাচ্ছে না। অরিনের এই হলো এক সমস্যা অতি দুঃখেও সে কাঁদতে পারে না। আকাশের ঘন কালো মেঘগুলোর দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর তাকাল অতিথি নিবাসের বন্ধ কপাটখানার দিকে। কারো দেখা নেই। কপাটের পাশ দিয়ে শুধু ছোট্ট একখানা লাল লাইট জ্বলছে। কি সুন্দর! বৃষ্টির ফোঁটাগুলো দ্বিধাহীন বাড়ির উঠোনটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। আশেপাশে কারো ছায়া নেই। সবাই বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে। অথচ অরিনের চোখে ঘুম নেই। শান্তর সাথে বড়ই অন্যায় করা হয়েছে। খুব বড় অন্যায়। নীরব দীর্ঘশ্বাস বের হলো হঠাৎ।
“কিরে ঘুমাবি না?”
হঠাৎই ফাবিহার কণ্ঠ শুনে পিছন ঘুরল অরিন। শান্ত স্বরে জবাব দিল, “হুম ঘুমাব তো।”
ফাবিহা এগিয়ে আসলো। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসলো। হাই তুলে শুধাল,
“ঘুমাবিই যখন– তখন এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
অরিনের মনমরা কণ্ঠের উত্তর,
“ঘুম আসছে না।”
“খারাপ লাগছে?”
“হুম।”
“খুব?”
“তেমনটাই।”
“কিছু ভেবেছিস?”
“ক্ষমা চাইব।”
“সুন্দর ভাবনা। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। তুইও ভুল করেছিস। শান্ত ভাইয়া খুব ভালো মনের মানুষ। আশা রাখি সে তোকে ক্ষমা করে দিবে।”
“আমি না বুঝে ওনায় আঘাত করেছি।”
“কষ্ট পাস না। মাফ চেয়ে নে। দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।”
আর উত্তর আসলো না। মেঘের হাঁকডাক শোনা গেল শুধু।
•••••••••••
সকাল হতেই আকাশ চুইয়ে রোদ্দুর চিঁড়ে আলোর দেখা মিলল। তীব্র বাতাসের ছড়াছড়ি ছিল চারিপাশে। ভার্সিটির প্রাঙ্গনে তখন মানুষের আনাগোনা। তৌহিদ এসে দাঁড়াল সেই প্রাঙ্গণে। সে বন্ধ দিয়েছিল মাত্র দু'দিন না যেন তিনদিন। অথচ মনে হচ্ছে কতকাল যেন আসা হয়নি। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ভিতরে পা রাখল তৌহিদ। এক মিষ্টি সুরেলা বাতাস তাকে ছুঁইয়ে মাথার চুল নাড়িয়ে দিল।'
ভিতরে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল মোহনার সাথে। মেয়েটা এদিকেই হেঁটে আসছে। তৌহিদ বেশি ভাবল না চলে যাচ্ছিল আপন মনে। মোহনা তাকে দেখা মাত্র সালাম দিল। তৌহিদ উত্তর দিয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে গেল। মোহনা ভেবেছিল স্যার বোধহয় দাঁড়াবে। কিন্তু দাঁড়াল না। তার মন খারাপ হলো। কিছু কথা বলার ছিল। বলতে পারল না। চলে গেল নিরাশ হয়ে।'
ঘড়ির কাঁটায় তখন বারোটা পয়তাল্লিশ। তৌহিদের ক্লাস তখন শেষ। সে তার বইটা টেবিলের ওপর থেকে নিয়ে বলল,
“আচ্ছা আজকে তাহলে এই পর্যন্তই আবার পরবর্তী ক্লাসে আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে। ততক্ষণ সবাই ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।”
হাসিমুখে বেরিয়ে গেল তৌহিদ। তৌহিদ বের হতেই নিজের আসন থেকে একপ্রকার দৌড়ে বেরিয়ে আসলো মোহনা। ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে চেঁচিয়ে বলল, “স্যার, আপনার সাথে কিছু কথা ছিল?”
কারো কণ্ঠ শুনে তৌহিদ দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছন ফিরে তাকাল তক্ষৎণাৎ। মোহনা এগিয়ে আসলো। তৌহিদ তার পানে তাকিয়ে। মোহনা জলদি পায়ে হেঁটে এসে বলল, “স্যার, আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?”
তৌহিদ তক্ষৎণাৎ উত্তর দিল না। চুপ করে রইল। মোহনা তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তৌহিদের হাবভাব বোঝা যাচ্ছে না। মোহনা আবার প্রশ্ন করে,
“স্যার রাগ করেছেন?”
এবার উত্তর আসলো। তৌহিদ সাবলীল কণ্ঠে উত্তর দিল, “আমাদের মধ্যে রাগ করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেছিল কি?”
মোহনা মাথা নুইয়ে ফেলল। অপ্রস্তুত কণ্ঠে জানাল,
“না মানে স্যার..।”
“আমার তো এমন কোনো ঘটনার কথা মনে পড়ছে না যাতে করে আমি আপনার ওপর রাগ হতে পারি।”
“না আসলে হয়েছিল কি স্যার? আমার আপার বিয়েতে আপনাকে আমার পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেইনি। এইজন্য আরকি..?”
“না আমি ওসব বিষয়ে রাগ হইনি। তবে বরের জায়গায় আমার জুতো চুরি করার ব্যাপারটায় আমি বড্ড অবাক হয়েছি।”
দাঁতে কামড় দিল মোহনা। বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তাকাল তৌহিদের দিকে। আয়হায় ধরা পড়ে গেল তাহলে। মোহনা দাঁত কামড়ে বলল,
“ওটা মিস্টেক ছিল বিশ্বাস করেন। কিভাবে কি হয়ে গেল বুঝতে পারিনি? সামান্য ভুলের জন্য হাজার টাকা মিস হয়ে গেল।”
হাসল তৌহিদ। খুবই মায়াময়ী হাসি। মোহনা বলল,
“আমি যখন জেনেছিলাম দুলাভাইর জুতোর বদলে আপনার জুতো নিয়ে এসেছি ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল আপনি খালি পায়ে গাড়িতে উঠে বসেছিলেন তাই আর ফেরত দিতে পারিনি। ওই ঘটনার জন্য আমি সাদরে দুঃখিত স্যার।”
“ইট'স ওকে। এখন ক্লাসে যান। আমি কোনো বিষয় নিয়েই রাগ করিনি।”
মোহনা খুশি হলো। হাসিমুখে জানাল,
“ধন্যবাদ স্যার। ভালো থাকবেন।”
চলে গেল মোহনা। তৌহিদও আর না ভেবে এগিয়ে গেল নিজ কক্ষের দিকে।
•••••••••••••
আজ দুপুর হতেই আরজের স্টুডিওতে বের হলো আরহান। আকাশটা মেঘে ঢাকা ছিল। সকালের রোদ্দুরখানা তখন নিভে গেছে প্রায়। আরহান যাওয়ার আগে বলে গেছে, “সাবধানে থাকিস শান্ত।”
শান্তও হাসিখুশি মুখে মাথা নাড়িয়েছে শুধু। পুরনো একটা ভাঙাচোরা রেডিও। রেডিওটা শান্তর বাবার। তিনি বেশ কয়েকবছর আগে মারা গিয়েছেন। শান্ত তার বাবাকে খুব ভালোবাসতো। যার দরুন এই ভাঙাচোরা রেডিওটা সঙ্গে নিয়ে ঘোরে। আজ হঠাৎ ইচ্ছে করছে রেডিও শুনতে। যদিও শান্তর শ্রবণশক্তি খুব একটা পাকাপোক্ত নয়। তবুও সে অল্পস্বল্প শুনতে পায়। ভাবছে রেডিওটা ছাড়বে। আবার ভাবল থাক। একটা পুরনো কাপড় দিয়ে রেডিও মুছতে ব্যস্ত হলো। রেডি হাতে ছুঁটে গেল পিছনে। এর আগে আঁটকে নিল অতিথি নিবাসের সামনে কপাটখানা। কেউ তো নেই বাড়ি— সে একাই।
সময়টা তখন বিকেলের কাছাকাছি। বাড়ির পিছনের বারান্দায় নিজের লেখা একটা বইহাতে বসে আছে শান্ত। চায়ের কাপখানা মেঝেতে বসে । এবারের বইটা হাতে পাওয়ার পর ছুঁয়ে দেখা হয়নি। তাই ভাবল আজ একটু ছুয়ে দেখবে। দুপুর থেকে একা একা সময় কাটাতে ভালো লাগছে না আর।
কপাটে কড়া নাড়ল কেউ। মেয়েলি কণ্ঠ। সে বিব্রত কণ্ঠ জানাচ্ছে, “ভিতরে কেউ আছেন? আমি কি ভাবে ভিতরে আসব?”
উত্তর পাওয়া গেল না। দু'বার কপাটে আঘাত হানতেই সেটা খুলে গেল। রমণী বুঝতে পারল কপাটখানা আগে থেকেই খোলা ছিল। তবুও আওয়াজ করল অরিন। বলল, “ভিতরে আসব?”
এবারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অনেক ভেবে অরিন ভিতরে পা রাখল। বুকের ভেতর কেমন যেন টিপটিপ করছে। শেষমেশ সরি বলতে পারবে তো। এ জীবনে এখন পর্যন্ত অরিন কাউকে সরি বলেনি। আজই প্রথম। অরিন ভিতরে ঢুুকেও কারো সাড়াশব্দ পেল না। কেউ কি নেই! নিশ্চয়ই কেউ একজন আছে। সবাই কোথাও গেলে নিশ্চয়ই তালাবদ্ধ করে যেত। অরিন অতি ভয়, অতি আগ্রহ, আর বিস্মিত এক অনুভূতি নিয়ে চলে গেল বাড়ির পিছনে।
.
.
.
চলবে......................................................................