রৈনীলকে ছাড়াই আমার জগতে আমি বেশ ভালো আছি। ভার্সিটি, ফারাহ'র সঙ্গে আড্ডা আর কন্টেন্ট ক্রিয়েশন, এই মিলে আমার দিনগুলো ভীষণ রঙিনভাবেই কাটছে। একদিন ক্লাসে গিয়ে নতুন করে দুজন মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। হুট করে ওরা একদিন আমার বাসায় এসে হাজির। কখনো আসতে বলিনি, শুধু বাসায় পৌঁছানোর সময় ওদের সঙ্গে ফিরেছিলাম। ব্যস আমার বাসাটা ওরা চিনে রেখেছে। অন্যদিন ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে ওরা আমাকে রিসিভ করতে এসেছে।
পুরো জীবনে বাসায় আমার বন্ধুবান্ধব এসেছে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। শেষ বার আমার বাসায় বন্ধুরা এসেছিল আমি যখন স্কুলে পড়ি। তাও আমার জন্মদিন উপলক্ষে দলবেঁধে এসেছিলো ওরা। আমার মা সেদিন খুব বিরক্ত হয়েছিলেন ওদেরকে দেখে। তাই এবার আমার বন্ধুরা আসামাত্র আমি ওদেরকে আমার রুমে এনে বসালাম।
ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ডেজার্ট বের করে খেতে দিলাম ওদের। জানতে চাইলাম ওরা নাস্তা করেছে কিনা। ওরা দুজনেই মাথা নাড়লো। কেউই নাস্তা করে আসেনি। আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। যারা ব্রেকফাস্ট করেনি তাদেরকে ডেজার্ট দিয়েছি খেতে, নিজের কাণ্ডে নিজেরই হাসি পাচ্ছে।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখি গরুর মাংস ভুনা, পরোটা, হালুয়া আর ফ্রুটস কাটা আছে। সবই আজকের নাস্তার আইটেম। আমাদের খাওয়াদাওয়ার পরও অনেকখানি রয়ে গেছে। আমি নিজেই ওদেরকে আমার রুমে নাস্তা পরিবেশন করলাম। ওরা নাস্তার পদ দেখে খানিকক্ষণ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? তোমরা মাংস খাও না?
'খাই। কিন্তু এগুলো কার জন্য? বাসায় কি মেহমান এসেছে?'
'না তো।'
'তোমরা বাসায় এগুলো খাও?'
'হ্যাঁ। কেন? কোনো সমস্যা? আজকে আইটেম কম হয়েছে।'
'এখানে কম হয়েছে?'
আমি অনেক্ষণ আশ্চর্য হয়ে ওদের দিকে চেয়ে রইলাম। সমস্যা কোথায় বুঝতে পারলাম না। ওদেরকে বারবার জিজ্ঞেস করার পর ওরা বললো, আমরা মেসে কি খাই জানো? পাতলা ডাল দিয়ে শক্ত শক্ত রুটি, কোনোদিন পাউরুটি ডিম। আর বেশিরভাগ দিন তো নাস্তা করিই না। আজকেও না খেয়ে বের হয়েছি।'
'ওহ।'
আমার মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেলো। ইচ্ছে করছে রোজ ওদেরকে বাসায় এনে আমার সঙ্গে নাস্তা খেতে বলি। আমার বাবা ভোজনরসিক মানুষ। কমবেশি প্রতিদিনই বাসায় বিলাসী খাবারদাবার রান্না হয়। কিন্তু আমার মা বাসায় মেহমান আসা পছন্দ করেন না। আজকের ঘটনায় উনি কতটা বিরক্ত হন সেটাও আমার ধারণার বাইরে।
আমার বন্ধু রুশা বললো, আন্টি বাসায় নেই?
'আছেন। মা রুমে।'
'ওহ আচ্ছা। আন্টি কি ঘুমাচ্ছেন?'
'দেখি জেগে আছেন কিনা।'
আমি লজ্জা পেয়ে উঠে এসে মায়ের দরজায় নক দিলাম। মা ভেতরে যেতে বললেন। মৃদু স্বরে বললাম, 'মা, আমার দুজন বন্ধু এসেছে।'
'তো?'
'ওদের সঙ্গে দেখা করলে ভালো হতো। ওরা অনেক খুশি হতো।'
মা কয়েক সেকেণ্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি বেশ বিব্রত বোধ করলাম। এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন আমি বড় ধরনের কোনো অপরাধ করে ফেলেছি। বিষয়টা আমার ভালো লাগছে না। কিছু না বলে বের হয়ে এসে ওদেরকে বললাম, মায়ের শরীরটা খারাপ। রেস্ট নিচ্ছে।
'আমরা দেখে আসি আন্টিকে?'
আমি কী উত্তর দিবো ভেবে পাচ্ছি না। সম্মান রক্ষার্থে বললাম, হুম শিওর।
ওদেরকে নিয়ে এলাম মায়ের সঙ্গে দেখা করাতে। মায়ের দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, আসবো মা?
মা ভেতর থেকে উত্তর দিলেন, 'তোমার বন্ধুদের কাজ শেষ হলে ওদের চলে যেতে বলো। ওরা কেন এসেছিলো?'
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না। কোনোমত বললাম, 'ওরা তোমাকে দেখতে এসেছে। আমরা কি ভেতরে আসবো?'
আমার বন্ধুরা আমার হাত টেনে ধরে বললো, 'না থাক রে। আজকে আর ভেতরে না যাই। আন্টির হয়তো শরীর বেশি খারাপ। চল আমরা বের হই।'
দ্রুত বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য ওরা তাগাদা দিলো। আমি ব্যাগ নিয়ে বের হলাম। ওরা জিজ্ঞেস করলো, 'তুমি কি গাড়ি নিয়ে যাবা? তাহলে আমরা দুজন রিকশায় যাই?'
ওরা একে অপরকে সায় দিলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, না না। আমিও তোমাদের সঙ্গে রিকশায় যাবো।
একটা রিকশা নিয়ে উঠে পড়লাম আমরা। কিন্তু পুরোটা পথ আমি লজ্জায় কোনো শব্দ করতে পারলাম না। ওদের সঙ্গে কথা বলার মতো মুখটাও যেন আমার নেই। কিভাবে এই মুখ ওদেরকে দেখাবো? লজ্জায়, অপমানে, ঘৃণায় আমি যেন ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যেতে লাগলাম।
তবে আমার বন্ধুরা বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে বলতে যথেষ্ট চেষ্টা করলো যেন কিছুই হয়নি। ওরা সবকিছু সহজ করার চেষ্টা করছে তাই আমিও স্বাভাবিক হওয়ার ভাব করলাম।
তবে সত্যি বলতে বন্ধুদের কাছে এভাবে অপমানিত হবার পর আমার মায়ের ওপর থেকে সমস্ত শ্রদ্ধা মুহুর্তেই উবে গেছে। আমি নিজেও এখানে ছোট হয়েছি, আমার মা ছোট হয়েছেন, একইসাথে আমার বন্ধুরাও অপমানিত হয়েছে। আমি আজও বুঝতে পারিনা কেন মা আমার সঙ্গে এমন করেন!
বাসায় ফিরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসে রইলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে ভাত খাবো না।
হঠাৎ আমার মনে হলো মা হয়তো রৈনীলকে সেদিন অপমান করার দরুণ সে আমাকে এভোয়েড করেছে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে আমার ধারণা কতখানি সঠিক। কিন্তু রৈনীলকে ফোন দিতে একদমই ইচ্ছে করছে না। তাহলে তার কাছেও ছোট হয়ে যাবো আমি।
রাত্রিবেলা বাবা বাসায় ফিরলে আমি গিয়ে তাকে বললাম, 'আমি কি তোমাদের নিজেদের সন্তান?'
বাবা নিষ্পলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, 'তোমাদের যদি আমাকে এতই অপছন্দ, তাহলে আমাকে বাসা থেকে বের করে দাও। কিংবা বিয়ে দিয়ে দাও। আর কোনোদিন আসবো না তোমাদের বাসায়। কিন্তু এভাবে আমাকে আর মেন্টাল টর্চা*র করো না। প্লিজ। আমার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু। আমি কোনোদিন কিছু বলিনি। কিন্তু আজকাল কষ্টগুলো আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। আর পারছি না আমি বাবা।'
কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। নিজের সাহস দেখে নিজেই আমি অবাক হচ্ছি। আগে কোনোদিন বাবা মাকে এভাবে বলার মতো দুঃসাহস হয়নি। কিন্তু রৈনীলকে ভুলে যাওয়ার কষ্টটা যেন আমাকে খানিকটা দুঃসাহসিক বানিয়েছে। ক্ষোভটুকু ঝাড়ার পরে কিছুটা শান্তি অনুভব করলাম।
বাবা আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য বেশ কয়েকবার ডাকলেন। আমি দরজা খুললাম না। কেউই আর ডাকলো না আমাকে ভাত খেতে। রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।
সকাল সকাল উঠে একটা ভিডিও শ্যুট করলাম। ততদিনে আমার ফলোয়ার্স সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে। দিনশেষে এটাই এখন আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অনুপ্রেরণা।
তবে এই অনুপ্রেরণাও বেশিদিন টিকতে পারলো না। একদিন হঠাৎ বাসায় সবাই জেনে গেলো আমার কন্টেন্ট ক্রিয়েশন সম্পর্কে। এবার বাবাও বিরোধিতা করলেন। আমাকে পাবলিকের সামনে চেহারা দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করতে হবেনা, ইত্যাদি ইত্যাদি শুনিয়ে খুব বোঝালেন। আর মায়ের সঙ্গে তো বহুদিন ঠিকমতো কথাই হয় না। এবার তিনি দ্বিতীয়বারের মতো আমার ফোনটা নিয়ে গেলেন।
নিজের জীবনে এতটুকুও শান্তি কোথাও নেই। সামান্য কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের জগতে নিজেকে একটু ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করেছিলাম। ভীষণ আবেগ নিয়ে নিজের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম। সেই প্রচণ্ড প্যাশনটুকুও এক ঠুনকো ঝড়ে উড়ে গেলো। আমার নিজের বলতে এখন আর কিছুই নেই। কেউই নেই। যেন ধূ ধূ মরুভূমির মাঝে আমি এক নিঃস্ব ভিখারিনী।
.
.
.
চলবে.........................................................................