তুমি রবে নীরবে - পর্ব ২৮ - নাদিয়া সাউদ - ধারাবাহিক গল্প


কথাটুকু বলেই রওনকের হাত ছেড়ে দাঁড়াল কুহু। ঠোঁটের হাসিটুকু ধরে রেখেই ফের নাচ আরম্ভ করলো গানের তালে তালে।

'আয় আয় আয়রে সখী আমার সনে আয়'
'এলো চুলে সিঁথি কেটে আদর দিব গায়'
'দুই চোখেতে আষাঢ় শ্রাবণ ভিজবি যদি আয়'
'বুকের ভেতর কাল বোশেখী কালো মেঘের ছায়'

রওনক স্তব্ধ হয়ে গেল কয়েক মুহুর্তের জন্য। কুহুর অত্যন্ত নিখুঁত ভঙ্গিমা তাকে বাকরুদ্ধ করলো। আলতো করে সরু কোমড় দুলিয়ে দু-হাত নাড়িয়ে খুব দক্ষতার সঙ্গে নাচছে মেয়েটা! গানের প্রতিটা লাইন তরঙ্গের মতো কানে বাজছে রওনকের।যেন তার মনের অব্যক্ত কথাগুলো সুরের সাথে গেয়ে চলছে কেউ! অদ্ভুত এক অনুভূতি তার পুরুষ সত্তাকে জাগিয়ে তুলল! আদুরে দৃষ্টি নিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। নাচে মনোযোগী কুহুর হাত চেপে ধরে। হঠাৎই থেমে যায় কুহু। জিগ্যাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।গভূর ঘোরলাগা দৃষ্টি রওনকের।ফিনফিনে চুলগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। পরিবেশ শীতল অনুভব হলো কুহুর।হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল!মন বোধহয় অনুভব করলো কিছু।ততক্ষণে কুহুকে টেনে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিল রওনক।যেন আষ্টেপৃষ্টে বক্ষপিঞ্জরের পুরে নিবে। কলেজে ঘটে যাওয়া কাহিনিটা বিদ্যুৎতের মতো মস্তিষ্কে খেলে গেল কুহুর।অত্যল্পকালে ভয়ংকর শিহরণ তুলল তনুময় জুড়ে।ততক্ষণে রওনক দু'হাত পেছনে নিয়ে কুহুর কোমড় জড়িয়ে নিল।দৃষ্টি নিচু করল কুহু।একহাতে কুহুর কোমড় বেঁধে রাখা ওড়নাটা খুলে নিল রওনক।খানিক কেঁপে উঠলো কুহু! আশ্চর্য ব্যাপার তার আজ কোনোই দ্বিধা কাজ করছে না! এই পুরুষের ছোঁয়া তার অতি আপন আপন লাগলো!মন জানে এই ছোঁয়ায় কোনোরকম হিংস্রতা নেই! কোনো জোরজবরদস্তিও না! এতদিনে রওনক ভাইকে এটুকু চেনা হয়ে গেছে।শক্ত বুকে নিশ্চুপ লেগে রইল কুহু।কিঞ্চিৎ লজ্জা কাজ করছে তার।যত্ন করে কাঁধের পাশ থেকে চুল সরিয়ে দিল। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,

"এই রূপে আমি বারংবার নিজেকে ভেঙ্গেচুরে গুড়িয়ে ফেলি!নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাই! মিষ্টি এক যন্ত্রণা আমাকে কুঁড়ে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত।মনের আত্নচিৎকার যদি শুনতে তবে দূরে সরে থাকতে পারতে না!তুমি কি গানের কথাগুলো শুনেছ কুহু? বুঝে থাকলে তুমি অবশ্যই এই মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা বুঝতে সক্ষম হবে!

কথা বলার সময় রওনকের উষ্ণ নিশ্বাস গলার পাশ ছেঁয়ে যাচ্ছিল কুহুর।বরফের মতো জমে গেল সে।অজানা এক ভাললাগা ভেতরে জলোচ্ছ্বাস বইয়ে দিল! রওনক ভাই তাকে ভালবাসতে শুরু করেছে? এত সুন্দর করেও তবে মনের বৃত্তান্ত প্রকাশ করা যায়? বিয়ের পর থেকে একটু একটু টের পেয়েছে কুহু।রওনক ভাই আগের মতো তার পায়ে পা লাগিয়ে জগড়া করে না। বরং যত্ন নিয়ে আগলায়! কুহুর বোকা মন বোধহয় ভালবাসার সুন্দর অনুভূতিটুকু বুঝতে পারছে।খানিক মাথা উঁচু করে রওনকের চোখের দিকে তাকিয়ে সোজা প্রশ্ন ছুঁড়লো সে,

" এতগুলো কথা বলার মানে কি দাঁড়ায় রওনক ভাই? তাহলে বলতে চান আপনি আমায় ভালবাসেন?

কুহুর কথা শুনে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো রওনকের।এই বোকামোতে সে অভ্যস্ত।মেয়েটার নিষ্কলুষ, মায়াবী মুখটাই তো তাকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছে! কুহুর কপালে টুক করে একটা চুমু খেয়ে বলল রওনক,

"ভালোবাসা মুখে ব্যক্ত করা যায় না।তোমাকে অনুভব করে নিতে হবে বোকা মেয়ে! আমি মুখে লক্ষ, হাজারবার ভালবাসি বলতে পারবো।তবে সেটা বুঝে নিতে হবে তোমার।কোনটা পুরুষের প্রকৃত ভালবাসা আর লালসা সেটা একটা মেয়েই উপলব্ধি করতে পারে।

রওনকের চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে আছে কুহু।সামনে থাকা পুরুষটা তাকে ভালবাসে এতে একচুলও সন্দেহ নেই!সেটা রওনক ভাইয়ের মুখ থেকে শুনে অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে তার।মোবাইলে গান শেষ হয়ে অন্য আরেকটা গান প্লে হলো।দুজনের মনোযোগ কেবল দু'জনাতে।আচমকা কুহুকে কোলে তুলে নিল রওনক।কুহু ডান হাত রাখলো রওনকের শক্তপোক্ত বুকে।অত্যল্পকালে বাইরে শুরু হলো তুমুল বষর্ণ।কুহুকে খাটে নামিয়ে দিয়ে জানালা বন্ধ করতে ছুটলো রওনক।খাটের পাশ ভিজে যাচ্ছে।পানির ছাঁট গায়ে লাগতেই শরীর শিরশির করে উঠলো কুহুর।হাঁটু তুলে তাকিয়ে রইল সে রওনকের দিকে।থাই লাগিয়ে দিয়ে পর্দা টেনে দিল রওনক।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই কুহুর চোখে চোখ পরলো।ঈষৎ হেসে ফিরে আসলো রওনক।মাথা নিচু রেখেই বলল কুহু,

" আমার ভয় লাগছে রওনক ভাই।

কথাটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো রওনকের।কুহুর পায়ের দিকে দৃষ্টি পরতেই দেখলো নক দিয়ে বেড শিট খুঁটছে।মেয়েটার ভেতর ঠিক কি চলছে এই মুহূর্তে বুঝতে বাকি নেই রওনকের।কুহু কি তবে মন থেকে সম্পূর্ণই মেনেছে তাকে? ভাবতেই বিশ্ব জয় করা আনন্দানুভূতি হলো।মাথায় চট করেই একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল তার।কয়েক পা ফেলে কুহুর পাশে এসে বসলো রওনক।হঠাৎ ফোন খুঁজতে লাগলো কুহু।সামনে থেকে ফোন তুলে নিয়ে বলল রওনক,

"এই তো ফোন! চোখের সামনেই ছিল।

" ও, হ্যাঁ।আরিয়ান তো বলেছিল তাকে ফোন দিতে। আমি কথা বলে আসি।

কুহু নামার জন্য উদ্যত হতেই বাঁধ সাধলো রওনক।কুহুকে চেপে ধরে বালিশে শুইয়ে দিয়ে হাত দিয়ে আঁটকে রাখলো।সটান হয়ে শুয়ে রইল কুহু।ড্যাবড্যাবে দৃষ্টি নিয়ে তাকাল রওনকের চোখে।মুখের কাছে ঝুঁকে আছে সে।গম্ভীর ভরাট স্বরে বলল রওনক,

"ভয় কেন পাচ্ছ বললে না তো।

এরুপ প্রশ্নে থতমত খেল কুহু।অপ্রস্তুত হয়ে বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো।আমতাআমতা করে বলল,

" মা...মানে ওই যে বাইরে ঝড়তুফান হচ্ছে না? আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! কখন জানি বজ্রপাত হয়! তা...তাই ভয় লাগছে আরকি।

কথাগুলো বলে চোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কুহু।বুকে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ! বেশ বুঝতে পারছে রওনক ভাই ইচ্ছে করে এই প্রশ্নটা করেছে তাকে জব্দ করতে।মনে মনে খুব রাগ হলো কুহু।আচমকা বজ্রপাত হলো।চিৎকার দিয়ে চোখমুখ খিঁচিয়ে নিল কুহু।তৎক্ষনাৎ দু'হাতে জড়িয়ে নিল দীর্ঘকায় পুরুষকে।কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর বলল রওনক,

"ভয় কিসের? আমি তো আছি।

রওনকের বুকে মুখ রেখেই সঙ্গে সঙ্গে বলল কুহু,

" আপনাকেই তো ভয়!

"কেন? আমি কি বাঘ নাকি ভাল্লুক? খেয়ে ফেলবো তোমাকে?

সরে আসতে চাইলো কুহু।অনুভব হলো দু'টো শক্ত হাতে আবদ্ধ সে।বেফাঁস কি বলে ফেলল এখন বুঝতে পারছে।চোখমুখ কুঁচকে নিয়ে বলল,

" আপনি খুব অসভ্য! মিনমিনে শয়তান।

হতাশার স্বরে বলল রওনক,

"আমার মতো সভ্য পুরুষকে তুমি অসভ্যের তকমা দিচ্ছ! সভ্যতা বজায় রাখতে নিজের অনুভূতির সঙ্গে যুদ্ধ করি, নয়তো এই রণক্ষেত্র তোমার সঙ্গে ঘটে যেত নির্বোধ মেয়ে!

রওনককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল।চোখমুখ কুঁচকে বলল,

" সরুন, আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করার ইচ্ছা নেই আমার।

মুহূর্তে শব্দ করে হেসে ফেলল রওনক।তার হাসি যেন থামছেই না।কুহু বোকার মতো তাকিয়ে রইল।তবে এই পুরুষের হাসি তাকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মুগ্ধ করে দিল।নিজেকে ধাতস্থ করে কুহুকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নিল রওনক।কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু আওয়াজে বলল,

"নির্ভয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারো তুমি।কথা দিচ্ছি আমি সেচ্ছায় হেরে যাব! নিজের সমস্ত আবেগ, অনুভূতি লুটিয়ে দিব তোমার পায়ের কাছে!

রওনকের কৌশলগত কথা বুঝতে বাকি নেই কুহুর।এই ছেলে আসলেই একটা নির্লজ্জ, অসভ্য।বার বার কথা দিয়ে কুহুকে লজ্জায় ফেলছে।চুপ করে রইল কুহু।আচমকা গলার পাশে পেলব ওষ্ঠের ছোঁয়া পেতেই কেঁপে উঠলো সে! সমস্ত তনুময় জুড়ে লোমকূপ গুলো গুঞ্জন তুলল!ভারী নিশ্বাসের শব্দ কানে বেজে উঠলো।পুরুষালি প্রগাঢ় স্পর্শে নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না কুহু।জড়িয়ে ধরলো রওনককে।অত্যল্পকালে কুহুর মাঝে উন্মাদের মতো ডুবে গেল রওনক।কোনোরকম বাঁধা, নিষেধাজ্ঞা জারি না দেখে মন বুঝে নিল মেয়েটা আজ সম্পূর্ণই নিজেকে উজার করেছে তার জন্য! অন্যরকম এক ভালো লাগার আবেশ ছুঁয়ে গেল রওনককে।শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শে ক্রমেই কেঁপে উঠছিল কুহু। মুখ তুলে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে কুহুর অধরোষ্ঠে গভীর ভাবে ওষ্ঠ দ্বারা ছুঁয়ে দিল।তাৎক্ষণিক চোখ বুজে ফেলল কুহু।হৃৎস্পন্দন থেমে গেল তার।গভীর স্পর্শের যে খুব ভয়ংকর অনুভূতি হয়! শরীর মৃদু কাঁপতে লাগলো কুহুর।রওনকের হাত অবাধ্যের মতো ছুঁটলো কুহুর তনুময় জুড়ে! ওষ্ঠে দন্তাঘাত পেতেই দ্রুত চোখ মেলে তাকাল কুহু।রওনকের চোখে চোখ পরলো।অন্যরকম এক ঘোর লাগা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সে।কপালে পরে আছে এলোমেলো চুল।অসম্ভব মায়া মায়া কাজ করছে!ঠোঁটে ব্যাথা অনুভব করতেই দৃষ্টি কাতর হলো কুহুর।চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল।ছেড়ে দিয়ে ঘনঘন দম ফেলল রওনক।কুহুর কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

"আমি কি তোমার ভয় কে বাড়িয়ে দিচ্ছি কুহু? অতিরিক্ত বেসামাল হয়ে গেছি?

মৃদু আওয়াজে কেবল বলল কুহু ,'হু'

মাথা তুলে ফের কুহুর দিকে তাকাল রওনক।সর্ব মুখে ছোট ছোট আদুরে চুমু খেয়ে বলল,

" আমি যদি ভয় টা আজ ভাঙ্গিয়ে দিতে চাই তুমি কি নিজেকে সামলে নিতে পারবে? নাকি ভুল বুঝে আরো দূরে সরিয়ে দেবে আমাকে?

কুহু কোনোরকম জবাব দিল না।রওনককে আলতো হাতে জড়িয়ে বক্ষস্থলে মাথা রাখলো নিশ্চুপ।সম্মোহনী কোনো আভাস পেল না রওনক।তবে মনে হলো তার বক্ষপিঞ্জিরায় মেয়েটা আশ্রয় খুঁজছে।দু'হাতে আগলে নিল রওনক।কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়াল।ইচ্ছে করলো এভাবেই আজন্ম বুকের মধ্যিখানে ধরে রাখুক মেয়েটাকে! তবুও কোনো দূরত্বের সৃষ্টি না করুক! তাহলে রওনক একেবারে ম*রেই যাবে!কুহু নড়লো না একটুও।এই অদ্ভুত অনুভূতিটুকু সামাল দেওয়া দুষ্কর হয়ে যাচ্ছিল তার জন্য! তনুময় জুড়ে অস্বাভাবিক কম্পন সৃষ্টি হয়েছে।আরেকটুখানি সময় পেরোলে বোধহয় হৃদপিণ্ড থমকে যেত! রওনক ভাইয়ের প্রকৃতিবিরুদ্ধ হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে।ওভাবে ঘাপটি মেরেই প্রশ্ন ছুঁড়লো সে,

"আপনি আমার উপর সম্পূর্ণ অধিকার রাখেন রওনক ভাই।আমি কি আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলছি? এই ভয় যদি আমার আজন্মও না কাটে?

কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে উত্তর দিল রওনক,

"একজন পুরুষের নারী শরীরের প্রতি আকর্ষণ থাকবে এটা স্বাভাবিক।চাইলেই যখন তখন তোমাকে কাছে টেনে নিতে পারি আমি।এতে আমার দেহজ তৃষ্ণা নিবারন হবে ঠিকই কিন্তু যখন তোমার মনে ভালবাসার সৃষ্টি করতে পারব, তখন আমার জন্য মানসিক তৃপ্তিও হবে সেটা! আর ভালবাসা সাহসী হতে শেখায়।যখন সম্পূর্ণরূপে আমাকে গ্রহণ করার ইচ্ছে হবে তোমার, তখন ভীতুর মতো ভালবাসার যুদ্ধের ময়দান থেকে চাইলেও ফিরে যেতে পারবে না তুমি। আমি অপেক্ষায় সেদিনটার!

খুব মনোযোগ নিয়ে রওনকের কথা শুনলো কুহু। চট করেই তার মাথায় একটা প্রশ্নের উদয় হলো, সে কি রওনক ভাইকে ভালবাসে? তাকে এতটা এলোমেলো করে দিয়ে নিশ্চুপ থাকাতেও মন, মস্তিষ্ক তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে! তবে রওনক ভাইয়ের আচরণ দিন দিন ভাল লাগার পরশ দিয়েই যাচ্ছে! কুহু যদি রওনক ভাইকে ভালোও বাসে সেটা মুখে বলবে কি করে? ভাবতেই লজ্জায় ককিয়ে গেল।আরেকটা আষ্টেপৃষ্ট জড়িয়ে নিল দীর্ঘকায় পুরুষকে।শক্তপোক্ত বুকে নাক ঠেকলো কুহুর।রওনকের টিশার্ট থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাসিকা রন্ধ্রে ধাক্কা খাচ্ছে।ইচ্ছে করে নাকটা আরেকটু ডুবিয়ে দিল কুহু।কেন ভীষণ ভাল লাগছে তার! রওনক বারান্দার দরজা গলিয়ে দৃষ্টি বাইরে রাখল।বৃষ্টির তেজ একেবারেই নেই বললেই চলে। পরিবেশ বেশ শীতল, নির্মল! কুহুর নড়াচড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে শীত করছে মেয়েটার।অগত্যা কুহুকে আরেকটুখানি শক্ত করে জড়িয়ে নিল রওনক। উষ্ণতার পরশ পেতে ঘুমে চোখ লেগে আসলো কুহুর।


কলিং বেল বেজে যাচ্ছে অনবরত। রান্নাঘরে নাশতা তৈরিতে ব্যস্ত শারমিন বেগম। এত সকালে কলিং বেলের শব্দ অবাকই করেছে তাকে। বাড়িতে সবাই-ই আছে। তবে কে আসলো? রাশেদ জামাল প্রভাতকালের নাশতা সেরে বেরিয়ে যাবেন কিছুক্ষণের মাঝে।একেবারে তৈরি হয়ে ডাইনিং রুমে আসলেন তিনি। ততক্ষণে শারমিন বেগম গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। মাঝ বয়সী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে কটকটে হলুদ রঙা সুতির থ্রিপিস। লাল ওড়নায় মাথায় ঘোমটা টেনে দেওয়া। পান চিবুচ্ছে মেয়েটা। হাতে একটা পুঁটলির মতো ছোট ব্যাগ। এই মেয়েকে চিনতে পারলেন না শারমিন বেগম।আপাদমস্তক দেখে নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন। মেয়েটি হাসিমুখে বলল,

"এইটা রওনাক স্যারের বাড়ি না?

শারমিন বেগম মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা বললেন।

মেয়েটি এবার হাসি চওড়া করে বলল,

" তাইলে সঠিক ঠিকানায়ই আইছি। আমি জুলেখা। আজ থিকা এই বাড়িতে কাম করুম। রান্নাবান্না থিকা শুরু কইরা ঘরমোছা, প্রতিদিনের কাপড় কাঁচা সব দায়িত্ব আমার। সকাল থিকা বিকাল পর্যন্ত সব কাম কইরা দিয়া যামু। তা ভাই সাহেব কি রুমে আছে?

শারমিন বেগম বললেন,

"তুমি এখানে দাঁড়াও আমি রওনককে ডেকে নিয়ে আসছি।

শারমিন বেগম ঘুরে তাকাতেই দেখলেন কুহু খাবার বেড়ে দিচ্ছে রাশেদ জামালকে।চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন তিনি।তক্ষুনি রুম থেকে বেরুলো রওনক।দরজা খোলা আর বাইরে জুলেখাকে দেখে এগিয়ে গেল সে।পরক্ষণে ভেতরে আসতে বলল।শারমিন বেগম অবাক দৃষ্টি নিয়ে ছেলের কান্ড দেখছেন।জুলেখার সাথে শারমিন বেগমকে পরিচয় করিয়ে দিল রওনক। নতুন পরিচারিকা সে। মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে বলল রওনক,

" আজ থেকে তোমার সব কষ্ট শেষ মা। সব কাজ জুলেখা করবে। কিছু করতে হবে না তোমাকে।

শারমিন বেগম ঘুরে তাকিয়ে কুহুকে বললেন জুলেখাকে রান্নাঘর দেখিয়ে দিতে।বাধ্য মেয়ের মতো চলে গেল কুহু।আশপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে এগিয়ে গেল জুলেখা। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন শারমিন বেগম,

"এতদিন মায়ের এই কষ্ট চোখে পড়েনি বাবা? সোজা বললেই পারিস বউয়ের কষ্ট কমাতে কাজের লোক রেখেছিস। আর রাখার আগে আমার থেকে একটাবার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিসনি!

" বউয়ের কষ্ট কমানোর কথা নয় মা।বাড়ির বউ হিসেবে কুহু সংসার সামলাবে এটাই নিয়ম।যেমনটা তুমি করে আসছো। কিন্তু কুহু তো এখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। সবদিক বিবেচনা করে আমি জুলেখাকে নিয়ে এসেছি।

ছেলের কথার উত্তর দিলেন না শারমিন বেগম। স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

"দেখো, শেখো ছেলের থেকে। কখনো বউয়ের চিন্তা হয়েছিল? আমার কাজ করা দেখে কষ্ট হয়েছিল? সারাদিন কতটুকু খেটে কাজ করি তদারকি করেছ কখনো? 

কথাটুকু বলেই চলে গেলেন শারমিন বেগম। রাশেদ জামাল ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

" কাজের মেয়ে এনেছ ভাল করেছ কিন্তু একবার তোমার মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার ছিল। বিয়ে তুমি একা করোনি। শতশত মেয়ে ডাক্তার হচ্ছে, কত রকম জব করছে তারা সংসার সামলাচ্ছে না?

রওনক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাকে ইচ্ছে করেই জুলেখার বলেনি রওনক। বললে তিনি কখনই রাজি হতেন না। আর কুহু মাকে সাহায্য না করলেও বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগে। এটা নিয়েও রওনের দিকেই আঙ্গুল উঠতো।রাশেদ জামাল অর্ধেক খাবার রেখে বেরিয়ে গেলেন।দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেল রওনক।


কুহু তৈরি হয়ে আসলো রিশার রুমে। জানালার ধারে বসে আছে রিশা।গভীর মনোযোগী দৃষ্টি বাইরে। আজকাল রিশাকে কেমন জানি লাগে কুহুর। কিছু নিয়ে চিন্তিত মনে হয়। আশফিক ভাইয়ের ঘটনাটার পর থেকেই রিশার এই পরিবর্তন। কি বলে সান্ত্বনা দিবে জানা নেই কুহুর। রিশার এমন গম্ভীর ভাব ভাল লাগে না কুহুর। ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল কুহু।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রিশা। মলিন হেসে বলল, যাবে না সে। এখন তো ক্লাস হয় না৷ সামনের প্রোগ্রামের জন্য ব্যস্ত সবাই। রিশা যেহেতু কিছুতেই অংশগ্রহণ করেনি তাই যাবে না সে। এগিয়ে এসে রিশার শরীরের হাত বুলাল কুহু। গা হালকা গরম লাগছে। রিশা জানাল মাথা ধরে আছে তার। জ্বর ভাব। অগত্যা আর জোড় করলো না কুহু। চলে গেল। রিশা অন্য চিন্তায় মগ্ন। সকাল থেকে অনেকবার রাতিম ভাইকে ফোন করার পর একটু আগে রিসিভ করেছে সে। জ্বরের প্রকোপে কথা বলতে পারছে না। মন কেমন অশান্ত, অস্থির লাগছে রিশার। সকাল থেকে কিছু খেয়েছে তো লোকটা? কথা বলার শেষ মুহূর্তে রাতিমের ফ্ল্যাটের ঠিকানা চেয়েছিল সে। তক্ষুনি লাইন কেটে গেছে। কুহু আসায় আর ফোন করা হলো না। ফোনে শব্দ হতেই ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার।স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো রাতিম ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।
·
·
·
চলবে..............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন