ভয়াল অন্ধকারে ডুবে আছে চরাচর। দিগ্বিদিক কবরের মতো নির্জন। আকাশ ফেটে বজ্র তেজ অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। প্রকৃতির রূঢ় অশনি চেহারা এক ঘনঘটা দূর্যোগের পূর্বাভাস! বন বনানী ঘেরা নিশ্ছিদ্র জঙ্গলে বসে আছে মাহবুব বিশ্বাস। ব্যাপক রক্তাক্ত, ক্ষত-বীক্ষত, মাথার ডানপাশ ফাটা। চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত গড়িয়ে গায়ের শুভ্র শার্টকে রক্তবর্ণে ছেয়ে ফেলেছে। গুমোট অন্ধকারে চারপাশ এমন ঝাপসা, দিনের উজ্জ্বল আলোকে দুঃস্বপ্ন বলে ভ্রম হয়। কখনো কল্পনাও করেনি মাহবুব, সভ্য নগরী ঢাকার বাইরে এমন নৃশংসতা লুকানো। এমন অপ্রকাশ্য ভয়াবহতা অতি লোমহর্ষক! জাগ্রত পশুর মতো হুংকার ছোঁড়ে সেই নরপশু! ভয়ে হৃৎপিণ্ড বরাবর ধ্বক করে উঠল তার! শিরদাঁড়া বেয়ে নামল শীতল স্রোত। গলার কাছে আঁটকে পড়া নিঃশ্বাসকে ঠোঁট হাঁ করে ছাড়তে ছাড়তে ফোনটা ডায়ালে রাখল। কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করতেই ফোনটা যখন রিসিভ হলো, ওমনেই ঝাঁপিয়ে পড়া জন্তুর মতো অস্থির হলো সে। ভয়ে টলটল করতে থাকা চোখ দুটো বন্ধ করে হড়বড় গতিতে বলে,
- আমাকে মেরে ফেলা হবে! যে কোনো দণ্ডে মেরে ফেলা হবে। আমি.. আমি জানি না কতক্ষণ বেঁচে থাকব। ওই জানোয়ার আমাকে জিন্দা যেতে দেবে না। কোনো দুর্বলতা নেই, কোনো পিছুটান নেই, কিচ্ছু নেই তাঁর। দলের বারো জনকে কুপিয়ে কচুকাটা করে ছেড়েছে! আমি ভয়ে কোনোরকমে জান বাঁচিয়েছি। এখনো নিশ্চিত না এইদিক পর্যন্ত......
এমন সময় খসমস শব্দে কোথায় যেন পাতা-মর্মর করে উঠল। তড়িৎ গতিতে চোখদুটো বামে ঘুরালো মাহবুব। ফোনটা কানে চেপে অস্থির, চঞ্চল, হতবুদ্ধির ন্যায় চারদিকে চোখ বুলাতে লাগল। কেউ নেই! অথচ অদৃশ্য সত্তার মতো আচরণ করছে ওটা! মাহবুব শুকনো কণ্ঠে অপ্রকৃতিস্থের মতো জানালো,
- মনে হয়... মনে হয় এসে গেছে। সময়... সময় শেষ হয়ে গেছে। আমি আর বাঁচব না। আমাকে শেষ করে দিবে। আমাকে শেষ... শেষ করে....
উন্মাদগ্রস্ত ব্যক্তির মতো চ্যাঁচাতে শুরু করলে হঠাৎ থমকে যায় মাহবুব। মুখ দিয়ে কোনো রা বেরুল না। চোখ দুটো বিস্ফোরিত করে আস্তে আস্তে মাথাটা পিছু ঘুরায় সে। মন বলছে পিছনেই আছে! আকাশে তখন ফরসা আলো ফুটে উঠল। সেই চৌঁচির আলোর মধ্য দিয়ে দেখল, এক রক্ত হিম করা দৃশ্য! ধপ করে হাতের ফোনটা মাটিতে ফেলে দিল সে। গোঙানির মতো আতঙ্ক মিশ্রিত স্বরে থেমে থেমে বলতে থাকে,
- আ-আ-আমাকে মারবেন না...
চারপাশ অন্ধকার করে ধূলোর ঝড় উঠেছে। হাওয়ায় শোঁ শোঁ পাতার ঘূর্ণি। গাছের ডালগুলো প্রচণ্ড আছড়া-আছড়ি করে উত্তাল অস্থির! ঝম ঝম করে শুরু হয়ে যায় অঝোর বৃষ্টি। সেই ভীতিকর দৃশ্য দেখে ঠোঁট দুটি আর নাড়াতে পারেনি মাহবুব। সুস্পষ্ট ভয়ে ওভাবেই চোখ দুটো স্থির রেখে বারবার ঢোক গিলছিল। মাথার উপর পৃথিবী কাঁপিয়ে বাজ পড়ছে। একের পর এক আত্মা হিম করা বজ্রস্বর! মাহবুবের মনে হলো, অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মূর্তিটিও সাক্ষাৎ বজ্র অবয়ব। আগাগোড়া যার হুডিতে ঢাকা। যার হুডির রঙ অন্ধকার বর্ণ কালো। হুডির কালো কাপড়ে মুখের অর্ধেক ঢাকা। কালো পোশাকে আবৃত বলেই প্রচণ্ড ভয়ানক, খতরনাক, জান্তব হয়ে ঠেকছে। মাহবুব তীব্র অস্থিরতার ভেতর দম টানতে পারছিল না। নিঃশ্বাসে টান পড়ে মুখ হাঁ করে ফেলছিল। চোখ দুটোয় দেখতে পাচ্ছিল, সেই অটল মূর্তিটি এক পা এক পা করে ধীর কদমে এগিয়ে আসছে। যার ডান হাতের মুঠোয় সেই ভয়ানক চেহারার শাবল। লম্বা শাবলের ধারালো মাথায় ছোপ ছোফ রক্ত। বৃষ্টির পানিতে সেটি ধুয়ে মুছে ভূমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। দৃশ্যটা দেখতেই শিরদাঁড়া বেয়ে বরফ-শীতল স্রোত বয়ে গেল তার। ঢোক গিলতেও যেন ভুল গেল মাহবুব বিশ্বাস। রক্তাক্ত ঠোঁট দুটো কাঁপাতে কাঁপাতে সে বলতে থাকল,
- আআ-আমাকে মারবেন না... আমাকে মারবেন না আপনি! আমার ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করছি। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি... কাউকে এক বিন্দু জানতে দিব না। যা দেখেছি... যা জেনেছি সব এই দণ্ডে ভুলে যাব। আমি এই দেশ ছেড়ে এক্ষুণি পালানোর জন্য....
হঠাৎ কানে শ জাতীয় ফিসফিস ধ্বনিটা শুনতে পেল। ঠিক একই রকম তেজবর্ধক ভঙ্গি, ঠিক একই রকম হিম শীতল ইঙ্গিত! বুকটা কেমন ধ্বক করে কেঁপে উঠল মাহবুবের। হুডির আড়ালে ঢাকা মুখটা নিজের ঠোঁটের উপর তর্জনী রেখে দিয়েছে। তাকে সুক্ষ্ম ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছে, “কথা বোলো না। চুপ...”। সেই নীরবতার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মাহবুব তখুনি নিশ্চুপ! এরপর যে দৃশ্যটি সমুখে উন্মোচিত হল, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না মাহবুব বিশ্বাস। সমস্ত চরাচর কাঁপিয়ে ফুটে উঠল গগন বিদারী আর্তস্বর। যেন গলার সবকটা রগ ফাটিয়ে আর্তনাদ ছেড়েছে! এরপর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। সব নিশ্চুপ... ঠাণ্ডা... ঝম ঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে।
•••••••••••
ধাম ধাম করে দরজায় আঘাত পড়ছে। যেন দরজার পাল্লাটা এক্ষুণি ভেঙে ফেলা হবে। সুপ্রশস্ত বারান্দায় আড্ডা দিচ্ছে চারজন তরুণ-তরুণী। দূরত্ব রেখে বসে আছে আরো একজন। প্রত্যেকেই গান আড্ডা বন্ধ করে প্রশ্নবোধক চোখ দুটোতে তাকিয়ে আছে। যেন চোখে চোখে খেলা করছে ' কে এল? এভাবে কেন দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে? '। বারান্দার ঠিক প্রবেশমুখে গুটিশুটি ভঙ্গিতে বসে আছে একজন। যার গায়ে জ্বর। সমস্ত শরীর সাদা কম্বলে মুড়োনো। সে এই মুহুর্তে কোলাহল থেকে দূরত্ব পালন করতে কিছুটা দূরে বসে ছিল। যে স্থানটিতে বসা, সেখান থেকে মুখ ঘুরিয়ে পিছু তাকালে দরজার ভাবমূর্তি দেখা যায়। করাঘাতে ছিটকিনির খোপটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাদুরে বসা অধৈর্য রোজা স্বর স্পষ্ট করে ডেকে উঠে,
- জানা! দ্যাখ না কে এসেছে? তুই তো মাথা পিছু ঘুরালেই দেখতে পাবি কে এল।
ওমন আহাম্মক গোছের কথাবার্তা শুনে মেজাজ খিঁচড়ে গেল শ্রেষ্ঠার। চোখমুখ ভীষণ রাগারুণ করে রোজাকে ঝলসে দিয়ে বলে উঠল,
- একটা উন্মাদই এসব আজগুবি কথাবার্তা বলতে পারে। কখন কাকে কোন ধরণের কথা বলিস সে জ্ঞানটুকু পর্যন্ত নেই। জানা কীভাবে বলবে দরজার ওপাশে কে এসেছে ? ও কী তোর মতো ছাগল হয়ে পাগল বনে আবোলতাবোল বলবে? বিরক্তিকর একটা! একদম মুখ বন্ধ!
বিকৃত মেজাজে ঝটিতি উঠে দাঁড়ায় ও। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির জন্য পরিবেশ শীতল। ঘরজুড়ে আলোকহীন আঁধার। ডানহাতে থাকা কোকের ক্যানটা আরেক সঙ্গী সোহানার কাছে বুঝিয়ে শ্রেষ্ঠা তখন দরজামুখো পা চালায়। এদিকে, বারান্দার মেঝেতে টান টান মাদুর পেতে আড্ডারত ছিল বাকি ক’জন। তারা প্রত্যেকেই শ্রেষ্ঠাকে একা যেতে বারণ করলেও একগুঁয়ে শ্রেষ্ঠা একটুও পাত্তা না দিয়ে ঝট করে দরজাটা খুলে দিল। কিয়ৎক্ষণ অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। এরপরই কপাল কুঞ্চন করে ভারি আশ্চর্য স্বরে বলল শ্রেষ্ঠা,
- তুই! তুই এভাবে কেন পাগলটার মতো দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছিলি? আমরা কেউ ঘুমিয়ে ছিলাম না নাযীফ! তোর অপেক্ষাতেই দুটো ঘণ্টা নষ্ট করা হয়েছে। বার-বি-কিউ কাজটা শেষপর্যন্ত জিদানের হাতে তুলে দিয়ে আমরা বারান্দায় বসলাম। অসহ্য! এভাবে কেউ করে!
শ্রেষ্ঠার রাগত মুখটা দেখে চুপ রইল নাযীফ। কেন উন্মত্তের মতো দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছিল তা উল্লেখ্য করল না সে। বরং, বোবা পুতুলের মতো রুমে প্রবেশ করে দরজাটা ছিটকিনি বদ্ধ করে দিয়েছে। সমস্ত শরীর বৃষ্টির পানিতে কাকভেজা। মাথা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি গড়িয়ে সাদা টাইলসের মেঝেতে নোংরা ছড়িয়ে দিচ্ছে। পায়ের জুতোজোড়া খুলে ভেজা পোশাক ছাড়ার জন্য শশব্যস্ত হল নাযীফ। কিন্তু ঘটনা তেমন সুবিধার মনে হলো না শ্রেষ্ঠার। কিছু হয়েছে? ওর হাসিখুশি মুখটা অমাবস্যার অন্ধকার বনে আছে কেন? যাওয়ার সময় তো ভরপুর প্রফুল্লে মেতে ছিল; কিন্তু আসার পর এমন থমথম! শ্রেষ্ঠা জহুরি দুটো চোখ ছুঁড়ে নিষ্কপট সুরে বলল,
- নাযীফ।
দুটি কর্মরত হাত স্থির করল নাযীফ। ট্রাভেল ব্যাগে টিশার্ট খোঁজা বাদ দিয়ে মুখটা উর্ধ্বে তুলল। বুকের কাছে দুহাত ভাজ করে স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে শ্রেষ্ঠা। মুখ নির্লিপ্ত, চোখ স্থির, কণ্ঠে নেত্রীসুলভ গাম্ভীর্য রেখে বলে উঠল,
- আমি যদি ভুল না বলি, তুই বের হবার সময় স্বাভাবিক ছিলি। ফুরফুরে মুখ। হাসিখুশি চেহারা। কিন্তু সে চেহারা এখন থমথম করছে। বাইরে কী হয়েছে নাযীফ? বিপত্তির ব্যাপারে সত্য গোপন করবি না। আমার সামনে মিথ্যা বন্ধ। বল!
ঠাঁট বজায় রাখা শ্রেষ্ঠার সামনে অপ্রস্তুত হলো ও। কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না নাযীফ। চিন্তায় আচ্ছণ্ণ মুখ প্রচণ্ড সাবধানে শান্ত বানিয়ে ভদ্রস্থ গলায় বলল,
- কিছু হয়নি। ক্যামেরাটা নষ্ট হয়েছে বলে মন খারাপ। তুই এসব ইন্টার্নাল কষ্ট বুঝবি না। সর, গেটআপ বদলাব। ভেজা গায়ে থাকতে ভালো লাগছে না।
ঝটপট ব্যাগ থেকে নেভি ব্লু টিশার্ট, কালো প্যান্ট তুলে অদৃশ্য হলো নাযীফ। শ্রেষ্ঠা ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পাচ্ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছিল দুশ্চিন্তার ঝড়। ওর চোখদুটো ওভাবেই তখনো স্থির করা ছিল। কিন্তু মনে মনে বুঝতে পারছিল লক্ষণ স্বস্তির নয়।
অন্যমনষ্ক হয়ে বারান্দামুখো আড্ডায় ফিরছিল শ্রেষ্ঠা। ঠিক তখনি বারান্দার প্রবেশমুখে বসে থাকা মেয়েটি ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলে উঠল,
- তোমার একটু সাহায্য প্রয়োজন।
চকিতে ভ্রম ভাঙতেই সংবিৎ ফিরে পেল শ্রেষ্ঠা। দেখতে পেল ওর দিকে তাকিয়ে আছে শাওলিন। মুখ পাণ্ডুর। গালে লালচে ছোপ। নাকের অগ্রভাগ, দুটো শুকনো ঠোঁট ঈষৎ লালবর্ণ। যেন শুকিয়ে যাওয়া লাল কৃষ্ণচূড়া সাময়িক অসুস্থতায় ভুগছে। যে ফুলের রঙ, রূপ, সৌন্দর্য আশু দুর্বলতায় নিস্তেজ হলেও স্বকীয় সৌন্দর্য বিলীন হয়নি একটুও। শ্রেষ্ঠা মুচকি হাসি দিয়ে নরম গলায় শুধোল,
- কী করতে হবে বল। আমি করে দিচ্ছি।
- ফোনটা এনে দাও। চার্জে দিয়েছি।
- বোস। এনে দিচ্ছি। কিছু খাবি? তোর জন্য কিছু খাবার অর্ডার দিই?
- নষ্ট হবে। যখন খেতে ইচ্ছে হবে, জানাব।
শাওলিনের মুখের দিকে কিয়ৎ ক্ষণ তাকিয়ে চাপা শ্বাস ছাড়ল শ্রেষ্ঠা। ও জানে, খাবারের বিষয়ে জোরাজুরি করলে মেয়েটা শুনবে না। গতরাত থেকে জ্বর। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকলেও সাড়াশব্দ করেনি। চুপচাপ নিজের মতো সবটা বুঝে নিয়ে ও কেবল আপন ভুবনেই মগ্ন। যে ভুবনে ওর নিবিড় নিভৃত একটি দূর্গ আছে, বহুদিনের লালিত একটি প্রাসাদ আছে, আছে স্বপ্ন দিয়ে বোনা একটি সুন্দর মনো-জগত। বুকের ভেতরে আজও শত শত প্রশ্ন নিয়ে ফোনটা এনে দিল শ্রেষ্ঠা। আজও মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করল না কেন ওর নির্জনতা পছন্দ? কেন পছন্দ নিজের মতো নিজের হয়ে থাকা? এই উদার মুক্ত প্রকৃতির মাঝে কেন অতো ঝুট-ঝামেলা সহ্য করে ছুটে এল? কেন শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও ঝুম বৃষ্টির মনোমুগ্ধ রূপে মন ডুবিয়ে রাখা। শ্রেষ্ঠা কিছুই জানে না। বহু অজানা সমীকরণের মাঝ দিয়ে চলতে চলতে ও আজও বাকি বন্ধুদের কাছে নিঃশব্দে চলে গেল। বারান্দার মেঝেজুড়ে মাদুর পাতা। সেখানে গিটার কোলে বসে আছে সেলিম। দুহাত টমেটো সসে মাখিয়ে মুরগীর পিসে কামড় বসাচ্ছে জিদান। হাতে ফোন নিয়ে ইন্সটাগ্রামের নতুন ফিল্টারে ওদের ক্যাপচার করছে রোজা। পাশে বসে থাকা সোহানা খট্ করে কোকের ক্যানটা খুলতেই ওর ডানদিকে বসল শ্রেষ্ঠা। অন্যদিকে, গায়ে আরেকটু কম্বল জড়িয়ে বসল শাওলিন। বন্ধুদলে যে নামটি বহুল প্রচলিত, সেটিই তখন পেছন থেকে শুনতে পায় ও,
- ‘জানা?’
নামের ছোট্ট সম্বোধনে মাথাটা পিছু ঘুরায় শেহজানা। এটা ওর বড়ো নাম। এ নামেই ডাকে বন্ধু, ক্যাম্পাসের মানুষজন। সদ্য হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পালটে দাঁড়িয়ে আছে নাযীফ। সে সরল মুখে হালকা গলায় শুধোল,
- তোর শরীরের অবস্থা কেমন? তাপমাত্রা কমেছে?
ঘুরিয়ে রাখা মুখটি সামনে ফিরিয়ে নেয় শাওলিন। গরম নিঃশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
- আগের চেয়ে ভালো। তাপমাত্রা সহনশীল।
কথাটা শুনে থমকে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখে নাযীফ। কম্বলে গা মুড়ে বসা মেয়েটার পাশে সেও দূরত্ব রেখে ডানপাশটায় বসে। পাদুটো সটান সামনে ছড়িয়ে দিতেই পাশ থেকে বলে উঠল মেয়েটা,
- কী হয়েছে তোমার?
বিষম খাওয়ার মতো চমকে তৎক্ষণাৎ বাঁয়ে তাকাল নাযীফ। ভ্রুঁদুটি কুঞ্চন করে মুখ স্থির করে শুধোল,
- কী হবে?
- আমি মূলত সেটাই জানতে চাই। একজন শান্ত মানুষ কখনো ওভাবে দরজা ধাক্কা দেবে না। তুমিও সেটা দাওনি। কারণ নিশ্চয়ই ছিল।
নাযীফের মুখ নিকষ আঁধারের মতো কালো বনে গেল। ঝটিতি মুখটা বাঁদিক থেকে ফিরিয়ে আনল সে। ঠোঁটদুটো টিপে জরুরি ভিত্তিতে কিছু একটা ভাবতে লাগল নাযীফ। চোখদুটো আবার বাঁদিকে ফেরাতে নেবে, ঠিক তখনি দেখল শ্রেষ্ঠা দূর থেকে ওর দিকে চেয়ে আছে। কয়েক সেকেণ্ড নীরব থেকে সমস্ত কথা গুছাল নাযীফ। এলোমেলো শব্দগুলো গোছগাছ করে বলল,
- প্রথমেই বলব....
একটু থামল নাযীফ। আশু ঝড়টা সহ্যের জন্য খানিকটা প্রস্তুত করে বলল,
- তোরা কেউ প্যানিক করবি না। এখন প্যানিক করার মতো পরিস্থিতি নেই। তুই যেভাবে কাউন্টার করছিস, বিষয়টা ওরকমই সিরিয়াস জানা। বাইরে গুরুতর একটা ঘটনা ঘটেছে। সবাই আতঙ্কে আছে। এখানে গুটিকতক যে কটা রেসোর্ট আছে, তারা সবাই তল্পিতল্পা গুটিয়ে চটজলদি পালাচ্ছে। পরিস্থিতি ভালো নেই। আমি ভেবেছিলাম তোরা খবরটা পেয়ে গেছিস। তাই ওভাবে দরজা ধাক্কা দিচ্ছিলাম। আর আমাদের হোটেল থেক.....
কথাটা বলতে গিয়ে আবারো থেমে যায় নাযীফ। সে লক্ষ করেনি তার কথা শুরু হতেই সমস্ত আড্ডা অজান্তেই ওদিকে থমকে স্থির। সেলিম-সহ বাকিরা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে এখন। নাযীফ আরো একটু গুছিয়ে সরাসরি ব্যাপারটা বলে উঠল,
- হোটেল ম্যানেজার বলেছে এক্ষুণি এখান থেকে চলে যেতে হবে। পরিস্থিতি সুবিধার না। এখান থেকে মাত্র দেড় মাইল দূরে খুবই ভয়ংকর একটা খুন হয়েছে। পুরো বডি চার টুকরো করা... মাথা থেঁতলে... উহঃ! ব্রুটালি মার্ডার কেস। খুনি হয়তো এখনো আশপাশেই আছে। এই ভয়ে আমাদের হোটেল থেকে দ্রুত বেরুতে বলেছে। ম্যানেজার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই হোটেলটা বন্ধ করে পালাবে।
কথাটা শেষ হতে না হতেই চারজন সমস্বরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বলল,
- কী !
দরজার চৌকাঠে বসা শাওলিন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ও বাকিদের মতো চিৎকার না করলেও বরাবরের মতো ঠাণ্ডা। মুখটা বাঁদিকে ফেরাতেই ওদিকে বসা শুধু শ্রেষ্ঠার দিকে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
- দেরি করাটা ঠিক হবে না শ্রেষ্ঠা। হোটেল বন্ধ করে দিলে মহাবিপদে পড়তে হবে। উনারা নিশ্চয়ই এমনি এমনি প্রোটোকল ভাঙছে না। তুমি উঠো।
শ্রেষ্ঠা হ্যাঁ সূচকে মাথাটা নাড়িয়ে দিতেই ঝটপট উঠে দাঁড়াল। ওর দেখাদেখি সেলিম, জিদান, রোজা ও সোহানা কাঠপুতুলের মতো সবকিছু গোছাতে দ্রুত ছুটে গেল। তিনদিনের ট্যূরে প্রত্যেকের ব্যাগ যথেষ্ট অগোছালো। এখনো হাতে একদিন বাকি আছে। কিন্তু তন্মধ্যে যে মারাত্মক ঘটনাটা ঘটল, এতে করে জানের উপর চরম মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ছে। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দে করাঘাত পড়লে দরজাটা খুলল সেলিম। বাকি সবাই চুপ। সবাই ব্যস্ত চোখে দেখল, হোটেল ম্যানেজার কেমন উদভ্রান্তের মতো ঢোক গিলছে। ভদ্রলোক ওদের চেকআউট করতে বলছে। একঘণ্টার ভেতর পুরো হোটেল বন্ধ করে ট্যূরিস্ট ক্যাম্পের দিকে রওনা দিতে হবে। কথা শুনে সম্মতি জানিয়ে দ্রুত কাজে হাত ছোটাল ওরা। দেরি করা যাবে না! একমাত্র শাওলিন ব্যতিত সবারই ট্রাভেল ব্যাগ গোছাতে সমস্যা হচ্ছে। এদিকে শাওলিন হাতমুখ ধুয়ে সবকিছু গুছিয়ে কী যেন ভেবে টিভিটা অন করে। যদি সব ভদ্রস্থ থাকে, তবে আজই ঢাকার পথে রওনা দেওয়া উত্তম। টিভিটা চালু হতেই বিছানায় বসল শাওলিন। বাকিরা হই হুল্লোড় করে যার যার লাগেজ তৎপর। হঠাৎ টিভির একটি সংবাদ পাঠে দৃষ্টি আঁটকালো ওদের। টিভির পর্দায় ফলাও করে দেখাচ্ছে আকস্মিক এক পাহাড়ি ধস! পার্বত্যাঞ্চলে আঁটকা পড়েছে কয়েকশো পর্যটক। নীচেই ব্রেকিং নিউজে যাচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুটি বাসের গুরুতর সংঘর্ষ। দীর্ঘ যানজটে মানুষের চরম ভোগান্তি। একের পর এক অতর্কিত সংবাদে কেউ ক’মিনিট কথা বলতে পারল না। অভূতপূর্ব এক শঙ্কার ভেতর আচ্ছণ্ণ হল সবাই। কী হচ্ছে এখানে? ভাগ্য-সারথি কোন পথে চালিত করছে? এ কেমন ভয়াবহ সর্বনাশ! জিদান বিছানা থেকে রিমোট তুলে টিভিটা বন্ধ করে দেয়। সকলের উদ্দেশ্যে ভীষণ শান্ত গলায় বলে,
- শোন, এখন আমাদের একজোট থাকতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। এখানে থাকাটা একদম নিরাপদ নয়। কেউ এখন আর দেরি করিস না। তাড়াতাড়ি হাত চালা। ব্যাগ গোছা। এক এক করে সব নীচে নাম। যা ঠিক করার আমরা গাড়িতে বসে বসে ঠিক করে নিব। সেলিম শোন ,
জিদানের ডাকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল সেলিম। গিটারের কেসে গিটার ঢুকানো স্থগিত করে বলল,
- জলদি বল্।
- তুই গিটারটা নাযীফের কাছে দিয়ে সর্বপ্রথম গাড়িটা স্টার্ট করবি। ড্রাইভ কে করবে আপাতত ওটা পরে দেখছি। আমি আর শ্রেষ্ঠা চেকআউটের সব ফর্মালিটিস পূরণ করব। আর এদিকে লাগেজগুলো হোটেলের দুটো ছোকরাকে ডেকে ফটাফট তুলে ফ্যাল।
- ওকে। ডান। আর কিছু?
- আর . .
কথাটার মধ্যে সুক্ষ্ম ইঙ্গিত রেখে থামল জিদান। চোখটা আস্তে করে বিছানায় বসা শাওলিনের উপর ঘুরিয়ে নেয় সে। শাওলিন নীরব থাকলেও যথাযথ ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে সুতেজি গলায় বলল,
- আমার কোনো সাহায্যের দরকার নেই। ভাবনার জন্য ধন্যবাদ। হাঁটাচলার মতো পর্যাপ্ত বল আছে। রোজার জন্য এগিয়ে এলে ভালো দেখায়। ওর ডানপায়ের বুড়ো আঙুল চোট পেয়েছে। নখটা নেই। বৃষ্টির পানি ওখানটা লাগলে সমস্যা হবে।
- হুঁ।
ছোট্ট করে জবাব রাখল জিদান। বুঝতে আর বাকি নেই, শাওলিন ওদের সাহায্য প্রার্থী নয়। বরং, যার সবচাইতে বেশি সাহায্য প্রয়োজন, ও তাকেই আঙুল উঁচু করে দেখিয়ে দিয়েছে। সেলিম মনে মনে সুক্ষ্ম অপমানে আক্রান্ত হলে উপস্থিত সবার সামনে প্রকাশ করল না। নীরব থাকল। মিনিট দশেকের ভেতর সবাই স্ব স্ব কাজে ছুটে গেলে গাড়িটা স্টার্ট দিল সেলিম। একে একে সবাই দ্রুত গাড়িতে চড়ে বসল। গাড়িটা অবশ্য ড্রাইভ করবে নাযীফ। মৃদু কাঁপুনি তুলে জড়তা ভাঙতেই নির্জন পথ দিয়ে যাত্রা ধরল গাড়িটি। দুপাশে ঘন নিবিড় বন। বন-জঙ্গল ঘেরা পরিবেশ। মাঝ দিয়ে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা সাপের মতো সুনশান রাস্তা। সেই নির্জন রাস্তার উপর দিয়ে ঝুম বৃষ্টি মেখে মেখে খুব সাবধানে দক্ষতার সাথে ড্রাইভ করছে নাযীফ। গাড়ির ভেতর সবাই যখন আপন কাজে মগ্ন, ঠিক তখনই উচ্চকণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠল রোজা,
- সেলিম... সেলিম! আমাদের গাড়ি ফলো করা হচ্ছে! পেছনে তাকাও!
রোজার অমন ভয় প্রকম্পিত স্বরে চমকে উঠল সবাই। চটজলদি মুখটা পিছু ফিরাতেই দেখল অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটা! গাড়ির পেছনে ঝাপসা, ঘোলা, অস্বচ্ছ কাঁচে বৃষ্টির আলপনা নামছে। সেই আলপনা ভেদ করে জ্বলছে দুটো হেডলাইটের আলো। জ্বলজ্বল করতে থাকা ফরসা আলোদুটি কেমন বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছে। সেলিম কিছু একটা ভেবে দ্রুত পাশ থেকে নাযীফকে বলে উঠল,
- নাযীফ, সাইড দ্যা কার। দ্যাখ, আমাদের ওভারটেক করে কিনা। যদি গাড়িটা না যায়, তাহলে এক্ষুণি আমাদের সেফ জোনে ছোটা লাগবে!
নাযীফ কথামতো প্রচণ্ড কৌশলের সাথে গাড়িটা একপাশে চাপিয়ে আনে। খেয়াল রাখল যেন এই গাড়িটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়। চোখ-কান সতর্ক ভঙ্গিতে খোলা রেখে স্টিয়ারিং খামচে ধরল সে। বাঁপাশে বসা সেলিম তখনো মুখটা পিছু ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে। ওই গাড়িটা আসছে... আসছে... চট করে নীচের অধরে দাঁত চেপে ধরল সেলিম। অপেক্ষা করতে করতেই দেখল সাদা গাড়িটা পঞ্চাশ মিটার দূরত্বে আসলো। আস্তে আস্তে স্থির হচ্ছে ওটা। তার মানে...? তার মানে ফলো করছে !
.
.
.
চলবে.....................................................