ফারাহর কথামতো আমি রৈনীলকে টেক্সট পাঠালাম। ওকে আমার যেকোনো একটা শখের কথা জানাতে হবে। দেখতে হবে সে ওই শখটা পূরণ করতে চায় কি না!
আমি রৈনীলকে টেক্সট পাঠালাম, "নাদির আহমেদকে চিনেন?"
রৈনীল রিপ্লাই দিলো, চিনিনা। কে উনি?
'না চিনলে আর বলে লাভ নেই। উনি একজন ইনফ্লুয়েন্সার।'
'ওওওওহহহ।'
এত বড় "ওহ" দেখে আমি খানিকটা হতাশ হলাম। এরপর সে আর কোনো মেসেজ দিলো না। আমি কি ধরে নেবো এই এটেম্পট ফেইল করেছি? অনেক ভাবনা চিন্তা করে আমি দ্বিতীয়বার মেসেজ পাঠালাম, 'নাদির আহমেদের এড্রেস ম্যানেজ করা যাবে?'
'কল দিবো?'
'সে কি! ওনার নাম্বার আছে আপনার কাছে!'
'আরে বোকা তোমাকে কল দিবো কিনা জানতে চেয়েছি।'
আমার অনুমতি নিয়ে রৈনীল কল দিলো বটে, আমি মোটেও টু শব্দটি করছি না। রাগ করার ভান ধরে আছি। আমি অভিনয় জিনিসটা পারিনা। তার ওপর রৈনীলের সঙ্গে তো একেবারেই জিততে পারবো না। তবুও অনর্থক চেষ্টা..
'কী হলো সরণী, কথা বলছো না কেন?'
'আমি একটা বোকা। বোকা আর কী বলবে?'
'ওরে পাগল। তুমি এইটুকুতে রাগ করেছো?'
'প্রথমে বোকা তারপর পাগল?'
'হা হা হা। আই এম সরি, দুইবার সরি। হলো?'
'জি না। আরও অনেকবার সরি বলতে হবে।'
'কতবার?'
'যতবার আমি বলবো আমাকে সরি বলুন?'
'ঠিক আছে। সরি বলতে বলো?'
'আমি তো এখন বলবো না। আমি আমার সময়মত বলবো।'
'অকারণে আমাকে দিয়ে সরি বলিয়ে নিবা?'
'জি না। আপনি আমাকে দুইবার গালি দিয়েছেন। যেগুলো আমি ডিজার্ভ করিনা। তাই আমার যতবার ইচ্ছে আমি আপনাকে সরি বলাবো।'
'তুমি যে আসলেই ওই দুইটা ডিজার্ভ করো, সেটা আমি প্রমাণ করে দিবো?'
'এবার আমি সত্যি সত্যি রাগ করবো।'
'এতক্ষণ তাহলে কি করেছো সরণী?'
'রাগের অভিনয়।'
'হা হা হা।'
রৈনীল হাসছে। আমিও মুখ টিপে হাসছি, তবে তাকে বুঝতে দিচ্ছি না আমার মুখেও হাসি। সে আবার আমার বোঝানোর আশায় বসে থাকেনা। নিজ দায়িত্বে সব বুঝে নেয়। বলল, 'মিটমিট করে হাসতে হবেনা, তুমি শব্দ করেই হাসো।'
'তারপর আমার মা এসে কষে একটা থাপ্পড় মারুক।'
রৈনীল আবারও হাসলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, 'নাদির আহমেদের ব্যাপারটা কি বলো তো? বারবার জিজ্ঞেস করছো কেন?'
'ওনাকে একটা গিফট পাঠাতে চাই। কোনোভাবে কি ওনার এড্রেস ম্যানেজ করা যাবে?'
'অবশ্যই যাবে। তুমি কি ওনার ফ্যান?'
'হুম। আমি সেই ছোট্টবেলা থেকে ওনার ফ্যান।'
'এই মেয়ে তোমার বয়স কত? তুমি তো এখনো ছোট।'
আমি দ্বিতীয়বার হতাশ বোধ করলাম। রৈনীল কি আমাকে এতটাই ছোট্ট মেয়ে ভাবে? যদি তাইই হয়, তবে তো মুশকিল। ওর হৃদয়ে জায়গা পাবার মতো বড় কি আমি এখনো হইনি!
'সরণী?'
'হুম..'
'আমি কি ওনার এড্রেস ম্যানেজ করে দিবো?'
'পারবেন?'
আমার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ শুনে রৈনীল বিস্মিত হয়ে বললো, 'সিরিয়াসলি? মনে হচ্ছে তুমি ওনার কঠিন ভক্ত। ঠিক আছে আমি দেখছি।'
'থ্যাংকিউ। এখন সরি বলুন।'
'কি জন্য?'
'একটু আগে বললাম না?'
'ওকে, সরি মিস বিজয়ী সরণী। কিন্তু আজকে তোমাকে অন্যরকম লাগছে। এর কারণ কি?'
'কি রকম?'
'ফুরফুরে।'
আমি হেসে বললাম,
'এটা তো ভালো। আপনি কি চান না আমি ফুরফুরে থাকি?'
'তুমি অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকে একটু বেশী পটরপটর করছো।'
আমি বোধহয় আরও অনুপ্রেরণা পেয়ে গেলাম। জোরগলায় বললাম,
'ইটস নরমাল। এখন থেকে আমার পটরপটর শোনার জন্য রেডি থাকুন।'
'কেন?'
'আমি ঠিক করেছি এখন থেকে বেশী বকবক করবো। এতদিন তো শান্তশিষ্ট মেয়ে ছিলাম। এখন নিজেকে একটু চেঞ্জ করবো ভাবছি।'
'তোমার মাথা ঠিক নেই।'
'আবার আরেকটা গালি? সরি বলতে বলতে আপনার জিন্দেগী বরবাদ হয়ে যাবে কিন্তু।'
'হা হা হা। আমার সরি বলতে সমস্যা নেই। ভালোই তো লাগছে।'
'কি ভালো লাগছে?'
'সরি বলতে।'
আমি মুখ টিপে হাসলাম। কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি। মাঝেমাঝে মনে হয় রৈনীলও আমাকে পছন্দ করে। আবার মাঝেমাঝে মনে হয় আমি একটু বেশীই ভাবছি। তবে ফারাহ আমাকে যতগুলো ট্রিকস খাটাতে বলেছে, আজকে তার প্রথমটা বলা শেষ। দেখা যাক ফলাফল কী দাঁড়ায়।
ঠিক দুদিনের মাথায় রৈনীলের ফোন। সে কখনো নিজে থেকে কল দেয় না। সবসময় আমি টেক্সট পাঠানোর পরেই অনুমতি নিয়ে ফোন দেয়। আজকে ওর কল দেয়াটা রীতিমতো আমাকে বিস্মিত করলো। আমি রিসিভ করেই বললাম, 'এড্রেস পেয়েছেন?'
'পাঁচ তারিখ, বিকেল পাঁচটায়, সয় সেভেন রেস্টুরেন্টে।'
'কি?'
'তোমার নাদির আহমেদের সঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করবা।'
'কিহ!'
আমি ঢোক গিললাম। এই লোক করেছে'টা কী! আমি তো কেবল এড্রেস চেয়েছিলাম। সেটাও বিশেষ কারণে। সত্যি বলতে আমি নিজেও নাদির আহমেদকে চিনিনা। আমার কোনো ব্যক্তিগত ফোন ছিলোনা কখনোই। আমি বরাবরই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বহু দূরে বসবাস করে আসা মানুষ। আমি কিভাবে চিনবো ওনাকে! পুরোটাই তো ফারাহর দেয়া বুদ্ধি।
কোনোমত নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, 'আমার বাসা থেকে যেতে দেবে না।'
'বাসায় বলো যে তুমি ওনার কত বড় ফ্যান। আর এটাও বলো যে ওনার সঙ্গে দেখা করা খুব টাফ।'
'এই টাফ কাজটা আপনি কেন করেছেন? কে বলেছে আপনাকে করতে?'
'আমি তো ভাবলাম তুমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবে।'
এরপর অনেক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। আমি খুবই বিব্রত বোধ করছি। প্রথমত, নাদির আহমেদ সম্পর্কে কিছু না জেনেই ওনার সঙ্গে দেখা করা বিশাল অন্যায় হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, দেখা করতে যাওয়ার মতো সুযোগ আমার বাড়ি থেকে কোনোদিন দেবে না।
রৈনীল বললো, 'ডেটটা মাথায় রেখো। আর সময়মতো চলে যেও।'
ফোন কেটে দিলো সে। আমি চরম বিরক্তি নিয়ে ইউটিউবে নাদির আহমেদের নাম লিখে সার্চ করলাম। ওনার ফলোয়ার্স ৩ মিলিয়ন। এটা দেখে আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো।
ফারাহকে কল দিলাম আমি। এ কেমন পরিস্থিতি! এটা সামলে নেয়ার মতো বুদ্ধি তো আমার নেই। সত্যিই তো আমি ভীষণ বোকা! সেদিন রৈনীলের সঙ্গে রাগ করা উচিৎ হয়নি আমার।
ফারাহ কথাটা শুনেই খুশিতে গদগদ হয়ে বললো, 'সিরিয়াসলি! কিভাবে ম্যানেজ করলো উনি?'
'জানিনা।'
'সেও তোমাকে পছন্দ করে সরণী। তুমি নিশ্চিত থাকো।'
'রাখো তোমার পছন্দ। আগে নাদির আহমেদের বিষয়টা সমাধান করো।'
'আমি যাবো দেখা করতে। তোমাকে যেতে হবে না।'
'উফফ, বাচলাম। থ্যাঙ্কিউ।'
ফারাহর কল কেটে দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। মেয়েটা আশ্চর্যজনক উপায় বলেছিলো বটে। তবে রৈনীল যে ঘটনা ঘটালো, তা সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এতে কি প্রমাণ হয় সে আমাকে পছন্দ করে? আমার তো সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না।
হঠাৎ এক রাশ বিষণ্ণতা আমাকে গ্রাস করলো। প্রেমে পড়ার ডিপ স্টেজে নাকি এমন হয়, ফারাহ বলেছিল। ভালো লাগছে না কিছুই। ইচ্ছে করছে হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কাঁদি।
চার তারিখ রাতে রৈনীলের মেসেজ, 'জেগে আছো?'
আমি চমকে উঠলাম। লাস্ট কয়েকদিন আমাদের কোনো কথা হয়নি। ভেতরে ভেতরে অপেক্ষা করিনি এমন নয়। তবে তার থেকে কোনো টেক্সট বা কল প্রত্যাশাও করিনি। তাই খানিকটা বিস্মিত হলাম।
বললাম, 'জেগে আছি।'
'কালকের দিনের জন্য প্রস্তুত?'
'সরি। আপনাকে অযথা কষ্ট দিয়েছি। আমি যেতে পারবো না। আমার বান্ধবী যাবে দেখা করতে।'
অনেক্ষণ রৈনীলের কোনো উত্তর না পেয়ে কল দিলাম আমি। সে রিসিভ করে চুপ করে রইলো। হয়তো আমার ওপর রেগে গেছে। আমি অপরাধীর মতো বললাম, 'সরি।'
'ইটস ওকে। তোমার বান্ধবীকে যথাসময়ে যেতে বোলো।'
'আপনি এটা কিভাবে ম্যানেজ করলেন?'
রৈনীল শুকনো হাসি দিয়ে বললো, 'এ আর এমন কী!'
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। আমি বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। ফোনটা রেখে দিতেও ইচ্ছে করছে না। বরাবরের মতো আজকেও রৈনীলই উদ্ধার করলো আমায়।
বললো, 'তোমার পটরপটর করার সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করেছো নাকি?'
'না। আমার মন খারাপ।'
'নাদির আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারবে না বলে?'
'না।'
'তাহলে?'
'আপনাকে বিব্রত করলাম।'
'সমস্যা নেই। তোমার মন খারাপ হচ্ছে না জেনে ভালো লাগলো।'
'আমার মন ভালো করে দিতে আপনার ভালো লাগে?'
রৈনীল কোনো উত্তর না দিয়ে বললো, 'আকাশে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখো।'
আমার বুকের ভেতর কেমন যেন ধুকধুক করে উঠলো। আমার জন্য কোনো অনুভূতি আছে বলেই কি এই প্রশ্নটা এমন করে এড়িয়ে গেলো সে! বুকের কাঁপন থামাতে আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।
এমন সময় দরজা খুলে আমার মা ঘরে প্রবেশ করলেন।
.
.
.
চলবে.........................................................................