গুলনূরের চোখের ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে জাওয়াদের শরীরেও একটা অজানা শিহরণ খেলে যায়। মেয়েটির সারা দেহ কাঁপছে, যেন কোনো ভয়ঙ্কর স্মৃতি তাকে গ্রাস করে ফেলেছে।
জাওয়াদ আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেল। তার কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব কোমল করে বলল, "আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাই না। আমি শুধু..." কথাটা শেষ না করেই থেমে গেল। গুলনূরের চোখে জল টলমল করছে। গুলনূর কাঁপা হাতে ইশারা করল। তার আঙ্গুলগুলো কথা বলছিল, 'আমি ঠিক আছি, কিন্তু দয়া করে দূরে থাকুন।' তার নীরব আর্জিতে জাওয়াদের বুকের ভেতরটা টনটন করে ওঠে। সে আরও দু'পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, "দেখো, আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। তোমার নিরাপত্তার সীমানা আমি লঙ্ঘন করছি না।"
ধীরে ধীরে গুলনূরের কাঁধের টানটান ভাব কিছুটা শিথিল হয়। তবে তার চোখে এখনও সতর্কতার ছায়া। জাওয়াদ দরজার দিকে পা বাড়ায়। যাওয়ার আগে একবার ফিরে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল, "যদি কখনো মনে করো কারও সাহায্য দরকার, আমি কাছেই আছি।"
সে গুলনূরের ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটছিল। তার পদক্ষেপে একটা অস্থিরতা, মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো প্রশ্ন। মহলের বাঁকে মনিরের সঙ্গে দেখা হয়। মনির তাকে দেখে সম্মানের সঙ্গে কুর্নিশ করতে যাচ্ছিল, জাওয়াদ হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল,
"আমার ঘরে চল। এখনই।"
মনির মাথা নত করে বলল, "জি, হুজুর।"
জাওয়াদ জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। তার চোখের সামনে কেবল ভেসে উঠছে গুলনূরের ভয়ার্ত মুখ। কিছুক্ষণ পর সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, "মনির, মন দিয়ে শোন। গুলনূরের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় জানতে চাই। ওর জন্ম থেকে শুরু করে, যতদিন না আমি এই মহলে এসেছি সবকিছু। কোনো ফাঁক যেন না থাকে।"
মনির কিছুটা অবাক হলেও প্রশ্ন করল না। মাথা নত করে বলল, "জি, হুজুর। কিন্তু..."
"কিন্তু কী?" জাওয়াদের ভ্রূ কুঞ্চিত হলো।
"হুজুর, এই কাজ সহজ হবে না। গুলনূর তো কথা বলে না..."
জাওয়াদ হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, "জন্মগত বোবা কানে শুনতে পায় না। কিন্তু গুলনূর শুনতে পায়। এর মানে কী?"
মনির নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। জাওয়াদ এবার তার মখমলের চেয়ারে বসে বলল,
"আমি জানতে চাই গুলনূর কি সত্যিই জন্মগত বোবা? নাকি..." জাওয়াদ একটু থামল, "নাকি কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনার পর ও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে? গুলনূর যে গ্রামে বড় হয়েছে, সেখানে গিয়ে খোঁজ নে। ওর পরিবার, প্রতিবেশী, সবার সঙ্গে কথা বল।"
"জি হুজুর, আমি নিজে গুলনূরের গ্রামে যাব।"
জাওয়াদ উঠে দাঁড়াল। জানালার কাছে গিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, "গুলনূরের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের খবর চাই।" তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে মনিরের চোখে চোখ রেখে বলল, "আগামীকাল থেকেই খোঁজ শুরু কর।"
মনির মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, "জি, হুজুর। আমি কাল ভোরেই রওনা হব।"
জাওয়াদ আবার জানালার দিকে ফিরল। অপলক তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে।
সকালের কোমল রোদ জানালার পর্দা ভেদ করে অলসভাবে বৈঠকখানায় ছড়িয়ে পড়ছে। ঘরের মাঝখানে বসা সুফিয়ান ভুইয়া গভীর মনোযোগে কিছু কাগজপত্র দেখছিলেন। কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ, চোখে অস্থিরতার ছায়া। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কাঁধ দুটো আরও ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে সাম্প্রতিক দুশ্চিন্তায়। পাশের ঘর থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এলে মুখ তুলে দেখলেন জাওয়াদকে।
"জাওয়াদ। " সুফিয়ান ভূঁইয়া ডাকলেন।
জাওয়াদ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বাবার সামনে দাঁড়াল। সুফিয়ান একটু গলা পরিষ্কার করে নিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর অস্ফুট স্বরে বললেন, "তোমার বন্ধুর ভাই কবে আসবে? একটা অবিবাহিত যুবতী মেয়ে আর কতদিন এভাবে আমাদের বাড়িতে থাকবে?"
একটু থামলেন। তারপর আবার শুরু করলেন, "গতকাল মসজিদের সাহেব আলী মিয়া ডেকে বলল, 'ভূঁইয়া সাহেব, আপনার ছেলে নাকি বাড়িতে একজন যুবতীকে...'" কথাটা শেষ করতে পারলেন না তিনি। গলায় আটকে গেল বাকি শব্দগুলো। "লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেল আমার। এই বয়সে..."
জাওয়াদের মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। সে যেন পাথরের মূর্তি। শান্ত, স্থির কণ্ঠে বলল, "চিন্তা করবেন না বাবা। ওর ভাই দ্রুতই এসে যাবে। আর বেশি দেরি নেই।"
সুফিয়ান টেবিলের উপর চশমাটা খুলে রেখে জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখেন গ্রামের সকাল জেগে উঠছে। দূরে কৃষকেরা মাঠে যাচ্ছে। সেদিকে চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, " আমি তোমার সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছি। তুমি যখন বললে মেয়েটাকে তুমি ভালোবাসো, প্রথমে রাগ হলেও পরে মেনে নিয়েছি, থাকতে দিয়েছি। কিন্তু এই ছোট গ্রাম তোমার শহরের মতো না৷ এখানে খবর ছড়ায় দাবানলের মতো। লোকে কত কী বলাবলি করছে। আমার বংশের মর্যাদা, সামাজিক অবস্থান সবকিছু নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে।"
জাওয়াদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ সিঁড়ির দিকে তার নজর আটকে গেল। রাইহা নেমে আসছে। হাতে একটা ছোট সুটকেস, কাঁধে ঝুলন্ত ব্যাগ। সুফিয়ানও ঘুরে তাকালেন। দুজনের চোখেই বিস্ময়ের ছায়া। রাইহা ধীর, নিঃশব্দ পদক্ষেপে এগিয়ে এল বৈঠকখানার দিকে।
রাইহা একবার জাওয়াদের দিকে তাকাল।
তারপর সুফিয়ানের দিকে ফিরে বলল, "আংকেল, আমি চলে যাচ্ছি।" রাইহার কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়া পাতার বিষণ্ণতা। এই বাড়িটা তার কাছে একটা স্বপ্নের মতো ছিল। এমন একটা আশ্রয় ছিল যেখানে সে নিরাপদ বোধ করত। এখন সেই স্বপ্নের মায়াজাল ভেঙে গেছে ধীরে ধীরে। তার বুকের ভেতর একটা অজানা যন্ত্রণা পাক খাচ্ছে। এই পৃথিবীতে তার জন্য কোথাও জায়গা নেই। কেউ নেই নিঃস্বার্থভাবে তাকে তার মতো করে ভালোবাসার। এখানে প্রতিটি মুহূর্তে সে টের পাচ্ছে, এই বাড়ির মানুষগুলো তাকে কতটা অপছন্দ করে। তাদের চোখে সে একটা বোঝা, একটা অবাঞ্ছিত অতিথি।
রাইহা থমথমে গলায় বলল, "আপনারা এত দিন আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন, পাশে ছিলেন… আমি কখনো ভুলব না। কিন্তু আমি জানি, আমার উপস্থিতি আপনাদের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার আমি নিজে থেকেই বিদায় নিচ্ছি।"
সুফিয়ানের মুখে বিভ্রান্তির ছায়া পড়ল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "কোথায় যাবে তুমি?"
রাইহা একটু থেমে উত্তর দিল, "শহরে আমার এক দূর সম্পর্কের খালার বাড়ি আছে। সেখানে যাব। তারপর..." কথাটা অসমাপ্ত রেখে সে মেঝের দিকে তাকাল।
ঘাটে গেলে নাভেদের লোক এসে তাকে নিয়ে যাবে। প্রথমে শুনে যে উচ্ছ্বাস কাজ করেছিল তা এখন পাথরের মতো ভারী হয়ে বুকে চেপে বসেছে। সে জানেও না তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। কোন অজানা পথের যাত্রী হতে হবে তাকে? যে পথের শেষ কোথায়, তা-ও অজানা। এই অনিশ্চয়তা তার হৃদয়ে তীক্ষ্ণ ছুরির মতো বিঁধছে। আসিফ ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই রাইহার চোখ ছলছল করে উঠল। সে কী সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছিল! নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে মুক্তির স্বাদ দিতে চেয়েছিল। এখন যদি সে না জানিয়েই অন্য কোথাও চলে যায়, এই খবর শুনে আসিফ ভাই নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাবে।
কিন্তু এখানেও বা কী করে থাকবে? এখানে সে আশ্রয় পেয়েছে, ভালোবাসা পায়নি। প্রতিটি দেয়াল যেন তাকে বলে, তুমি এখানে অবাঞ্ছিত।
সুফিয়ান এগিয়ে এলেন, "কিন্তু তোমার ভাই তো ইংল্যান্ড থেকে আসবে। জাওয়াদের সঙ্গে তোমার বিয়ের কথাবার্তা..."
রাইহা কথা শেষ হতে দিল না। "আংকেল।" তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, "আমরা মিথ্যা বলেছি। আমার কোনো ভাই নেই ইংল্যান্ডে। জাওয়াদের সঙ্গে আমার কোনো প্রেমের সম্পর্কও নেই।"
সুফিয়ান বিস্ময়ে চকিতে জাওয়াদের দিকে তাকালেন।
জাওয়াদ এতক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল। এবার সে কৈফিয়ত দেয়ার তাড়নায় এক পা এগিয়ে এল, "বাবা, আমি রাইহাকে ওর বিয়ের আসর থেকে উদ্ধার করেছিলাম। ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। আমি ভেবেছিলাম..."
সুফিয়ান ভুইয়ার মুখ রাঙা হয়ে উঠল ক্রোধে। তিনি প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, "একটা পরের মেয়েকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনে আমাদের বাড়িতে রেখেছো? আর আমাদের বলেছো ও তোমার প্রেমিকা? এতবড় মিথ্যা?"
জাওয়াদ কিছু বলতে চাইল, তার আগেই সুফিয়ান বললেন, "একটা মেয়েকে তার পরিবার থেকে জোর করে নিয়ে আসা! এটা অপহরণের শামিল। তুমি কি জানো এর শাস্তি কী?"
জাওয়াদ বাবার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে রইল, "বাবা, আপনি জানেন না সেখানে কী হয়েছিল! না জেনে কথা বলছেন। রাইহাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। ও কাঁদছিল, মিনতি করছিল..."
"তাতে কী?" সুফিয়ান প্রায় গর্জে উঠলেন, "সেটা তাদের পারিবারিক ব্যাপার। তুমি কে হও মাঝখানে নাক গলানোর?"
"বাবা, আমি জানি আমি ভুল করেছি। কিন্তু..."
"চুপ করো!" সুফিয়ান এমন গর্জে উঠলেন যে ললিতা, জুলফা সহ দাসীরাও সেই স্থানে চলে এল।
সুফিয়ান বলছেন, "তুমি নিজেকে কী ভাবো? মহান রক্ষাকর্তা? কোন সাহসে অপরিচিত একটা মেয়েকে তার পরিবার থেকে নিয়ে এলে? তারপর বাবা-মাকে মিথ্যার পর মিথ্যা বললে। প্রেমিকা? ইংল্যান্ডে ভাই? বিয়ের পরিকল্পনা? সব ফাঁকি?"
জাওয়াদ একটু নরম সুরে বলল, " সেই মুহূর্তে আমার কাছে এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। আসিফ আমার বন্ধু, ও আমাকে অনুরোধ করেছিল..."
"পথ ছিল না?" তিনি প্রায় গর্জে উঠলেন, "পুলিশে যেতে পারতে না? আইনি পথ নিতে পারতে না? কিন্তু না, তোমাকে তো মহানায়ক সাজতে হবে!"
জাওয়াদ বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। সে বোঝাতে চেষ্টা করল, "বাবা, আপনি যদি সেই পরিস্থিতি দেখতেন..."
সুফিয়ান ছেলের কথা শুনতেই ইচ্ছুক নন। নিজের মতো বলে যাচ্ছেন, "এখন ওর পরিবার যদি পুলিশে যায়? ভূঁইয়াদের নামে অপহরণের মামলা করে? সমাজে মুখ দেখাবার জায়গা থাকবে? তুমি কি একবারও ভেবেছ এর পরিণতি কী হতে পারে?"
ঘরের মধ্যে অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। জাওয়াদ নিশ্চুপ। হঠাৎ সুফিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তিনি ধীর, অটল কণ্ঠে বললেন, "এই মুহূর্ত থেকে তুমি আর এই মেয়ে, দুজনেই আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।"
কথাটা যেন বাজের মতো আছড়ে পড়ল সবার মনে। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল হতবাক নীরবতায়। জাওয়াদের চোখ বিস্ফোরিত, মুখে অবিশ্বাসের ছাপ। "বাবা!" সে আর্তনাদ করে উঠল, "আপনি কথায় কথায় আমাকে চলে যেতে বলবেন না।"
সুফিয়ান ভুঁইয়া আরও কঠোর হয়ে উঠলেন, "আমার কাছে সবকিছুর থেকে আমার পরিবারের সম্মান বড়। আমি জীবনভর মাথা উঁচু করে বেঁচেছি। তোমার এই বেপরোয়া কাজের জন্য আমি আমার জীবনের সব অর্জন ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারব না।"
রাইহা এতক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়েছিল। এবার সে এক পা এগিয়ে এল। তার চোখে জল টলমল করছে। কণ্ঠস্বরে অদম্য সাহস নিয়ে বলল, "আংকেল, প্লিজ, আমার কথা শুনুন।"
সুফিয়ান অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন। ছেলেকে বাড়ি থেকে বের হতে বলে তিনি নিজেই ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছেন।
রাইহা তার কথাগুলো বলতে শুরু করল, "এ ঘটনার জন্য আমিই দায়ী আংকেল। জাওয়াদের কোনো দোষ নেই। ও আমাকে এখানে আনতে চায়নি। আমার ফুফাতো ভাই আর আমি... আমরাই ওকে অনুরোধ করেছিলাম। আমি আপনার ছেলের বন্ধু আসিফের ফুফাতো বোন। আমার দাদা ছিলেন ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। একজন সফল ব্যবসায়ী। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন সুখকর ছিল না। বাবার জন্মের কিছুদিন পর দাদা-দাদির মধ্যে ভয়ানক ঝগড়া হয়। শেষ পর্যন্ত উনারা আলাদা হয়ে যান।"
রাইহা থামল, গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "দাদি দাদার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বাবাকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। বাবা বড় হলেন মায়ের আদরে, কিন্তু বাবার ভেতরে সারাজীবনের জন্য রয়ে গেল দাদার শূন্যতা।"
রাইহার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। সে নিজের বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করছে, "আমি প্রথমে বাবা-মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশেই ছিলাম। আমাদের সংসারে অনেক সুখ ছিল, অনেক হাসি ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। বাবা-মায়ের মধ্যে শুরু হলো ঝগড়া, অশান্তি। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম, বুঝতাম না কেন এমন হচ্ছে। শুধু দেখতাম, মা প্রতিদিন কাঁদছেন, বাবা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন।"
রাইহার শরীর কাঁপছে। জাওয়াদ এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ালে রাইহা তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করল, "শেষ পর্যন্ত বাবা-মাও আলাদা হয়ে গেলেন। আমার দুনিয়াও ভেঙে পড়ল। কয়েক বছর পর মা একজন প্রবাসীকে বিয়ে করে আমাকে নিয়ে লুকিয়ে ইংল্যান্ড চলে গেলেন। সেই থেকে আমি সেখানেই ছিলাম। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ। কিন্তু মনের ভেতর বাবার অভাবটা প্রতিনিয়ত টের পেতাম।"
রাইহার কণ্ঠস্বর এবার আরও ভারী হয়ে এল। তার চোখে জল আর থামছে না। "কতগুলো বছর কেটে গেল। আমি বড় হলাম। কিন্তু বাবার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো কমল না। প্রতিদিন ভাবতাম, একদিন হয়তো বাবা আমাকে খুঁজতে আসবেন। কিন্তু তিনি কখনো আসেননি।"
রাইহা একটু থেমে নিজের চোখ মুছল। "শেষ পর্যন্ত আমিই ঠিক করলাম, আমি বাবার কাছে যাব। মায়ের অনুমতি না নিয়েই চলে এলাম বাংলাদেশে। ভেবেছিলাম, বাবা আমাকে দেখে খুশি হবেন। কিন্তু..." রাইহার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল।
জাওয়াদ এবার এগিয়ে এসে রাইহার পাশে দাঁড়াল। সে ধীরে ধীরে বলল, "রাইহার বাবা ওকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইছিল ওর চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে। যাতে ও আর বিদেশে ফিরে যেতে না পারে।"
রাইহা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তার কাঁধ কাঁপছে। সে কষ্টে বলল, "বাবা আমার পাসপোর্ট নিজের কাছে রেখেছেন। মা ব্যক্তিগত কিছু আইনি জটিলতার কারণে দেশেও আসতে পারছেন না। আমি একটা অন্ধকার গর্তে পড়ে গিয়েছিলাম, আংকেল। কোথাও কোনো আলো দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাই আসিফ ভাই জাওয়াদকে অনুরোধ করে আমাকে কিছুদিন লুকিয়ে রাখার জন্য। বাবা হয়তো এখন পাগলের মতো আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আমাকে পেলেই..." রাইহা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
সুফিয়ান দীর্ঘক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার চোখে-মুখে একইসঙ্গে বিস্ময়, সহানুভূতি, ক্রোধ, হতাশা। একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে মনের ভেতর দিয়ে।
অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই তাকিয়ে আছে সুফিয়ানের দিকে। রাইহা নত মাথায় কেঁদে চলেছে।
সুফিয়ান যখন গম্ভীর কণ্ঠে ডাকলেন, "রাই।"
রাইহা চমকে উঠল। তার বুকের ভেতর হাতুড়ির মতো বাজছে। সে ভয়ে ভয়ে, অপরাধীর মতো সুফিয়ানের দিকে তাকাল। সুফিয়ান ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন রাইহার দিকে। বললেন, "তুমি কোথাও যাচ্ছো না।"
রাইহা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। তার চোখে বিভ্রান্তি। জাওয়াদও অবাক হয়ে গেল বাবার এই আকস্মিক ঘোষণায়।
সুফিয়ান আরও নরম সুরে পিতৃসুলভ স্নেহে বললেন, "তোমার জীবনে যা ঘটেছে, তা কোনো মেয়ের জীবনে ঘটা উচিত নয়। তোমার বাবা-মা দুজনেই তোমার প্রতি চরম অবিচার করেছেন। তাদের স্বার্থপরতা আর অমানবিকতার শাস্তি তোমাকে ভোগ করতে দেওয়া যায় না।"
রাইহার চোখে অশ্রুর বান ডেকে এল। সুফিয়ান এক পলকের জন্য ঘরের সবার দিকে তাকালেন। জাওয়াদ, তার স্ত্রী, জুলফা এমনকি বাড়ির কাজের লোকদের দিকেও। তিনি সবার নীরব সম্মতি চাইছেন এই মেয়েটিকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য। তারপর করুণায় ভরা কণ্ঠে বললেন, "এই বাড়িতে তুমি যতদিন খুশি থাকতে পারো। এখানে তোমার নিরাপত্তার কোনো অভাব হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে, নিরুদ্বেগে থাকবে। তোমার বাবা বা অন্য কেউ, সে যত বড় ক্ষমতাধরই হোক না কেন, তোমাকে জোর করে কিছু করাতে পারবে না। আমরা সবাই মিলে তোমাকে রক্ষা করব। তোমার দূরসম্পর্কের খালার বাড়িতে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। আমার এই বাড়িতে অনেক জায়গা আছে, অনেক ঘর খালি পড়ে আছে। তুমি যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকো।"
রাইহা আর নিজেকে সামলাতে পারল না। সে সত্যি এখানে থাকতে চায়৷ তার বুকের ভেতর যে আবেগের বাঁধ ছিল, তা এক মুহূর্তে ভেঙে পড়ল। সে কেঁদে উঠল। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে, মনে হচ্ছে সে ভেঙে পড়বে। সুফিয়ান ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন রাইহার দিকে। তিনি আস্তে করে হাত রাখলেন রাইহার মাথায়। সেই স্পর্শে এক অদ্ভুত নিরাপত্তাবোধ ছড়িয়ে পড়ল রাইহার সারা শরীরে। সুফিয়ান কয়েক মুহূর্ত রাইহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। যেন একজন পিতা তার কন্যাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তারপর তিনি আস্তে করে সরে গেলেন, রাইহাকে তার নিজের অনুভূতির সাথে একা থাকার সুযোগ দিয়ে।
জাওয়াদ অবাক বিস্ময়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। সে জানত তার বাবা কঠোর স্বভাবের মানুষ, কিন্তু আজ তিনি যে রূপ দেখালেন, জাওয়াদকে অভিভূত করে দিল। একটা বিপদগ্রস্ত মেয়ের অসহায়ত্বর কথা শুনেই তিনি তাৎক্ষণিক নরম হয়ে গেলেন! তার বাবা শুধু একজন সফল ব্যবসায়ী নন, বরং একজন অসাধারণ মানবদরদী ব্যক্তি, সেটা সে আজ প্রথম উপলব্ধি করল।
·
·
·
চলবে........................................................................