হালকা সালকা মেঘলা আকাশ, মৃদু মৃদু বাতাস বইছে। সূর্যের মৃদু আলো মাথা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। জানালার কাঁচ গলিয়ে সূর্যের নরম আলো মেঝেতে পড়েছে। তূর্ণ গভীর অলসতায় ঘুমিয়ে আছে। সূর্যের মিষ্টি উষ্ণতা সে অনুভব করতে পারছে না। কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল পিঠে ছড়িয়ে আছে, ভেজা চুল থেকে পানি পরছে টপটপ। জুবিয়া তার ভেজা চুলে একটা তোয়ালে জড়িয়ে নিল। তারপর পরিষ্কার নীল আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, আর সাথে সাথে জেনো ভালোলাগার অনূভুতি এসে তাকে আদর করে জড়িয়ে ধরলো। মনটা খুশি আর উত্তেজিত হয়ে উঠল তার। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ব্যালকনি থেকে রুমে ফিরে এলো জুবিয়া। বিছানায় তূর্ণর খোলা বুক দেখে সাথে সাথে তার বুক ভারী হয়ে উঠল। এলোমেলো চুলগুলো কপালে ছড়ানো, আর তূর্ণ শিশুর মতো ঘুমিয়ে আছে। জুবিয়া স্থিরভাবে খাটের দিকে এগিয়ে গেল। সেসময় সূর্যের আলো তূর্ণর মুখে আঁচড়ে পড়ে। মৃদু কেঁপে উঠল তূর্ণ।
জুবিয়া আস্তে করে তূর্ণর পাশে বসল। তূর্ণর ঘুমন্ত মুখ দেখে তাকে অসহায়ত্ব ঘিরে ধরলো, হুট করেই কান্না পাচ্ছে। জুবিয়া খানিকটা ঝুঁকে পড়ল, আজই এই মানুষটিকে শেষ দেখছে সে। আবার কবে দেখা হবে তা জানে না। ঘড়িতে কয়টা বাজে? হয়তো সকাল ছয়টা বা একটু বেশি। বিকেলের ফ্লাইটে তূর্ণ চলে যাবে দূর দেশে।
জুবিয়ার বুকে কম্পন শুরু হলো, ভয়াবহ ভাবে কাঁপতে লাগল। হঠাৎ চারিপাশ খালি লাগছে তার। জুবিয়া তূর্ণর বাবরি চুলে হাত গুঁজে দিল। আচ পেয়ে চোখ খুলল তূর্ণ। চোখ খুলে প্রথমে জুবিয়াকে দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হাসল, তারপর জুবিয়ার হাত ধরে কাছে টেনে নিল। ফর্সা, লোমহীন বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ওঠল জুবিয়া। সহসা তূর্ণর ঘুম একেবারে কেটে গেল। ভ্রুকুটি করে উঠে বসল সে। তূর্ণ জুবিয়ার সামনে বসে তার গালে একটা হাত রাখল। হঠাৎ পুরুষালি স্পর্শে কেঁপে ওঠে জুবিয়া। তূর্ণ মৃদু ও ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
'বউ, কাঁদছ কেন?'
জুবিয়া কিছু বলল না। আলগোছে চোখের জল মুছে তারপর কিছুক্ষণ তূর্ণর বুকে শুয়ে রইল। তূর্ণ হাসল। সে জুবিয়ার ভেজা চুল থেকে ঘ্রাণ নিল। তারপর শুধল,
'শ্যাম্পু করেছ?'
জুবিয়া উচ্চারণ করলো,
'হুহ।'
'গন্ধটা বেশ ভালো।'
তূর্ণ খানিকক্ষণ চুপ থাকল। সে দ্বিতীয়বার জুবিয়ার মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করেনি। জুবিয়ার চোখ দেখে বুজতে চেষ্টা করলো হঠাৎ মন খারাপ হলো কেন তার? অবশেষ একটা কারণ তার মাথায় এলো। তূর্ণ জুবিয়াকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বলল,
'আমার ফ্লাইট কাল সকালে বউ, আজ যাবো না।'
জুবিয়া মাথা তুলে তূর্ণর চোখের দিকে তাকাল। তূর্ণ কুটিল হেসে বলল,
'আজ আমি তোমার সাথে দেশেই থাকব। ইতালি যাওয়ার আগে আমি তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। নাস্তার পর রেডি হবে।'
জুবিয়া মাথা নেড়ে উঠে গেল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল তূর্ণ। সে আচমকা জুবিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। জুবিয়ার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। তূর্ণ তার কাঁধে থুতনি রেখে ফিসফিস করে বলল,
'আমি আজ প্রথম তোমাকে স্পর্শ করছি না। তাহলে কাঁপছ কেন?'
কাঁপা কাঁপা গলায় বলল জুবিয়া,
'আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন?'
তূর্ণ নরম গলায় বলল,
'এখন বলব না, সময় হলেই দেখতে পাবে।'
জুবিয়া দেয়ালের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তারপর জিজ্ঞেস করলো,
'আমি আপনার জন্য নাস্তায় কী বানাবো?'
তূর্ণ এখনো জুবিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে সাবধানে হাত দিয়ে জুবিয়ার মাথা থেকে তোয়ালেটা খুলে দিল। তারপর ভেজা চুল হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকাতে লাগল। জুবিয়া হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্ণ হেয়ার ড্রায়ার পাশে রেখে দিল। জুবিয়ার চুলগুলো ধরে বাম দিকে রাখল তারপর জুবিয়ার পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ালো তূর্ণ। জুবিয়া কেঁপে উঠল এবং দ্রুত সরে গেল। জুবিয়া আতঙ্কিত গলায় বলল,
'আমি কিছুক্ষণ আগেই গোসল করেছি।'
একটা বাঁকা হাসি দিয়ে তূর্ণ বলল,
'আবার করবে। সমস্যা কি?'
জুবিয়া এক-দুই কদম পিছিয়ে যেতে যেতে বলল,
'পানি খুব ঠান্ডা।'
তূর্ণ ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে বলল,
'তোমার সাথে আমি থাকলে ঠান্ডা পানি ও গরম লাগবে।'
জুবিয়া ঠোঁট চেপে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাল। তূর্ণ জোরে হেসে উঠল। তারপর লহু কণ্ঠে বলল,
'আমি মজা করেছি। ভয় পেও না আর শোন, তোমাকে নাস্তা বানাতে হবে না। স্টিফেনকে বল সে ব্যবস্থা করবে। আর সেহরিশকে জানাতে হবে আমি আজ ওদের সঙ্গে যাব না। আমার ফোন এবং স্যুট বের করে বিছানায় রাখো, আমি গোসল করে আসছি।'
জুবিয়া জিজ্ঞেস করলো,
'আপনি আজ কোন স্যুট পরবেন?'
তূর্ণ বাথরুমে ঢুকল। সে দরজা খুলে মাথা গলিয়ে জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
'তোমার যা খুশি।'
জুবিয়ার পরনে মেরুন রঙের হাফ সিল্কের শাড়ি। আর চুলগুলো খুলে রেখেছে সে, তূর্ণ পাশে দাঁড়িয়ে আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি দেখছে। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করে আয়নায় একবার জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের দিকে তাকাল। জুবিয়া সরু গলায় বলল,
'বর বর লাগছে।'
তূর্ণ ওষ্ঠদ্বয় মিলিয়ে কুটিল হাসল।
স্টিফেন গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্ণকে আসতে দেখে গাড়ির দরজা খুলে দিল সে। তূর্ণ আর জুবিয়া একসাথে গাড়িতে বসল। স্টিফেন এবং কিছু দেহরক্ষী তূর্ণকে ফলো করবে আরও দুটি গাড়িতে করে। জুবিয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। একটু পর তূর্ণর উদ্দেশ্য বলল,
'আজ আপনার ফ্লাইট আছে। আপনি ফ্লাইট বাতিল করেছেন, রাগ করবে না বড় ভাইরা?'
তূর্ণ জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
'সেহরিশ আর সাদাফের কথা বলছ?'
'হ্যাঁ।'
'ওরা রাগ করবে না। এটা খুব সহজ বিষয়, তুমি চাপ নিও না। আমি সামলে নেব।'
জুবিয়া চুপ করে রইল। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চেনা পথ দেখে হুট করে জিজ্ঞেস করলো,
'এদিকে কোথায় যাচ্ছি?'
'জানতে এত কৌতুহল কেন? আমাকে বিশ্বাস করো না?'
'এটা বিশ্বাসের কথা নয়, আমি শুধু জায়গাটার নাম জানতে চাই।'
তূর্ণ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
'বসুন্ধরা।'
জুবিয়া চমকে উঠল।
'আপনি সেখানে যাচ্ছেন কেন?'
তূর্ণ বলল,
'আমরা যাচ্ছি।'
'কেনো?'
'সিক্রেট কথা বলা যাবে না।'
দেশে তূর্ণর বিশাল ফ্যানবেইস রয়েছে। বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের সামনে ভক্তদের উন্মাদনা, তূর্ণ এসেছে শুনে লোকজন তাকে দেখতে ছুটে আসে, তূর্ণকে দেখে তারা আরও উচ্ছ্বসিত হন। দূর থেকে দুটো কথা বলে তূর্ণ ভেতরে প্রবেশ করল। বডিগার্ডদের কড়া পাহারায় লোকজন কাছে যেতে পারেনি।
বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের বেসমেন্ট-২-এর একটি দোকানে ঢোকে তূর্ণ। জুবিয়া হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তূর্ণ বেশ কয়েকটি আইফোন বের করতে বলে। তারপর অনেক ফোন বের করে কাচের উপর রাখা হয়। সবগুলোর মধ্য থেকে তূর্ণ জুবিয়ার জন্য একটি ফোন বেছে নিল। তখন তা জুবিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
'পছন্দ হয় নাকি আমি আরেকটা দেখব?'
জুবিয়া ইতস্তত করে বলল,
'এই ফোনের দাম বেশি। আমার মোবাইল ঠিকঠাক কাজ করছে। এত দামি ফোনের দরকার নেই।'
নরম সুরে বলল তূর্ণ,
'আমি সিদ্ধান্ত নেব তোমার কী দরকার আর কী লাগবে না। তুমি শুধু বল তোমার পছন্দ হয়েছে কি না?'
জুবিয়া এখনো ইতস্তত করছে। তূর্ণ এগোল। জুবিয়া এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,
'আমি প্রতিদিন তোমাকে ফলো করতাম। তুমি কখন, কোথায়, কী করেছ সেদিকে নজর রেখেছি। তুমি যখন তোমার ফোনটি কিনছিলে তখন আমি বাইরে থেকে দেখছিলাম। তখন সারা দোকানের ফোন তোমাকে কিনে দিতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু উপায় ছিল না তখন। এখন আমার সেই অধিকার আছে। জুবিয়া, তুমি আমার বউ! পৃথিবীর সব সুখ তোমার পায়ের কাছে নিয়ে আসবো শুধু তোমার জন্য।'
জুবিয়া কোনো জবাব দিল না। মুখ তুলে একবার তাকাল ও না সে। তূর্ণ ফোনটা কিনে জুবিয়ার হাতে দিল। তারপর একটা কল এলো আর সঙ্গে সঙ্গে তূর্ণ দোকান থেকে একটু বেরিয়ে গেল। জুবিয়া মাথা তুলে তাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে।
সেহরিশ ফোন করেছে। তূর্ণ তাকে সব বুঝিয়ে বলল, তার না যাওয়ার কারণ শুনে সেহরিশ রাগ করল না। শান্ত কণ্ঠে বলল,
'কালকের ফ্লাইট মিস করবি না।'
তূর্ণ হতভম্ব। তূর্ণ যাবে না শুনে ওর রেগে যাবার কথা, কিন্তু শান্ত গলায় কথা শেষ করে কল কেটে দিল। সেহরিশ -এর এত পরিবর্তন কার জন্য? ভাবলো তূর্ণ।
❐
সেহরিশ নিচতলা থেকে দ্বিতীয় তলায় এলো। তারপর ভ্রুকুটি করে রুমের ভেতর তাকাল, ঘরের প্রতিটি কোণে চোখ বুলিয়ে নিল সে। রোদেলা রুমে নেই। সেহরিশের ভেতরটা কেঁপে উঠল হঠাৎ, এই সময় রোদেলা কোথায় গেল? সেহরিশ দ্রুত বাথরুমে গিয়ে দেখল রোদেলা সেখানেও নেই। দুই আঙুল দিয়ে মাথা চুলকাতে লাগল, চুলে বিলি কাটতে কাটতে হঠাৎ জোজোর কথা মনে পড়ল তার। ওমনি বারান্দায় হেঁটে গিয়ে দেখল রোদেলা জোজোর সঙ্গে বসে আছে। জোজো গুটিশুটি মেরে বসে রোদেলার কথা শুনছে।
সেহরিশ নিচে নেমে এলো। রোদেলার পাশে বসল। তারপর স্পষ্ট কণ্ঠে শুধল,
'জোজোকে নিয়ে চিন্তিত খুব?'
রোদেলা উপর-নিচ মাথা নেড়ে বলল,
'হুম। দূর দেশে গিয়ে ওকে আর দেখতে পাব না।'
রোদেলার গলা ভেঙ্গে যাচ্ছে। ভিতর থেকে উপচে পড়া কান্না গিলে ফেলার চেষ্টা করল সে। তখন সেহরিশের আওয়াজ শুনে থেমে গেল রোদেলা। সেহরিশ বলল,
'তুমি রেডি হও, গ্রাম থেকে বের হওয়ার সময় তোমার মামা-মামির সঙ্গে দেখা করে যাব। আর মামার বাড়িতে জোজোকে সাথে নিয়ে যাব। আমরা চলে যাওয়ার পর তুহিন ওকে এই বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে।'
রোদেলা নিশ্চুপে চলে গেল।
সেহরিশ জোজোর দিকে তাকিয়ে দেখল তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। সেহরিশ একটু ঝুঁকে পড়ল। জোজোর মাথায় হাত রাখতেই সে চোখ বন্ধ করল। সেহরিশ জোজোকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির উত্তর পাশে বিশাল নদীর দিকে হাঁটতে হাঁটতে এসে থামল। জোজো প্রশ্নবিদ্ধ চোখে সেহরিশের দিকে তাকায়। হয়তো সে কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়। সেহরিশ তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আস্তে করে বলল,
'আমি রোদকে সযতনে আগলে রাখব। আমি থাকতে তার কোনো ক্ষতি হবে না।'
.
.
.
চলবে......................................