তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ১৭ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


রৈনীলের সঙ্গে অনেক্ষণ ধরে গল্প করছি। একফাঁকে আমরা নিচে নামলাম। রাত খুব বেশী নয়। বাড়ির সামনে জ্বলতে থাকা উজ্জ্বল বাতিগুলো যেন আমাকেই আলোকিত করছে। আমার মনটা অসম্ভব ভালো। রৈনীলের সঙ্গে সমানতালে আমিও কথা বলছি, প্রাণখুলে। আমার পরিচিত কেউ দেখলে হয়তো তার মানতে কষ্ট হতো এটা সরণী। আমার চিরচেনা রূপের বাইরে এসে আমি কথা বলছি, কথা বলতে পারার মাঝেও যে সীমাহীন আনন্দ আছে তা আজ অনুভব করছি। তবে এই আনন্দ বেশীক্ষণ স্থায়ী হলোনা। 

হঠাৎ দেখলাম স্বাগতা আপু এদিকেই আসছে। কাছাকাছি এসে মুচকি হাসি দিয়ে বললো, 'তোমাদের পাঠ্যদান শেষ হলো?'
রৈনীল ভ্রু কুঁচকে ফেললো, 'পাঠ্যদান?'
'তুমি ওকে লেকচার দিচ্ছিলে না?'
'একদম না। সরণী আমাকে উলটো লেকচার দিচ্ছে।'
'এখন ড্রিংকস করবো। ভাইয়া আসুন।' 

আপু চলে যেতেই রৈনীল উঠে দাঁড়ালো। ভীষণ বিব্রত হলাম আমি। হঠাৎ বলে ফেললাম, 'আপনি মদ খান?'
'হুম।'
'রেগুলার?'
'না। অকেশনালি।'
'আমার না এসব একদম পছন্দ না।'
'খেও না। তোমাকে তো কেউ খেতে বলেনি।'

রৈনীল চলে যেতেই আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো। স্বাগতা আপুর সার্কেলে ড্রিংকস করাটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আগে কখনো বিষয়টাতে আমি বিব্রত হইনি। কিন্তু রৈনীল ড্রিংকস করবে সেটা আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ভয়ংকর রাগ করে থাকি। অথচ আমার এসব চিন্তা যেমন ছেলেমানুষী, ওর সঙ্গে রাগ করাটাও নিছক ছেলেমানুষী। ওর সাথে তো আমার রাগের সম্পর্ক না!

ওদের হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসছে। শান্ত হয়ে বসে আছি। আমি বেশ টের পেলাম, আমার চোখ ছলছল করছে। ভাইয়াকে একটা কল দিয়ে রুমের বাইরে আসতে বললাম। মিনিট খানেকের মাথায় ভাইয়া এসে জিজ্ঞেস করলো, 'কি রে? এখানে বসে আছিস কেন? ভেতরে আয়।'
'ভাইয়া, বাসায় যাবা কখন?'
'সবাই মিলে অনেক মজা করছি। এত তাড়া কেন তোর?'
'আমার ভালো লাগছে না।'
'তোর ভালো লাগেটা কি? ওরা অনেক ফানি। এসে ওদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দে, ভালো লাগবে। আয় আয়..'

ভাইয়া ভেতরে ঢুকে গেলো। আমি উঠলাম। বাসার বাইরে অসম্ভব সুন্দর বাগানটাতে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। এদিকের লাইটগুলো এত সুন্দর করে সাজানো, দাঁড়ালেই মন ভালো হয়ে যায়। আমি ইদানীং একটা বিষয় খেয়াল করেছি, আমার লাইট খুব পছন্দ। মৃদু আলো কিংবা ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো, সবকিছু ভালো লাগে আমার। খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পর বাসায় ফিরে এলাম। 

জুবায়ের ভাইয়ার ক্লোজ ফ্রেন্ড একটা গল্প বলছিলেন। সকলে সেটাই শুনছে মন দিয়ে। আমার প্রবেশে কারোই ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি নিঃশব্দে ওদের পাশে বসলাম।

আড্ডা চললো অনেক রাত অবধি। দুয়েকজন একটু বেশীই ড্রিংকস করে ফেলেছে। জুবায়ের ভাইয়া ওদেরকে গেস্টরুমে রেখে এলো। রৈনীল বেরিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ওর সঙ্গে আর কথা হয়নি।
আমরা ফেরার সময় আপু বাটিতে ভরে কিছু খাবার দিয়ে দিলো। আমার কানের কাছে এসে বললো, 'সীমান্ত কিন্তু টাল হয়ে আছে। বাসায় ফিরে মাকে একটু ব্যস্ত রাখিস। যেন টের না পায়।'

আমি একটা শ্বাস ফেলে বললাম, 'গাড়ি চালাবে কিভাবে ও?'
'রৈনীল ভাইয়া যাচ্ছে। উনি চালাবেন। তোদেরকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে উনি উবার নিয়ে চলে যাবেন।'
'উনি চালাতে পারবে?'
'উনি খুব সামান্য খেয়েছে, অসুবিধা হবেনা। নরমাল আছেন উনি।'

আমি কিছু বললাম না। বাসা থেকে বের হতেই দেখি রাস্তার পাশে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়া ওদের পাশে গাড়ি দাড় করালো। রৈনীল উঠে এলো গাড়িতে। আমি পেছনের সিটে বসে আছি নির্বিকার ভঙ্গীতে। 

রৈনীল খুব সচেতনভাবে গাড়ি চালিয়ে আমাদেরকে বাসায় পৌঁছে দিলো। এরমধ্যে একবারও আমাদের মধ্যে কোনো কথা হলোনা। সীমান্ত ভাইয়া ও রৈনীল মাঝেমাঝে টুকটাক আলাপ করছিলো নিজেদের মধ্যে। 

গ্যারেজে ঢুকতেই আমি গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাসায় চলে এলাম। একবারের জন্যও রৈনীলের দিকে তাকালাম না। এসেই মাকে বললাম, আমার চুলগুলো খুব জট লেগে গেছে। একটু খুলে দিবা? 

মা আমার সঙ্গে রুমে চলে আসলেন। আলতো করে চুল আচড়ে দিচ্ছিলেন। এমন সময় ফোনে টুং করে মেসেজ এলো। আমার আগেই ফোনটা নিয়ে নিলো মা। আমার বুক কাঁপছে, রৈনীল কোনো টেক্সট দেয়নি তো!

মা বললো, সীমান্ত মেসেজ দিয়েছে। থ্যাঙ্কিউ লিখে। কিসের জন্য ও আবার তোকে থ্যাঙ্কিউ দেয়?

আমি আমতা আমতা করে বললাম, 'আরে তেমন কিছু না। আপুর বাসায় একটা গেম খেলছিলো সবাই মিলে। ভাইয়াকে আমি জিততে হেল্প করেছি।'
'সেটা বাসায় ফিরে দিতে হবে কেন? এতক্ষণ সময় পায়নি?'
'হয়তো ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছে। তারপর মনে পড়েছে আমাকে থ্যাঙ্কিউ বলা হয়নি।'

মা আর কিছুই বললেন না। মা বেরিয়ে যাওয়ামাত্র আমি ভাইয়াকে রিপ্লাই দিলাম, অল্পের জন্য ধরা খাচ্ছিলে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘুমাও। 

ফোনটা রেখে আমিও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ভীষণ ক্লান্ত অনুভব করছি। রৈনীল ঠিকমতো বাসায় পৌঁছাতে পেরেছে কিনা জানতে ইচ্ছে করছে। ফোনটা নিয়ে অনেক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছু লিখবো লিখবো করেও লিখলাম না। 

আজ ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেইনি। ঘুমিয়ে পড়লাম অনায়াসে। খুব ভালো ঘুম হলো আজ। এক ঘুমে রাত কাবার। 

একদিন ভার্সিটিতে এসে ফারাহ মেয়েটার খোঁজ করলাম। খুঁজে পেলাম না। ভাবলাম, ক্লাসের ফাঁকে গিয়ে ওর বাসায় খোঁজ করবো। বাসার ঠিকানা আছে আমার কাছে। 

ঠিকানায় পৌঁছে ফারাহ'র নাম বলতেই দাড়োয়ান ফ্ল্যাট নাম্বার জানিয়ে দিলো। আমি খুবই বিব্রতভাব নিয়ে কলিং বেল চাপলাম। 

দরজা খুলে দিলেন ফারাহ'র আম্মু। উনি বললেন, তুমি বসো মামনি। ফারাহকে কল দিচ্ছি। 

আমার খুব লজ্জা ও সংকোচ দুটোই কাজ করছিলো। ফারাহ ওর মায়ের ফোন দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললো। জানালো দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে সে। আমি যেন অপেক্ষা করি। 

ফারাহ'র মা অত্যন্ত মিশুক। ঠিক ফারাহ'র মতো। ঝটপট নাস্তা রেডি করে আনলেন, ঠান্ডা জুস বানিয়ে দিলেন। আমি বসে রইলাম ফারাহ'র জন্য। 

ফারাহ এসেই আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো, নাইস টু মিট ইউ। আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি এসেছো তাই। 

ব্যাগটা ছুড়ে মেরেই ফারাহ আমাকে হাত ধরে ওর রুমে এনে বসালো। ওর প্রাণবন্ত হাসি আর খলখল কথা শুনতে শুনতে আমাকে অসম্ভব ভালোলাগা ঘিরে ধরলো। ফারাহ'র নাম্বার নিয়ে আমি বাসায় ফিরলাম। 

এরপর হতে প্রায়ই আমাদের দেখা হয়। ক্যাম্পাসে একসঙ্গে বসে গল্প করি, ঝালমুড়ি খাই, ক্যান্টিনে বসে দুপুরের খাবার কিংবা টং দোকানে চা। এভাবেই আমার দিনগুলো ক্রমশ রঙিন হয়ে উঠতে লাগলো। 

একদিন বাসায় ফিরে দেখি সায়েমের মা এসেছেন। আমি যথাসম্ভব ভদ্রভাবে ওনাকে অভ্যর্থনা জানালাম। রুমে এসে ফ্রেশ হয়েছি, এমন সময় মা ডাকলেন একসঙ্গে খাবার খাওয়ার জন্য। ওনার সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। 

সাহস করেই আমি শুয়ে পড়লাম। মা আরো একবার এসে ডাকলেন আমাকে। আমি ঘুমানোর ভান করে পড়ে রইলাম।

রাত্রিবেলা এটা নিয়ে খুব বকাঝকা করলেন আমাকে। ভার্সিটিতে উঠতে না উঠতেই আমি নাকি কথার অবাধ্য হতে শিখে গেছি। আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে কোলের ওপর পড়লো। 

আমি বললাম, 'ভদ্রমহিলা কেন এসেছিলো?'
'আজব তো। আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক হয়েছে। মেহমান আসবে না নাকি বাসায়?'
'উনি কেমন মেহমান? কি চায় উনি?'
'ভদ্রভাবে কথা বলো সরণী'

আমি চুপ করে রইলাম। কিছুক্ষণ পর মা নিজে থেকেই বললেন, 'উনি তোমাকে ছেলের বউ করতে চান।'
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp