আমার বুক কাঁপছে, রৈনীলের পাশে বসে থাকা'টা এখন আর আনন্দ নয়, আতংকে পরিণত হচ্ছে। কখন সে টের পেয়ে যায় আমি এতটা নার্ভাস, ভেবেই আমি দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে যাচ্ছি। কেন সে এভাবে আমাকে খোলা বইয়ের মতো পড়তে পারে!
'সরণী?'
আমি চমকে উঠে বললাম, 'হুম।'
'ওয়েদার ভালো না। বৃষ্টি নামবে।'
'নামুক।'
আমি মনেমনে বৃষ্টিরই প্রতীক্ষায়। আজ এই ঝুম বর্ষণ আমার সমস্ত অস্থিরতাকে সিক্ত করে দিয়ে যাক। আমি শান্ত হই, স্নিগ্ধ হই। এত উত্তেজনা আমার আর ভালো লাগছে না।
'সরণী?'
আমি এবার খুব চমকে গেলাম। তাকালাম ওর দিকে। সে বললো,'ভয় পেলে কেন?'
'আপনি যেভাবে আমাকে সরণী বলে ডাকেন, এমন করে আর কেউ ডাকেনা আমাকে।'
'কেমন করে?'
'কেমন একটা দরদ মিশিয়ে ডাকেন।'
'ওহ।'
বৃষ্টি নামলো। গাড়ির ফ্রন্ট গ্লাসের ওপর ছিটে আসছে পানি। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। রৈনীল মৃদু ভলিউমে একটা গান ছেড়ে দিলো। আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটা মুহুর্ত যেন এটি। বুকের ভেতর কী যে সীমাহীন ভালোলাগা তোলপাড় করছে। আনন্দ, আতংক, উত্তেজনা, ভালোলাগা, সবকিছু একসঙ্গে আমাকে গ্রাস করেছে আজ।
এমন বুক ভরা আনন্দ নিয়ে ক্যাফেতে পৌঁছলাম আমরা। পার্কিং থেকে বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে ক্যাফেতে প্রবেশ করলাম। ভেতরে প্রবেশের সাথে সাথেই কফির কড়া সুঘ্রাণ আমাকে অভিবাদন জানালো। আমি নিজের নার্ভাসনেস ঢাকতে আশেপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। রৈনীল একটা চেয়ারে গিয়ে বসলো।
খানিকক্ষণ এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করে ওর মুখোমুখি এসে বসলাম আমি। বাইরে এখনও বৃষ্টি। এখান থেকে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগছে। রাস্তা ভিজছে, গাড়িঘোড়া ভিজছে, ভিজছে উন্মুক্ত প্রকৃতি। আর সেইসাথে ভিজে যাচ্ছে আমার হৃদয়।
আমি রৈনীলের দিকে তাকালাম। ওর ভেজা চুলগুলো এলোমেলোভাবে কপালের ওপর ছেঁয়ে আছে। অসম্ভব মায়া মায়া লাগছে ওকে দেখতে। ওর মুখখানা যেন শিশুর মতো। শুভ্র, শান্ত, অথচ মোহনীয়।
মোহ? হ্যাঁ মোহ'ই বটে। ওর প্রতি আমার ক্রমশ মোহ বাড়ছে। ওর সঙ্গে কথা বলার তীব্র ইচ্ছে, ওর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ, ওর সাথে সময় কাটানোর মাঝে সীমাহীন আনন্দ খুঁজে পাওয়া, এগুলো সবই তো মোহ। এমন মোহ আমি জাগাতে চাই না। আমি আমার মনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতের মুঠোয় রাখতে চাই। রৈনীলের কাছ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি বৃষ্টি উপভোগে মন দিলাম।
রৈনীল এগিয়ে এসে মেন্যুটা আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বললো, 'কি খাবে দেখো।'
'এখানে মানুষ কফি ছাড়া আর কি খায়?'
'সিগারেট।'
আমি আশ্চর্য হয়ে তাকালাম ওর মুখের দিকে। রৈনীল এক গাল হেসে বলল, আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসি।
আমি ভাবলাম সে ক্যাফে থেকে বের হয়ে বাইরে যাবে সিগারেট টানার জন্য। আমারও ইচ্ছে করলো ওর সঙ্গে বাইরে থেকে ঘুরে আসি। তাই ঝটপট বলে ফেললাম, আমিও যাবো।
রৈনীল কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। যেন আশ্চর্যজনক কিছু বলে ফেলেছি। ঠোঁটের কোণে দু্ষ্টুমিভরা হাসি। আমার ইচ্ছে করছিলো ওর গালদুটো টেনে দেই।
যখন দেখলাম সে বাইরে না গিয়ে একটা দরজা ভেদ করে বেলকুনিতে এসে দাঁড়ালো, লজ্জায় যেন আমার মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড়। রৈনীল আমাকে কী যে নির্লজ্জ ভাবছে সেটা অনুমান করেই আমি নিজের মুখ লুকাতে মরিয়া হয়ে গেলাম। এত উঁচু থেকে রাস্তা দেখে খুব খুশি হওয়ার ভান ধরে উল্লাস করে বললাম, ওয়াও! রাস্তাটা কি সুন্দর লাগছে তাইনা এখান থেকে?
'হুম। রাত্রে আরও সুন্দর লাগে।'
'উফফ, রাতে সবগুলো গাড়িতে লাইট জ্বলে। ল্যাম্পপোস্ট গুলোতে আলো ঝিকঝিক করে। দারুণ নিশ্চয়ই।'
রৈনীল সিগারেট ধরালো। আমি বরাবরই ওর সিগারেট ফোঁকার এই দৃশ্যটার ভীষণ ভক্ত।
রৈনীল ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কি দেখছো অমন করে?'
'আমি কখনো কাউকে সিগারেট খেতে দেখিনি, একমাত্র আপনি ছাড়া।'
'তুমি জীবনে কয়জন মানুষ দেখেছো?'
'উহু, সিগারেট খেতে দেখিনি বলেছি। তারমানে এই না যে আমি চিড়িয়াখানায় থাকি।'
'হা হা হা।'
রৈনীল আমার কথায় মজা পেলেও আমি বোধহয় ভেতরে ভেতরে গম্ভীর হয়ে গেলাম। সত্যিই তো আমি যেখানে থাকি সেটা চিড়িয়াখানার মতোই। সবগুলো মানুষ অদ্ভুত আচরণ করে, আমাকে সবসময় বন্দির মতো করে ট্রিট করা হয়। কোনোদিন বাসার নিচের গ্যারেজেও আমি একা নেমেছি কিনা সন্দেহ! সবসময় তো সেই নিজের বেডরুম আর বারান্দা!
রৈনীল জিজ্ঞেস করলো, 'দীর্ঘশ্বাস কেন?'
'দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম নাকি?'
'হুম।'
আমি চুপ করে রইলাম। রৈনীল আমার পেছনে এসে দাঁড়ালো। একদম আমার গা ঘেঁষে। তার দুই হাত রাখলো আমার দুইপাশে, বারান্দার রেলিঙের ওপর। আমাকে ওর বাহুর ভেতর আবদ্ধ করে ফেলতেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সমস্ত শরীর বেয়ে কীসের যেন সুর বেজে উঠলো। হৃদস্পন্দন এত দ্রুত হচ্ছে, বাইরে থেকে বোধহয় রৈনীল শুনতে পাবে!
সে বললো, 'আমার হাতের ইশারা বরাবর তাকাও।'
আমি চমকে উঠে চোখ মেললাম। ও হাত দিয়ে দূরে কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করছে। অথচ আমি ভেতরে ভেতরে দূর্বাঘাসের ন্যায় নুয়ে পড়েছি। কী যে অস্থিরতা চেপে ধরেছে আমায়!
ওর হাত বরাবর তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। রৈনীল এক হাতে ইশারায় দেখাচ্ছে আর ওর অন্য এক হাত রাখলো আমার কাঁধের ওপর। আমি সেদিকে তাকালাম। এই বুঝি আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে।
রৈনীল আমাকে খানিকটা ঘুরিয়ে দিয়ে বললো,'এবার দেখো।'
এতক্ষণে বিষয়টা নজরে এলো আমার। অনেক দূরে কয়েকটা বেলুন একসঙ্গে আকাশে উড়ে যাচ্ছে। সুন্দর দৃশ্য। অজান্তেই আমার মুখে হাসি ফুটলো। তবে ওই দৃশ্যের চেয়ে আমার সঙ্গে যা হচ্ছে, সেদিকেই আমার মন পড়ে রইলো বেশী।
রৈনীলের সাধারণ একটা স্পর্শই আমার কাছে ভীষণ দামী বলে বোধ হলো। সে যখন আমার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, আমি অনুভব করলাম আরও কিছুক্ষণ সে এভাবেই আমার কাছাকাছি থাকলে আমার ভালো লাগতো।
রৈনীল অনেক গুলো স্ন্যাকস অর্ডার দিলেও আমি কিছুই খেতে পারলাম না। অন্যান্য দিনের মতো হাসিও এলো না, প্রাণখুলে কথাও বলা হয়ে উঠলো না। বরং কেমন যেন বিষণ্নতা গ্রাস করে রইলো আমাকে। পুরোটা সময় জুড়েই আমি শুধু ওর দিকে অবাক মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে রইলাম।
রৈনীল আমাকে বাসার কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে গেছে। রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরলাম। মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। উনি হয়তো আমার মুখ দেখে কিছু একটা আঁচ করেছেন। রুমে এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'কি হয়েছে তোমার?'
'কিছু হয়নি।'
'কেউ কিছু বলেছে?'
'না তো।'
'কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা?'
আমি চমকে উঠে মায়ের দিকে তাকালাম। মা কী বুঝলেন জানিনা। উঠে চলে গেলেন আমার রুম থেকে।
পরদিন ভার্সিটিতে এসেই ফারাহ'কে খুঁজে বের করলাম। জড়িয়ে ধরে বললাম, 'আমাকে বাঁচাও প্লিজ।?'
'কী হয়েছে!'
'আমি শেষ।'
'মানে? বাসায় কি সায়েম আবার এসেছে?'
'উফফ না।'
'তাহলে?'
আমি ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। ফারাহ আমার হাত ধরে বললো, 'তোমাকে ভালো দেখাচ্ছে না। বাসায় চলো।'
ফারাহ ওর রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। বালিশে ভর দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছি আমি। ফারাহ এসে আমার পাশে শুয়ে পড়লো। মৃদু স্বরে জানতে চাইলো, 'এবার বলো। কী ঘটনা?'
আমি কিছুক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারলাম না। ফারাহ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, 'ইজ এভ্রিথিং ওকে?'
'উহু।'
'বলবা তো। নাকি?'
আমি আনমনে বলে ফেললাম, 'আমার কী যেন একটা হয়েছে ফারাহ। কাল থেকে মন খারাপ। অস্থির লাগছে। সারাটা রাত এক ফোঁটা ঘুমাতে পারিনি।'
'হুম।'
'হুম না। কিছু বলো?'
'ডাক্তার দেখাবে?'
'আমার মনে হয় ডাক্তারের কাছে এর সমাধান নেই।'
'আর কি কি সমস্যা হচ্ছে আমাকে বলো তো?'
'কাল থেকে কোনো খাবার খেতে পারছি না। শুধু ছটফট লাগে। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।'
'লংটার্ম স্ট্রেস থেকে এরকম হয়।'
'আরে এসব স্ট্রেস ফেস্ট্রেস কিছু না।'
'তাহলে?'
ফারাহ উৎসুক চোখে চেয়ে আছে। আমি খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে বললাম, 'একজনকে চিনি। পৃথিবীতে সে একমাত্র ব্যক্তি, যার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। সে সামনে থাকলে আমি পুরোটা সময় জুড়ে তাকে দেখি। আমার মনে হয় ও যেন একটা শিশু। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ওনার কাছাকাছি এলেই আমার শরীরে কী যেন হয়ে যায়। এত দ্রুত হার্টবিট হয়, এই বুঝি হার্ট ফেটে যাবে। আমার সবসময় ইচ্ছে করে ওনার সঙ্গে কথা বলি, ওনার সামনে বসে থাকি। ওর খুব নরমাল একটা স্পর্শ, এই ধরো এভাবে শুধু একটু ধরলাম। একদম নরমাল অথচ আমার পুরো শরীরে কেমন যেন শুরু হয়ে যায়। আমি যে কী এক বিপদে পড়েছি..'
ফারাহ খুব শান্ত গলায় বলল, 'তুমি প্রেমে পড়েছো।'
'কিহ!'
আৎকে উঠলাম আমি। নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। কোনোমত ঢোক গিলে বললাম, 'এগুলো কি প্রেমে পড়ার লক্ষণ?'
'এখনো লক্ষণ নিয়ে ভাবলে হবে? ইউ আর ডিপলি ইন লাভ। তুমি গভীর প্রেমে আচ্ছন্ন।'
'যাহ!'
আমি বিছানায় গা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। নিজের মনেই নিজেকে বলছি, এ কী সরণী! তুমি প্রেমে পড়েছো? তুমি! তোমার জীবনে প্রেম এসেছে? তা কী করে হয়! আমার যে নিজেকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
ফারাহ বললো, 'ফার্স্ট স্টেজে জগতের সবকিছু ভালো লাগে। আর ডিপ স্টেজে গেলে বিষণ্ণতা চেপে ধরে। তখন জগতের কিছুই ভালো লাগে না। শুধু তার জন্য মন কেমন করে। তুমি এখন সেখানে পৌঁছে গেছো।'
'এখন আমি কী করবো?'
'ওনাকে জানাও।'
'অসম্ভব।'
'কেন?'
'ওনাকে জানানো অসম্ভব। আমি পারবো না।'
'এভাবে তো থাকা যন্ত্রণার।'
'আমার যন্ত্রণা এখানে নয় ফারাহ, যন্ত্রণা অন্যখানে।'
'কোথায়?'
'সে মানুষের মুখ দেখলেই সব বলে দিতে পারে। আমি একশো পার্সেন্ট শিওর, সে জানে আমি কেমন ফিল করছি।'
ফারাহ অবিশ্বাসের সুরে বলল, 'ওহ মাই গড! এখন তুমি জানার চেষ্টা করো সেও তোমাকে এভাবে ফিল করে কি না?'
'করে না।'
'শিওর হচ্ছো কিভাবে? তুমিও কি তাকে বুঝতে পারো নাকি?'
'না। পারিনা। কিন্তু সে আমাকে পছন্দ করে এরকম কখনো টের পাইনি।'
'ওটা না পাওয়ার ই কথা। কারণ সে যেহেতু সব জানে, তাই সে নিজেকে অপ্রকাশিত রাখার চেষ্টা করেছে। তুমি তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করো তোমাকে তার ভালো লাগে কিনা?'
'এটা অসম্ভব। আমি পারবো না।'
'তাহলে কিছু ট্রিকস দিয়ে বিষয়টা জানার চেষ্টা করো।'
'যেমন?'
'আমি কিছু বিষয় বলি তোমাকে। তুমি সেগুলো ওনাকে করতে বলবা। যদি সে করে, ধরে নিবা সেও তোমাকে পছন্দ করে।'
আমি বিস্মিত চোখে চেয়ে আছি। এইমুহুর্তে আমার যে কী অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।
.
.
.
চলবে.........................................................................