আশিয়ানা - পর্ব ৬৩ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


সকালের গায়ে হাত বুলিয়ে গেল স্নিগ্ধতার আস্তরণ। মিষ্টি সূর্যের আলো পৃথিবীর বুকে টুকটুক করে উঁকি দিচ্ছে। ধূসরিত রাতের তরল অন্ধকার কাটিয়ে ধীরে ধীরে সূর্যের আলোর প্রলেপ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। কড়ুই গাছের ডালে বসা এক জোড়া পাখি খাবারের সন্ধানে একে অপরের সাথে বাসা ছেড়ে মুক্ত আকাশে উড়াল দিল।

ঘুম থেকে ওঠার পর জুবিয়া আরও কিছুক্ষণ বিছানায় বসে রইল। ঝিমুনি ভাবটা কেটে যেতে শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে গেল। এখনও পুরোপুরি সকাল হয়নি, দিনের আলো বাতাসে এক অদ্ভুত দ্যুতি আর উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

ভেজা চুল পিঠে বিছানো। চা হাতে নিয়ে বহুতল ভবনের বারান্দায় বসে রয়েছে জুবিয়া। হাতের চা ঠান্ডা হয়ে আসছে। তূর্ণ পাশে বসে জুবিয়ার দিকে তাকাল। ঠোঁটে একটা অমায়িক হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়ল তার। পরিষ্কার আকাশে মনের আনন্দে সাদা মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে। উত্তর আকাশে ঝাপসা করে উঠল সাত রঙের একটি রংধনু। মেঘনা সিটির অলিগলির রাস্তা থেকে রিকশার ঘণ্টার টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। পৃথিবীর বুককে আড়াল করার জন্য বিশাল আকাশ যেন নিজেকে ছাতার মতো তুলে ধরেছে। তূর্ণ এক পলক দু'পলক দূরের আকাশ দেখল। জুবিয়া মাথা তুলে তূর্ণর মুখের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
  'আজ সকালটা কি সুন্দর না?'

তূর্ণ গোপনে একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে ম্লান কণ্ঠে বলল,
  'আজকের ফ্লাইট মিস করা যাবে না। শীঘ্রই এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরতে হবে।'
বিস্মিত গলায় জুবিয়া বলল, 
  'আমি তোমার সাথে এয়ারপোর্টে যাবো।'
তূর্ণ জুবিয়ার কোমরে হাত রেখে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ল। ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে বলল,
  'না। আমি তোমাকে সামনে রেখে যেতে পারব না।'

জুবিয়া মাথা নিচু করে ফেলল। এভাবেই কেটে গেল অনেকক্ষণ। তূর্ণ হঠাৎ তার জায়গা থেকে সরে গেল। দুই পা পিছিয়ে যেতেই জুবিয়া তার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। জুবিয়ার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ভেজা গলায় জুবিয়া বলল,
  'এখুনি চলে যাচ্ছো কেন? আর একটু থাক।'

তূর্ণ আরজ করল,
  'হাত ছাড়ো জুবিয়া, আমাকে যেতে হবে।'
জুবিয়ার কান্না আরো বেড়ে গেল। তূর্ণর হাত দুটো একটু শক্ত করে ধরে আকুল কণ্ঠে বলল, 
  'আমাকে ছেড়ে যেও না।'
তূর্ণ বলল,
  'আমি তাড়াতাড়ি তোমাকে নিতে আসব জুবিয়া। এখন আমাকে যেতে দাও আর মায়া বাড়িয়ো না।'

জুবিয়া একটু সময় নিল তারপর তূর্ণর হাত ছেড়ে দিল। গুটিশুটি দিয়ে একপাশে দাঁড়াল। স্টিফেন লাগেজ গাড়িতে তুলতে নিয়ে গেল। তূর্ণ জুবিয়ার সাথে কথা শেষ করে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেল। এমন সময় হঠাৎ আয়ানের ফোন এলো। তার কণ্ঠ করুণ বার বার হিচকি দিচ্ছে। জুবিয়া বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
  'কাঁদছিস কেন?'
আয়ান নাক টেনেটেনে বলল,
  'আমার ব্রেকআপ হয়েছে। আমি তাকে সত্যি ভালবাসতাম আর সে আমার সাথে চিট করছে।'

ফ্ল্যাটের ভেতর প্রবেশ করে জুবিয়া। ড্রয়িংরুমের দিকে যেতে যেতে বিরক্তিকর গলায় বলল,
  'তোর দুদিন পরপর ব্রেক আপ হয়। আর তুই সবাইকে রিয়েল লাভ করিস। ভাই, তুই কি এই কুমিরের কান্না শোনানোর জন্য আমাকেই পাস?'

আয়ান আগের চেয়ে করুণ গলায় বলল,
  'বন্ধু হয়েও তুই আমাকে বুঝলি না।'
হঠাৎ বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিল জুবিয়া। তারপর সোফায় হেলান দিয়ে জোরে শ্বাস নিল। মনটা খালি লাগছে। তখনই ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠল। মেসেজ এসেছে, আর মেসেজটি তূর্ণ করেছে। জুবিয়া সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ চেক করলো। তূর্ণ সংক্ষেপে লিখেছে,
  'আই লাভ ইউ মাই মুনশাইন।'
মেসেজটা পড়তেই জুবিয়ার ঠোঁটের কোণে একটা চিরল হাসি ফুটে উঠল।

অন্ধকার আকাশে বিশাল মেঘের ফোয়ারা। ঘন ঘন বজ্রপাতে প্রায়ই আকাশ কেঁপে ওঠছে। খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঘরে প্রবেশ করছে। উমাইয়া বিছানা থেকে উঠে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। খোলা জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করতেই তার চোখ পড়ল বাড়ির ঠিক সামনে। বডিগার্ডরা মাটিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমবার দেখলে যে কেউ ভাববে তারা পাথরের মূর্তি। উমাইয়া আকাশের দিকে তাকাল, মনে হচ্ছে খুব জোরে বৃষ্টি নামবে।

জানালা বন্ধ করে নিশ্চল পায়ে হেঁটে এসে খাটের কাছে দাঁড়াল উমাইয়া। আবছা আলোয় সাদাফকে দেখে এক হাতে সাদাফের গায়ে একটা চাদর দিয়ে দিল। তারপর স্থিরভাবে হেঁটে বিছানায় উঠে সাদাফের পাশে শুয়ে পড়ল। সাদাফ ঘুমের মধ্যে একটু চোখ খুলে উমাইয়াকে দেখে এগিয়ে এসে দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরলো। তার হাত বরফের মতো ঠান্ডা। সাদাফ হঠাৎ ওষ্ঠাধর উমাইয়ার কাঁধে ছুঁয়ে আস্তে করে বলল, 
  'ঘুমাও নি?'

উমাইয়া চাপা গলায় বলল,
  'নতুন জায়গা তাই ঘুম আসছে না।'
সাদাফ হাত দিয়ে উমাইয়াকে তার দিকে ঘুরিয়ে দিল। তার ঠান্ডা হাতটা রাখে উমাইয়ার গালে তারপর মোহিত গলায় বলল, 
  'আরো ভালোবাসা পেলে ঘুম আসবে?'
উমাইয়া আকস্মিক চমকে উঠল সহসা একটু সরে গেল। তারপর ম্লান গলায় বলল, 
  'ছিঃ, না। আপনি আমাকে স্পর্শ করবেন না।'

সাদাফ একগাল হেসে নিল। তারপর হঠাৎ উমাইয়াকে একটু শক্ত করে ধরে নেশাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল,
  'তুমি আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছ, এখন আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসা দিবো।'

সাদাফ উমাইয়ার ঘাড়ে একটা গভীর চুম্বন করে। উমাইয়া কেঁপে উঠল। সাদাফ কর্কশ কণ্ঠে বলল, 
  'উমা, প্লিজ নড়বে না।'

 উমাইয়া সাদাফকে দুই হাতে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। তারপর দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। সাদাফ অসহায় দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে। তারপর একটা গভীর শ্বাস নিয়ে চোখ ও মুখ বন্ধ খিঁচে বলল, 
  'তুমি কিন্তু কাজটা ভালো করলে না উমা প্লিজ বাইরে এসো।'

উমাইয়ার হাসির শব্দ শোনা গেল। সাদাফ তার চোয়াল চেপে দরজায় করাঘাত করে উচ্চ ও গম্ভীর গলায় বলল, 
  'উমা তুমি বাইরে আসবে নাকি আমি দরজা ভেঙে ফেলব?'
উমাইয়া ঠোঁট চেপে হাসল। এবার সে মুখ খুলে বলল,
  'কথা দিন দুষ্টুমি করবেন না, তাহলে বের হবো।'

সাদাফ মৃদু হেসে ফ্যাকাশে গলায় বলল,
  'আচ্ছা আমি কিছু করব না। তুমি বাইরে এসো।'
উমাইয়া বেরিয়ে এলো। সাদাফ সাথে সাথে তাকে জড়িয়ে ধরলো। উমাইয়া চোখ তুলে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলল। তারপর বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
  'কিন্তু আপনি কথা দিয়েছিলেন।' 
সাদাফ তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দিল না। সে হেসে ফিসফিস করে বলল,
  'আমার স্ত্রী আমি যা খুশি তাই করব। তুমি বাঁধা দেওয়ার কে?'
উমাইয়া লাজুক কণ্ঠে বলল, 
  'আপনি দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন।'
সাদাফ জোরে হেসে উঠল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, 
  'শুধু তোমার জন্য।'

কালো মেঘ আর সাদা বৃষ্টির মিতালিতে সেজেছে প্রকৃতি। পিচঢালা তপ্ত রাস্তাও বর্ষণ অবগাহনে আজ বৃষ্টির কারণে শান্ত। ঝোড়ো বাতাসে সড়কের পাশের গাছগুলো একটু কেঁপে উঠল। অন্ধকার ঘরে যুবক যুবতী মনের পুল উন্মুক্ত করে বসে। বৃষ্টির সাথে মেঘ গর্জনের শব্দ ক্রমাগত উচ্চস্বরে শোনা যাচ্ছে। সাদাফের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সাদাফ তার উভয় হাত উমাইয়ার পিঠের উপর রেখে খুব ধীরে ধীরে নাড়াচাড়া করছে। মাঝে মাঝে উমাইয়ার দিকে তাকিয়ে তার ক্ষুদ্রসত্তায় থাকা অসীম অনুভূতিকে স্পর্শ করে দিচ্ছে। হঠাৎ দূর থেকে মেঘ গর্জনের মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা গেল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মোহিত শব্দে সাদাফের অস্থির মনটা হঠাৎ করেই দ্রুত হয়ে উঠল। বৃষ্টিটা যেনো শুধু তাদের জন্য হচ্ছে।

বুকের ভেতর এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে। সাদাফের প্রতিটা স্পর্শ লেপ্টে যায় উমাইয়ার সৌন্দর্যে। ভালোবাসার এক অদ্ভুত অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে শরীর ও মনে। উমাইয়ার চোখে হঠাৎ ঘুম নেমে আসে। সাদাফ নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো। 
  'শুনছ?'
উমাইয়া ক্লান্ত গলায় বলল, 
  'হুম।'
  'চুপ কেন? কি ভাবছ?' সাদাফ জিজ্ঞেস করল।
উমাইয়া লাজুক হেসে বলল,
  'আমাদের একটা বাচ্চা মেয়ে হলে খুব ভালো হবে।'
সাদাফ হেসে বলল,
  'এখনও বিয়ের এক মাস হয়নি আর তুমি বাবুর হওয়ার পরিকল্পনা করছো?'
উমাইয়ার ঠোঁটে উজ্জ্বল হাসি। সে নরম গলায় বলল,
  'আমার বাচ্চা খুব পছন্দের। ভেবেছিলাম বিয়ের পরপরই বাবু নেবো।'
সাদাফ কাতর স্বরে বলল, 
  'তুমি নিজেই এখনও বাচ্চা আবার আরও একটা বাচ্চা চাচ্ছ। আমি দুজনকে সামলাবো কীভাবে?'
উমাইয়া বিড়বিড় করে বলল, 
  'আপনি খুব অসভ্য।'
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন