শুক্রবার।
নীল-সাদাটে আকাশের বুক ছিঁড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে রঙবেরঙ পাখিগুলো। শাহজাহান বাড়ির পেছন দিকটার সুউচ্চ শ্যাওলা পড়া প্রাচীরের মুখে বসেও আছে এক জোড়া। সম্ভবত দোয়েলপাখি। তারা ঝলমলে রোদ্দুর সকালের মিঠা হাওয়া উপভোগে ব্যস্ত। বাগিচায় একটি টিয়াপাখি হাঁটছে। সাধারণত টিয়াপাখির দর্শন মেলা বেশ ভার। তবে কখনোসখনো দেখা পাওয়া যায়। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে এসে রুখেছে সাতটা কুড়িতে। আজ বাড়ির সব বুজুর্গ যখন ঘুম থেকে উঠেছেন, তখনো দেশজুড়ে নিশাচরী প্রাণীর ঘুরপাক চলছিল। অলিতে-গলিতে ঘেউঘেউ করে যাচ্ছিল কুকুরের দলবল। জবেদা বেগম আধকাঁচা ঘুম ছেঁঁড়ে উঠেই লেগে পড়েছেন কাজে। এমনিতে তাদের বাড়িতে হেল্পার বলতেই একজন আছে, রূপালি। তবে বিয়েবাড়ির কাজকর্মের জন্য এই মাসে আরেকজন হেল্পার রাখা হয়েছে। নাম কুশুম। আজ দুজনই ফজরের আজানের পরপরই হাজির হয়েছে। এসে থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কাজকর্মে। ডায়মন্ডের মতো চকচকা ভাবেই ঘরদোর পরিষ্কার করে ফেলেছে। ছাঁদ থেকে ধরে প্রত্যেকটি রুম সহ —উদ্যান পর্যন্ত পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ করেছে সবেমাত্র। অল্পস্বল্প রান্নাবান্নার ব্যস্ততা চলছে রান্নাঘরে। সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যেই কমিউনিটি সেন্টার-এ উপস্থিত হতে হবে স-পরিবারের। সাতটা থেকে অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হবে যেহেতু। তন্ময় আকাশকে নিয়ে গতকাল রাত বারোটার পর গিয়েছিল সেন্টারে। ঘণ্টাখানেক ছিল অবজার্ভেশন এর জন্য। আজও বারোটার পর শেষবার রাউন্ড দিতে যাবে। সবকিছু নিখুঁত ভাবে এগুচ্ছে কি-না নিজ চোখে দেখা প্রয়োজন। এমনিতেও খাবারদাবার সম্পর্কিত লিস্ট ধরিয়ে দেয়া হয়েছে গতকালই। আপাতত কতদূর কী আয়োজন করল তার খবরাখবর নেয়া অত্যন্ত আবশ্যক। তন্ময় মিনিটখানেক আগেই কমিউনিটি সেন্টার এর ম্যানেজার ইজমত মোল্লার সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে। ভদ্রলোক ধারাবাহিক ভাবেই এ টু যেট আপডেট দিয়েছে। কল কেটে বিছানার পাশেই দৃষ্টি গেল তন্ময়ের। ওখানে আছে, টু টায়ার স্মল স্লাইডিং হেঙার রেক। সেখানে তার আজকের সন্ধ্যার পাঞ্জাবি স্যাট প্যাকেজ করে হেঙারে ঝুলিয়ে রাখা। নিচের পাইঠায় কালো জুতোর বাক্স। যেটায় আছে পাঞ্জাবির সাথে কেনা কালো রঙের লোফার। গতকাল রাতেই তার ম্যানেজার দিয়ে গিয়েছে। প্যান্টের পকেটে মানিব্যাগ ভরে, হাত ঘড়িটা পরতে নিয়েই রুম ছেড়ে বেরুলো তন্ময়। ইত্যবসরে ঘড়ির কাঁটা নয়টায় পৌঁছেছে। অরুর রুমের দরজাটা সটানভাবে খোলা। তবে ওর অস্তিত্ব নেই। পরিপাটি করা বিছানায় লম্বা ড্রেসের প্যাকেজ-টা রাখা। শাবিহার রুম থেকে ভেসে আসছে কয়েক জনের যৌথ অট্টোহাসির ধ্বনি। দোতলার করিডোর এর রেলিঙ ছুঁয়ে দাঁড়াতেই, লিভিং রুমে কয়েকটি জানাশোনা মুখ দেখা গেল। তার নানা হুঁশিয়ার সাহেব সোফায় বসে আছেন। পরনে সফেদ লুঙ্গি। গায়ে পাঁকা কুমড়ো রঙের হাতাকাঁটা ফতুয়া। আমোদেই চা খাচ্ছেন। পাশেই তার নানি জয়তুন বেগম এবং মামা-মামিরাও আছেন। মোস্তফা সাহেব সহ ওহী সাহেব, আনোয়ার সাহেবও কাছাকাছি বসে। বেশ স্ফূর্তি ভঙ্গিতেই গল্পগুজবে বিভোর। তন্ময় সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল। তাকে দেখতে পেয়েই জয়তুন বেগমের চোখজোড়া উচ্ছ্বাসে টলমল করল। গলা ধরে এলো প্রায়,
‘নানুভাই, আমার। আসো - আসো। তুমারে একঝলক দেখতে পাওয়া আর চাঁদ হাতে পাওয়া একই কথা।’
তন্ময় অসহায় অনুভব করে। নানির সমীপে সে রুগ্ণ বটেই। অসহায় হেসে সালাম জানায়। কাছে পৌঁছে– একেবারে জয়তুন বেগমের গা ঘেঁষেই পাশেতে বসে। আদুরে ভঙ্গিতেই বৃদ্ধ– কুঁচকানো দুর্বল হাতটা, যত্নসহকারে তুলে নেয় নিজের দু'হাতের মধ্যে। হেসে-হেসেই শুধায় নরম গলায়,
‘কেমন আছো?’
জয়তুন বেগম হাসেন ছলছল নয়নে। নাতির গাল ছুঁয়ে আনন্দিত গলায় বলেন,
‘আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো। এইযে এখন তোমাদের বিবাহ দেখবার নসিব মিলতেছে। দোয়া করো যেন নাতির ঘরের পুতিও দেখে ম র তে পারি।’
তন্ময় মোটেও লজ্জা পেলো না। তার চামড়া বরাবরই বড্ড পাতলা। লজ্জাসংকোচহীন সে আমোদেই জবাবে বলল,
‘ইনশাআল্লাহ্।’
এই জবাবটুকুতেই জয়তুন বেগমের বৃদ্ধ হাসিটুকু অল্পবয়সী রমণীর ন্যায় সুদীর্ঘ করে। তিনি আকাঙ্ক্ষা জড়িত গলায় আবদার ধরেন,
‘নানুভাই, তোমার সংসার দেখবার বড়ো ইচ্ছা আমার। তুমি নাতবউ নিয়া বাসায় আসবা। আমার সামনে বসে খাইবা। বেড়াইবা। তোমাদের মধ্যে একটা সোনামণি থাকলে তো আমার আর কিচ্ছুর চাহিদা রইব না।’
তন্ময় নিজের মনের সুপ্ত জবাব দিতে নিয়েও নিজেকে ক্ষণিকের জন্য দমাল। মাথা তুলে চতুর্দিক তাকাল চতুর চোখেতে। বুজুর্গগণ ছাড়া কেউই নেই। তাই বলেই বসল মজার ছলে,
‘আমার সংসার হচ্ছে না একজনের জন্য।’
জয়তুন বেগমের পূর্বেই প্রশ্ন করেন হুঁশিয়ার সাহেব, ‘কে?’ কণ্ঠ সুগভীর, গম্ভীর। কার এতবড় দুঃসাহস? তার নাতির সংসার হতে দিচ্ছে না? ওদিক গুরুগম্ভীর হলেন মোস্তফা সাহেব। চোখও রাঙালেন কঠিনভাবেই। হাসছেন আনোয়ার সাহেব। তন্ময় যেন নিজ পিতার চোখ রাঙানো দেখেনি। তার তীক্ষ্ণ নজর উপেক্ষা করে বলে,
‘তোমার মেয়ে জামাই।’
সহসা দু'জন নাতি ভক্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রশ্নবোধক তীব্র, তীক্ষ্ণ, অনড় দৃষ্টির সম্মুখীন হলেন অনাড়ম্বর মোস্তফা সাহেব। বুজুর্গ দুজনের দৃষ্টির সম্মুখে অসহায় তিনি দুর্বল গলায় সাফাই গাইতে বলেন,
‘বাবা….মা…আ— আপনারা তো জানেনই, আরাবি ছোটো এখনো! নতুন করে কী বলব বলুন তো?’
হুঁশিয়ার সাহেব মেয়ে জামাইকে গাঢ়; নিশ্ছিদ্র চোখে একপলক দেখে নিলেন। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফেললেন আনোয়ার সাহেবের ওপর। গম্ভীরমুখে শুধালেন,
‘বাবাজীবন, তুমি কথা বলো! মেয়ে তোমার। আবার আমার নাতিও। নাতি আমার আবার তোমার ভাইপুতও। তারা দু'জন দু'জনারে সোহাগ করে। মানে দাঁড়ায় –মিঁয়া বিবি রাজি। বুঝছ নি? সেইখানে ওদের বিয়েটা তখনই দিয়ে দেওয়াটা তুমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে কি-না কউ দেহি! যেখানে আমার নাতি, সংসার করতে চাইতেছে। সেখানে তোমরা হাত গুটাইয়া রাখছ? এইডা কেমন কথা?’
তন্ময় আপনমনেই হাসল। মুখের আদল তার শান্ত নদীর মতন। স্থির বাতাস বিহীন গাছের মতন। দৃষ্টি মলিন। এযাত্রায় জুসের গ্লাস হাতে এলেন জবেদা বেগম। মুখ জুড়ে চাপা হাসি বিদ্যমান । তন্ময় অবুঝ ভঙ্গিতে বাড়িয়ে ধরা জুসের গ্লাসটা নিলো। পান করল আরাম করে।যেন এই হাসিঠাট্টা তাকে ঘিরে মোটেও নয়। তার মেজো মামা শফিক গলা ঝেড়ে বললেন,
‘বাবা, থামুন তো। দুলাভাই তো বললেনই —অরু ছোটো। আর সত্যিই ছোটো। গ্রাজুয়েশন শেষ করুক। এমনিতে নিজেরা তো বিয়ে করেছেই। আনুষ্ঠানিক বিয়েটা না-হয় বছরের মাথায় করা যাবে। এখন নাতনির বিয়েটা খান।’
আনোয়ার দুর্বোধ্য হাসেন। সাবলীল শব্দে গুছিয়ে মনের কথা ব্যক্ত করেন,
‘আমার কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই। ছেলে-মেয়ে দুটোই আমার। বড়ো ভাইও আমার। তাদের ইচ্ছেই, আমার ইচ্ছে। ভাইয়া যখন বলবেন তখনই না-হয় সব হবে। ততদিনে মেয়েটাও আমার হয়তো-বা সংসার বুঝতে পারবে। দেখেছেনই তো অরুকে। খুব দুষ্টু। এখনো বাচ্চামি যায়নি…..।’
কথাটুকু মাটিতে পড়তে না পড়তেই ধরে নিয়ে–মুহূর্তেই অসন্তোষ কণ্ঠে মোস্তফা জবাবে বলেন,
‘বাচ্চামি কোথায় যাবে? দুষ্টুমি ও না করলে কে করবে? আলবাত করবে, সারাজীবন করবে।’ পরপরই নাক সিটকালেন আড়চোখে ছেলের পানে চেয়ে, ‘যেইভাবে দেখে পছন্দ করেছে, সেইভাবেই সারাজীবন কাছে রেখে সংসার করবে।’
ঠোঁট টিপে হাসল তন্ময়। মিটিমিটি হেসে দারুণ ছলনাময় কণ্ঠে বলল,
‘আমার কোনো আপত্তি নেই। বরঞ্চ তুমি বললে কাজি ডেকে আনি? বিয়েটা করে ফেলি। তারপর একজন সুনামধন্য আর্কিটেক্ট ডাকাব। আমাদের দু'জনের রুম দুটো কম্বাইন্ড করে সংসার পাতার রুম করে নেব। কী বলো?’
বিকট হাসির রোল পড়ল লিভিংরুম জুড়ে। মোস্তফা সাহেব ব্যতীত সবাই হেসে উঠেছেন। তন্ময় বাবার চোখে চোখ রেখেই জুস খেল। মোস্তফা সাহেব দুর্বল হেসে দাঁতে দাঁত পিষে বলেন,
‘বাবা, আমার!’
তন্ময় মিষ্টি করে হাসে, ‘বলুন বাবাজান। আপনার জন্য আমি কী করতে পারি? শুড আই ডু দ্যাট? একজন আর্কিটেক্ট ডাকি?’
মোস্তফা সাহেব নিজের অসহ্যকর ছেলেকে দেখে বিনয়ী হাসেন, ‘অয়নের জন্য আংটির অর্ডার-টা রিসিভ করে আনলে উপক্রিত হতাম।’
তন্ময় যেন বড়ো হতাশ হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল বৃদ্ধের মতন। অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে বলল, ‘পিতার আদেশ চিরধার্য।’
ফের শব্দ করে হাসেন সবাই। জয়তুন বেগমের চোখের কোণ ভিজে উঠেছে হাসির প্রকোপে। এবার মোস্তফা সাহেবের ঠোঁটেও মৃদু হাসির রেখা দেখা যায়। ভদ্রলোক একমাত্র ছেলের সামনে নিরুপায়, অসহায়। স্নেহের চোখে একবার ছেলের গমন পথও দেখে নেন একটিবার।
————
শাহজাহান আরাবির দর্শন পাওয়া আর আসমানের চাঁদ হাতে পাওয়া যেন একই বিষয়বাসনা হিসেবে দাঁড়িয়েছে, এই সুবিস্তৃত জগৎসংসারে। গতকাল সন্ধ্যা থেকে ওই সুশ্রী মুখটার একঝলক ললাটে জোটেনি। রাতে ঘুমিয়েছে শাবিহার ঘরে। সকালেও নিজের ঘরে ছিল না। এখন দুপুর তিনটা বাজতে চলল। খাবার খেতেও টেবিলে আসেনি। মেয়েরা মিলেমিশে খেয়েদেয়ে দিব্বি দরজা লাগিয়ে আলাপে মজেছে। কিছুক্ষণ আগে পার্লারের টিম ঢুকল। এখন তো আরো দেখা যাবে না। হয়তো-বা বেরুবে যাওয়ার সময়ে। তাও চড়বে নিশ্চিত আনোয়ার সাহেবের গাড়িতে। মহারানি উজ্জ্বল বেশভূষায় তৈরি হওয়া ছাড়া আর বেরোবে না। এতগুলো কল, মেসেজেস পাঠানো হলো.. জবাব নেই। তন্ময় নিঃসঙ্গ ভাবে কপালে আঙুল ঘষল। এই কেমন অভিমান? আদর করছে না দেখে এমন করবে? এখন কি চব্বিশঘণ্টা চুমুতেই থাকবে সে? তন্ময় কি চুমুখোর নআকি? অবশ্যই চুমুর বাসনা তো মনের সুপ্ত স্থানে আছে। কিন্তু…আশ্চর্য! এরমধ্যেই ফোন বাজল। কল করেছে মাহিন। তন্ময় রিসিভ করতেই রেডিও এর গান শুনতে পেলো,
‘মুঝসে সাদি কারোগি…
ও মুঝসে সাদি কারোগি…’
পরপর মাহিন উচ্চকণ্ঠে গেয়ে উঠল,
‘তুঝসে সাদি কারুঙ্গি…
ও তুঝসে সাদি কারুঙ্গি…. ’
তন্ময় কান থেকে ফোন সরাল নির্বিকার হয়ে। মিনিটখানেক পর ফের কানে গুঁজল। শুধাল ছোটো করে, ‘কতদূর তোরা? কখন আসবি?’
রিয়ান চেঁচাল, ‘গিফটস কিনতে যাচ্ছি। তারপর রেডি হয়ে বেরোব। পাঁচটায় পৌঁছে যাব, বস। নো টেনশন।’
মাহিন পরপর দ্রুত বলল, ‘এখন টিপিকাল আত্মীয়দের মতন বলিস না, সাবধানে আসুন। কারণ আমরা তো আর একজনের মতো বিয়েশাদি করে, বাসর সেরে ফেলিনি। এখনো উন্নত মানের ফার্স্টক্লাস কুমার ছেলে। যার সতীত্ব আছে।’
তন্ময় বিড়বিড়িয়ে উঠল, ‘সতীত্ব জীবনভর রাখুন গুছিয়ে। এই কামনা।’
মাহিনের দৃঢ় প্রতিবাদ, ‘কক্ষনো না।' এরপর একটু ইতস্তত করল ও, ‘আচ্ছা, শোন না…অরুর ওই ফার্মের মুরগি নামের বান্ধবী আসতেছে তো?’
তন্ময় আশ্চর্যে ভ্রু তুলল, ‘মারজির কথা হঠাৎ?’
‘এমনিতেই। ওইযে ভুলবশত অরুর ফোন রিসিভ করেছিলাম না? ইউনিক নাম দেখে জানতে ইচ্ছে করল। রাখছি, বায় বায়।’
কথাটুকু শেষ করেই কল কেঁটে দিল ওপারে। তন্ময় ক্ষণিকের জন্য স্তম্ভিত হলো। কিচ্ছুটি বুঝল না। বলা যায় বোঝার চেষ্টা করল না। সে এখন অন্য কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামাতে পারবে না। চব্বিশঘণ্টায় –তেইশঘণ্টাই অভিমান করে বসে থাকা প্রিয়তমাই আপাতত তার মাথা জুড়ে বসবাস করছে। তন্ময় উচ্চস্বরে দীপ্তকে ডাকল। এই ছেলেই শেষ ভরসা। ও যদি পারে অরুকে ঘরটা থেকে বের করে আনতে। বিড়বিড়িয়ে উঠল নিজমনে,
‘দীপ্ত..দীপ্তরে…ইউ আর মাই লাস্ট হোপ।’
তখন সন্ধ্যা পাঁচটা পঞ্চাশ। ইতোমধ্যে মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব, ওহী সাহেব সহ তন্ময়ের চার মামা, তাদের স্ত্রী— সবাই রওনা দিয়েছেন কমিউনিটি সেন্টার এর উদ্দেশ্যে। বাকিরা এখনো তৈরি হচ্ছে। তখন দীপ্ত অরুকে নামাতে সক্ষম হয়নি। ওই দুষ্টু মেয়ে নিজের কথাতে অটল। গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল আনমনা। হাত ঘড়িতে দৃষ্টি ফেলল অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। হঠাৎ কারো উপস্থিতি পেয়ে পাশ ফিরল। কলি এগিয়ে আসছে। তন্ময় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। কলি এসেই সালাম জানাল,
‘কেমন আছেন, ভাইয়া?’
তন্ময় সাবলীলভাবেই জবাবে বলল, ‘ভালো। গাড়িতে বসো। ওরা আসছে?’
কলি উদগ্রীব গুলায় প্রত্যুত্তর করল, ‘জি। এইতো আসবে…’
কথাটুকু বলতে না বলতেই বেরিয়ে এলো দীপ্ত, রুবি… শাবিহা। শাবিহা এসেই মুখ ভরে হেসে— গোল করর ঘুরে নিজের ফ্লোর ছোঁয়া গাউন দেখিয়ে শুধাল, ‘কেমন লাগছে, ভাইয়া?’
তন্ময় মুগ্ধ চোখে দেখল। ছোটো বোনটা তার বড়ো হয়ে গিয়েছে কেমন। এগুলো সে কয়েক পদক্ষেপ। ছোটো বোনের মাথা ছুঁয়ে দিলো আলতো হাতে। গর্বিত গলায় আওড়াল, ‘চমৎকার। গরম লাগবে। গাড়িতে বোস। অরু কোথায়?’
রুবি গাড়িতে উঠতে-উঠতেই জানাল চটপট , ‘অরু নেইলপলিশ দিতে ভুলে বসেছে। সেটা দিতেই রুমে গিয়েছে। এসে পড়বে।’
এরমধ্যেই চলে এলো জবেদা বেগম, মুফতি বেগম আর সুমিতা বেগম।সামান্য ঠেলেঠুলেই মিলেমিশে উঠে বসল ব্যাক সিট গুলোতে। এমনিতেই ফাঁকা রাখল ড্রাইভিং এর পাশের সিট। কলি তখনো বাইরে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত ভাবে। এবারে কিঞ্চিৎ আগ্রহী হয়ে শুধাল,
‘সামনে বসব?’
তন্ময় তখনো দুয়ারপানে চেয়েই আছে। না ফিরেই প্রশ্ন ছুঁড়ে, ‘পেছনে জায়গা নেই?’
রুবি গাড়ির কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করল, ‘এই কলি, কীরে আয়! তোর জন্য জায়গা করেছি।’
মিনিটখানেক গেল তবুও অরুর দেখা নেই। এতক্ষণ লাগে নাকি? তন্ময় পিছু ফিরল। মায়ের উদ্দেশ্যে বলল, 'তোমরা বসো। আমি ওকে নিয়ে আসি।’
তন্ময় সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলো দোতলায়। এখান থেকেই টুংটুং শব্দ শোনা যাচ্ছে চুড়ির। ছনছন, ছনছন, ছনছন। সে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল দোরগোড়ায়। দরজাটা আধখোলা। অরু হেঁটে-হেঁটে আপনমনে বকবক করছে অস্পষ্ট স্বরে। বকাঝকা করে ঠিক কার গুষ্ঠি উদ্ধার করছে, বুঝতে আর বাকি নেই তার। ওর পরনে নীল রঙা কাজ বিহীন– সাধারণ জর্জেটের লেহেঙ্গা। কপালে ছোটো নীল রঙের পাথরের টিকলি। দু’হাত ভরতি নীল ভেলভেটের চুড়ি। কাঁধে ওড়না পরে সে দিব্যি ব্যস্ত ভাবে পায়চারি করছে। হাঁটার তালে দুলছে কার্ল চুলগুলো। তন্ময় ক্ষণিকের জন্য শ্বাস বন্ধ রাখল। গভীর চোখে দেখল বেশ কিছুটা সময়। লম্বা, গাঢ় ঢোক গিলে, এযাত্রায় দরজা ঠেলে ঢুকল। আকস্মিক ধ্বনিতে অরু সামান্য হকচকাল। পরপর মুখ ভেঙাল। অন্যদিকে ফিরে গেল ততক্ষণাৎ। তন্ময় সেই অভিমানের দাম দিলো না এক আনার। তোয়াক্কা না করেই— কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ করেই ওকে কাঁধে তুলে নিলো। এমন ভাবে কাঁধে তুলল যেন একটি কাপড় নিয়েছে। অরু মুখ ফসকে বেরোল বিকট শব্দের চিৎকার। তার উচ্চস্বরের চ্যাঁচানো যেন তন্ময়ের কর্ণগোচর হলো না। অরুকে বাম কাঁধে নিয়ে, বাম হাতে পায়ের দিকটা ধরে এগুতে থাকল। অরু তখন দিশেহারা প্রায়,
‘কেউ দেখে ফেলবে, তন্ময় ভাই। নামান, নামান। প্লিজ।'
তন্ময় তখন রুম পেরিয়ে করিডোর ধরে হাঁটছে, ‘কেন? আদর করছিলাম না বলেই তো মাথাটা খেলি। এখন করছি। সমস্যা কোথায়? মনের মাধুরি মিশিয়ে খা। আমার মস্তক তো নিয়মিত খাসই। এই আর এমন কী!'
অভিমান তরতর করে বাড়ল মেয়েটার। প্রত্যুত্তর করবে এরমধ্যেই তন্ময় সিঁড়ি দিয়ে নামতে ধরলে, ভয়ে আঁটসাঁট হয় কাঁধের শীর্ণ দেহখানা। ভয়ে চুপসে যাওয়া অরু এবেলায় খাঁমচে ধরে তন্ময়ের পিঠের পাঞ্জাবির কিছু অংশ।
.
.
.
চলবে....................................