অতিথি নিবাস - পর্ব ১৭ - তানজিল মীম - ধারাবাহিক গল্প


রোদ মাখানো দুপুর। অতিথি নিবাসের গেটের মুখে কড়া রোদ পড়েছে তখন। আরহানের হাতে চায়ের কাপ। এ নিয়ে তার তিনকাপ চা খাওয়া শেষ। মাথার যন্ত্রণা থেকে বেশ দূরে সে। খানিকটা ভালো লাগা আর অফুরন্ত সুন্দর অনুভূতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। ঘরের ভিতর তৌহিদ আর শান্ত বিয়েতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। একপ্রকার রাগ নিয়েই হচ্ছে। তাই তো আরহান রাগটা এড়াতে চা নিয়ে বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎই কি যেন হলো আরহানের দৃষ্টি গেল মায়াকুঞ্জের দোতলার বারান্দার দিকে। ফাবিহা এসে দাঁড়িয়ে , গায়ে জড়ানো লেমন রঙের লেহেঙ্গা, চুলগুলো ভেজালো বিধায় তোয়ালে দিয়ে ঝাড়ছে। আরহান দৃষ্টি সরিয়ে নিল। আরহানের মতে, মেয়ে মানুষদের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে নেই এতে চোখে সমস্যা নয়। তবে ভালোবাসার মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকা জায়েজ আছে এতে সমস্যা উল্টো চোখের যতি বেড়ে যায়। আরহান মুচকি হাসল। কাল রাতে বে'কায়দায় কিছু কথা হয়তো ফাবিহাকে বলে দিয়েছে। বলাটা ঠিক হয়নি। সুযোগ আসলে সরিটা বলে দিতে হবে। ফাবিহা চলে গেছে, আরহান এরপর তাকাল একবার। নীরব দীর্ঘশ্বাস বের হলো হঠাৎ। মনে হলো মন বুঝি গান গাইছে, “নিষিদ্ধ জগতের— নিষিদ্ধ জিনিসের ওপর আকৃষ্ট হওয়া বড় অপরাধ আরহান, বড় অপরাধ।

•••••••••••••

ঘড়িতে তখন বারোটা চার ছাড়িয়ে! মাসুদ উদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন অতিথি নিবাসের বাহিরে ছায়াকুঞ্জের মাঝপথে। তৌহিদ আর শান্ত বের হলো তখন। তৌহিদের গায়ে নীলরঙা পাঞ্জাবি, শান্তর সাদা। পাশেই এলেমেলো বেসে টিশার্ট আর ট্রাউজার পরিধিত আরহান দাঁড়িয়ে আছে। সে শান্তকে দাঁড়াতে বলল। শান্ত দাঁড়াল। এরপর শান্তের চোখের চশমাটা খুলে নিজের টিশার্ট দিয়ে মুছতে মুছতে বলল,
 “তৌহিদের সাথে সাথে থাকবি। কোনোরূপ সমস্যা হলে তৌহিদকে বলবি। ও যদি করতে ব্যর্থ হয় তবে আমাকে কল করবি। ঠিক আছে।”

শান্ত মাথা নাড়াল। যার অর্থ, 'ঠিক আছে।' আরহান চশমা পড়িয়ে দিল। একটু ফিস ফিস করে বলল, “তৌহিদ একটু রেগে আছে বিয়ে বাড়ির কোনো সুন্দরী মেয়ে পেলে তাকে বলবি, তৌহিদের মাথায় যেন ঠান্ডা পানি ঠেলে দেয়।”

হেঁসে ফেলল শান্ত। হাসল আরহানও। আর তৌহিদ গম্ভীর মুডে বলল, “তোদের কি হয়েছে?”

আরহান এগিয়ে গেল। কাঁধে হাত দিয়ে শান্ত স্বরে জানাল, “দোস্ত রাগ হোস না, আমরা আমরাই তো।”

উত্তরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকাল তৌহিদ। আরহান বলল, “তোকে যে জোশ লাগছে কতগুলো মেয়ে যে আজ তোকে দেখে ফিদা হবে আল্লাহ মালুম।”

তৌহিদের তক্ষৎণাৎ উত্তর আসে,
 “পাম কম মারা শালা। ফাসিয়ে দিয়ে পাম মারা হচ্ছে।”
 “আরেহ্ পাম না সত্যি বলছি।”
 “চুপ কর শালা।”

হেঁসে ফেলল আরহান। তৌহিদও কিছু সময় গম্ভীর মুডে থেকে হাসল। শান্ত এগিয়ে এলো তখন। মাসুদ উদ্দিন বললেন, “তোমাদের হয়েছে তৌহিদ?”

তৌহিদ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, “জি আঙ্কেল।”

 আর দাঁড়াল না। আরহানের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল তৌহিদ আর শান্ত। আরহান তাদের পানে তাকিয়ে থেকে দাঁড়িয়ে রইল।"

একে একে সবাই বের হলো মায়াকুঞ্জ থেকে। ফাবিহার দৃষ্টি গেল আরহানের দিকে। সে দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ। মনে মনে বলল, 'ছেলেটা অগোছালো বেসে দাঁড়িয়ে আছে কেন— আমাদের সাথে কি যাবে না?' অরিন তাড়া দিল। উত্তেজিত কণ্ঠে শুধাল, “কি হলো দাঁড়িয়ে পড়লি কেন– যাবি না?”

ফাবিহা বিনা বাক্যে হাঁটল। দৃষ্টি তখনও অতিথি নিবাসের গেট মুখে দাঁড়িয়ে থাকা আরহানের দিকে। আরহান বুঝি বুঝল ফাবিহার দৃষ্টির কথা সে একা মনে বিড়বিড়ায়, “আরহানের প্রেমে পড়বেন না রৌদ্রময়ী, আরহান বড্ড বেমানান মানুষ— তার প্রেমে পড়া যায় না।

•••••••••••••

গাড়িতে উঠতেই শান্তকে দেখে চোখ মুখ কুঁচকে গেল অরিনের। এই বেয়াদব ছেলেটাকে তাদের গাড়িতেই বসতে হলো। তৌহিদ ব্যাপারগুলোতে চরম বিরক্ত। কাউকে চেনে না, কাউকে জানে না। মাঝখান থেকে বউ আনতে যাচ্ছে। অদ্ভুত না! অরিনকে গাড়ির ভিতর উঠতে না দেখে ফাবিহা বলল, “কি হলো তুই ভিতরে আসছিস না কেন?”

অরিন বিনাবাক্যে ভিতরে গিয়ে বসল। তবে শান্তর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিতে ভুল হয়নি। শান্ত অন্যদিকে তাকিয়ে থাকায় দেখতে পায়নি। ফাবিহারা বরের গাড়িতে যাচ্ছে না। আহিরের গাড়িতে তার দুটো পাজি বন্ধু আছে যাদেরকে ফাবিহা খুব অপছন্দ করে। এছাড়াও আহিরের বন্ধু সংখ্যা বেশ। তাই তাদের মাঝে থাকল না ফাবিহা। ফাবিহা না যাওয়ায় অরিনকেও আসতে হলো ফাবিহার সাথে। ফাবিহা পিছন ফিরে চাইল। তৌহিদ মাথা নুইয়ে বসে আছে। সে অবস্থাটা উপলব্ধি করে বলল, “আপনারা খুব বিরক্তবোধ করছেন তাই না?”

তৌহিদ তাকাল ফাবিহার দিকে। স্মিথ হেঁসে জানাল, “না ওইরকম কোনো ব্যাপার নেই।”

ফাবিহা আরো বলল,
 “ওইরকম ব্যাপার নেই বললেও ওইরকম ব্যাপার আছে কিন্তু।”
 “তা অবশ্য একটু আছে। কাউকে চিনি না জানি না মাঝখানে বউ আনতে যাচ্ছি ব্যাপারটা একটু বেমানান বটে।”
 “মাঝে মাঝে কিছু বেমানান কাজও করতে হয় বলুন।”

কথা শুনে তৌহিদ যেন কেমন দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। ফাবিহা অপ্রস্তুত বোধ করল। বলল, “কিছু ভুল বলে দিলাম নাকি?”

সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করল তৌহিদ। বলল,
 “না না। আসলে হয়েছে কি এখানে আরহানের থাকার কথা ছিল কিন্তু শয়তানটা আসলো না। ও আবার বেমানান জায়গাগুলোতে এক নিমিষেই মানিয়ে নিতে পারে। আমি আবার পারি না। এসব পছন্দ নয় আরকি।”

ফাবিহা বেশ আশ্চর্য হলো। এ তো তারই মতো। স্মিথ হাসল ফাবিহা। জিজ্ঞেস করল,
 “উনি আসলেন না কেন? ইচ্ছেকৃত!”
 “উনি বলতে— আরহানের কথা বলছেন?”

মাথা নাড়ায় ফাবিহা। তৌহিদ বলে,
 “কিছুটা তেমনই। তবে ও একটু অসুস্থ। কাল রাত থেকে মাথা যন্ত্রণা। যদিও এখন সেরেছে চাইলে আসতে পারত। কিন্তু এলো না। আমরাও জোর করিনি৷ ফের যদি মানুষের ভিড়ে মাথার যন্ত্রণা হয়।”

মন খারাপ হয়ে গেল ফাবিহার। সে ছোট্ট করে উত্তর দিল, “ওহ।”

গাড়ি চালানোর প্রস্তুতিটা তখন কেবল মাত্র নেয়া হলো। সেই মুহূর্তে গেটের বাহিরে এগিয়ে এলো আরহান। তার হাতে শান্তর ফোন। ছেলেটা এত বেখেয়ালি ফোন নিতেও ভুলে যায়। আরহানকে আসতে দেখে ফাবিহা গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থেমে গেল। আরহান এগিয়ে এসে প্রথমে বলল, “দুঃখিত।

এরপর তৌহিদকে উদ্দেশ্য করে বলে “তৌহিদ শান্তকে ফোনটা দে। ও তো ফোন না নিয়েই চলে যাচ্ছিল।”

ফাবিহা হাত পেতে ফোনটা নিল। এগিয়ে দিল শান্তর হাতে। শান্ত দেখে স্মিথ হাসল।'

গাড়ি পুনরায় ছাড়া হলো। এরপরই একটু একটু করে আরহানকে রেখে এগিয়ে গেল তারা। অরিনের মুড অফ। তার বিন্দুমাত্র পছন্দ হচ্ছে না শান্তকে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আহির ভাইয়ের বিয়েতে আসাটাই ঠিক হয়নি।”

   অতিথি নিবাসের বারান্দায় হেঁটে এসে চুপটি করে বসল আরহান। এবার নিজেকে একটু শান্ত শান্ত লাগছে। পুরো বিয়ে জমজমাট পরিবেশটা বেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। বাড়িতে বোধহয় রিনা বেগম ছাড়া কেউ নেই। ওহ না, রাহেলা আছে বোধহয়। মেয়েটাকে তো গাড়িতে দেখল না। হঠাৎ ফোন বাজল আরহানের। চেনা একটা নাম্বার। ফোন তুলতে ইচ্ছে না। রিং বেজে ফোনটা কেটে গেল। দ্বিতীয় বার আবার বাজল। আরহান ধরল না। কেন ধরবে— পৃথিবীতে সবার ফোনকলই যে ধরতে হবে এমন তো কথা নেই।

••••••••••••

আহিরদের বাড়ি থেকে উর্মিদের বাড়ির দূরত্ব মাত্র চল্লিশ মিনিট। এত কাছে শশুর বাড়িটা একদমই পছন্দ হলো না অরিনের। পছন্দ হলো না ফাবিহারও। লাভ ম্যারেজে এই হলো এক সমস্যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শশুর বাড়িগুলো হয় কাছে।'

  একপ্রকার হম্বিতম্বি হয়ে হয়ে খয়েরী রঙের লেহেঙ্গা পড়ে গেটের সামনে ছুটে আসলো মোহনা। কারণ চারিদিকে বাতাসের ন্যায় ছুটছে যে, “জামাই এসেছে, জামাই।”

পুরনো দিনের রীতি অনুযায়ী গেটের সামনে ফিতা দিয়ে পথ আটকানো হলো জামাইর। মোহনাদের দাবি হলো,
 “বিশ হাজারের নিচে এক টাকা কম দিলেও তারা ভিতরে ঢুকতে দিবে না। বউ নেয়া এত সহজ নাকি।”

মোহনার দাবি শুনে আহিরের বন্ধু মুশফিক বলল,
 “আরেহ বিয়াইন, বিশ হাজার টাকা কখনো একত্রে দেখেছেন।”
 
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসে মোহনার,
 “রসের বেয়ান বলে কি— আমাদের দেখে কি খয়রাতি মনে হয়।”
 “না যেভাবে এসে হাত পাতলেন মনে তো কিছুটা তেমনই হলো।”
 “এগুলোকে অধিকার বলে বেয়ানসাব। আপনারা বুঝবেন না।”

এসব নিয়ে তুমুল কথা কাটাকাটি শুরু হলো মোহনা তার আহিরের বন্ধুদের মাঝে। অন্য দিকে সবার পিছনে বিরক্ত বেশে দাঁড়িয়ে ছিল তৌহিদ আর শান্ত। বিরক্তির চরম সীমানায় পৌঁছে গেছে তারা। যদিও শান্ত ব্যাপারটা উপভোগ করছে কিন্তু তৌহিদ, তার মেজাজ বিগড়াচ্ছে। কখন জানি কাকে গিয়ে ধমক দিয়ে বসে। বিশেষ করে মোহনা। এই মেয়েটা এত কথা বলে! অসহ্যকর।
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp