আশিয়ানা - পর্ব ৬০ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


রাস্তার দুপাশে গাছগাছালি আর পাখির কিচিরমিচির সঙ্গে গ্রামীণ পরিবেশের ছোঁয়া সেহরিশের হৃদয় কেড়ে নিয়েছিল। পুকুরের জল সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। সেহরিশ এই পথে হাঁটতে থাকে ও তাঁর সঙ্গে সঙ্গী হয়েছে জোজো। মেঘ-সূর্যের লুকোচুরিতে আজ সূর্য হেরে গেল আর বাতাসে আর্দ্রতা অনেক। মাঝে মাঝে ঠান্ডা বাতাসে শরীর খুব আরাম বোধ করছে সেহরিশ। মহাসড়কের পাশে অনেক গরু অবাধে চলে যাচ্ছে। চারপাশে সবুজের সমারোহ। বাতাসে গাছের পাতা দোলছে। দেখে মনে শিহরণ জাগে। রাস্তার পাশ থেকে একটা গাছের সুন্দর ডাল তুলে নিল সেহরিশ। এখনও জোজো তাকে চুপচাপ দেখছে। দু-একবার উল্টো রাস্তা পার হয়ে ওপার থেকে ঘুরে এলো সে! হঠাৎ সেহরিশের মনে খচখচানি কাজ করছে। এখানে আর থাকতে পারবে না, বাড়ি যেতে হবে। নদীর পাড় থেকে যেতে হাঁটতে লাগল। আজ সকালের সূর্য তেমন উজ্জ্বল নয়। রাস্তায় নামতেই দুই পাশ দিয়ে মালামাল ভরা দুটি ভ্যান চলে গেল।

হটাৎ করে দুই-চার ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। অবশ্য ভিজিয়ে দেওয়ার মতো নয়। পথের দুই পাশের দখল আবার তালগাছের কাছে চলে গেছে। অল্প এগিয়েই চৌধুরী বাড়ির ফটক। দুজন দারওয়ান আছে গেটে। বাড়ির সামনে আসতেই জোজোর বিরতিহীন ঘেউঘেউ শুরু হলো। একজন দারোয়ান এগিয়ে এলো। তিনি জোজোর গলার বেল্ট ধরে তাকে নিয়ে গেল।

সদর দরজা খুললেন ফারিয়া বেগম। ছেলেকে দেখে দুই হাত দিয়ে গাল ছুঁলেন। তারপর ঠোঁটে হাসি দিয়ে বললেন,
  'এই অসময়ে কোথায় গিয়েছিলি বাবা? একটু পরেই তো চলে যাবি।'
সেহরিশ মৃদুস্বরে জবাব দিল, 
  'আমি জোজোকে নিয়ে বাইরে গিয়েছিলাম, মা। আর আমি এখনই চলে যাব। গ্রাম থেকে আমাদের গাজীপুর যেতে হবে তারপর সেখান থেকে আবার এয়ারপোর্টে যেতে হবে। অনেক সময়ের ব্যাপার, মা। শুধু আফসোস আরুশির সাথে দেখা হয়নি।'
সেহরিশ জিজ্ঞেস করলো
  'বড় ভাই আর বাবা কোথায়?'
ফারিয়া বেগম বললেন, 
  'তোর বাবা ঘরে আছেন আর সোহান তুই চলে যাবি বলে বাজারে গেছে।'
  'অনেকক্ষণ মারিয়াকে দেখিনি।'
  'ও কি এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠবে? ঘুমাচ্ছে।'
সেহরিশ দুটো সিঁড়ি ভেঙে উঠল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
  'ওকে একটু জাগাও। দেখা করে না গেলে পরে কান্না করবে।'

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। সেহরিশের পা থেমে গেল। সে দাঁড়িয়ে ফোন চেক করল কে ফোন করছে? এখনও রিং হচ্ছে, সাদাফ কল দিয়েছে। সেহরিশ কল ধরল না। কিছুক্ষণ পর কল কেটে গেল। সেহরিশ রুমে যাবার জন্য আবারও হাঁটা শুরু করে আর সঙ্গে মেসেজ টাইপ করছে। সাদাফকে মেসেজ পাঠালো। ফোন করার কারণ জানতে চাইল সে।
সাদাফ কপালে দুই আঙুল দিয়ে বসে আছে। ফোনটা ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে তার। কল রিসিভ না করে, কল কেটে যাওয়ার পর আবার কল দেওয়ার কারণ জানতে চাচ্ছে? প্রচণ্ড বিরক্তিতে সাদাফের কপালে চার ভাজ পড়ল। দ্রুত টাইপ করলো
  'কখন ফিরবি?'
সেহরিশ উত্তর দিল,
  'আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে বের হবো।'

সাদাফ ফোনটা সাইড করে রেখে দিল। সেহরিশ ফোন হাতে রেখে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বেখেয়ালি ভাবে দরজা ঠেলে ঢুকতে নিল সে। আচমকা দু চোখ বড়সড় হয়ে গেল তার। রোদেলা রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সে শাড়ি পরার চেষ্টা করছে। শাড়ির আঁচলটা মেঝেতে পড়ে আছে। রোদেলা মাথা নিচু করে নিখুঁতভাবে দুই হাতে শাড়ির কুঁচি দিচ্ছে। খোলা চুলগুলো বারবার সামনে চলে আসছে। তারপরও বিরক্ত না হয়ে রোদেলা কানের পেছনে চুলগুলো আলতো করে গুঁজে দিল এরপর আবার শাড়ির কুঁচি দিতে লাগল সে।

সেহরিশ বিভ্রান্তিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত গতিতে ছুটছে। বুকের মাঝে ধুকধুক করছে। মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যাচ্ছে। সেহরিশের হাত অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে রোদেলাকে নিবিড়ভাবে দেখতে লাগল সে। শুঁকনো ঢোক গিলে ফেলল আচমকা। মুহূর্তের মধ্যে বুকটা ভারী হয়ে গেল তার। একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে সেহরিশ সঙ্গে সঙ্গে দরজার সামনে সরে দাঁড়াল সেহরিশ। এক ফোঁটা স্বেদজল কপাল বেয়ে পড়ল। সেহরিশ তার তর্জনী দিয়ে আলতো করে মুছে নিল। এখনো বুকের মধ্যে ধড়ফড়ি করছে। ডান হাত বুকে রেখে সেহরিশ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল।

হুইল চেয়ারে বসে আছেন শফিকুল চৌধুরী। বাড়ির সবাই মিলে ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই সেহরিশ আর রোদেলাকে বিদায় জানায়। মারিয়া সোফায় বসে আছে, মনমরা হয়ে। সেহরিশ তার সাথে কথা বলল, তারপর মারিয়া হেসে তাকে জড়িয়ে ধরল। সেহরিশ তার ভাই-ভাবী ও মায়ের সাথে কথা শেষ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শফিকুল চৌধুরীর দিকে এগিয়ে গেল। একটু নত হয়ে মৃদু স্বরে বলল, 
  'বাবা!'

হঠাৎ মুখ তুলে তাকালেন শফিকুল চৌধুরী। উনি দ্বিধাগ্রস্ত। ভাবলেন বয়স হয়েছে তাই হয়তো তিনি কানে বেশি শুনেছে। চশমার আড়ালে তার চোখ দুটো ছলছল করছে। সেহরিশ হাঁটু ভাজ করে বসে গেল। বাবার দু-হাত তার মুঠোয় নিয়ে পূর্বের চেয়ে কোমল গলায় বলল, 
  'বাবা, বছরের পর বছর ধরে আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তুমি আমার ভালো চেয়েছিলে, আর আমি খারাপ ভেবেছিলাম আর অকারণে তোমার উপর রাগ করি, তোমাকে অদৃশ্য কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখে এত বছর আমার থেকে দূরে রেখেছিলাম। যখন বাস্তবতা বুঝলাম আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই কিন্তু তখন নিজেকে অপরাধী মনে হয়। ইচ্ছা থাকলেও কথা বলতে পারলাম না। সময়ের সাথে সাথে আমাদের মধ্যে এক বিশাল প্রাচীর তৈরি হয়ে যায়। বাবা, বাবা আমাকে ক্ষমা করো। তোমার দুঃসময়ে তোমার পাশে থাকতে পারিনি।'

এক হাতে চশমা খুললেন শফিকুল চৌধুরী। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। সেহরিশ ছোট বাচ্চার মত চুপ করে রইল। শফিকুল চৌধুরী দুই হাত দিয়ে সেহরিশের চুল ও পিঠে বুলিয়ে দিতে লাগল। তারপর নিচু গলায় বললেন,
  'আমার ছেলে, আমার সাত রাজার ধন! আমি কি তোর উপর রাগ করে থাকতে পারি? তুই আমাকে বাবা বলে ডাকলি, আমার হৃদয় জুড়িয়ে গেছে। এতগুলো বছর আমার চোখের সামনে সোহান আর আরুশি ছিল, তারা আমাকে সবসময় বাবা বাবা বলে ডাকত, কিন্তু তবুও আমার মনে খচখচ করত। মনে হতো আমার ছোটো ছেলে নেই, সে থাকলে এমন করে সেও আমাকে বাবা বলে ডাকত। আমি সবসময় তোর শূন্যতা অনুভব করেছি, বাবা। তুই আমার ছেলে, তুই আমার ছেলে। আবার বাবাকে ডাক শুনে আমার কান জুড়াই।'

রোদেলা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তর্জনী দিয়ে চোখ মুছল। ফারিয়া বেগম তার দিকে এগিয়ে গেলেন। রোদেলাকে এক হাতে ধরে কপালে আলতো করে চুমু খেলেম। তারপর আস্তে করে বললেন, 
  'খুব খুশি হও মা।'

পুতুল বেগম খাবার নিয়ে এলেন। তাকে আসতে দেখে জোজো গুটিশুটি মেরে রোদেলার পাশে বসল। পুতুল বেগম জোজোকে পছন্দ করতেন না, সুযোগ পেলেই তাকে ধমকাতেন। রোদেলা জোজোর মাথায় হাত রাখে, জোজো ফ্যালফ্যাল চোখে রোদেলার দিকে তাকায়। রোদেলার পাশে বসেছেন পুতুল বেগম। তারপর রোদেলার মাথায় হাত রেখে নিচু গলায় বললেন,
  'আমি তোর উপর অনেক অন্যায় করছি মা। তোর এই মামীকে মাফ করে দিস।'
রোদেলা বিস্মিত গলায় বলল, 
  'তুমি এভাবে বলো না মামী। আমি তোমার উপর রাগ করিনি। তুমি আমার বড়, আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে ছোট করো না।'

সেহরিশের পাশে বসে আছে মাসুদ মিয়া। সেহরিশ গম্ভীর মনে বসে আছে। মাসুদ মিয়া জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
  'বাবা, এটা তোমার সাথে আমার দ্বিতীয় দেখা। তুমি আমার মেয়েকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছ। এখন সে তোমার স্ত্রী, তুমি তার সাথে যা খুশি করতে পারো। তোমার কাছে একটাই অনুরোধ বাবা, খেয়াল রেখো ওর। এইটুকু জীবনে ও অনেক কষ্ট পেয়েছে। তুমি এখন তার একমাত্র নিজের মানুষ। তোমরা যেখানে থাকো সেখানেই ভালো থেকো। সময় পেলে আমাদের সাথে একটু কথা বলিও। তাতেই আমরা খুশি হব।'
  
সেহরিশ মাসুদ মিয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, 
  'সে এখন আমার দায়িত্ব। আমার অর্ধাঙ্গিনী, তার কল্যাণ এবং তার সমস্ত দায়িত্ব আমার। রোদ আমার প্রথম অগ্রাধিকার।'
.
.
.
চলবে..................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন