ইউরোপের অন্যতম গভীরতম জলাভূমি লেক কোমো। রাস্তার একপাশে পাহাড় সগর্বে দাঁড়িয়ে, অপর পাশে সরু লোহার রেলিং। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ের সারি বেয়ে গাড়িটি আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথে নেমে যাচ্ছে ১২০০০ ফুট নিচে। রোদেলা জানালার পাশে বসে বাহিরের সৌন্দর্যে মনোনিবেশ করলো। লেক কোমোর নীল জল ও পার্বত্য গাছপালার সবুজের সংমিশ্রণে তৈরি জায়গাটির সৌন্দর্যে আপ্লূত রোদেলা। এই স্থানটির জনপ্রিয় একটি প্যালেস সেহরিশ তার জন্য কিনেছিল। লেক কোমোর পার ঘেঁষে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক প্যালেস। ৪০টি ঘর রয়েছে ভিলার অন্দরে। মডার্ন আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো প্যালেসের অন্দর। সেহরিশ প্রায়ই ঢুঁ মারে এখানে। আকাশের রং গাঢ় নীল। সূর্যের তীব্রতা বেশ। প্যালেসের প্রধান ফটকের সামনে গাড়ি থামালেন ড্রাইভার। সঙ্গে সঙ্গে চারজন দারওয়ান লোহার গেট খুলে দিতে গাড়ি ঢুকে গেল। ১৬ ঘণ্টার যাত্রার পর রোদেলার শরীর খুব দুর্বল লাগছে। সিটের সাথে হেলান দিয়ে আরাম করতে চায় সে, কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। রোদেলা জায়গাটির সৌন্দর্য থেকে চোখ সরাতে পারছে না। সে জানালার কাঁচ গলিয়ে বাইরে তাকাল। রাস্তার দু'ধারে নাম না-জানা বড়বড় গাছপালা, তার পাশে ছোট ছোট গাছ। মসৃণ রাস্তা দিয়ে গাড়ি যতই ভেতরে যাচ্ছে সৌন্দর্য ততই ফুটে ওঠছে। গাড়ি থামানো হলো বড় সাদা রঙের প্যালেসের সামনে। সেহরিশ প্রথমে বেরিয়ে এলো। তারপর হেঁটে এসে গাড়ির অপর দরজা খুলে দিল রোদেলার জন্য। রোদেলা বেরিয়ে এসে চারপাশটা ভালো করে দেখে নিল, প্রাসাদ থেকে কয়েক কদম দূরে একটা বাগান। বাগান থেকে উত্তর দিকে নেমে গেলেই আরেকটি সিঁড়ি। একটি স্পিডবোট সিঁড়ির পার ঘেঁষে স্বচ্ছ জলে দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলা জায়গাটা ঘুরে দেখল, প্রাসাদের চারপাশে শুধু গাছ আর গাছ, রোদেলা বেশ কিছু গাছের নাম জানে। সদর দরজার সামনে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশকে দেখে তারা এগিয়ে আসলো। সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করল সেহরিশ আর রোদেলা। মুহূর্তের মধ্যে রোদেলার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল যেন। সদর দরজা দিয়ে দুই মিনিট হেঁটে সামনে আসতেই একটি সুইমিং পুল ও তার নীল জল দেখতে পেল রোদেলা। সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। পুলের চারপাশে বড় বড় কয়েকটা গাছ। সেহরিশ রোদেলার হাত ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে গেল। রোদেলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সেহরিশের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,
'এইটা তো রাজপ্রাসাদ।'
সেহরিশ রোদেলার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,
'তুমিই এর একমাত্র রাণী।'
সেহরিশ সিঁড়ির কাছে থামল। গার্ড এবং কর্মীদেরকে নির্বিঘ্নে ইতালীয় ভাষায় তাদের অনুসরণ করতে নিষেধ করে সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়। রোদেলা জিজ্ঞেস করলো,
'আপনি এখন তাদের কি বললেন? আমি কিছুই বুঝিনি।'
সেহরিশ বলল,
'আমি তাদের বলেছি, নিজের কাজ করো আর আমাদের পিছনে এসো না। আমি যদি তাদের বাধা না দিতাম, তারা আমাকে ফলো করে রুম পর্যন্ত আসত। এ ছাড়া, তুমি এখানে নতুন ইতালীয় ভাষা বুঝতে পারবে না। ধীরে ধীরে তোমাকে সব শিখিয়ে দেওয়া হবে।'
রোদেলা ফ্যালফ্যাল চোখে সেহরিশের দিকে তাকায়। তার মনে হচ্ছে সে একটি মাঠে আছে আর মাঠের একপাশ থেকে অন্য দিকে যেতে তার অনেক সময় লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে মাঠ দ্বিগুণ বড় হচ্ছে। রোদেলা আশেপাশের জিনিসপত্র পর্যবেক্ষণ করে তার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে। রোদেলা একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো,
'এইখানে আপনি একা থাকতেন?'
'যতবার আসছি একাই থেকেছি।'
রোদেলার ভ্রু কুঁচকে গেল।
'এটা ছাড়া আপনার আরও একটা বাড়ি আছে?'
সেহরিশ ভ্রুকুটি করল। রাশভারী গলায় বলল,
'আমার বাড়ির গাড়ির হিসাব নেই।'
রোদেলা জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
'এই এত্তো বড় প্রাসাদে আপনি হারিয়ে যান না?'
সেহরিশ অবাক হলো না। সে আশংকা করেছিল রোদেলা তাকে এমন প্রশ্ন করবে, তাই সে আগে থেকেই উত্তর প্রস্তুত করে রেখেছিল। সেহরিশ শান্তভাবে বলল,
'আমি কখনো হারাইনি কিন্তু তুমি অবশ্যই হারাবে।'
রোদেলা তাকাল। সেহরিশ আর কথা বলল না। ওরা একটি রুমের সামনে থামল তারপর রুমে প্রবেশ করলো। সেহরিশ রোদেলার উদ্দেশ্য বলল,
'তোমার যা কিছু দরকার সব আলমিরাতে রাখা আছে। তুমি গোসল করে নাও, ডোনা রান্না করছে। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে তারপর ঘুমাবে।'
রোদেলা ইতস্তত করে বলল,
'কোথায় আলমারি আর কোথায় বাথরুম?'
সেহরিশ জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। সে রোদেলাকে রুমের অবস্থান ও বাথরুম ব্যবহারের পদ্ধতি দেখিয়ে দিল।
রোদেলা ড্রেসিং টেবিলের পাশে বসে আছে, সেহরিশের দুটি দৃঢ় এবং স্বীয় চোখ প্রতিনিয়ত তাকে দেখছে। রোদেলার পরনে লাল-সাদা শাড়ি। সে ভেজা চুলগুলো শুঁকাতে চেষ্টা করছে। সেহরিশের দৃষ্টি রোদেলার মিষ্টি মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই স্থির আছে। রোদেলা আয়নার দিকে তাকাতে তার চোখ পড়ল একজন গম্ভীর ব্যক্তিত্বের লোকের দিকে। সে ফোনে কিছু একটা দেখছে। রোদেলা সহসা নিচের দিকে তাকাল। সেহরিশ আবার চোখ সরু করে রোদেলার দিকে ফেলল। এইসময় ডোনা এলো। দরজায় টোকা দিয়ে সে ইংরেজিতে বলল,
'স্যার ভিতরে আসবো?'
সেহরিশের অনুমতি নিয়ে ডোনা প্রবেশ করে। সে খাবার টেবিল প্রস্তুত করেছে। সেহরিশ কখন খাবে? নির্দিষ্ট সময় জানতে চাইল। সেহরিশ বলে ওরা কিছুক্ষণের মধ্যে নিচে নামবে। ডোনা ঘরের উত্তর দিকে হেঁটে গেল। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত জানালার পর্দা সরাতে শুরু করল ডোনা। তারপর রোদেলার উদ্দেশ্য ইংরেজিতে বলল,
'ম্যাম, আপনার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে বলবেন।'
রোদেলা ওকে ছোট্ট করে ধন্যবাদ দিল। রোদেলার উদ্দেশ্য গম্ভীর গলায় বলল সেহরিশ,
'আজ থেকে আমরা এই প্রাসাদে থাকব। ডোনা খুব ভালো মনের মানুষ। কিছু খেতে চাইলে তাকে বলবে, সে সব করে দেবে।'
সেহরিশ ফোনটা ধরিয়ে দিল রোদেলার হাতে। দৃঢ় ও শক্ত কণ্ঠে বলল,
'তোমার মামার সাথে কথা বলে নাও। তারা তোমার জন্য চিন্তিত হয়ে আছে।'
রোদেলা কল দিতেই ওপাশ থেকে মাসুদ মিয়া বললেন,
'আসসালামু আলাইকুম! আপনি কে?'
রোদেলার চোখ মূহুর্তে ছলছল করে উঠল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
'মামা।'
মাসুদ মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। একটু পর বললেন,
'কেমন আছিস মা? তোর শরীর ভালো তো?'
পাশে বসে আছেন পুতুল বেগম। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
'জিজ্ঞাসা করো ঠিকমতো পৌঁছেছে কিনা? প্লেনে কোন সমস্যা হয়নি তো? ফোন করতে এত সময় লাগল কেন?'
মাসুদ মিয়া মুখে এক হাত রেখে তাকে চুপ থাকতে বললেন,
'চুপ করো, চুপ করো। আমি আগে কথা বলি তারপর তুমি বইলো। তাছাড়া ওরা আকাশপথে অন্য দেশে গেছে, প্লেনে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না।'
পুতুল বেগম কড়া গলায় বললেন,
'কী করে বুঝলে সমস্যা হয় না? তুমি কি কখনও প্লেনে উঠেছো?'
মাসুদ মিয়া চুপ হয়ে গেল। ফোনটা বাড়িয়ে দিলেন পুতুল বেগমের দিকে। রোদেলা নরম গলায় বলল,
'মামি কেমন আছো? খেয়েছ? ছোটু কি ঘুমিয়ে পড়েছে?'
পুতুল বেগম বললেন,
'আমরা সবাই ভালো আছি। হ্যাঁ, রাফসান অনেক আগেই ঘুমিয়েছে। আমাদের তোর কথা অনেক মনে পরছে মা। তুই ঠিক আছিস তো?'
রোদেলা নরম গলায় বলল,
'আলহামদুলিল্লাহ মামি আমি ভালো আছি। আমরা ভালো ভাবেই এ দেশে পৌঁছেছি।'
পুতুল বেগম বললেন,
'জামাই বাবা কোথায়?'
'মাত্রই গোসল করতে বাথরুমে গেছে।'
'এখন কি ওখানে রাত নাকি দিন?'
পুতুল বেগমের কণ্ঠে কৌতূহল। রোদেলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,
'আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মামি। ঘড়িতে ছয়টা বাজে আর বাইরে এখনও প্রখর রোদ।'
পুতুল বেগম ম্লান গলায় বললেন,
'আচ্ছা, দুপুরের খাবার খেয়েছিস?'
'আমি ফ্লাইটে একটু খেয়েছিলাম, মামি। এখন ডোনা আবার এসে খাবার জন্য ডেকে গেছে। উনি গোসল সেরে বের হলেই খেতে যাব।'
'ডোনা কে?'
'মামি, এই প্রাসাদে সম্ভবত একশো লোক কাজ করে। তাদের একজনের নাম ডোনা।'
বলে থামলো রোদেলা। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল, 'মামি, তোমরা নিজেদের খেয়াল রাখবে কেমন? আমি মাঝে মাঝে ফোন করব। এখন তাহলে রাখি? উনি কিছুক্ষণের মধ্যে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসবেন।'
'আচ্ছা রাখ। আর শোন, তোর নতুন বিয়ে হয়েছে স্বামীকে বেশি বেশি আদর সোহাগ করবি। তাহলে স্বামীর কাছ থেকে আরও ভালোবাসা পাবি।'
রোদেলার গাল আবার লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সে দ্রুত কল কেটে হাফ ছাড়ল।
খাবার টেবিলে বসে রোদেলা সংকোচ বোধ করছে। বড় প্রাসাদের মত, এর আসবাবপত্র বড়, এত বড় টেবিল কিন্তু মানুষ মাত্র দু'জন। একটা জিনিস কমন দেখল রোদেলা। এই প্রাসাদের সবকিছু প্রায় সাদা শুধু অল্প কিছু অন্য রঙের আসবাবপত্র। রোদেলার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো খাবার লেগেছে। সেহরিশ খাবার বন্ধ করে রোদেলার ঠোঁটের দিকে এক পলক দেখে এগিয়ে এল। তর্জনী দিয়ে আলতো করে খাবারের অংশ মুছে ফেলল সে। রোদেলার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। দৃঢ় কণ্ঠে বলল সেহরিশ,
'তুমি কি ভাবছো? ঠিকমতো খাবার খাচ্ছ না কেন? তোমার মনোযোগ কোথায়?'
রোদেলা নিবিড়ভাবে মাথা নাড়ল। যার অর্থ কিছুই না। সেহরিশ চোখ তুলে সামনের দিকে তাকাল। সে কর্মজীবী নারী-পুরুষদের সামনে থেকে সরে যাওয়ার জন্য বলল,
'আমার ওয়াইফ আপনাদের সামনে খেতে ইতস্তত করছে। আপনারা ভিতরে চলে যান। আমার কিছু লাগলে আমি আপনাদের ডাকব।'
রোদেলা জিজ্ঞেস করল,
'আপনি কি করে বুঝলেন আমি ওনাদের সামনে খেতে পারছিলাম না?'
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
'তুমি আমার, তাই তোমাকে বোঝার দায়িত্ব আমার। তারপরও তুমি নিজে থেকে আমাকে কিছু বলবে না, তাই বারবার বুঝে নিতে হবে, তাই বুঝে নিলাম।'
রোদেলা হঠাৎ বলে উঠল,
'আপনি সুন্দর।'
সেহরিশের বলিষ্ঠ ও গম্ভীর স্বভাব যেন এক নিমিষেই নরম হয়ে গেল, রোদেলার দিকে তাকিয়ে সেহরিশ অগোচরে হেসে নিলো।
.
.
.
চলবে.........................................