আশিয়ানা - পর্ব ৬১ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


চৈত্রের সকাল। আকাশে মেঘ নেই। আছে সূর্যের চোখ রাঙানি। সকালটা শুরু হচ্ছে ঝকঝকে প্রখর রোদ দিয়ে। সময়ের সাথে সাথে তেতে উঠছে সূর্য। বাড়ছে রোদের তাপ। মাঠে মাঠে ঠা ঠা রোদ। চৈত্র তার ঝাঁঝ বুঝিয়ে দিচ্ছে। চারিদিকে রুক্ষ আবহাওয়া বিরাজ করছে। রাস্তায় ভিড় কম। রাস্তাঘাট ফাঁকা। ড্রাইভার চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক এভাবে চলে গেল। ঘড়িতে তখন দুপুর বারোটা। জানালা দিয়ে আসা ফুরফুরে বাতাসে গা এলিয়ে মুহূর্তে ঘুমে ঢলে পড়ল রোদেলা! ফুরফুরে বাতাস এসে বুকে লাগছে। প্রশান্তি লাগছে তার। হঠাৎ সেহরিশের চোখে পড়ল রোদেলা তার কাঁধে মাথা রেখেছে। হাত দিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এরই মধ্যে জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে প্রখর রোদের ঝলকানি। কিছু দূর এগোতে রোদেলা ঘেঁষে বসল সেহরিশের সঙ্গে। রোদেলার কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর স্বভাব। এখন ঘুমের ঘোরে সে বোধহয় সেহরিশকে কোলবালিশ ভেবে আঁকড়ে ধরেছে। 

সেহরিশের গলা শুকিয়ে এলো যেন। বুকের ভেতর ধুকপুকানিটা মূহুর্তেই বেড়ে গেল। রোদেলার ঘুমন্ত মুখের দিকে নয়নাভিরাম চোখে তাকিয়ে রইল সেহরিশ। রোদেলার স্নিগ্ধ মুখ, চোখ, নাক, ঠোঁট যেন কাছে ডাকছে তাকে। সেহরিশ হাত বাড়িয়ে রোদেলাকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিল। বহু প্রতীক্ষার পরে রোদেলার ফর্সা কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো সেহরিশ। একবার তারপর দুইবার সঙ্গে সঙ্গে মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল তার। সেহরিশের মনে হচ্ছে, সে হাঁটতে হাঁটতে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে। সেহরিশ ঘোর লাগানো কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল, 
  'কী সুন্দর মায়াবী ফুল।'

গাড়িটা আর একটু এগোলে দেখা মিললো সারি সারি গাছ। আকৃতি ছোট। তবে ফুল ফুটেছে গাছে। সাদা সাদা ফুলের মায়াময় পথ ধরে এগোতে থাকল তার গাড়িগুলো। একটু পর পর লাগানো হয়েছে ভিন্ন জাতের গাছ। সেগুলোতেও ফুল ফুটেছে। চিরল চিরল সবুজ পাতা ভেদ করে আকাশের সাদা গুচ্ছ মেঘের মতো ফুলগুলো। সেহরিশ ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হাসলো।

গাজীপুরে এসে রোদেলার ঘুম ভাঙল। চোখ খুলেই সেহরিশের বাহুতে নিজেকে আবিষ্কার করল সে। মুহূর্তের মধ্যে রোদেলা নতুন বউয়ের মতো লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নিল। সেহরিশের বুক থেকে সরে গেল। সেহরিশ ফোন স্ক্রল করছে। ফোনে চোখ স্থির রেখে জিজ্ঞেস করলো।
  'ঘুম ভালো হয়েছে?'

রোদেলা এখনও লজ্জা পাচ্ছে। প্রশ্নের উত্তর দিল না সে। সেহরিশ আর কথা বলল না। সেহরিশের বাসার সামনে গাড়ি থামল। দু’জন দেহরক্ষী এসে দরজা খুলতেই সেহরিশ বেরিয়ে এলো, তারপর রোদেলা বেরিয়ে এলো। ঘরে কিছু কাগজপত্র আছে, সেগুলো নিয়ে সাদাফের কাছে যাবে সে। তারপর দুজনে একসঙ্গে এয়ারপোর্টে যাবে। সেহরিশের অনুমতি নিয়ে তার ম্যানেজার লাগেজ দুটো গাড়িতে তুলে দিল, সেহরিশ রোদেলার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, 
  'তুমি কথা বলছ না কেন? একটু যাচাই করে দেখ তোমার সব নিয়েছ কিনা।'
রোদেলা ইতস্তত করে বলল,
  'আমি সব নিয়েছি।'
সেহরিশ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধল,
  'কিছু বলবে?'
রোদেলা নিবিড়ভাবে ডান থেকে বামে মাথা নেড়ে বলল, 
  'না।'
সেহরিশ একটু চুপ করে রইল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো, 
  'তুমি কি ক্ষুধার্ত? কিছু খাবে?'
রোদেলা মাথা নিচু করে ফেলল। সেহরিশ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা বিছানায় রাখল তারপর শার্টের দুটো বোতাম খুলে কনুই পর্যন্ত হাতা গুটিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। কম সময়ে নিজের ইচ্ছামতো একটা খাবার তৈরি করল সে। রোদেলা ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছে। খাবারের প্লেট টেবিলে রেখে সেহরিশ নরম গলায় বলল, 
  'খাবার শেষ করো। আমাদের যেতে হবে।'

রোদেলা চুলগুলো হাত খোঁপা করে বসে গেল। খাবার শুরু করবে এমন সময় দেখল সেহরিশ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রোদেলা ভাঙা গলায় বলল,
  'আপনি খাবেন না?'
সেহরিশ সোজাসাপটা উত্তর দিল,
  'না।' তারপর জিজ্ঞেস করলো,
  'খাচ্ছো না কেন? খাবার দেখে ভালো মনে হচ্ছে না?'
রোদেলার গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। সে নিচু কণ্ঠে বলল,
  'আমি কারো সামনে খেতে পারি না।'
সেহরিশ শক্ত কণ্ঠে বলল, 
  'আমার সামনে রোজ খেতে হবে। এখন থেকে অভ্যেস করে নাও।'
রোদেলা চোখ তুলে তাকাল। দিশেহারা ও ফ্যাকাশে কণ্ঠে শুধল,
  'জি?'
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, 
  'খাবার শুরু করো। আমি খাইয়ে দেব?'
রোদেলা আচমকা কাশতে লাগল। শুঁকনো কাশি। সেহরিশ চামচ হাতে তুলে নিল। রোদেলার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল সেহরিশ। তারপর প্রশ্ন করলো,
  'কি হলো? তোমার শরীর খারাপ? আমাকে আগে কেন বলোনি?'
রোদেলা পানি পান করে হাফ ছাড়ল। বলল,
  'আমি অসুস্থ নই। আলহামদুলিল্লাহ, সম্পূর্ণ ঠিক আছি। আপনি অযথা দুঃশ্চিন্তা মাথায় নিচ্ছেন।'
সেহরিশ সোজা হয়ে বসল। চামচে এক টুকরো খাবার তুলে নিয়ে রোদেলার মুখের সামনে ধরলো। রোদেলার ফর্সা মুখ, নাক ও কানের লতি লাল টুকটুকে হয়ে গেছে লজ্জায়। সেহরিশ চাপা গলায় বলল,
  'তোমার নাক মুখ হুটহাট লাল হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে।'
রোদেলার অসহায় দৃষ্টি এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। ঠোঁট চেপে হাসল সে। সেহরিশ ম্লান কণ্ঠে বলল,
  'হা করো।'

সাদাফ অবাক হয়ে সেহরিশের দিকে তাকাল। বিরক্তি যেন তার কপালে লেপ্টে আছে। মেঝের দিকে তাকিয়ে জোরে শ্বাস নিল সে। তারপর বলল,
  'তূর্ণ কি এখনও ছোট? ও প্রতিবারই এই কাজ করে। এই মুহূর্তে আমাদের ইতালি যাওয়া বেশি জরুরি নাকি তার?'
সেহরিশ শান্ত গলায় বলল,
  'নতুন বিয়ে করেছে, সেজন্যই আরও একদিন থাকতে চাচ্ছে। এতে রাগের কিছু নেই। কাল চলে আসবে।'
সাদাফ বলল,
  'না আসলে কী হবে?'
সেহরিশ তার দুর্বোধ্য দৃষ্টি রোদেলার দিকে রেখে বলল,
  'আসবে।'

এয়ারপোর্টের সামনে লোকজন ভিড় করেছে। তাদের প্রিয় গায়ককে শেষবার সামনে থেকে দেখার জন্য ওনাদের ছুটে আসা। গাড়ি থেকে নেমেই শতশত ক্যামেরা ও লাইটিং মুখে আছড়ে পড়ল। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে সবাইকে বিদায় দিয়ে চলে গেল সেহরিশ। এয়ারপোর্টে চেক-ইন করে ওরা।

কেবিনে প্রবেশ করে উমাইয়া ও সাদাফ ওদের সিটে গিয়ে বসে গেল। সেহরিশ এর পাশের সিটে বসে থরথর করে কাঁপছে রোদেলা। রোদেলা ও উমাইয়া প্রথমবার প্লেন ওঠল। রোদেলা ভয় পেলেও উমাইয়ার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ নেই। সে উপভোগ করছে।

সেহরিশ মাথা ডান দিকে কাত করে রোদেলার মুখের দিকে তাকাল। সে এখনও সিটবেল্ট বাঁধেনি। সেহরিশ একটু ঝুঁকে এসে সিট বেল্টটা বেঁধে দিল। বন্ধ চোখগুলো পিটপিট করে খুলে সেহরিশ কে দেখল রোদেলা। সেহরিশ নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
  'ভয় করছে?'
রোদেলা লহু কণ্ঠে বলল,
  'হুম।'
সেহরিশ সোজা হয়ে বসল। তারপর ডান হাতখানা নিজ বুকের উপর রেখে বলল,
  'এখানে মাথা রাখো। ভয় লাগবে না।'
রোদেলার দৃষ্টি এলোমেলো! সেহরিশ ভ্রু কুঞ্চিত করলো। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে আবারও বলল,
  'ফ্লাইট টেকঅফ করলে তুমি ভয়ে চিৎকার করবে, এজন্য বলেছি মাথা রাখো।'
রোদেলা বিড়বিড় করে বলল,
  'আমার লজ্জা করছে।'
সেহরিশ মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে বলল,
  'আমি তোমার বর। আমরা বিবাহিত! তাছাড়া গাড়িতে তো পুরো রাস্তা আমার বুকেই ছিলে। তবু এখন লজ্জা করছে?'
রোদেলা বাকরুদ্ধ নির্বাক চেয়ে আছে। একটু দম নিয়ে বলল,
  'কখন?'
সেহরিশ সপটচস্ত জবাব দিল, 
  'রোদ।'
রোদেলা ডাক শুনে সেহরিশের চোখে চোখ রাখল। সেহরিশ তার একহাত রোদেলার গালে রাখে তারপর কোমল গলায় বলল, 
  'সবাইকে ছেড়ে যাচ্ছ বলে মন খারাপ?'

রোদেলা নিশ্চুপ। সেহরিশ তার হাত রোদেলার কানের কাছে নিয়ে গেল তারপর ছোটো ছোটো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল, 
  'জানো? আমি যখন প্রথমবার বাবা-মা ভাইবোন সবাইকে ছেড়ে চাচার সঙ্গে ইতালি যাচ্ছিলাম তখন আমারও ভীষণ মন খারাপ ছিল। আমার কান্না পাচ্ছিল, আমি যেতে চাইনি। বাবা জোর করে পাঠান। আমিও ভয় পেয়ে ছিলাম। সে সময় আমাকে বোঝার জন্য কেউ ছিল না। কিন্তু দেখো তোমার জন্য আমি আছি। তোমার সম্পর্কে যতটা জেনেছি, তুমি মনের কথা কাউকে বলো না। কিন্তু আমাকে বলতে পারো, আমি সব সময় শুনব। সব পরিস্থিতিতে আমাকে তোমার পাশে পাবে। তোমার ভয় করছে? আমি তোমাকে জোর করবো না। তুমি সংকোচ ঝেড়ে আমার কাছে আসতে পারো।'

রোদেলা চোখ নামিয়ে নিল। এরইমধ্যে এয়ার হোস্টেস এসে ফ্লাইট টেকঅফ এর বার্তা দেওয়ার কাজটি করে চলে যান। তাত্ক্ষণিক সেহরিশ রোদেলাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। রোদেলা বেশ কিছুক্ষণ পর ক্ষীণ গলায় বলল,
  'আপনার বুকে ধুকধুক করছে।'
সেহরিশ মুচকি হেসে বলল, 
  'আর কি শুনতে পাচ্ছো?'
  'বিড়বিড় করে কিছু বলছে।'
  'কী বলছে?'
রোদেলা হাসিহাসি মুখে বলল,
  'বলছে যে, রোদেলা ভয় পাচ্ছে।'
 সেহরিশ ওর ডানহাতটা ঠোঁটের উপর রেখে উল্লাসে হাসিতে ফেটে পড়ল।
.
.
.
চলবে.......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন