আমি বিয়ে করতে রাজি হলে আমার মায়ের কিরকম রিয়েকশন হয় সেটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো। অনেকটা কৌতুহল বশত আমি বলে ফেললাম, 'তোমরা কি চাও এখনই আমার বিয়ে দিতে?'
'তোমার বিয়ে হলে আমি নিশ্চিত হই।'
'তাই বলে যার তার হাতে আমাকে তুলে দিবা?'
'সায়েম ভালো পরিবারের সন্তান, ক্যারিয়ারে সেটেল্ড। ওদের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস আমাদের সঙ্গে যায়।'
'ঠিক আছে। বিয়ে দিলে যেহেতু তুমি বাঁচো, আমি রাজি। তোমরা আমাকে যখনই বিয়ে করতে বলবা আমি করবো। কিন্তু সায়েম ছাড়া জগতের অন্য যে কাউকে। সায়েমকে আমার ভালো লাগে না। এমন কাউকে ধরে নিয়ে আসো যাকে অন্তত হাজবেন্ড হিসেবে আমার ভালো লাগবে।'
মা বোধহয় আমার জন্মের পর থেকে আমার কোনো আচরণে এত আশ্চর্য হননি। বিস্মিত চোখে উনি আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমি বললাম, 'এখন আমাকে একা থাকতে দাও।'
মা ধীরপায়ে ঘর থেকে বের হলেন। আমি শব্দ করে দরজা বন্ধ করে মেঝের ওপর ধপ করে বসে পড়লাম। আমাকে বিয়ে দিতে পারলে নাকি আমার মা নিশ্চিত হবেন! কী আশ্চর্য চিন্তাভাবনা। এই যুগে এসেও মায়েরা এরকম ভাবেন?
রাত্রিবেলা বাবা আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন, 'তোমার মায়ের কাছে জানলাম ব্যাপারটা। তুমি অনেক মন খারাপ করেছো বুঝতে পারছি। তোমার মায়ের কথায় কষ্ট পেও না। ও সবসময় এমন টিপিক্যাল মহিলাদের মতোন আচরণ করে। তুমি আমার একমাত্র মেয়ে। মাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছো। তোমাকে এখনই বিয়ে দিয়ে আমি অপরাধ করে ফেলতে চাই না। আগে পড়াশোনা করো, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো, তারপর আমি তোমার বিয়ের কথা ভাববো। কেউ তোমাকে চাইলেই বিয়ে দিতে পারবে না। তুমি একদম এসব নিয়ে ভেবো না কেমন?'
আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, 'থ্যাঙ্কিউ বাবা।'
'ক্লাস কেমন লাগছে?'
'ভালো।'
'মন দিয়ে পড়াশোনা করো। কিছু লাগলে আমাকে জানাবে।'
'একটা জিনিস চাইবো বাবা?'
'অফকোর্স। বলো কি চাও?'
'সায়েমকে এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করে দিবে?'
বাবা স্মিত হেসে বললেন, 'আচ্ছা মা, দেবো। ওসব তোমার মায়ের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। তোমার মাকেও স্পষ্ট বলে দিয়েছি যেন তোমার ওপর এসব প্রেশার না দেয়। তুমি এখন বড় হয়েছো। তোমার নিজের লাইফ নিয়ে ভাবার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ও সবসময় তোমাকে যেভাবে কোণঠাসা করে রাখতে চায় সেটা এখন আর উচিৎ নয়।'
'থ্যাঙ্কিউ বাবা।'
আমি ঘর থেকে বের হওয়ামাত্র মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। মা হয়তো বাবার কথাগুলো শুনতে পেয়েছেন। মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। আমার একবার ইচ্ছে করলো 'সরি' বলি। পরক্ষণেই ইচ্ছেটা দমিয়ে ফেললাম। আমি তো কোনো অন্যায় করিনি, সরি বলার প্রশ্নই আসে না।
অনেকদিন হয়ে গেলো রৈনীলের বইগুলো পড়ে শেষ করেছি। ওগুলো ফেরত দেয়া উচিৎ। ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে ওকে কল দিলাম। সেই ভারিক্কি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে, 'হ্যাঁ বিজয় সরণী, বলো?'
'আপনার বইগুলো কি আজকে ফেরত দেয়া যাবে?'
'যাবে। কিভাবে দিবা?'
'আমার ক্যাম্পাসের কাছাকাছি কোথাও আসতে পারলে আমি সঙ্গে নিয়ে যেতাম।'
'ওকে। আমি অফিসের ফাঁকে একবার যাবো।'
আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কোনো কিছু না বলেই কল কেটে দিলাম। একটা ব্যাগে সবগুলো বই ভরে নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হলাম। আজ বাবা আমাকে রিকশা নিয়ে যেতে বলেছেন। গত দুদিন যাবত আমি একা যাতায়াত করছি। বাবা কিংবা ভাইয়া আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিচ্ছে বলেই আমার ধারণা। এই বেলায় এসে নিজেকে আমার বড্ড স্বাধীন মানুষ মনে হয়।
অন্তত যতক্ষণ বাইরে থাকি, নিজেকে মনে হয় মুক্ত পাখি। রিকশায় বসে শহর দেখতে দেখতে ভার্সিটিতে পৌঁছাই, ক্যাম্পাসে প্রবেশের সাথে সাথেই অন্যরকম এক আনন্দ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। নানান রঙের জামাকাপড় পরা বিচিত্র সব মানুষ, কেউ দলবেঁধে, কেউ দুইজন। কেউ হাঁটছে, কেউ বসে আড্ডা দিচ্ছে আবার কেউ পড়াশোনা। আমার হৃদয়ে সুখের নাচন শুরু হয়ে যায়।
এখনো আমার তেমন কোনো বন্ধু হয়নি। ফারাহ ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করে, তারপর ওর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা হয়। আড্ডায় শুরুর দিকে আমি একেবারেই আনাড়ি হলেও ধীরেধীরে আমিও যেন নিজেকে উজাড় করে দিতে শুরু করেছি।
ক্লাসের ফাঁকে রৈনীলের টেক্সট, "কখন ফ্রি হবে?"
আমি ওকে একটা ঠিকানা জানিয়ে দিলাম। ক্লাস শেষ হতে আরও কয়েক মিনিট বাকি। অথচ ওর মেসেজটা দেখার পর থেকে খুব উত্তেজনা কাজ করছে। ক্লাসে বসে থাকতে একদম ইচ্ছে করছে না। বাকি সময়টুকু আমি বরং ব্যস্ত হয়ে পড়লাম রৈনীল কেন্দ্রিক ভাবনায়। ওর সামনে গিয়ে কিভাবে আচরণ করবো, কিভাবে বইগুলো ফেরত দিয়ে ওকে বোঝাবো আমি এগুলো পড়ে ভীষণ খুশি।
কিন্তু সামনাসামনি দেখা হওয়ার পর তার উলটো পথে হাঁটলাম। আমি জানিনা কিভাবে এটা হয়ে গেলো। আমার আচরণে খানিকটা রাগের বহিঃপ্রকাশ। রৈনীল কতটুকু টের পেয়েছে জানিনা। তবে আমার মনে হলো সেদিনের রাগের রেশটা এখনো রয়ে গেছে। আমি চাইলেও এটা কন্ট্রোল করতে পারছি না।
আমাকে ঠাণ্ডা করার জন্য রৈনীল কোল্ড কফি অর্ডার দিলো। কফিশপ জুড়ে কেবলই নীরবতা। একটু আগে মৃদু সুরে গান বাজছিল, রৈনীল ওটা বন্ধ করতে বলেছে। এরপর যেন আরও নিস্তব্ধতা এসে ভর করেছে। আমি মুখ ভার করে বসে আছি।
রৈনীল বললো, 'ফিলস লাইক, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড।'
'কিহ?'
'রাগ করো না। তুমি যেরকম গাল ফুলিয়ে বসে আছো, যেকেউ দেখলে বলবে আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড।'
'বয়ফ্রেন্ড? আমি কি সেরকম আচরণ করছি?'
'হুম।'
'ওকে। সরি।'
রৈনীল তার এসপ্রেসো কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। ওর সেই কফি খাওয়ার স্টাইল দেখেও আমার আজকে রাগ হচ্ছে। স্বাগতা আপুর বাসায় শেষবার দেখা হয়েছিল বহুদিন আগে। অথচ এখনো কেন আমি রেগে আছি, এর কারণ উদঘাটন করতে কষ্ট হচ্ছে আমার।
কোল্ড কফি চলে এলো। আমি এক চুমুকে অনেকটুকু খেয়ে খকখক করে কেশে উঠলাম। রৈনীল এগিয়ে এলো, ব্যস্ত ভঙ্গীতে আমার দিকে টিস্যু পেপার এগিয়ে দেয় সে। আমি বললাম, 'ইটস ওকে। কফিটা অনেক ঠাণ্ডা।'
'তোমাকে ঠাণ্ডা করার জন্যই তো এটা দিতে বললাম।'
'মজা আছে কিন্তু।'
'জানি। আগে খাওনি কখনো?'
'উহু।'
'তোমার কি মেজাজ খারাপ কিছুটা কমেছে সরণী?'
'কিছুটা।'
'পুরো গ্লাস শেষ করতে করতে দেখবা সবটুকু মেজাজ খারাপ গায়েব হয়ে যাবে।'
'আমিও সেটাই আশা করি।'
কফিটা অর্ধেক খেয়ে আশেপাশে তাকালাম। বাইরের ঝলমলে রোদ কাঁচের দেয়াল ভেদ করে কফিশপে এসে ঢুকেছে। শান্ত, স্নিগ্ধ একটা আবেশ তৈরি হয়েছে সবমিলে। হঠাৎ খেয়াল করলাম শপের ডেকোরেশন ভীষণ সুন্দর। এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। চারপাশে আরেকবার ভালো করে তাকিয়ে আমার মনটা ধীরেধীরে ভালো হয়ে উঠতে লাগলো।
রৈনীল বোধহয় আমার মন ভালো হওয়ার পুরো প্রসেসটা দেখতে মজা পাচ্ছে। হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি জানতে চাইলাম, 'অফিস নেই আপনার?'
'অফিস থেকেই এলাম।'
'অফিসের ফাঁকে এভাবে বের হতে দেয়?'
'আমাকে দেয়।'
'আপনি মনে হচ্ছে স্পেশাল?'
'হুম। তোমার মেজাজ ঠিক হয়েছে?'
আমি মুচকি হেসে বললাম, 'হুম। থ্যাংকস ফর দ্য কফি। কফিশপের ডেকোরেশন খুব সুন্দর। আমার ভালো লেগেছে।'
রৈনীল ওর ফোন ঘেঁটে একটা নান্দনিক ক্যাফের ছবি বের করে আমাকে দেখতে দিলো। আমি অবাক হয়ে বললাম, 'এটা তো দারুণ সুন্দর!'
'আমার খুব পছন্দের একটা জায়গা। তোমার খুশি দেখে মনে হচ্ছে তোমাকে নিয়ে যাই ওখানে।'
'আমারও যেতে ইচ্ছে করছে।'
'ঠিক আছে। একদিন ক্লাসের ফাঁকে চলো তোমাকে নিয়ে যাই। যাবে?'
আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। সত্যি বলতে আমার ভীষণ যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ চোখে আমি রৈনীলকে দেখছি। কী উত্তর দিবো জানা নেই।
রৈনীল বললো, 'অসুবিধা হলে যেও না। তোমার ভালো লাগবে এজন্য..'
'যাবো। আপনি যেদিন ফ্রি থাকবেন, জানাবেন আমাকে।'
'কিভাবে?'
'কল দিয়ে বা টেক্সট দিয়ে।'
'তোমাকে কল দিতে আমার একশোবার চিন্তা করতে হবে, কেউ তোমার ফোনটা দেখে ফেললে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় কিনা। আমি তোমাকে কোনো অসুবিধায় ফেলে দেই কিনা।'
আমি কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলাম না। এই ভাবনা তো আমার নিজস্ব। রৈনীলের কল বেজে উঠলে যদি আমার মায়ের নজরে পড়ে যায়, তবে তো অসুবিধা আমারই। সেই ভাবনা ওকে কিভাবে ছুঁয়ে গেলো!
স্মিত হেসে বললাম, 'আমি আপনাকে কল দিবো। তারপর কবে যাওয়া যায় সেটা নিয়ে আলাপ করবো।'
'ওকে।'
আমি খেয়াল করলাম, ওর ওপর জমে থাকা মেজাজ খারাপের রেশটুকু সত্যি সত্যি গায়েব হয়ে গেছে। মুচকি হাসি আটকাতে পারছি না দেখে অন্যদিকে ফিরলাম। রৈনীল বললো, 'যাও, ওদিকে ঘুরে এসো। পুরোটা একবার ঘুরে দেখো, সুন্দর জায়গা।'
আমি উঠলাম। ধীরপায়ে একটু একটু করে আশেপাশে ঘুরছি। দেয়ালে মনোরম গ্রাফিতি আঁকা, কয়েক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে রইলাম। মন দিয়ে দেখছিলাম দেয়ালটা। হঠাৎ পিছন ফিরতেই আৎকে উঠে রৈনীলের বুকের ওপর এসে পড়লাম। রৈনীল কখন উঠে এসে আমার পিছনে দাঁড়িয়েছে আমি টের পাইনি। ধাক্কাটা সামলে নিতে রৈনীল খপ করে আমার বাহু ধরে ফেলেছে। কী ঘটে গেলো বুঝে উঠতে সময় লাগলো আমার। কোনোমত স্বাভাবিক হতেই কয়েক পা পিছিয়ে এসে দাঁড়ালাম।
'আর ইউ ওকে সরণী?'
'হুম।'
মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলেও আমি জানি, এইমুহুর্তে আমি ঠিক নেই। আমার ভেতর কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে। দ্রুত শ্বাস পড়ছে আমার, যেন হার্টবিটটাও বেড়ে গিয়েছিল ক্ষণিকের জন্য। রৈনীল আবারও আমার দুই বাহুতে হাত রাখলো। আমার চোখ চলে গেলো সেদিকে। ও আমাকে ধরে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। কয়েক সেকেন্ড পর স্বাভাবিক হলাম আমি।
রৈনীল দৌড়ে গিয়ে এক বোতল পানি এনে এগিয়ে দিলো আমার দিকে। ঝুঁকে এসে জিজ্ঞেস করলো, 'ভয় পেয়েছিলে নাকি?'
'না। আমি জানতাম না আপনি উঠে এসেছেন।'
'আমি তো উঠলাম যে তোমার কয়েকটা ছবি তুলে দেই..'
'ওহ।'
রৈনীল এখনো আমার সামনে ঝুঁকেই আছে। এত কাছ থেকে ওকে দেখার পর আমার মাথার ভেতর ঝি ঝি শুরু হয়ে গেছে। ওর চিবুক জুড়ে লেপ্টে থাকা খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলোর দিকে নজর চলে গেলো। ওর নাক, ওর কান, সবকিছুই যেন ভীষণ কোমল। যেন আস্ত শিশুর নাক। আমি অজান্তেই হাত বাড়িয়ে ওর নাক ছুঁতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় রৈনীল বললো, 'আমার নাকে কি?'
আমি চমকে উঠলাম। রৈনীল বললো, 'আমার নাকে কিছু লেগে আছে?'
'না।'
'তাহলে?'
'হ্যাঁ।'
অকস্মাৎ বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে আমি হাত দিয়ে ওর নাকটা এমনভাবে মুছে দিলাম যেন সেখানে কোনো ময়লা লেগে ছিলো। রৈনীল তার এই উপকার করাতে খুশি হয়ে বললো, 'থ্যাংকিউ। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। বের হবো এখন।'
ও ওয়াশরুমের দিকে যেতেই আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম আমি। এটা কী হয়ে গেলো আমার সঙ্গে! আমার ভেতর এমন তোলপাড় করছে কেন? কীসের উত্তেজনা গ্রাস করেছে আমায় এমন তুমুলভাবে? বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম।
.
.
.
চলবে..........................................................................