তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ১৯ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


রাত যত গভীর হচ্ছে, আমার ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছে ততই জাগ্রত হচ্ছে। রৈনীলের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে। কোনোভাবেই চোখ দুটোকে বন্ধ করতে পারছি না। চোখ বুজলেই কফিশপের ওই ঘটনা'টা স্পষ্ট ভেসে ওঠে। তখন আরও বেশী অস্থির লাগে। ঠিক যেমন অস্থিরতায় কেটেছিলো রৈনীলকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার পরের দিনটা। সারাদিন ভয়ানক এলোমেলোভাবে কাটিয়েছিলাম। 

অনেক্ষণ ধরে ভাবতে ভাবতে শেষ অবধি একটা মেসেজ লেখার সাহস অর্জন করলাম, "আচ্ছা, আপনার জন্মদিন কবে?" 

এত রাতে রৈনীলের রিপ্লাই পাওয়ার আশা করিনি। একেবারেই যে করিনি তাও নয়। মনেমনে ঠিকই চাচ্ছি, সে একবার কল করুক। রৈনীল আমাকে বুঝতে পারে। দেখি আজ বোঝে কী না!

মিনিট দুয়েকের মাথায় সে কল দিলো। আমার হার্টবিট এক লাফে তুঙ্গে। কোনোমত শ্বাস নিয়ে ফোনটা রিসিভ করলাম আমি। রৈনীল বললো, 'এখনো ঘুমাওনি কেন'
'আপনিও তো জেগে আছেন।'
'আমি রোজই দেরী করে ঘুমাই।'
'আমার আজ ঘুম আসছে না।'
'জানতাম।'
'কি?'
'ঘুম আসবে না।'

আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ও আমাকে এভাবে বুঝে ফেলবে আমিও জানতাম। তবুও কেন যে এত রাতে ওকে মেসেজ পাঠাতে গেলাম! সে কী ভাবছে কে জানে।

রৈনীল বললো, 'আমার জন্মদিন ১১ই অক্টোবর।'
'সত্যি!'
'হ্যাঁ।'
'থ্যাংকস।'
'ওয়েলকাম। তোমার কবে?'
'দোসরা মার্চ।'
'আমার জন্মদিন ঘিরে কখনো কোনো প্লান থাকেনা। বেশিরভাগ সময় মা অপেক্ষা করে থাকে। জন্মের পর থেকে দেখে আসছি প্রত্যেক জন্মদিনে মা আমার জন্য পায়েস রান্না করেন। আমার পছন্দের খাবারগুলো যত্ন নিয়ে আয়োজন করেন। আমি এজন্য মায়ের কাছে যাই। মা দাঁড়িয়ে থাকে, আমি তৃপ্তি নিয়ে খাই। মায়ের এতে মন ভরে, আর আমার মাকে খুশি করতে পারলে মন ভরে।'

আমি মুগ্ধ হয়ে রৈনীলের কথাগুলো শুনছিলাম। তাই কিছু বলা হয়ে উঠলো না।
'সরণী?'
'হুম।'
'চুপ করে আছো যে?'
'আপনার মায়ের কথা বলুন।'
'আমার মা হচ্ছেন পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তশিষ্ট, সাধাসিধা মহিলা। খুবই সংসারী, আর মায়াবী। মায়ের হাতে গড়া প্রত্যেকটা জিনিসে ভীষণ যত্নের ছাপ। আমাদের বাড়িতে কেউ গেলে মায়ের ঘর গোছানো দেখে মুগ্ধ হয়।'
'আপনি কি মায়ের কোনো গুণ পেয়েছেন?'

রৈনীল একটু ভেবে বললো, 'আমি মায়ের মতো শান্ত স্বভাবের হয়েছি।'
'আন্টি কি অনেক শান্ত?'
'হ্যাঁ। মিষ্টি একটা মানুষ। কথা বললেই মন ভরে যায়।'
'আপনার মতো?'
'আমার সঙ্গে কথা বললে কি কারো মন ভরে যায়?'
'আমার যায়।'
'ওহ আচ্ছা। জানতাম না তো। আমি মায়ের এই গুণটাও পেয়েছি জানা ছিলো না। থ্যাঙ্কিউ জানানোর জন্য।'
'আমার এখন আপনার মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।'
'তাই? চলো একদিন বাড়িতে। মায়ের সঙ্গে দেখা হলে তোমার ভীষণ ভালো লাগবে। আমার জন্মদিনেই চলো। ওইদিনকে কেন্দ্র করে অনেক খাবারের আয়োজন হয়।'

আমি আমার উৎসুক হৃদয়কে টেনে এনে হৃদয়ের দরজা বন্ধ করে দিলাম। যে সরণী কোনোদিন একা ঘরের বাইরে যায়নি, সে কিনা যাবে রৈনীলের বাড়ি! এ তো কেবল স্বপ্নেই সম্ভব। রৈনীল সবটা না জানলেও কিছুটা তো জানে। তবুও কিভাবে বলে ফেলে এমন অনায়াসে?

রৈনীল বললো, 'সরণী? যাবে?'
'আগে বড় হয়ে নেই।'
'কত বড়?'
'যত বড় হলে যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাওয়ার অনুমতি পাবো।'
'আহারে, কত দুঃখী একটা মেয়ে। আমি কিনা বোকার মতো এই মেয়েটাকে ক্যাফেতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম!'

আমি বললাম, 'ক্যাফেতে তো যাবো। ভার্সিটির জন্য বের হলে ক্যাফেতে যেতে পারবো। কিন্তু আপনার বাড়িতে সম্ভব না।'
'ঢাকা থেকে যেতে ঘন্টা দেড়েক লাগবে। আসতে ঘন্টা দেড়েক। আমাদের বাড়িতে থাকবে ধরো ২ ঘন্টা। এই হলো মোট ৫ ঘন্টা। যদি এইটুকু সময় কখনো বের করতে পারো, জানাবে আমায়। আমি তোমাকে আমার জমানো সমস্ত বই দেখাবো।'

আমি খানিকটা বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, 'আপনার পুরো বেডরুম জুড়ে যে লাইব্রেরিটা, ওইটা?'
'হুম।'
'যাবো। একদিন ঠিক যাবো।'
'আশা করাটা সবচেয়ে বড় কথা। আশা রাখো, হয়তো যাওয়া হবে।'
'আগে কোনোদিন কোনো আশা করতাম না। কারণ আশা করতেও যে সাহস লাগে। আমার ওইটুকু সাহস কখনো ছিলোনা। ইদানীং সাহস হয়েছে খুব।'
'তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এই গভীর রাতে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলছো, এটা তো সাহস নয়। রীতিমতো দুঃসাহস।'

আমি যেন হঠাৎ দমে গেলাম। সত্যিই কি আমি দুঃসাহসিক কিছু করে ফেলেছি! কিন্তু তা তো ভালো হচ্ছে না। রৈনীল আবার ভেবে বসবে কিনা আমি ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। একদিন ওর এই ধারণা'টা আমি ভাঙিয়ে দিবো। আমি যে ওর প্রেমে পড়িনি, সেটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিবো ওকে। যেন আর কক্ষনো এই ভুলটুকু না বোঝে। 

'সরণী?'
'হুম।'
'বেশ রাত এখন। ঘুমাও।'
'ঘুমাচ্ছি।'
'আমি একটা কবিতা শোনাই? তুমি ধীরেধীরে ঘুমিয়ে পড়ো।'
'যেটা বলার জন্য আপনাকে মেসেজ দেয়া, সেটাই তো বলা হলোনা।'
'কি?'
'আপনি ক্যাফেতে কবে নিয়ে যাচ্ছেন আমায়?'
'এটা শোনার অজুহাতে আবার কালকে কল দিতে পারবা।'
'কিহ?'
'হা হা হা। হো হো হো।'

রৈনীল হাসতে লাগলো। আমি লজ্জা পেলাম। সে কিভাবে বোঝে আমার সবকিছু! মুখ ফুটে বলতে হয়না, ইঙ্গিত দিতে হয়না। তবুও সবকিছু ঠিকঠাক অনুমান করে। উফফ, এত লজ্জা কোথায় রাখি! 

সকালে ঘুম ভাংলো বেশ বেলা করে। রৈনীলের মুখে পরপর তিনটা লম্বা কবিতা শুনে তবেই ঘুম এসেছিলো। সকালে উঠতে না পারায় আমার ক্লাস মিস হয়ে গেছে। রুম থেকে বের হতেই মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হলো।

আমি বললাম, 'ডাকোনি কেন? ক্লাস ছিলো আটটায়।'
'আমার জানার কথা নাকি?'

মা এখনো খুব রাগ করে আছেন। আমি রাগটুকু পুষে রাখতে দিচ্ছি। আমার মাঝে কোনো অনুশোচনা নেই। সায়েমের বিষয়টা নিয়ে বাবা মায়ের মধ্যে ছোটখাটো রাগারাগি হয়েছে। বাবা স্পষ্ট করে মাকে বলে দিয়েছে যেন আমাকে আমার মতো বড় হতে দেয়া হয়। মা যেন আমাকে আর কোণঠাসা করে না রাখেন। তাই মায়ের এত অভিমান। 

বেশ কয়েকটা দিন পার হয়ে গেলো। আমি রোজ রাতে রৈনীলের নাম্বারটা বের করে বসে থাকতাম। তবে কল দেইনি। ওদিনের লজ্জা'টা কাটিয়ে উঠতে পারিনি বলে। আজ মনে হচ্ছে লজ্জা খানিকটা শেষ। এবার তাকে স্মরণ করা'টা স্বাভাবিক ঘটনা। তাই রাত নামতেই একটা ছোট্ট টেক্সট পাঠালাম, 'কবে নিয়ে যাচ্ছেন?'

ফিরতি মেসেজে রৈনীল লিখলো, 'এত উতলা হয়ে আছো কেন?'
'ছি ছি। কীসব বলেন!'
'আগামীকাল যাই চলো। তোমার সুবিধামতো সময় আর লোকেশন আমাকে পাঠিয়ে দিও। আমি ওখানে গিয়ে হাজির হবো।' 

রৈনীলের মেসেজটা দেখার পর থেকেই আমার বুক ধুকপুক শুরু হয়ে গেলো। জীবনে এই প্রথমবারের মতো আমি প্লান করে কোথাও যাচ্ছি, তাও একা! বাড়িতে না জানিয়েই.. এতটা উত্তেজনা কাজ করছে, এই বুঝি আমি উত্তেজনায় ফেটে যাবো। 

পুরোটা রাত শুয়ে, বসে, পায়চারি করে কাটালাম। এমন অস্থির লাগেনি কভু আগে। ঘুরেঘুরে ক্লোজেট থেকে জামাকাপড় বের করছি আর ঢুকিয়ে রাখছি। ঠিক কোনটা পরবো সিদ্ধান্ত নিতে নিতে ভোর হয়ে গেলো। 

আজ আমি একদণ্ড ঘুমাইনি, অথচ আমার চোখে বিন্দুমাত্র ঘুমের রেশ নেই। ক্লান্তিও এতটুকু ছোঁয়নি আমাকে। বরং প্রাণবন্ত আর সতেজ অনুভব করছি। সকাল সকাল কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়ে আমি সেজেগুজে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হলাম। পথে দেখা হলো রৈনীলের সঙ্গে। 

গাড়ির দরজা খুলে রৈনীল আমাকে ভেতরে বসার আহবান জানালো। আমার ধারণা ছিলো আমরা রিকশায় যাবো। রৈনীল গাড়ি নিয়ে আসবে তা আমার ধারণাতীত। ও কি ওর ব্যাচেলর বাসায় গাড়ি নিয়ে থাকে? প্রশ্নটা মনে ঘুরপাক খেলেও সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। 

রৈনীল সাবধানে গাড়ি ড্রাইভ করছে। আকাশের অবস্থা ভালো না। বোধহয় বৃষ্টি নামবে। কিন্তু মেঘাচ্ছন্ন দিনের এমন গুমোট আবহাওয়ায় গাড়ির ভেতর বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে। বৃষ্টি নামলে আমি বেশ খুশি হবো। 

রৈনীলের পাশে বসে আছি অথচ কোনো জড়তা আমাকে স্পর্শ করছে না। আচ্ছা, ওকে আমার আজকাল এত চেনা কেন মনে হয়? 

আমি ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকালাম। সে একদৃষ্টে রাস্তায় তাকিয়ে আছে। দুই হাত দিয়ে ধরে রাখা স্টিয়ারিং। আমি পাশে হাত রেখে আরাম করে বসতে যাচ্ছিলাম, সেই সময়ে সেও অজান্তেই পাশে হাত রাখলো। ঠিক ওর হাতের ওপরেই আমার হাতটা পড়লো। আচমকা ওর হাতে হাত রেখে আমি যেন বিদ্যুৎ শক লেগে ওঠার মতো দ্রুত হাত সরিয়ে নিলাম। রৈনীলের কোনো ভাবান্তর নেই। যেন এই ঘটনা'টা খুবই তুচ্ছ। অথচ আমার ক্রমশ হৃদস্পন্দন বাড়ছে। 

এই প্রথমবার আমি কোনো পুরুষের হাত স্পর্শ করেছি! অজান্তেই....!
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp