ছোট থেকে বুড়ো, শেখ পরিবারের প্রতিটি সদস্যের দৃষ্টি পশ্চিম আসমানের ঐ বাঁকা চাঁদের উপর। সরু কাস্তের ন্যায় চাঁদটা আজ যেনো তার স্বাভাবিক রূপের থেকে বেশিই আলো ছড়াচ্ছে। ঈদের চাঁদ বলে হয়তো! সকলেই জানে আজ ঈদের চাঁদ দেখা যাবে। তবুও এই চাঁদ দেখার জন্য প্রত্যেকের মাঝে আলাদা এক উত্তেজনা বিরাজ করছে।
ইফতার শেষ হওয়া মাত্রই নামাজ পড়ে সবাই উঠোনে চলে আসে। বাহাদুর শেখকে রুম থেকে আসমানী বেগম ও স্মরণ গিয়ে ধরে নিয়ে আসে। প্রথম দিকে গাছপালার ঝোপঝাড় ভেদ করে কেউই চাঁদ খুঁজে পাচ্ছিলো না। পরে রাফির গোয়েন্দা দৃষ্টিতে গিয়ে চাঁদ ধরা পরে। মুহূর্তেই সে 'চাঁদ, চাঁদ' বলে চিৎকার দিয়ে উঠলে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে একে একে সবাই চাঁদ দেখলো।
চাঁদ দেখার খুশিতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে 'ঈদ মোবারক' বললো। ছোট বড় যে যার মতো কোলাকুলি করছে। বাইরের কেউ যদি এ মুহূর্তে উঠোনে আসে, তবে এ আনন্দঘন মুহূর্তটুকু দেখে আবেগে আপ্লূত হয়ে পড়বে।
বাহাদুর শেখ চাঁদ দেখার পরপরই তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আসমানী বেগমের দিকে দৃষ্টি ফিরে তাকালেন। মৃদু হেসে আসমানী বেগমকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
" ঈদ মোবারক দিল। আরেডা ঈদ আমরা একসাথে কাটাইতাছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো বুঝছো।"
আসমানী বেগম হেসে ফেললেন। তিনি সত্যিই আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করলেন, এই বুড়োটার সাথে আরেকটা ঈদ দেখার সৌভাগ্য হওয়ার জন্য।
কাজিনমহলের মেয়েরা মেয়েরা, ছেলেরা ছেলেরা একে অপরকে কোলাকুলি করে ঈদের শুভেচ্ছা জানালো। সবশেষে স্মরণ এসে নীলিমার সামনে হাজির হলো। সে কিছুক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছিলো, নীলিমা নিজ থেকেই ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে আসে কি না তা দেখার জন্য। কিন্তু তার অপেক্ষা বৃথা গেলো। কেননা নীলিমা বাড়ির সমস্ত মানুষকে ঈদের শুভেচ্ছা জানালেও তাকে জানায়নি। এক প্রকার উপেক্ষা করে গিয়েছে বলা চলে। স্মরণ অবশ্য এর কারণ জানে।
গতকাল রাতের ঐ কান্ডের পর থেকে নীলিমাকে যতবার একা পেয়েছে ততবার 'সরি' বলেছে সে। আর নীলিমা শুনেও তা পুরোদমে উপেক্ষা করে গিয়েছে।
চাঁদ দেখা শেষে একে একে সবাই বাড়ির ভেতরে ফিরে যাচ্ছিলো। নীলিমাও ফিরতি পথ ধরেছিলো। এমন সময় স্মরণ পিছন থেকে ডাকলো,
" নীলিমা!"
নীলিমা দাঁড়ালো না। সে ফের একইভাবে ডাকলো। নীলিমা তবুও দাঁড়ালো না। নীলিমা যখন সিঁড়ির কাছাকাছি প্রায় চলে গেলো সে মুহূর্তে স্মরণ নরম সুরেই ডাক দিলো,
" নীলি!"
নীলিমা থমকে দাঁড়ালো। প্রায় ছয় বছর পর এ সম্বোধন শুনে তার কদম থমকালো, নিঃশ্বাস থমকালো। বোধহয় হৃৎস্পন্দনও ক্ষণিকের জন্য থমকালো। 'নীলি' সম্বোধনটা তার হৃদয়ের ভীষণ কাছে। স্মরণ আগে সময়ে অসময়ে এই নামেই তাকে ডাকতো। স্মরণ যতবার এই সম্বোধনে ডাকতো, কিশোরী নীলিমা ততবারই প্রেমে পিছলে পড়তো। যেনো নতুন করে ক্ষণে ক্ষণে আবারও প্রেম জাগ্রত হতো তার অন্তঃস্থলে। এ নামের সাথে তার আবেগ জড়িয়ে আছে, প্রথম প্রেমের আবেগ!
স্মরণ এখন 'নীলি' নামে ডাকে না। দীর্ঘ সময় পর দেখা হওয়ায় সম্পর্কের আবেগ, গভীরতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে ঐ ডাকনামে ডাকতে গেলেও মনের মধ্যে খানিক খচখচ করে। কিন্তু আজ শেষ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেই স্মরণ নীলিমার ডাকনাম ধরে সম্বোধন করে, যে নামটা শুধু সে দিয়েছিলো। এ নামে বাড়ির আর কেউই ডাকে না নীলিমাকে। প্রত্যেকের মুখে নীলু নামটা প্রচলিত হলেও স্মরণের জন্য ছিলো 'নীলি'।
নীলিমার থমকে যাওয়া কদম দেখে স্মরণের হৃদ মাঝারে স্বস্তির ছায়া নেমে এলো। জয়ী হাসিতে তার গাল দুটো চওড়া হয়ে এলো। এতক্ষণে উঠোন থেকে একে একে সবাই চলো গিয়েছে। পিছে আছে শুধু স্মরণ ও তার সামনে নীলিমা। আর নীলিমার সামনে রাফা। নীলিমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে রাফা আর দাঁড়ালো না। সে দ্রুত বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।
নীলিমা এবার ঘাড় ঘুরে তাকালো। শীতল গলায় শুধালো,
" কি বলবেন?"
স্মরণ আরেকটু এগিয়ে এসে সিঁড়ি হতে দু কদম দূরে দাঁড়ালো। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে মুগ্ধ হাসি ঝুলিয়ে নরম গলায় বললো,
" ঈদ মোবারক নীলি!"
নীলিমার হৃদযন্ত্রটা প্রায় লাফিয়ে উঠলো। ইশ, কে জানতো এখনও এ নামের সাথে তার আবেগ জড়িয়ে থাকবে! নচেৎ স্মরণের সম্বোধনে সে কি দাঁড়াতো! তার হৃদযন্ত্র কি অস্বাভাবিক ক্রিয়া করতে আরম্ভ করতো! এ সম্পর্কে নীলিমা নিজেও অজ্ঞাত ছিলো।
নীলিমা দ্রুতই নিজেকে সামলে শুকনো মুখে বললো,
" ঈদ মোবারক! "
বলেই একটা শুকনো ঢোক গিলে স্মরণকে সতর্কবাণী শোনালো,
" শুনুন, এরপর থেকে আমাকে ঐ নামে ডাকবেন না।"
স্মরণ কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভুলে বসেছিলো বলে তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নীলিমার মুখপানে বিচরণ করলো। অতঃপর বুঝ হতেই সে মৃদু হেসে প্রশ্নোত্তর করলো,
" নীলি?। কেনো এ নামে কি সমস্যা? "
নীলিমা কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
" সমস্যা আছে বলেই বলছি। আপনি হয় নীলিমা না হয় নীলু বলে ডাকবেন। সবাই যেটা বলে আরকি।"
স্মরণ নীলিমার দৃষ্টিতে মোটেও নড়বড় হলো না। বরং কি মনে নীলিমাকে একটু ঝালাই করতে উদগ্রীব হলো সে। ঠোঁটের কোনে পূর্বের ন্যায় সেই হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বললো,
" উঁহু, নীলু নামটা আমার কেনো যেনো পছন্দ নয়। আর নীলিমা নাম বলে আমি অভ্যস্ত নই। তাই নীলি বলেই ডাকবো তোমাকে। নীলি!"
নীলিমার ভেতরে বোধহয় শান্ত এক ঝড়ের সূচনা ঘটলো। পুরোনো ঝড়। যে ঝড়কে সে বহু বছর পূর্বে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিলো, সে ঝড়ের পূনঃসূচনা কি তবে আজ ঘটলো?
নীলিমা আর দ্বিতীয় কথা বলার সাহস পেলো না। স্মরণকে পিঠ দেখিয়ে বাড়ির ভেতর রওনা হলো। পিছে স্মরণ স্বর উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" এতবার সরি বলার পরও কি ক্ষমা পাবো না?"
নীলিমা পিছনে না ফিরেই বললো,
" আমার সব কথা শুনলে তবেই ক্ষমা পাবেন। "
বলেই সে স্মরণের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো। পিছে স্মরণ এ নিয়ে বেশ খুশি হলো বটে। তবে তার দুষ্টু মনে নতুন ঐ মুহূর্তেই এক ফন্দি এঁটে বসলো।
গতকালের ঘটনার পর থেকে রাফা বেশ কয়েকবার নীলিমাকে বুঝিয়েছে, স্মরণকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য। স্মরণও যথেষ্টবার 'সরি' বলেছে। এত কিছুর পর নীলিমা ইফতারের আগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো আজ স্মরণকে ক্ষমা করে দিবে সে। স্মরণ নিজ থেকে কথা এগুলেই সে মাফ করে দিবে। তখন সে ইচ্ছে করে দুবার স্মরণের ডাকে সাড়া দেয়নি। কেননা তখনও সবাই বাড়ির ভেতরে যায়নি।
নীলিমা দ্রুত পায়ে এসে মানতাসার রুমে গিয়ে বসলো। রুমে মানতাসা, রাফা, নওরীন বসে মেহেদির ডিজাইন দেখছিলো। নীলিমাকে রুমে প্রবেশ করতে দেখেই নওরীন জিজ্ঞেস করলো,
" মেহেদি দিবি না নীলু?"
নীলিমা ফটাফট মাথা নাড়িয়ে বললো,
" হুম হুম দিবো।"
" আচ্ছা, ডিজাইন সিলেক্ট কর তাহলে।"
" হুম করছি। তোমরা করতে থাকো। "
" মানতাসার বিয়ের জন্য কি একেবারেই মেহেদি নিবি? "
" না আপু। শুধু ডান হাতের উপরে নিবো। রাফা দিয়ে দিবে। তুমি?"
" আমিও তাই ভাবছি। আজ পুরো ডান হাতে নিয়ে মানতাসার মেহেদি অনুষ্ঠানে বাম হাতে নিবো। আর মানতাসা তো আজ মেহেদি দিবে না। নাহলে ওর হাতটাই তো নষ্ট হয়ে যাবে।"
" হুম ঠিক বলেছো।"
বলেই সে রাফার দিকে তাকালো। রাফার ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,
" সব ঠিক আছে?"
নীলিমা ভেতরকার ঘটনাটুকু আর বললো না। শুধু মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বললো,
" হুম ঠিক আছে।"
অতঃপর সে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার নিজেকে দেখে নিলো। স্মরণকে সে ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে স্মরণ কি তার মাঝে আবারও সেই পুরোনো অনুভূতির সূচনা ঘটাবে! নীলিমা নিজেকে বুঝালো, এ অঘটন ঘটতে দেয়া যাবে না। নিজেকে শক্ত রাখতে হবে, যেমনটা এত বছর রেখেছিলো। স্মরণের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে যেনো এ নামে তার কিছুই যায় আসে না। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হবে।
------------------
মা খালা মামি চাচিদের মাঝে ঈদের রান্না নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। আগামীকাল সকাল সকাল দু পদের সেমাই রান্না হবে। কাজ এগিয়ে রাখার জন্য আগে থেকেই কাঁচা দুধ জ্বাল দিয়ে নিচ্ছেন তারা। এরপর রান্না হবে খিচুড়ি ও গরুর গোশত। সে জন্য পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ কাটাকুটি চলছে। এগুলো শেষ হলে আবার বাঁটাবাঁটির কাজও করতে হবে। বেজায় কাজ তাদের ঘাড়ে।
এদিকে তাদের এ কাজের মাঝে উদয় হলো নীলিমার। মেহেদি লাগানোর আগে একটু চা খেয়ে পেট ও মস্তিষ্ককে শান্ত করবে সে। কিন্তু রান্নাঘরে গিয়েই তার মাথায় হাত। এ কি! চায়ের জন্য রাখা দুধ ও চিনি নেই। আছে শুধু চা পাতি। ঈদের জন্য বাজার করে আনা দুধ ও চিনি প্রায় সবটাই ঈদের রান্নায় লেগে যাবে। বাকি যেটুকু বাঁচবে তা দিয়ে এতগুলো মানুষের চা বানানো অসম্ভব। কেননা রান্নাঘরে যাওয়ার আগে নীলিমা চা পান করতে ইচ্ছুক এমন জনগণ দিয়ে এ লিস্টকে বেশ লম্বা করে এনেছে। এখন উপায়!
নীলিমাকে নাজমা বেগমকে জিজ্ঞেস করলে নাজমা বেগম ক্ষণেই স্মরণের নাম বলে বললো,
" স্মরণকে আনতে বল। আরেকটু পর এমনিই বাজারে যাবে আড্ডা দিতে। এর আগে চায়ের জন্য দুধ, চিনি কিনে আনুক।"
নীলিমা প্রথমে ভেবেছিলো স্মরণকে বাজারে যাওয়ার কথা বলবে না। কিন্তু যেহেতু নিজেকে স্মরণের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে বলেছে সেহেতু এ বিষয়টাকে উপেক্ষা করা উচিত হবে না। তাই নীলিমা স্বাভাবিকভাবেই ড্রয়িং রুমে গিয়ে স্মরণকে বললো,
“ আমার এক্ষুণি দুধ, চিনি লাগবে। চা বানাবো। নিয়ে আসুন।”
স্মরণ অবাক হয়। কিছুক্ষণ আগেই না ইফতার করলো নীলিমা! আর এখন চা? সে বিস্ময় নিয়ে শুধালো,
“ এখন! কিছুক্ষণ আগে ইফতার করলে যে?”
“ তো? আমার চা খেতে মন চাচ্ছে। বাড়িতে কিছু নেই। ”
“ দেখো নীলিমা, সারাদিন রোজা থেকে আমি ক্লান্ত। এখন বাজারে যেতে পারবো না। রাফি বা মাহবুবকে পাঠাও।”
“ অপশন নেই। মামি আপনাকেই যেতে বলেছে।”
স্মরণ প্রচণ্ড বিরক্ত হয়। এই মেয়েটা গতকাল পর্যন্ত না কথা বলতো, না নিজের দেখা দিতো। অথচ আজ এমন হুকুম ফলাচ্ছে যেনো তাদের ছয় বছর না ছয় দিন পর দেখা হয়েছে। স্মরণ নীলিমার কথার তোয়াক্কা না করে বললো,
“ পারছি না। একবেলা চা না খেলে মরে যাবে না।”
নীলিমা অবাক হয়। বললো,
“ আশ্চর্য! আপনি ইনডিরেক্টলি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছেন!”
স্মরণ বিস্ময় নিয়ে চাইলো,
" আমি! আমি কখন মারতে চাইলাম তোমাকে? পাগল হয়ে গিয়েছো?"
" হ্যাঁ। চা না খেলে কেমন যেনো পাগল পাগল লাগে সবকিছু। সারাদিন চা খাইনি। এখন না খেলে আমার ঘুম আসবে না৷ চা আমার জন্য ওষুধ। "
"ওষুধ না৷ নেশাদ্রব্য। তুমি চা দিয়ে নির্ঘাত নেশা করো নীলিমা!"
.
.
.
চলবে..................................