সময়টা সন্ধ্যার পর পর, হুট করে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে। গভীর চিন্তা নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় আবার রুমে ফিরে যায় রোদেলা। উমাইয়া ভ্রু কুঁচকে দেখে রোদেলাকে। উমাইয়া একপলক রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল,
'কি দেখছিস ওমন করে?'
রোদেলা উমাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
'উনি কখন আসবেন? এত দেরি হয়ে গেল এখনও আসছেন না কেন?'
উমাইয়া মুচকি হাসলো। দুই পা এগিয়ে এসে রোদেলার কাঁধে হাত রাখল তারপর কোমল গলায় বলল,
'চলে আসবে নিশ্চিন্তে থাক।'
রোদেলা মন খারাপ করে রাস্তার দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে উমাইয়া রোদেলার গাল জোড়া মৃদু টেনে বলল, 'কি হয়েছে আমার রোদুর? স্বামীর জন্য মন কেমন করছে? বড় ভাইয়া তো তোকে একদম বশ করে নিয়েছে।'
রোদেলা মুচকি হেসে তার লজ্জা লুকানোর চেষ্টা করছে। তার ফর্সা গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেছে যেন। উমাইয়ার ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির বরণ। রোদেলা খেয়াল করে উমাইয়ার থেকে দূরে সরে গেল। নরম গলায় বলল,
'বৃষ্টি নামছে তুই এখানে কি করছিস? চল ভেতরে।'
রোদেলা একবার আবারও রাস্তার দিকে তাকাল। ভীষণ জোরেই বৃষ্টি পরছে, পথের কোন কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। রোদেলা ভ্রু কুঁচকে জোর করে দেখার চেষ্টা করছে কোনো গাড়ি আসছে কি না? ভারী নিঃশ্বাস ফেলে রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
রোদেলা রান্না ঘরে এসে দাঁড়াল। উমাইয়ার জন্য সামান্য কিছু খাবার বানাবে সে। উমাইয়া ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে। তাকে রান্নাঘরে যেতে দিচ্ছে না রোদেলা। উমাইয়া জুবিয়াকে কল করলো। জুবিয়ার মন খারাপ সে যথা সম্ভব কষ্টটা লুকিয়ে উমাইয়ার সঙ্গে কথা বলে নিল।
এই সময় হঠাৎ কলিংবেলটা বাজলো। রোদেলার হাত তখনই থেমে যায়। প্রথমবার মনে হলো সেহরিশ এসেছে পরোক্ষণে ভাবনাটা উপেক্ষা করে কাজে মনোনিবেশ করলো।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে প্রচুর, না চাইতেও অল্প ভিজে গেছে সাদাফ। হাত দিয়ে নেড়ে চুল থেকে পানি ঝেরে ফেলতে লাগল। সাদাফ সেহরিশের উদ্দেশ্য বলল,
'তুই বোস। আমি চেঞ্জ করে আসছি।'
সেহরিশ চারিদিকে তাকিয়ে উমাইয়ার উদ্দেশ্য বলল,
'রোদ?'
উমাইয়া মৃদু স্বরে বলল,
'রান্নাঘরে, আমি ডেকে দিচ্ছি'
সেহরিশ বলল,
'আমি দেখছি। তুমি সাদাফের সঙ্গে যাও।'
সেহরিশ নিশ্চল পায়ে হেঁটে এসে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। রোদেলা কাজ করছে দেখে মৃদু স্বরে বলল,
'কি করছ?'
সেহরিশের কণ্ঠে কেঁপে উঠল রোদেলা। সেহরিশের দিকে তাকিয়ে বলল,
'তেমন কিছু না৷ উমাইয়ার জন্য একটু রান্না করছিলাম।'
সেহরিশ বলল,
'আমাদের যেতে হবে।'
রোদেলা ইতস্তত করে বলল,
'বাহিরে তো অনেক বৃষ্টি পরছে। আমরা ওতো দূর কিভাবে যাবো?'
'আমরা লেক কোমো তে যাবো না।'
'প্রাসাদে যাবো না?'
'না। আজ থেকে রোমে থাকব।'
রোদেলা মাথা নিচু করে ফেলল। উমাইয়া তাকে জানিয়েছিল সেহরিশের বাড়ি এখানে আছে। রোদেলা জিজ্ঞেস করলো,
'আপনার নিশ্চয়ই ক্ষুধা লাগছে? আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি আপনার জন্যও কিছু বানিয়ে দিচ্ছি।'
সেহরিশ হেঁটে এগিয়ে এলো। রোদেলার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে গেল সে। দুইহাতে রোদেলাকে জড়িয়ে ধরলো। রোদেলা জিজ্ঞেস করলো,
'কি হয়েছে আপনি ঠিক আছেন তো?'
সেহরিশ নরম গলায় বলল,
'আমি ক্ষুধা লাগেনি। তোমার জন্য টেনশন করছিলাম, তোমাকে দেখলাম এখন সব ঠিক আছে।'
রোদেলা মুচকি হেসে তারপর জিজ্ঞেস করলো,
'এতো ভালোবাসা কবে হলো?'
সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
'আমি জানি না, ইচ্ছে করে হয়নি শুধু হয়ে গেছে।'
রোদেলা ঘুরে সেহরিশের দিকে তাকাল। সেহরিশ তার মুখটা দেখল একহাত রোদেলার গালে রেখে জিজ্ঞেস করলো,
'বুঝোনি?'
রোদেলা ডান থেকে বামে নিবিড়ভাবে মাথা নাড়ল। যার অর্থ সে বুঝেনি। সেহরিশ আলগোছে রোদেলাকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিল। একটু পর লহু কণ্ঠে বলল,
'নদীর এক পাড়ে গিয়ে একটা খাল কাটলে সেই নদী থেকে একটু জল সেই খালে আসবে, তারপর ধীরে ধীরে সেই খাল দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হবে, তোমার জন্য আমার অনুভূতি সেই রকম। তুমি আমার মনের কিনারায় ঢুকে বসে গেছ, এখন আমি তোমায় পরিপূর্ণ।'
রোদেলা অকপটে বলল,
'কেউ দেখে ফেলবে ছাড়ুন।'
সেহরিশ আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর তটস্থ গলায় বলল,
'দেখলে দেখুক, আমার বউ।'
সাদাফ আর উমাইয়া এক সঙ্গে উপর থেকে নিচে নামল। এরইমধ্যে রোদেলা খাবারের টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। সাদাফ খাবার টেবিল দেখে অবাক গলায় বলল,
'বাহ, এত তাড়াতাড়ি এত কিছু তুমি বানিয়েছ?'
উমাইয়া বলল,
'আমার থেকে ও রোদু অনেক ভালো রান্না করে।'
সাদাফ খানিকটা ঝুঁকে খাবারের স্মেইল নিয়ে বলল,
'বেশ ভালো ঘ্রাণ আসছে মনে হচ্ছে খেতেও বেশ মজা হয়েছে।'
সেহরিশ নির্বিকার চূড়ান্তে শক্ত গলায় বলল,
'রোদ রান্না করেছে আর তার রান্না সবসময়ই সেরা।'
সাদাফ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সেহরিশ ও উমাইয়া খেতে বসে গেল। রোদেলা ওদের খাবার দিয়ে নিজেও বসল। সব পদ রান্না থেকে অল্প অল্প চেকে দেখল সাদাফ। সাদাফ মুগ্ধ হয়ে বলল,
'রোদেলা সত্যি তোমার রান্না অনেক ভালো। মনে হচ্ছে মুখে লেগে আছে।'
সেহরিশ বলল,
'ভালো তো হবেই কারণ রোদ রান্না করেছে।'
সাদাফ পূর্বের দৃষ্টিতে তাকাল সেহরিশের দিকে। সাদাফ স্পষ্ট গলায় বলল,
'দেখ ভাই শোন, তুই আমার বউয়ের সামনে তোর স্ত্রীর প্রশংসা করছিস।'
সেহরিশ শক্ত ও গম্ভীর গলায় বলল,
'শাট আপ, রোদের রান্না করা খাবার খাওয়ার সময় কেউ আমাকে বিরক্ত করা পছন্দ করি না।'
সাদাফ ফিসফিস করে বলল,
'আমি তোকে চিনতে পারছি না। তুই কি সত্যিই সেহরিশ?
সেহরিশ চোখ ঘুরিয়ে রাগী চোখে তার দিকে তাকাল। সাদাফ অস্ফুটস্বরে বলে ওঠল, 'স্যরি স্যরি।' বলে থামল সাদাফ। মাথা নিচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,
'শালা বউ পাগল।'
উমাইয়া হঠাৎ বলল,
'একটা কথা বলব?'
সাদাফ জবাব দিল,
'হ্যাঁ বলো।'
উমাইয়া একটু সময় নিয়ে বলল,
'আজ যখন আমি ছাদে গিয়েছিলাম তখন বাড়ির পেছন দিকে ঝোপঝাড়ে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। একজন গার্ড যখন ওখানে যায় তখন সেখানে কেউ ছিল না।'
সেহরিশ ভ্রু কুঞ্চিত করলো। তারপর বলল,
'তখন কটা বাজে?'
উমাইয়া ভেবে বলল,
'আনুমানিক পাঁচটা বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে।'
রোদেলা জিজ্ঞেস করলো,
'আমায় কেন বলিসনি?'
উমাইয়া বলল,
'তোকে টেনশন দিতে চাইনি।'
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
'তুমি নিজের খেয়াল রেখো আর নেক্সট টাইম এমন ঘটনা হলে ভুল করেও বাহিরে যাবে না।' কথাটা বলে থামল সেহরিশ এরপর সাদাফের উদ্দেশ্য ফের বলল,
'আবার এমন হওয়ার আগে বাড়ির নিরাপত্তা কঠোর কর। অপরিচিত কাউকে বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা না যায়।'
সাদাফ চোয়ালদ্বয় শক্ত করে বলল,
'আমি আজই ব্যবস্থা নেব।'
ঘড়ির কাটা দশটা ছুঁই ছুঁই! বৃষ্টি কমে গেছে ঘন্টা দুয়েক আগেই, আকাশটা এখন পরিস্কার। বৃষ্টির পরও ঠান্ডা ভাবটা রয়ে গেছে। বাতাসের সঙ্গে শরীরে কাটা ফুটে। সেহরিশ তার হাত ঘড়িতে সময় দেখল তারপর সাদাফ ও উমাইয়ার থেকে বিদায় নিয়ে রোদেলার সঙ্গে বেরিয়ে এলো। গাড়ি আজ সেহরিশ নিজে ড্রাইভ করবে। এজন্য ড্রাইভার কে বডিগার্ড ওদের সঙ্গে অন্য গাড়িতে আসার জন্য বলে সেহরিশ।
পূর্ণিমার পূর্ণ চন্দ্র আকাশে গোল থালার মতো একটা চাঁদ, জ্যোৎস্নার উজ্জ্বল আলো চারিদিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রাস্তা তেমন কোলাহল নেই। শান্ত পরিবেশে ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে সেহরিশ। রোদেলা জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলল,
'একটু আগেই কত বৃষ্টি হলো কিন্তু এখন পরিবেশ দেখে বোঝাই যাচ্ছে না। আর বৃষ্টির পর চাঁদটাও যেন অপরুপ লাগছে।'
সেহরিশ চাঁদের দিকে তাকাল না। রোদেলার দিকে মনোনিবেশ করে বলল,
'তোমার চেয়ে বেশি না।'
.
.
.
চলবে...................................................