আষাঢ়ে মাসের এক শুক্রবার। দুপুরের সময়। বন্ধের দিন। রঞ্জুন বসেছিল উঠোনের মধ্যিখানে। ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটে হঠাৎ - হঠাৎ ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে সে। কোলে ব্যবসাবাণিজ্যের হিসেবখাতা। কলম-টা ভূমিতে পড়ে গিয়েছে মিনিটখানেক হবে। রঞ্জুনের ইচ্ছে হলো না উঠে গিয়ে সেটি তুলতে। কলামটি তোলাতে —চওড়া গলায় কাউকে ডেকে আনতে ইচ্ছে হচ্ছে। ভাবুক সে নারিকেল গাছটা দেখছিল। হঠাৎ করে অঘোষিত বৃষ্টি নামল। ঝিরিঝিরি নয়, ঝুম বৃষ্টি। অথচ বিশ মিনিট আগেও ঝলমলে রোদ ছিল। রোদ আর বৃষ্টি একসাথে দেখা দিলে নাকি খেঁকশিয়ালের বিয়ে হয়। কিন্তু আপাতত রোদ নেই। প্রকৃতি বেশ গুমোট। বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটার স্পর্শে ভিজছে রঞ্জুনের কোলের হিসেবখাতাটা। ভিজেছে রঞ্জুন নিজেও। সফেদ রঙের ফতুয়া আর লুঙ্গি খানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লেপ্টেছে। এসময়ে দেখা গেল রূপচাঁদ ছুটে বেরুচ্ছে। তাড়াহুড়ো পদচারণে বেরুতে নিয়ে দুয়ারে উষ্ঠা খেলো ভালোরকমের। ব্যথা পেলো কী? রঞ্জুন আনমনা ভাবল। দেখল খুব করে, পরনের পুরানো সুতি শাড়িটা পেটের কাছ থেকে সরে গিয়েছে। কোমরের মসৃণ কালো চামড়ায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। চিকচিক করছে। সবসময় নিজেকে ঢেকে রাখা রূপচাঁদের সেদিকে চেতনা নেই। তাড়াহুড়ো সে দড়ি থেকে কাপড়চোপড় ছুটিয়ে নিতে বড্ড ব্যস্ত। বাড়ির সকলের কাপড়চোপড় কি আর একজোড়া হাতে –এক মুহূর্তে ঘরে নেয়া সম্ভব? ইতোমধ্যে শুকনো কাপড়চোপড় সহ রূপচাঁদ ভিজে একাকার। মাথার কাপড় পড়ে গিয়েছে। শাড়িটা লেপ্টে আছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। কোমরের ঢেউ খানা সুস্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান। অসহায় রূপচাঁদ দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে। তাড়াহুড়ো করেও লাভের লাভ কিছুই হলো না। কিছু কাপড় হাতে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রঞ্জুন ওই অসহায় বদনখানি আজ খুবকরে দেখছে। যেন আজই নতুন দেখছে। রূপচাঁদ ফিরে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। রঞ্জুন অদ্ভুত কিছু একটা অনুভব করল ভেতরে। যা সে অনুভব করেনি অনেককাল। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে! বৃষ্টিতে ভেজা কালো মুখখানা—যেখানে আছে ঘন পাপড়িযুক্ত ডাগরডাগর একজোড়া চোখ, মোটা ভ্রু, খাঁড়া নাক আর ভরাট ঠোঁট। সুডৌল দেহের অধিকারিণী এই নারীর ভেতর যেন সবই আছে গৌরবর্ণ চামড়া ব্যতীত। রূপচাঁদ দ্রুত মাথায় কাপড় তুলল। ঠিক করে নিলো পরনের বিধ্বস্ত শাড়ি। ব্যস্ত পায়ে সে ফের কাপড়চোপড় নিতে ব্যস্ত হলো। অদূরেই সাইকেল চড়ে রূপম মিঁয়াকে আসতে দেখা গেল। এবেলায় ঠোঁট ফাঁক করে দুটো শব্দ বলল রঞ্জুন,
‘আহ, থামো। ভিজেছে, ভিজুক। ঘরে ঢোকো।’
রূপচাঁদ একমুহূর্ত আর অপেক্ষা করল না। চলে যেতে উতলা হলো। রঞ্জুন পুনরায় মুখ খুলল,
‘এদিকে আসো। খাতাটা নিয়া যাও।’
রূপচাঁদ ফের এগিয়ে এলো। রঞ্জুন কাছ থেকে দেখল বৃষ্টিতে ভেজা মুখটা। রসমালাইয়ের মতন লোভনীয় লাগল রূপচাঁদের ঠোঁটজোড়া। আচ্ছা, রঞ্জুন কি কখনো ওই ঠোঁটে চুমু খেয়েছে? এমন লোভনীয় জিনিসে সে মুখ লাগায়নি? এও কী সম্ভব? রঞ্জুনের কিছুতেই মনে পড়ছে শেষ কবে সে রূপচাঁদকে সোহাগ করেছে। হয়তো-বা মাসে একটিবার! তাও পুরুষোচিত উত্তেজনার তাড়নায়। অনিচ্ছুক ভাবে, আঁধারে রুমে। বিয়ের যেন তাদের কয় বছর হচ্ছে? তিন নাকি চার? সেটাও মনে পড়ছে না রঞ্জুনের। বাবার পছন্দে বিয়ে করেছিল। আর তার পছন্দের মানুষটা হয়ে গিয়েছিল ছোটো ভাইয়ের বউ। একই বাড়িতে থেকে পছন্দের মানুষটাকে সুখে সংসার করতে দেখার যন্ত্রণা এতটাই কষ্টের ছিল যে চোখের সামনের সব ধোঁয়াটে হয়েছিল।
জখমিত হৃদয় নিয়ে সে নিজের জগতে ছিল একাকী। তারপর… তারপর চলে গেল কয়টি বছর। কয়টি বছর? ভাবনার বুননে ছেঁদ পড়ল রূপচাঁদের আলতো গলার স্বরে,
‘ঘরে চলেন। ভিজলে শরীর খারাপ করব। আমি কি লুঙ্গি, গামছা গোসল ঘরে নিয়া আসমু?’
রঞ্জুনের সহসা একটি চিন্তা মস্তিকে হানা দিলো। রূপচাঁদ কী জানে তার পছন্দের কথা? সে নিজের ছোটো ভাইয়ের স্ত্রীকে পছন্দ করতো যে! একই বাড়িতে থেকে নিশ্চয়ই অজানা নয়? কেমন অনুভব করেছিল? রঞ্জুনের বুকের ভেতরটা মুষড়ে উঠল। এক অসহনীয় অনুভূতি বিরাজ করল ভেতরটা জুড়ে। সেই অনুভূতি ভিন্ন, অন্যন্য। রঞ্জুন একচিত্তে নতমুখ পানে চেয়ে ধরে আসা গলায় বলল,
‘পরে। আগে শাড়ি পরিবর্তন করো। তারপর নিয়া আসো।’
রূপচাঁদ বুঝি চমকাল? তার নরম কণ্ঠে? নাকি তার কোমল বাক্যে? রঞ্জুন জানে না, বুঝেওনি। তবে তার ভালো লাগল চমকিত মুখখানা দেখতে। রূপচাঁদ মাথা দুলিয়ে খাতা, কলম নিয়ে দুয়ার পেরিয়ে ঢুকল ভেতরে।
রঞ্জুন নড়তে পারল না। তার বৃষ্টিতে ভিজতে আজ ভালো লাগছে। বৃষ্টি ছিল তার অন্যতম অপছন্দের বিষয়। আজ সেই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে। কতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে রইল জানে না। সুভেধা বানুর ডাকে সম্বিত ফিরল। তিনি দুয়ারপানে দাঁড়িয়ে চিন্তিত কণ্ঠে ডাকছেন,
‘রঞ্জুনরে…আব্বা তুই বৃষ্টিতে ভিজতাছস কেন? জ্বর আইব যে।’
রঞ্জুন দেখল সুভেদা বানুর পেছনে রূপচাঁদ দাঁড়িয়ে আছে কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে। শাড়ি পরিবর্তন করেছে। পুরানো সুতি শাড়ি, একই ধাঁচের। শরীরের ভাঁজ বোঝা যাচ্ছে না। মাথায় সুন্দরভাবে কাপড় টানা। হাতে লুঙ্গি, ফতুয়া আর গামছা। আচ্ছা, ওর নাকের নাকফুলটা কী স্বর্ণের? আর হাতের বালা দুটো কীসের? রঞ্জুন বোধহয় কিছুই কখনো দেয়নি ওকে—স্ত্রী হিসেবে। প্রত্যুত্তর না পেয়ে সুভেধা বানু আশ্চর্য হলেন বুঝি? তিনি পুনরায় ডাকলেন,
‘এই রঞ্জুন…কী হইছে বাবা তোর?’
এযাত্রায় প্রত্যুত্তর করল সে, ‘মিনিটের লাইগা আর কী হইব?’ কথাটুকু বলে রঞ্জুন আরেকটিবার দেখল অদূরের মুখখানা। অস্পষ্ট তবে অমায়িক। তার এতো অস্বস্তি, এতো বেদনাবোধ হচ্ছে কেন?
— — —
রঞ্জুনরা তিন ভাই, দু বোন। সে বাড়ির বড়ো ছেলে। বাবা মা রা যাওয়ার পর সেই বাড়ির কর্তা। বাড়ির কমবেশ সবকিছুর দায়িত্ব তার কাঁধে। ছোটো দুটো ভাই কামচোর স্বভাবের। পড়াশোনা শেষ করেও কাজের কাজ কিছুই করছে না। এখনো হাত পাততে হয় রঞ্জুনরে কাছে। এতে অবশ্য রঞ্জুনের সমস্যা ছিলো না। তার আর্থিক অবস্থা ঢের ভালো। পনেরো বয়স থেকেই সে কাজ করে এসেছে। ব্যবসায় খুব চতুর ছোটোবেলা থেকে। টাকাপয়সা ভাঙার ক্ষেত্রেও বেশ কিপটে ধাঁচের। প্রাপ্তবয়স্ক হতেই ব্যবসাবাণিজ্যে তার সফলতা হয়েছে খুব। গ্রামে তার নামও ভালো। সবাই বলে বেড়ায় সে এই গ্রামের চেয়ারম্যানের চেয়েও আর্থিকভাবে বিত্তশালী। কথাটা ফেলে দেবার মতো নয়। গত সপ্তাহে সে পাঁচ তলা বাড়ি কিনেছে ঢাকায়। কোটি পড়েছে। নিজের কেনা এই বাড়িটার কথা এখনো বাড়িতে জানানো হয়নি। বাড়িটা আপাতত ভাড়া দিয়ে রেখেছে সে। শুধু দোতলা বাদ রেখে। ওটায় কাজ করাবে মনের মতন। রঞ্জুনের ব্যবসা শহরেই অবস্থিত। ওখানে থাকাটাই তার জন্য উত্তম। তবে পরিবারের জন্য ওখানে সেটেল্ড হওয়া সম্ভব হয়নি, হবেও না হয়তো-বা। তবুও সে দোতলা ফাঁকা রেখেছে! আজ এক সুপ্ত বাসনা মনের ঘরে ওঁৎ পাততে শুরু করেছে। রঞ্জুন সেই বাসনা উপলব্ধি করতে পেরেই শিউরে উঠছে। এইযে নতুন অনুভূতি!
খেতে বসে আজ অন্যমনস্ক রঞ্জুন। খাবারের প্লেটে দৃষ্টি রেখেও সে রূপচাঁদকে অনুভব করতে পারছে। তার পাশেতেই দাঁড়িয়ে আছে। এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। বউমানুষ স্বামীর খাওয়ার সময় পাশে দাঁড়িয়ে বেড়েধরে খাওয়াবে— এই হচ্ছে তাদের তাদের বাড়ির তথাকথিত নিয়ম। এতকাল এই বিষয়ে ভাবান্তর না হলেও আজ খচখচে অনুভূতি হলো। ইচ্ছে হলো রূপচাঁদকে টেনে পাশে বসাতে। তবে পরমুহূর্তেই এক আশ্চর্যজনক ঘটনা খেয়াল করল সে। তার ভাইয়ের স্ত্রী দুটো দাঁড়িয়ে নয়। পাশেই বসে স্বামীর। বাচ্চা গুলোও বসে। খেতে ব্যস্ত। ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী নুরী আমোদেই বলল,
‘বড়ো ভাবি, তরকারির বাটিটা দাও।’
রঞ্জুনের কানে যেন বজ্রপাত পড়ল। ঝাঁঝাঁ করল কানের ভেতরটা। রূপচাঁদ দ্রুত বাটি-টা কয়েক'পা গিয়ে এগিয়ে দিলো। রঞ্জুন নিঃশব্দে খেয়াল করল টেবিলের প্রত্যেকের আদেশ পালন করে যাচ্ছে তার স্ত্রী। যেন এই হচ্ছে, হয়ে চলেছে, হয়ে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে। রঞ্জুন আড়চোখে সুভেধা বানুর দিকে তাকাল। ভদ্রমহিলা খাচ্ছেন। ছেলের চোখে চোখ পড়তেই তিনি অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,
‘এতগুলা শুকনা কাপড়চোপড় সবই ভিজল। একটু তাড়াহুড়া কইরা হাত চালাইতে হয় না?’
রূপচাঁদ মাথা নুইয়ে ফেলল। রঞ্জুন হঠাৎ করেই নিজেকে বলতে শুনল,
‘বাড়িতে আর মানুষ নাই? সবাই কী করে? ঘাস খায় নাকি? এতগুলা কাপড়চোপড় একটা মানুষ কীভাবে আনে? বৃষ্টি নামল হঠাৎ! ও কী রোবট?’
মুহূর্তেই যেন চুপসে গেল আশপাশ। সবই নিশ্চুপ। সবাই আশ্চর্য, হতবাক। নুরীর হাতটা থেমে গেল। সে নিজের বাচ্চা ছেলেটাকে খাওয়াচ্ছিল। অবাক চোখে চাইল রঞ্জুনের দিকে। মুশফিকও কম হতবিহ্বল নয়। রঞ্জুন তখনো মায়ের দিকে চেয়ে। আশ্চর্য হয়ে আছেন সুভেধা বেগমও। অকপটে এমন প্রত্যুত্তর ছেলে কখনো দেয়নি বলেই হয়তো। নিজের মনের বিরক্ত, অসন্তুষ্টি গিলে নিয়ে বলেন,
‘ওগো দু'জনের ল্যাদা বাচ্চা। সামলাইতে হয়। তোর বউয়ের তো সেই মুরোদও নাই।’
রঞ্জুনের কপালের ভাঁজ গুলো গাঢ় হলো বেশ। সে কখনোই তর্কে যেতে পছন্দ করে না। বিশেষ করে মাতাপিতার। সে নিজ চোখে দেখেছে একগাদা কাপড়চোপড় দড়িতে দেয়া। একজনের পক্ষে এতো কাপড়চোপড় আনা সম্ভব না। সে সকালে রূপচাঁদকে এসব দড়িতে দিতেও দেখেছিল! বাড়িতে থাকে না বলে কিছুই দেখে না। একদিন থেকে যেসব কীর্তিকলাপ দেখছে তাতেই তো তার রাগের মাত্রা বেড়ে চলেছে হুড়মুড়িয়ে। কোনোরকমে নিজের রাগ গিলে নিয়ে সে নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
‘যার-যার কাপড়চোপড় সে-সে আনব এখন থেইকা। আর না পারলে কাজের বুয়া আনাইতে বলেন।’
সুভেধা বেগম যেন উড়ন্ত মাছি খেয়েছেন। মুখের করুণ দুর্দশা। তিনি অসন্তোষ চোখে নিজের বাধ্যগত বড়ো ছেলেকে দেখছেন, ‘এই কেমন কথা কইতাছস তুই?’
রঞ্জুন প্রত্যুত্তর করল না। মায়ের বিড়বিড়িয়ে বলা একটি কথাও যেন সে শুনেনি। তার মুখ দিয়ে আরেকটি শব্দও উচ্চারিত হলো না। কারো সাহসও হলো না রূপচাঁদকে দিয়ে ফরমায়েশ খাটানোর। রূপচাঁদ দাঁড়িয়ে রইল রঞ্জুনের পাশে। চুপচাপ তরকারির বাটি এগিয়ে দিচ্ছে। রঞ্জুন খেয়াল করল ওর হাতের উশকোখুশকো অবস্থা। কালো চামড়ার কয়েক জায়গাতেই ফোসকা পড়ে আছে। খুব নিগূঢ়ভাবে না চাইলে বোঝাও সম্ভব না।
ঘড়ির কাঁটা তখন রাতের দশটা নয়ে। বাইরে ঝড়োতুফান বয়ে যাচ্ছে। সেই তুফান যেন রঞ্জুনের ভেতরেও বইছে। আজ দুপুরের পর থেকেই তার শরীর জুড়ে এক অন্যরকম উত্তেজনা। ভেতরের অকথিত কামনার কথা ভাবতেও অসহ্যকর লাগছে। রঞ্জুন দুয়ারের কাছে দু'বার গিয়ে ফিরে এসেছে। এতক্ষণ লাগে ফিরতে? সবাই তো ঘুমুতে চলে গিয়েছে। এখনো কী করছে রান্নাঘরে? হিসেবখাতাটা কয়েকবার হাতে নিয়েও হিসেব মেলাতে পারছে না। কিছুতেই না। রূপচাঁদ এলো দশটা ঊনত্রিশে। রঞ্জুন মুহূর্তেই চাইল। আগুন চোখে দেখল অনেকক্ষণ। ঘরে ঘুরে-ঘুরে কাজ করতে থাকা বদনখানি যেন অচেনা, অজানা। সেই বদন এক্ষণ জানার এই তৃষ্ণা যেন বেড়েই যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভেজা ওই ঠোঁটে এইক্ষণে ডুব না দিলে যেন আগুনের তাপে ম রেই যাবে সে। এই অনুভূতি এতো অসহ্যকর! এতো অসহনীয়! বিছানার ওপর ফেলে রাখা শার্ট ভাঁজ করছে রূপচাঁদ। রঞ্জুন উঠে দাঁড়াল। হিসেবখাতা, কলম টেবিলে রেখে দরজা লাগাতে উতলা হলো। শব্দ হলো তার লাগানোর অস্থিরতায়। সেই শব্দে চমকে তাকাল রূপচাঁদও। পরপরই সে ভাঁজ করা শার্ট আলমারিতে রাখতে গেল। রঞ্জুন পেছন পেছন এলো। একমুহূর্ত আর দেরি না —সঙ্গে সঙ্গেই পেছন থেকে জাপটে ধরল রূপচাঁদের শীর্ণ কোমর। তুলতুলে কোমল কোমর শক্ত, রুক্ষ হাতে ছুঁতেই রূপচাঁদ মিইয়ে গেল। তার আশ্চর্যের কোনো শেষ নেই আজ। রঞ্জুন ক্ষুধার্ত বাঘের মতোই ডুবল তার ঠোঁটে। বাইরের ঝড়োতুফানও যেন তুচ্ছ তাদের কাছে।
— — —
আজকের ভোর ভিন্ন খুব অন্যরকম। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা খোলা। রূপচাঁদ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ঘন, কালো, দীর্ঘ চুলগুলো মুছছে একমনে। গুনগুন করে গান গাইছে বুঝি? মেয়েটাকে এতোটা স্বতঃস্ফূর্ত হতে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। আজ ওকে অন্যরকম লাগছে। স্নিগ্ধ মুখে লাজুক হাবভাব। হঠাৎ করেই আড়চোখে ফিরে তাকাল রূপচাঁদ। দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়তেই যেন হকচকাল। মেয়েটার লজ্জার মাত্রা কয়েকগুণে বাড়ল। জানালার কাছ থেকে সরে এলো চটজলদি। এমনিতেও রূপচাঁদ রঞ্জুনের চোখে চায় না। ভুলবশত মাঝেমধ্যে চাইলেও আজ কোনোভাবেই চাইছে না। কেমন বিড়ালের মতন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। রঞ্জুন শুয়ে শুয়ে উপভোগ করল। ওঠার তাড়া নেই তার। আজ সে দীর্ঘক্ষণ ঘুমাবে। বেলা করে! ঘুম ভাঙল তার বেলা এগোরোটায়।
উঠে গোসল করে নিলো। এসময়ে ঘরে ঢুকেই বিছানা গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রূপচাঁদ। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে রঞ্জুন দেখল ব্যস্ততম দেহখানা। আজ তাকে ঢাকা যেতে হবে। ফিরতে দু'দিন লাগবে। ফেরার তাড়া কখনো ছিলো না তার। অথচ আজ না গিয়েও যেন ফেরার খুব তাড়া।
সোমবার সন্ধ্যায় ক্লান্ত রঞ্জুর বাড়ি ফেরে। আজ না ফিরলেও হতো। কিন্তু তার যেন ফিরতেই হবে। বৃষ্টি-টৃষ্টির ধার সে ধারেনি। বাড়ির চতুর্দিক, ভেতরটা —সব নীরব। কোনো সাড়াশব্দ নেই। দরজা তিনটাই লাগানো। ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ পড়ে তার। সবাই কোথায়? দরজায় করাঘাত করতেই রূপচাঁদের সন্দিহান কণ্ঠ শোনা যায়,
‘কে? কে বলছেন?’
রঞ্জুন আওয়াজ তোলে,‘আমি!’
দরজাটা খুলল কতক্ষন। রূপচাঁদ চমকে ওঠে। কণ্ঠ জুড়ে অস্থিরতা, ‘এমনে ভিজ্জা আইছেন? কেন?’
রঞ্জুন ভেতরে দৃষ্টি ঘুরিয়ে শুধাল, ‘সবাই কোথায়?’
‘কুলসুম আপারে দেখবার আইছে। সকাল সকাল সবাই ওখানেই গেছে। আজ মনে হয় ফিরব না।’
রঞ্জুন কিছুক্ষণ চুপ থাকল। সবাই গিয়েছে রূপচাঁদকে রেখে বিষয়টা ভালো লাগল না তার। কিন্তু এরপরই কিছুক্ষণ চুপ থেকে— হেসে ফেলল। বলল,
‘চমৎকার।’
‘জি?’
ভেজা কাপড়ে ঘরে ঢুকল রঞ্জুন। হাতের ব্যাগটা ফেলে দরজা লাগাল। মুহূর্তেই কোলে তুলে নিলো রূপচাঁদকে। ছুটল রুমে। অনুভূতিরা যখন শান্ত হলো তখন রাত গভীর। আজ আর মেয়েটাকে সরে যেতে দেয়নি রঞ্জুন। বুকে জড়িয়ে রেখেছে। অনেকটা সময় ধরে। রূপচাঁদকে কাঁদতে দেখল। কেন কাঁদল? রঞ্জুন বোঝার চেষ্টা করছে। জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কিন্তু প্রত্যুত্তর মিলছে না। এতেও যেন বিরক্ত হলো না অন্তর। বরঞ্চ চিন্তিত হয়। কণ্ঠ মোলায়েম হতে থাকে। উদগ্রীব হয়। এসব কী ভালোবাসার লক্ষণ? রঞ্জুন উঠে বসে। কোনোরকমে লুঙ্গি পেঁচিয়ে ব্যাগটা তুলে নিয়ে ফেরে। সে স্বর্ণের বালা, নাকফুল এনেছে। মোটাসোটা বালা জোড়াতেই ছয় ভরি স্বর্ণ ব্যবহার হয়েছে। এক ভরিতে নাকফুল। রূপচাঁদের হাতে রঞ্জুন নিজেই পরিয়ে দিলো বালাজোড়া। নাকফুলটা পরাতে পরাতে দেখল রূপচাঁদ কাঁদছে।
‘কাঁদতাছ কেন?’
ভাঙা কণ্ঠে থেমে থেমেই জবাব দিলো মেয়েটা, ‘এমনিতেই।’
রঞ্জুন খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল, ‘ঢাকায় বাড়ি কিনছি। গ্রামে থাকবার পারব না আমি। এতবার আসা-যাওয়া সম্ভব না। তুমি সাথে চলো। যাইবা তো?’
রূপচাঁদের চোখজোড়া কেমন ভরে এলো। নাকটা ফুলেফেঁপে উঠল। ধরে আসা গলায় বলল, ‘আপনি যেখানে আমি সেখানেই থাকতে চাই। আমি আর কিছুই চাই না।’
রঞ্জুন খুব কাছ থেকে দেখল স্নিগ্ধ কান্নারত মুখটা। কাঁদতে থাকা একটি মুখে এতো আনন্দ থাকতে পারে বলে তার জানা ছিল না। উজ্জ্বল চোখ দুটোতে যেন পৃথিবী সমান আনন্দ, উচ্ছ্বাস। রঞ্জুন মুহূর্তেই রূপচাঁদকে বুকে জড়িয়ে নিলো। বিড়বিড়িয়ে উঠল,
‘অনেকটা সময় লাইগা গেলেও ভালো কিন্তু বাইসা ফেলছি।’
.
.
.
সমাপ্ত.............................