গাড়িতে ওঠার সময় রৈনীল আমার পাশে বসলো। এটা একেবারেই কল্পনায় ছিলোনা আমার। আমার পাশে কিছুটা জায়গা ফাঁকা ছিলো। বাকি সিটগুলো পূর্ণ হওয়ায় রৈনীল আমাকেই জিজ্ঞেস করলো, 'এখানে বসতে পারি?'
আমি নিঃসংকোচে 'অসুবিধা নেই' বলার পর সে আমার পাশে এসে বসলো। জুবায়ের ভাইয়ার সবচেয়ে বড় গাড়িটা নিয়ে আমরা বের হয়েছি। তবুও জায়গা সংকুলান হচ্ছেনা। তবে রৈনীল খুব জড়োসড়ো হয়ে বসেছে যাতে আমার কোনো অসুবিধা না হয়। সে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো, 'কি অবস্থা বিজয়ী সরণী?'
'ভালো।'
'তোমার ফোন পেয়েছো?'
'হুম।'
'জানাওনি কেন?'
"ফোন ইউজ করছি না।'
'ওহ আচ্ছা।'
গাড়িতে গান ছেড়ে দিলো। দুলুনির তালে তালে একটা মনমাতানো গান। বরাবরের মতোই আমার স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। তবে এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে মাকে না জানিয়ে আমি কোথাও ঘুরতে যাবোনা। প্রথম প্রথম মাকে লুকিয়ে সবকিছু করতে আমার ভালো লাগতো। কিন্তু গত কয়েকদিন রৈনীলকে ভুলে থাকতে চেষ্টা করে আমি নিজেকে ভেতরে ভেতরে অনেক বদলে ফেলেছি। এখন আমার কোনো মিথ্যাচার ভালো লাগেনা।
রৈনীল এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলো, 'সায়েমের বিষয়টা কি চিরতরে মিটমাট হয়েছে?'
'সঠিক জানিনা। অনেকদিন ওনাকে নিয়ে কোনো আলাপ হয়না বাসায়। আর উনিও কোনো যোগাযোগ করেনি।'
'ওহ আচ্ছা। ভার্সিটি লাইফ কেমন লাগছে?'
'প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছে বহুবছর পর আমার সঙ্গে আপনার দেখা?'
'হা হা হা। অনেকদিন পরেই তো। আগের সরণী আর এখনকার সরণীর মধ্যে বিস্তর ফারাক। তাই জানতে চাইলাম।'
'কিরকম ফারাক?'
'তুমি কয়েকদিনেই যেন অনেকটা বড় হয়ে গেছো।'
আমি চুপ করে রইলাম। ভাইয়ার বন্ধুরা একসাথে আড্ডা দিচ্ছে। একে অপরকে টেক্কা দিচ্ছে জোকস বলে। প্রত্যেকবার জোকস শেষে সকলে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। আমি সেদিকে মনযোগ দিলাম। ।
হাসি, আড্ডা আর গানে খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলাম আমাদের ট্রিপের গন্তব্যস্থলে। গাড়ি থেকে নেমেই ভাইয়া ব্রিফিং দিলো। আমাদের কখন কী কাজ, কখন কোথায় উপস্থিত থাকতে হবে সবকিছু। আজকে একটামাত্র ভিলাতেই থাকবো আমরা। একটা বড় লিভিংরুম, দুইটা বেডরুম। ভেতরে প্রবেশ করেই সবাই ভিলাটা ঘুরে দেখতে লাগলো। আমি বারান্দার কাঁচের দরজা সরিয়ে সেখানে এসে দাঁড়ালাম। বাইরের ছোট্ট সুইমিংপুলের অপূর্ব ভিউ পাওয়া যায় এখান থেকে।
অন্যান্য সময়ে হলে চাইতাম রৈনীল এসে পাশে দাঁড়াক। আজ সেটা চাইছি না। কল্পনায় তো সে আমার সঙ্গেই আছে। মন চাইলেই সেই কল্পনার জগতে প্রবেশ করে আমি ওর সঙ্গে গল্প করতে পারি। বাস্তবে সে থাকুক না তার মতো। যদি প্রকৃতি চায় আমি তার হবো আর সে আমার, তবে সমস্ত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে অবশ্যই আমরা এক হবো। আমার কোনো তাড়া নেই।
রৈনীলের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। জোরগলায় কারো সঙ্গে কথা বলছিল সে। ওর গলার স্বর আমার এতটাই চেনা হয়ে গেছে যে, একবার শুনলেই মনে হয় "সে আমার নিজের মানুষ। আমার আপন মানুষটা কথা বলছে।"
ওরা ফ্রেশ হয়ে একসঙ্গে কিছু একটা খেলতে বসেছে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো আমি খেলবো কিনা। আমি ঘাড় নাড়লাম। রৈনীল সবার সামনেই আমায় জিজ্ঞেস করলো, 'তোমার কি মন খারাপ?'
আমি ছোট্ট উত্তর দিলাম, না।
'আসো, জয়েন করো আমাদের সঙ্গে।'
'আমি বাইরে যাচ্ছি, ঘুরে দেখবো।'
একাই বের হলাম সাহস করে। ভিলার চারপাশে গাছগাছালিতে ভরা অপূর্ব জায়গাটা দেখছিলাম। আজ কি রৈনীল আসবে না আমার কাছে? বারবার অজান্তেই আমি ভিলার মেইন দরজার দিকে তাকাচ্ছি। এই বুঝি বের হয়ে আসবে রৈনীল। অনেক্ষণ পরও তাকে দেখা গেলো না। কিঞ্চিৎ হতাশ হলাম। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আমি কল্পনায় ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আসলে না কেন?
কল্পনার রৈনীল উত্তর দিলো, আমি খেলতে মজা পাচ্ছি। তুমি আমাদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিলে না কেন?
'আমার কাছে খেলার চাইতে আপনার সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে বেশী ভালো লাগে।'
'কার সঙ্গে কথা বলছো?'
কণ্ঠ শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি রৈনীল!
আমি চমকে উঠে বললাম, নিজে নিজে। ।
'নিজের সঙ্গে আলাপ করা ভালো। কি নিয়ে কথা বলছো শুনি?'
'সেটা আপনার শুনতে হবেনা। খেলা বাদ দিয়ে এলেন কেন?'
'আসর ভঙ্গ হয়েছে। ওরা এখন খাওয়াদাওয়া করবে।'
'আর আপনি?'
'আমিও খাবো। তোমাকে ডাকতে এলাম। দশ মিনিটের মধ্যে খাবার দেবে। তুমি চাইলে ফ্রেশ হয়ে নিতে পারো।'
আমি ভেতরে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করলাম। রৈনীল আমায় ডাকতে এসেছে, ফ্রেশ হতে বলছে, আর এইযে সবাইকে রেখে আমার জন্য বের হয়ে আসা, সবকিছুকেই আমার কেমন যেন অনুভূতির জানান দেয়া মনে হচ্ছে। সেও কি তবে আমার জন্য কিছু একটা অনুভব করে! আমি নিষ্পলক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
ও বললো, তোমাকে আজ এত বিষণ্ণ লাগছে কেন সরণী?
'কই না তো।'
'মুড সুইং? নাকি বাসায় কিছু হয়েছে?'
'জানিনা। তবে আই থিংক আমার কিছু হয়নি।'
'তোমার এরকম মুড কবে থেকে? যেদিন ফোনটা নিয়ে নিলো সেদিন থেকে?'
'ওরকমই।'
'বুঝতে পেরেছি।'
'কি বুঝলেন?'
'কিছু না। আমিমি একটা সিগারেট ধরাতে পারি?'
'আশেপাশে এত বিশাল জায়গা থাকতে আমার পাশে দাঁড়িয়ে কেন ধরাতে হবে?'
'ভালো প্রশ্ন তো।'
রৈনীল ওর দুই ঠোঁটের মাঝখানে সিগারেট রেখে খানিকটা দূরে সরে দাঁড়ালো। তারপর সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে টানতে শুরু করলো। আমি এইমুহূর্তে অন্য কিছু ভাবছি। যেদিন ওর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল সেদিন থেকেই আমার মন মেজাজ এমন ঠাণ্ডা কিনা। সত্যিই কি তাই? আমি কোনো উত্তর বের করতে পারলাম না। তবে রৈনীল কি এটাই ধরে নিয়েছে? তারমানে সে জানে আমি তাকে কতটা নিজের করে চাই। রৈনীলের কাছে নিজেকে এভাবে প্রকাশ করে দিতে আমার একদমই ইচ্ছে ছিলো না। তবে এখন খানিকটা ভারমুক্ত লাগছে নিজেকে।
রৈনীল সিগারেট শেষ করেছে। ইশারায় দেখাচ্ছে ভিলায় ফিরে যাওয়ার জন্য। আমি হাঁটতে আরম্ভ করলাম। ভিলায় প্রবেশের ঠিক আগ মুহুর্তে সে বললো, তোমার সঙ্গে একটা পারসোনাল কথা আছে সরণী। একা হলে আমাকে জানাবে।
আমার পুরো শরীরে বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো কিছু একটা বয়ে যাওয়ার অনুভূতি হলো। আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম। রৈনীল সবকিছু বুঝে ফেলেছে! সেও কি আমাকে আজ নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করবে?
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি আমি। পিছন ফিরে এগিয়ে এসে রৈনীল আমার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে চললো। আমি যেন পা ফেলতে পারবো না। যন্ত্রের মতো চলছি। সে আমাকে চালাচ্ছে। এই প্রথম সে আমার হাত ধরেছে। বুকের ভেতর অজস্র নক্ষত্র তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে হঠাৎ!
ডাইনিংয়ে বসলেও আমার একদমই স্থির থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। পাছে সবাই টের পেয়ে যায়, সেই ভয়ে আমি ফ্রেশ হওয়ার দোহাই দিয়ে রুমে চলে এলাম।
রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। এতটা অস্থির হয়ে আছি যে কয়েক সেকেন্ড শুধু এদিক সেদিক ছোটাছুটি করলাম। তারপর ধীরেসুস্থে হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিংয়ে এসে বসলাম আমি।
খাওয়াদাওয়ার পর সবাই কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। কয়েকজন মিলে সুইমিংপুলে নেমেছে। বাকিরা ফটোশুটে ব্যস্ত। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুলে সবার লাফালাফি দেখছি। আজকেই প্রথম রৈনীলকে খালি গায়ে দেখলাম। ওর দিকে তাকাতে বড্ড লজ্জা করছে আমার। তবে চোখ সরিয়ে থাকতেও পারছিলাম না। ইচ্ছে করছিল খালি গায়ের এই রৈনীলকেই দেখছি।
ওকে ঠিক হ্যান্ডসাম বলা যায় কিনা আমার জানা নেই। তবে এটুকু জানি, ওর এই শরীরটাকেই দেখতে ভালো লাগছে। ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। এমন নির্লজ্জ ইচ্ছে আমার কেনই বা জাগছে, ছি ছি। এক দৌড়ে রুমে চলে এলাম।
স্বাগতা আপু জিজ্ঞেস করলো, কি রে কি হয়েছে?
'কিছু না।'
'বাইরে যাই চল।'
আপুর সঙ্গে বাইরে এলাম। আপু এসে একদম পুলের পাশেই দাঁড়ালো। জুবায়ের ভাইয়ার কয়েকটা ছবি তুললো সে। রৈনীলের সঙ্গে কয়েকবার চোখাচোখি হলো আমার। দ্রুত আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছিলাম যেন আমি তার দিকে তাকাই নি। তবে ওর চোখ ফাঁকি দেয়া মুশকিল।
এতটা কাছ থেকে ওকে এভাবে সিক্ত শরীরে, খালি গায়ে দেখার পর আমার মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। রৈনীল উঠলো পুল থেকে। পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। আমি মাটির দিকে তাকিয়ে আছি। সে আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার মাথায় ছোট্ট করে একটা টোকা দিলো। আমি মুচকি হাসলাম। ।
আপুর সঙ্গে কিছুক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করে অনেক গরম লাগতে শুরু করলো। ফিরেই সুইমিংপুলে লাফিয়ে পড়লো স্বাগতা আপু। ততক্ষণে সবাই রুমে চলে গেছে। আশেপাশে কেউই নেই। তবুও আমার নামতে ইচ্ছে করছিল না। যদি রৈনীলের নজরে পড়ে! আমি যথেষ্ট শালীনতা বজায় রেখেই নামবো, তবুও লজ্জা করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত নামাই হলো না আমার।
দুপুরের খাবার খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সবাই ভিলার বাইরে বের হয়েছে। আমি সাজগোজ করছি রুমে বসে। বারবার আইলাইনার ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে যাচ্ছে। ঠিক করতে বের পেতে হচ্ছে আমার।
এমন সময় দেখলাম রুমে রৈনীল ঢুকলো। আমার হৃদপিন্ড জোরে লাফিয়ে উঠলো ওকে দেখে। রৈনীল বললো, বাইরে বের হচ্ছো না যে?
'আ আ আমি রেডি হচ্ছি।'
'ওহ আচ্ছা। সবাই ওদিকে হাঁটতে যাচ্ছে। তারাতাড়ি আসো।'
'সবাই যাক। আমরা পরে যাই?'
রৈনীল কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার ভেতর কী যে সীমাহীন তোলপাড় করছে তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। রৈনীল বললো, ওকে। তুমি রেডি হও। আমি বাইরে সোফায় বসছি। ।
সে দরজা টেনে দিয়ে চলে গেলো। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমার এমন অস্থির লাগছে কেন! সে আশেপাশে এলে, কাছাকাছি থাকলে আমার বড্ড কেমন কেমন লাগে। আচ্ছা, তারও কি এমন লাগে?
আমি বের হয়ে দেখলাম লিভিংরুমে রৈনীল একা বসে আছে। আমাকে দেখে বললো, তোমাকে সুন্দর লাগছে।
আমি লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলাম।
রৈনীল ফিক করে হেসে বলল, টমেটো হয়ে গেছো কেন? এত লজ্জা পেতে হবেনা।
আমি আরও লজ্জা পেয়ে গেলাম। সে আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। আমি চোখ তুলে ওর দিকে তাকাতে পারছি না। সে হাত দিয়ে আমার কপালের সামনে আসা চুলটা ঠিক করে দিয়ে বললো, এবার ঠিক আছে।
আমার শরীর তখন রীতিমতো কাঁপছে। ।
রৈনীল এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। ডাকলো আমাকে, কই আসো? একটু পরে আলো কমে যাবে। তখন আর ভালো ছবি তুলতে পারবা না।
আমি হেসে ওর সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। এতকিছু জানে অথচ এটুকু জানেনা যে ছবি তোলা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই?
ঘুরতে ঘুরতে বিকেল গড়িয়ে এলো। নাস্তা খাওয়ার উদ্দেশ্যে সবাই তখন ভিলার দিকে হাঁটা ধরেছি। এমন সময় রৈনীল বললো, নাস্তা খাওয়ার পরে বাইরে এসো। কথা আছে তোমার সঙ্গে।
আমি আরও একবার কেঁপে উঠলাম। মুহুর্ত বোধহয় এখানেই আটকে গেছে। ঠিকমতো হাঁটতেও পারছিলাম না। সবাই আগে আগে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আর আমি কোনোমত ধীরপায়ে কদম ফেলছি। রৈনীলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব মনে হচ্ছে আমার।
সে বলল, তুমি ভেতরে যাও। আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসি। নাস্তার পর, এদিকেই আসবে। ঠিক আছে?
কোনোমত মাথা ঝাঁকালাম। সবাই মজা করে নাস্তা খেলেও পুরোটা সময় আমি যেন আর এই দুনিয়ায় নেই। সে কী বলবে, আমাকে কী প্রপোজ করবে! ঠিক কিভাবে বলবে কথাটা? সরণী, তোমাকে আমার ভালো লাগে? নাকি সরণী, আই লাভ ইউ.. উফফ ভাবতে পারছি না। সে বলার পরে আমিও বলবো, আই লাভ ইউ টু। আমি কি পারবো বলতে? আমার অতটা সাহস নেই যে!
.
.
.
চলবে........................................................................