প্রেমান্বেষা - পর্ব ১৩ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


সমস্ত বাড়ি জুড়ে ঈদ ঈদ আমেজ। আগামীকাল ঈদ। তারই তোড়জোড় চলছে। কেউ ঘরদোর গোছগাছে ব্যস্ত, কেউ রান্নাবান্নায়, কেউ মেহেদি দেয়ায়। নীলিমা চা খেয়ে মেহেদি নিয়ে বসেছে। আজ রাফার কাছ থেকে মেহেদি নিবে সে। আর পাখিকে সে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছে। ঈদের তিন দিন পরে মানতাসার বিয়ে বলে ঈদে ওভাবে কেউই মেহেদি নিচ্ছে না। শুধু ডান হাতে একদম সাধারণভাবে মেহেদি দিচ্ছে যেনো ঈদ ঈদ আমেজটা জমে। 

ড্রইংরুমে বসে নীলিমা পাখির হাতে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছে। রাফি বসে টিভি দেখছে। বাহাদুর শেখ ও আসমানী বেগমও ড্রইংরুমে আছেন। বাহাদুর শেখের অনুরোধে রাফি বিটিভি চালিয়ে বসে আছে। সেখানে 'ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে' গান চলছে। বাহাদুর শেখের ভীষণ পছন্দের গান এটি। প্রতি রোজার ঈদে টিভি চালিয়ে এ গানটি শোনেন আর সোনালী অতিতের স্মৃতিতে ডুব দেন। 
এদিকে রাফি বেচারা ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বসে আছে। আজ খেলা দেখবে সে। এজন্যই টিভির রিমোট নিয়ে বসেছিলো। কিন্তু তখনই বাহাদুর শেখ এসে হুকুম দেন, বিটিভি অন করতে। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাফি বিটিভি অন করে বসে আছে। একই গান বারবার শুনতে শুনতে সে প্রচণ্ড বিরক্ত। এবার বিরক্ত নিয়েই বললো,
" আর কতক্ষণ এই গান দেখবেন নানা? অনেকক্ষণ তো হলো। "

বাহাদুর শেখ মৃদু ধমকে বলে উঠলেন, 
" তুই চুপ কর! হারাদিন তো লাত্থানো গুঁতানো দেখতি দেখতি সময় যায়। এই গানের আবেগ বুঝোস তুই? আগে কাজ থেকে ফিইরাই রেডিও চালু কইরা বসতাম। কহন গানডা বাজবো। তর নানি আর আমি শুনতাম। কি সুন্দর দিনগুলান ছিলো। আহা।"

রাফি আর কথা বাড়ালো না। ফোঁস করে হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়লো। সে জানে আজ টিভিতে খেলা দেখা সম্ভব না। তাই রিমোট রেখে সে যাচ্ছে স্মরণকে তেল দিতে। স্মরণ যে খেলা দেখার পাগল এটা সে ভালো করে জানে। ক্রিকেট, ফুটবল কোনোটার প্রতি অনাগ্রহ নেই তার। এজন্য সে সঠিক জায়গায় তেল খাটাতে যাচ্ছে। কিন্তু স্মরণ এখনও বোধহয় বাজারে আছে। আড্ডা দিচ্ছে হয়তো! তবুও একবার বাইরে গিয়ে দেখা যাক। এই ভেবে রাফি রিমোট রেখে উঠে চলে গেলো। 

এদিকে নীলিমার মেহেদি প্রায় শেষের দিকে। আঙুল দুটোর ডিজাইন দেয়া হলেই সে রাফার কাছ থেকে মেহেদি নেয়া শুরু করবে। পাখির হাতে মেহেদি দিচ্ছিলো নীলিমা। এমন সময় হঠাৎ ড্রইংরুমে স্মরণের আগমন ঘটলো। হাতে একটা ঠোঙা নিয়ে সে 'নীলি, নীলি' বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। তার সম্বোধনে প্রকাশ পাচ্ছে স্পষ্ট কোমলতা। 
স্মরণের মুখে 'নীলি' সম্বোধন শুনে ফের থমকে গেলো নীলিমা। হাতখানা আচমকাই কেঁপে উঠলো। ফলস্বরূপ মেহেদির ডিজাইন গেলো নষ্ট হয়ে। বুকটা তার মৃদু স্পন্দনে কাঁপছে। কি আশ্চর্য! স্মরণ যে তাকে মেরেই ফেলবে!
ঘাবড়ে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে সে স্মরণের দিকে তাকালো। স্মরণ তার ঠিক সামনে একটা ঠোঙা ধরে একগাল হেসে বললো,
" নাও, তোমার জন্য গরম মুচমুচে পেঁয়াজু এনেছি। বাজারে ভাজছিলো।"

নীলিমা খানিক উষ্ণ চাহনিতে স্মরণের দিকে তাকালো। তার কিছু বলার আগেই পাখি স্মরণকে কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
" শুধু নীলুপুর জন্য? আমার জন্য আনোনি ভাইয়া?"

স্মরণ ফের হেসে পাখির গাল টেনে বললো,
" তোর জন্যও এনেছি রে পাগলি। এত কি নীলিমা একা খাবে নাকি! এখানে সবার জন্যই আছে। আরো দু প্যাকেট এনেছিলাম। একটা রান্নাঘরে দিয়ে এসেছি। আরেকটা সাজিদ ভাইয়ের কাছে। "

নীলিমা এখনও স্মরণের দিকে চেয়ে আছে। চোখের চাহনি দিয়ে তাকে শাসাচ্ছে যেনো। স্মরণ অবশ্য টের পেয়েছে বিষয়টা। কিন্তু ফিরতি জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কেননা সে নীলিমাকে জ্বালানোর জন্যই ইচ্ছেপূর্বক এ সম্বোধনে ডেকেছে। স্মরণ ঠোঙাটা দিয়ে বাঁকা হেসে ফিরতি পথ ধরলো। নীলিমাকে নিয়ে তার সন্দেহ ধীরে ধীরে প্রবল হচ্ছে। নীলিমা মনে যদি এখনও তাকে নিয়ে সুপ্ত অনুভূতি থাকে তবে ব্যাপারটা জমবে বেশ। 

এদিকে স্মরণ যেতেই নীলিমা আপনমনে চিবিয়ে চিবিয়ে স্মরণের গোষ্ঠী উদ্ধার করলো। নিজেকেও বোঝালো শক্ত হতে৷ সে ভেবে পায় না, এই বয়সে এসেও পুরোনো সময়গুলোর ন্যায় নামে এতো আবেগ মিশে থাকবে কেনো। এখনও কি কিশোরী মনের সেই অনুভূতি আছে নাকি!

----------------------------

বাড়ির প্রায় সবাই সকাল ৭টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। সকলের মধ্যে সে কি তোড়জোড়! মেয়েরা রান্না ও ঘর গোছানোয় ব্যস্ত আর ছেলেরা গোসলে। বাড়ির তিনটা বাথরুমেই ভীড় লেগে আছে। একের পর একজন গোসল করতে ঢুকছে৷ ঈদের নামাজের জামাত পৌনো আটটায়। গোসল করে, সেমাই খেয়ে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হতে হবে। 
নাজমা বেগম ও মাসুদা বেগম রাতের জ্বাল করে নেয়া দুধ ফ্রিজ থেকে বের করে আবারো চুলোয় দিলেন। সেমাই রান্না করতে হবে যে! লাচ্ছা সেমাই ও চিকন সেমাই। স্মরণ ও সাদের লাচ্ছা সেমাই ভীষণ পছন্দের। উপরে কিশমিশ ও কাঠবাদাম দিলে দুজনের মধ্যে সেমাই নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যায়। সেই ভেবেই নাজমা বেগম দুই ছেলের জন্য আলাদা বাটিতে সেমাই রেখেছেন। 

এদিকে বাহাদুর শেখকে তার দুই ছেলে ধরে গোসল করিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে তিনি দূর্বল শরীর নিয়ে নিজ হাতে গোসল করতে পারেন না। প্রায় দিনই আসমানী বেগম গোসল করান তাকে। মাঝে মাঝে ছেলে দুটো গোসল করায়। আজ ঈদের দিন বলে ছেলে দুজন যত্নসহকারে বাবাকে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন৷ 
বাহাদুর শেখকে গোসল করিয়ে দুই ছেলে মিলে নতুন পাঞ্জাবি পায়জামা পরিয়ে আতর মেখে দিলেন। বাহাদুর শেখকে ঈদের জামাতের জন্য পুরোপুরি তৈরী করে তাঁরা গেলেন নিজেরা তৈরী হতে। 

স্মরণ মাত্রই গোসল সেরে বেরিয়ে আসলো। তিনজনের সাথে যুদ্ধ শেষে এবারে গোসল করতে পেরেছে সে। বেরিয়েই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলগুলো মুছতে আরম্ভ করলো সে। তার গৌঢ়বর্ণের উন্মুক্ত শরীর বেয়ে চুলের পানি টপটপ করে পরছে। পিছনে সাদ পাঞ্জাবী পায়জামা পরে রেডি হচ্ছে। 
তাদের রুমে এই ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ালে বাইরের ডাইনিখ টেবিলটা স্পষ্ট দেখা যায়। স্মরণ তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে দেখলো নীলিমা কোমড়ে ওড়না গুঁজে ডাইনিং টেবিলটা গুছাচ্ছে। তার মাঝে ব্যস্ত এক সাংসারিক রমনীর ছোঁয়া অনুভব করা যাচ্ছে। স্মরণ কয়েক সেকেন্ডের জন্য নীলিমার দিকে চেয়ে ফের নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। 

ঈদ উপলক্ষে নিজের পছন্দে কেনা হালকা জলপাই রঙের পাঞ্জাবি ও সাদা রঙের পায়জামা শরীরে জড়িয়ে নিলো স্মরণ। এ রঙটা তার গায়ে ভীষণ মানিয়েছে। তার গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি, জেল দিয়ে সেট করা বিন্যস্ত সিক্ত চুল, ফোল্ড করা পাঞ্জাবির স্লিভ ও হাতে চামড়ার ঘড়ি, সব মিলিয়ে স্মরণকে অত্যধিক সুদর্শন দেখাচ্ছে। উপরন্তু গায়ো মেখেছে কড়া মিষ্টি ঘ্রাণের একটা আরব আতর, যেটা তার বন্ধু জন্মদিনে উপহারস্বরূপ দিয়েছিলো। 
স্মরণ ঈদ জামাতের জন্য তৈরী হওয়া মাত্রই রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলে কাজ করা নীলিমার হাত চেপে ধরলো। অতঃপর তাকে এক টানে বাড়ির বাইরে উঠোনে নিয়ে এলো। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটলো যে নীলিমা কিছু বলার সুযোগ পেলো না। তাকে উঠোনে নিয়ে আসতেই আশ্চর্যান্বিত গলায় শুধালো,
" কি হয়েছে আপনার! এভাবে না বলেকয়ে উঠোনে নিয়ে এলেন কেনো?"

স্মরণ তার হাতে থাকা ফোনটা নীলিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
" আমাকে ফটাফট কয়টা ছবি তুলে দাও। "

নীলিমা বিস্ময় এবার অতি বিস্ময়ে পরিণত হলো। বললো,
" এই ছবি তোলার জন্য আমাকে এখানে এনেছেন!"

স্মরণ ঠিক এই কথার রেশ ধরে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
" তো? আর কিছু ভেবেছিলে বুঝি?"

নীলিমা ভ্রু কুঁচকিয়ে অকপট ক্রোধ নিয়ে বললো,
" আপনার মতো খারাপ না আমি। কাজ আছে আমার। আর কেউ ছিলো না বুঝি?"

" চোখের সামনে তুমিই ছিলে। বাকিরা কাজে ব্যস্ত ছিলো। "

" তো আমি কি বসে ঘাস কাটছিলাম মনে হচ্ছে?"

" আহহা, সময় নষ্ট করো না। তোমার ছবি তোলার হাত ভালো। দ্রুত ছবি তুলে দিয়ে নিজের কাজে যাও আর আমি নামাজে যাই। এই নাও, ধরো ফোনটা। "
বলেই স্মরণ প্রায় জোরপূর্বক নীলিমার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিলো। তার জোরাজোরিতে নীলিমা অগত্যা ছবি তুলতে আরম্ভ করলো। 
ছবি তুলতে গিয়ে আজ ছয় বছর পর স্মরণকে বেশ ভালোভাবো লক্ষ্য করলো সে। এতোদিন চাপা ক্রোধে স্মরণের দিকে ভালো করে দুদন্ড তাকানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেনি সে। কিন্তু আজ স্মরণকে সরাসরিই দেখলো সে। কিশোরী বয়সে যে স্মরণের প্রেমে সে হাবুডুবু খেয়ে ডুবতে বসেছিলো,সেই স্মরণ আর এই স্মরণের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে বলা চলে। এই স্মরণের মধ্যে পরিপক্বতা বা ম্যাচুউর ভাবটা প্রবল। ফলস্বরূপ সদ্য ভার্সিটিতে পা দেয়া সেই স্মরণ ও চাকরিতে যোগ দেয়া বর্তমান স্মরণের সুদর্শনতার মাঝে বেশ পার্থক্য আছে। স্মরণ এখন আগের চেয়েও দ্বিগুন সুদর্শন হয়েছে। উপরন্তু হাফ ফোল্ডেড পাঞ্জাবির স্লিভে উন্মুক্ত শিরাময় শ্বেতকায় হাত দুটো, গালের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে তার সৌন্দর্য যেনো আরোও উপচে পড়ছে। স্মরণের এ চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে অবাক হয়ে নীলিমা আপনমনে শুধালো,
" স্মরণ ভাই আগের চেয়ে এত হ্যান্ডসাম হয়ে গিয়েছে! কি আশ্চর্য! কত মেয়ের যে রাতের ঘুম হারাম করে কে জানে!"
এই বলেই জিব কাটলো সে। নিজের জন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নীলিমা টিপ্পনী কেটে বললো,
" বাংলার শাহরুখ খান হওয়ার চেষ্টায় আছেন বুঝি?"

স্মরণ ছবি তোলার জন্য পোজ দিতে দিতে বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে বললো,
" চেষ্টায় থাকবো কেনো। আমি তো শাহরুখ খানই!"

নীলিমা কপট হাসি দিয়ে খোঁচা দিয়ে বললো,
" হাহ...... যেই না চেহারা সুরুত! তার আবার শাহরুখ খান হওয়ার শখ!"

স্মরণও কম যায় না। নীলিমাকে একদম জায়গায় মতো তীর ছুঁড়ে বললো,
" অপমান করো না নীলি। এই শাহরুখ মার্কা চেহারা দেখেই আমার প্রেমে পড়েছিলে তুমি।"
.
.
.
চলবে................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন