অতিথি নিবাস - পর্ব ২০ - তানজিল মীম - ধারাবাহিক গল্প


তুমুল হুল্লোড়ে ভরা জমজমাট বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান। বাচ্চাদের ছোটাছোটি, বড়দের খোশগল্পের আওয়াজে চারপাশ বড়ই ম্যাচম্যাচে। আরহান, তৌহিদ আর শান্ত সবেমাত্র পা রাখল মায়াকুঞ্জে। তাদের দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল সবাই। তিন তিনটে সুদর্শন যুবক ঘুরাঘুরি করছে চারপাশে— ভাবা যায়! মাসুদ উদ্দিন এগিয়ে এলেন। উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,
 “এতক্ষণ তোমরা কোথায় ছিলে— এখন আসার সময় হলো তোমাদের?”

আরহান এগিয়ে এসে বলল,
 “আমরা তো সব কাজ গুছিয়েই গিয়েছিলাম আঙ্কেল।”
 “বুঝেছি যাও। খাবারের ওখানে যাও। ভজন শুরু হয়ে গেছে।”

আরহানরা দেরি করল না। দ্রুত ছুটে গেল তিনবন্ধু! ছাঁদেই মূলত ভোজনের আয়োজন করা হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখা পাওয়া গেল ফাবিহা আর অরিনের। আজ তারা দুজন জর্জেটের গর্জিয়াস থ্রি-পিস পড়েছে। ফাবিহা সবুজরঙা আর অরিন মেরুন কালার। অরিন আর আরহানের ড্রেসের রঙ মিলে যাওয়ায় ফাবিহার ভালো লাগল না। তবে প্রকাশও করল না। কারণ মিলটা অনাকাঙ্ক্ষিত। অরিন প্রথমে ফাবিহাকে মেরুন রঙটাই পড়তে বলেছিল কিন্তু ফাবিহা রাজি হয়নি। তাই অরিন পড়ে ফাবিহারটা আর অরিনেরটা ফাবিহা। ধূর! এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে অরিনের কথাটা তখন শোনা উচিত ছিল। ফাবিহার সাথে আরহানের চোখাচোখি হলেও কথা হলো না কোনো। আর অরিন, পোশাকের কালার মিলে যাওয়ায় তার মধ্যে কোনোরূপ ভাবান্তর ভাব দেখা গেল না। তার তো মেজাজ বিগড়াচ্ছে শান্তকে দেখে। ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে শান্তকে দেখলেই সেদিনকার গায়ে হলুদের ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। অরিন দ্রুত পায়ে শান্তকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। শান্ত দেখল। অনেক কিছু বুঝল। কিন্তু কিছুই করা গেল না।'

বিয়ের খাদিমদার হিসেবে আরহান, তৌহিদ আর শান্ত থাকল। এছাড়াও থাকল আহিরের দুজন বন্ধু। খাদিমদার হিসেবে তৌহিদ থাকলেও পরিবেশনের কাজে খুব একটা হাত রাখল না। সে ছিল শান্তর সাথে। সে বলেছে শান্ত পরিবেশন করেছে। শান্তর ভালো লাগছে ব্যাপারটায়। মোহনাদের টেবিলে থাকার সময় তৌহিদ বলেছে, “কোনোরূপ লজ্জা রেখে খাবেন না। পেট ভরে খাবেন।”

মোহনা শুধু তাকিয়ে রয়েছে তৌহিদের দিকে। তার মাথায় শুধু একটা জিনিসই ঘুরছিল তার কি উচিত তার পরিবারকে বলা, 'তৌহিদ তার ভার্সিটির টিচার।' পুরো সময় ভেবেই গেল বলা আর হলো না। তৌহিদও টিচার স্টুডেন্ট বলার প্রয়োজন মনে করল না।'

বেশ জমজমাট পরিবেশের মাধ্যমে বউভাতের অনুষ্ঠান শেষ হতে লাগল। মাসুদ উদ্দিনকে জানাল হলো উর্মির বাবা মা চান জামাই মেয়েকে তাদের সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যাবেন। দু'দিনের জন্য। সঙ্গে ফাবিহা অরিনকে দিতে চাইলে তারা নিতে চান। মাসুদ উদ্দিন বেশক্ষণ ভাবলেন। তবে মানা করলেন না। কিন্তু ফাবিহা যেতে রাজি হলো না। তার ভার্সিটি আছে। অরিনেরও তাই। শেষমেশ ফাবিহার মামাতো ভাই শরীফ আর তার ছোট বোন লিলি যাবে বলে জানানো হলো। পাত্রীপক্ষরাও রাজি হলেন।'

বউভাতের অনুষ্ঠান শেষ পর্যায়ের একদম ছুঁই ছুঁই। বাড়ির বসার ঘরে তখন প্রবলভীড়। মানুষে মানুষে গা লাগার মতো অবস্থা। অরিন কিছু একটা নিতে রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছে। রাহেলাকে আজ সারাদিনে রান্নাঘর থেকে বের করতে পারেনি। তার আজ কাজ ছিল শুধু রান্নাঘর। অরিন ছুটে গিয়ে বলল, “কি গো রাহেলা সুন্দরী কিতা কর তুমি?”

রাহেলা চুলা মুছতে মুছতে বলল,
 “হেমন কিছু করি না আপা, চুলা মুছি।”
 “আচ্ছা কাজুবাদামগুলো কোথায়?"
 “খাইতেন আপা?”

অরিন একগাল হেঁসে বলল, “হু।”
রাহেলা রান্নাঘরের একদম কর্নারে থাকা কতগুলো ব্যাগ দেখাল। বলল, “ওই জায়গায় আছে আপা দ্যাহেন।”

অরিন এগিয়ে গেল। অরিনের কাজুবাদাম খুব পছন্দ। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কতগুলো বাদাম হাতে দ্রুত ছুটে এলো বাহিরে। রাহেলা তাকে দেখে তখন শুধু হাসল।'

অনুষ্ঠানের শেষে তখন বিদায়ের পালা আসায় একে একে সবাই বের হচ্ছিলেন বাড়ির ভিতর থেকে। অরিন, ফাবিহা, আরহান, শান্ত, তৌহিদও বের হচ্ছিল সবার সাথে। হঠাৎ কি যেন হলো সবার ভিড়ে অরিন ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিল শান্তর গালে। আকস্মিক এমন কান্ডে ভীমড়ি খেল সবাই। আরহান, তৌহিদ, ফাবিহাসহ আশেপাশের সবাই থমকে গেল। শান্ত স্তব্ধ বনে তাকিয়ে। আচমকা কি হলো?' অরিন কেঁদে উঠল হঠাৎ। এতে যেন আরো অবাক হলো সবাই। বড়দের অনেকেই বাহিরে বেরিয়েছে তখন। ফাবিহা এগিয়ে গিয়ে বলল, “কি হয়েছে? তুই ওনাকে মারলি কেন?”

অরিন বলে না। কাঁদে শুধু। আরহান তাকায় শান্তর দিকে। শান্ত মাথা নাড়িয়ে বুঝায়, “সে কিছু করেনি।”

কিছুক্ষণ আগে সবার ভীড়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই কোমড়ে শক্ত হাতের স্পর্শ পায় অরিন। ঠিক সেই মুহূর্তেই তার পিছনে শান্ত থাকায়। অরিনের ঘৃনা আসে এবং কিছু না ভেবে স্ব-জোরে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় গালে। অরিনকে কাঁদতে দেখে তৌহিদ এগিয়ে গেল। সরাসরি প্রশ্ন করল, “আমার বন্ধুকে মারলেন কেন? ও কি করেছে?”

অরিন বলে না। চুপ করে রয়। আরহানের এবার রাগ উঠছে। এতগুলো মানুষের সামনে কোন সাহসে এই মেয়ে তার বন্ধুর গালে হাত দিল। অপরাধ কি! আরহানের দৃঢ় বিশ্বাস কোনো অপরাধ নেই। তাহলে মেয়েটা মারল কেন? আরহান ঝাঁঝাল কণ্ঠে শুধাল, “কান্না বন্ধ করুন।”

আরহানের ধমকে থমকে গেল অরিন। ফাবিহাও তাকাল তখন। এই প্রথম কি আরহানের রাগান্বিত কণ্ঠ শুনতে পেল সে। শান্ত এগিয়ে এসে আরহানকে সামলাতে চাইল। বোঝাল ভুলে যেতে। আরহান কোনোরূপ মানল না। আরো শক্ত কণ্ঠে বলল, “এই মেয়ে কথা বল, কোন সাহসে আমার বন্ধুর গালে হাত দিয়েছিস। দোষ কি ওর?”

মুহুর্তের মধ্যে পরিস্থিতি আরো জটিল হলো। বাড়ির বড়রাও ইতিমধ্যে ভিতরে প্রবেশ করল। আহিররাও যেতে যেতে আবার ফিরে এলো। তৌহিদ বলল,
 “কন্ট্রোল কর আরহান। আমি কথা বলছি। শান্ত হ তুই।”

আরহান রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে বলল,
 “ওকে জিজ্ঞেস কর এতগুলো মানুষের সামনে কোন সাহসে আমার বন্ধুর গালে থাপ্পড় মারল। কি দোষ ছিল?”
 “হ্যাঁ আমি বলছি। তুই চুপ করে দাঁড়া।”

আরহান নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। শান্তর ফর্সা গালে তখন পাঁচ আঙুলের দাগ বিদ্যমান। আরহান ওর গালে হাত বুলিয়ে বলল, “খুব ব্যাথা পেয়েছিস ভাই?”

শান্তর চোখ ছলছল করে উঠল। সে মাথা নাড়াল। যার অর্থ, “না।”

তৌহিদ অরিনের কাছে গিয়ে বলল,
 “আরহানের কথার ধরনের জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আপনি বলুন শান্তর দোষ কি? আপনি মারলেন কেন? কি করেছে ও?”

অরিন এখনও চুপ থাকে। রাগে আরহানের সর্বাঙ্গ কাপে। সে চেঁচিয়ে বলে,
 “কথা বলে না কেন?”

তৌহিদ অনুরোধের স্বরে বলে,
 “প্লিজ কথা বলুন নয়তো পরিস্থিতি আরো জটিল হবে।”

এবার অরিন মুখ খুলল। অশ্রুভেজা কণ্ঠে বলল,
 “উনি ভীড়ের মাঝে আমার শরীরে বাজে স্পর্শ করেছে।”

সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ আরো স্তব্ধ বনে গেল। মাসুদ উদ্দিন এগিয়ে এলেন। আহির তো তক্ষৎণাৎ শান্তর শার্টের কলার চেপে ধরল। আরহান তাকায় শান্তর দিকে। শান্ত তখনও মাথা নাড়ায়। যার অর্থ, “সে কিছু করেনি।”

আরহান আহিরের হাত ছাড়ায় প্রথমে। বলে,
 “কন্ট্রোল ও কিছু করেনি। আপনাদের বাড়ির মেয়ের কোথাও একটা ভুল আছে।”

অরিন এবার আরো বলল,
 “আমার কোনো ভুল নেই। আহির ভাইয়ের গায়ের হলুদের অনুষ্ঠানেও উনি আমায় বাজে কথা বলেছিলেন।”

এবার যেন ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল। আরহান তাচ্ছিল্যে হেঁসে বলল, “দেখেছেন, যে ছেলে জন্মগত থেকে কথা বলতে জানে না সেই ছেলে নাকি আপনাদের বাড়ির মেয়েকে বাজে কথা বলেছে।”

অরিন বিস্ময়ের ন্যায় তাকিয়ে রয়। অবাক কণ্ঠ বলে, “উনি কথা বলতে পারে না।”

ফাবিহা অরিনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল। যার অর্থ, ‘না।'

  গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যা ঘটেছিল। অরিনকে যে ছেলেরা বাজে কথা বলেছিল। তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল শান্ত। সে স্টেজের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকায়। ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি। যে মুহূর্তে মন্তব্যকারী বুঝল অরিন পিছন ঘুরবে ঠিক সেই মুহূর্তেই তারা সরে যায়। আর অরিনের নজর পড়ে শান্ত দিকে। সে ভেবেই বসে বাজে মন্তব্যগুলো শান্তই বলেছে।'

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে অরিন। কি বলবে বুঝতে পারছে না। তাহলে কি এই কয়দিন শান্তকে খামোখাই ভুল বুঝে ছিল অরিন। কিন্তু এখন! এখন কি হলো তাহলে? তার পিছনে তো শান্তই ছিল।'

 আরহান এদিক সেদিক তাকায়। তার হঠাৎ নজর যায় ক্যামেরা ম্যানের দিকে। সে দ্রুত এগিয়ে যায় তার কাছে। এবং ছবি দেখতে চায়। বাড়িতে দুজন ক্যামেরাম্যান আনা হয়েছিল। যার একজন শুধু ভিডিও করে আর একজন ছবি তুলেছে। আরহানদের কাছ থেকে ছবি তোলা ব্যক্তিটি কাছে ছিল। দেখা যাক কিছু পাওয়া যায় কিনা। আরহান বেশ কয়েকটা ছবি দেখার পর হঠাৎ একটা ছবিতে চোখ আটকায়। যে'টায় দেখাচ্ছিল শান্তর পিছনে থাকা একটা ছেলে অরিনের কোমড়ে হাত ছোঁয়ায়। চেহারা অস্পষ্ট কিন্তু পাঞ্জাবির কালার গ্রিন আর হাতায় সাদা ফুলের কারুকাজ। আরহান চারপাশে চোখ বুলায়। তখনই আহিরের এক বন্ধু নাম সাজ্জাদ। সে সেইম একটা পাঞ্জাবি পড়েছে এবং হাতার কাচটাও ছবির মতো।'

আরহান রাগান্বিত হয়ে এগিয়ে যায়। আরহানকে আসতে দেখে খানিকটা পিছিয়ে যায় সাজ্জাদ। ততক্ষণে আরহান এগিয়ে গিয়ে পাঞ্জাবির কলার চেপে সামনে এনে দাঁড় করায়। এবং বলে, “এ আসল দোষী।”

বলেই ঠাস করে দু'টো থাপ্পড় বসায় গালে। আহির রেগে যায়। বলে, 
 “ও আমার ফ্রেন্ড ও এই কাজ কখনো করতে পারে না।”

আরহান ক্যামেরা এগিয়ে দেয় আহিরের কাছে। আহির দেখে। আরহান বলে, “সব বন্ধু বন্ধু হয় না।”

 এরপর আরহান অরিনের দিকে এগিয়ে শান্ত স্বরে বলে, “প্রতিবাদে করা উত্তম, কিন্তু ভুল মানুষকে আঘাত করা অন্যায়।”

কথাটা বলেই শান্তর হাত ধরে বেরিয়ে গেল আরহান। পিছনে গেল তৌহিদও। উপস্থিত সবাই তখন চুপচাপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। যাওয়ার পথে তৌহিদের সাথে চোখাচোখি হয় মোহনার। তবে কথা আর হয় না।'

আরহানরা বের হতেই। সাজ্জাদের গালে থাপ্পড় মারল আহির। আর অরিন ভুল মানুষকে থাপ্পড় মারার লাঞ্ছনায় দৌড়ে গেল ঘরে। আর ফাবিহা সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। কি সুন্দর পরিবেশটায় আচমকা কি ঘটে গেল! ভাবতেও ভালো লাগছে না।
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp