মাঝরাতের আকাশটা আজ বড্ড বিষণ্ণ। ঘড়িতে তখন বারোটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। তীব্র মাথা ব্যাথার পীড়া নিয়ে বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়াল আরহান। শরীর মন আজ বড্ড ক্লান্ত। খুব বেশি খাটুনি হলো কিনা বুঝতে পারছে না। আরহানের মাথায় এখনও ঘুরছে তখনকার সেই ফোন কলটার কথা আর আচমকা বলে বসা, “আপনি খুব খারাপ আরহান।”
কণ্ঠটা বড্ড চেনা ঠেঁকল আরহানের। মনে হলো আশেপাশে থাকাই কেউ বলেছিল। কিন্তু কে? এখনও বুঝতে পারছে না। বাড়ির মুখে দাড়িয়ে থাকা ভাড়ি গেটটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে করাত করাত শব্দ হলো। বিচ্ছিরি লাগল শুনতে। আরহান ভিতরে প্রবেশ করল। পুরো বাড়ি লাইটের আলোতে আলোকিত। ছাঁদঘরে হাল্কা করে সাউন্ড বক্সের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এখনও বোধহয় অনেকে সজাগ। অবশ্য সজাগ থাকবে না কেন? বাড়ির ছেলের বিয়ে বলে কথা। আরহানের হঠাৎ তার মায়ের কথা মনে পড়ল। বিগত কয়েকদিন যাবৎ মায়ের সাথে কথা বলা হচ্ছে না। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই মাকে একটা করবে। একবার বাড়ি গিয়েও ঘুরে আসবে ভাবছে। ছুটি নিতে হবে কিছুদিনের। হঠাৎই মায়ের হাতের রান্না খেতে খুব ইচ্ছে করছে। আরহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথার মধ্যে কেমন চিনচিনে ব্যাথা করছে। সে দ্রুত ভাড়ি গেট আটকে অতিথি নিবাসের দিকে অগ্রসর হলো। রাস্তার মুখে দেখা গেল ফাবিহাকে। সে একা একা এদিকেই হেঁটে আসছে। আরহান দাঁড়িয়ে পড়ল। বেশ অবাক হয়ে বলল, “এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন ফাবিহা?”
ফাবিহা দাঁড়িয়ে পড়ল। আরহানকে সে আগেই দেখেছে। ঘরে ঘুমানো যাচ্ছে না। সাউন্ড বক্সে তার মাথা ধরে গেছে। তারওপর তার রুমটা তার ফুপুরা দখলে দিয়েছে। এতে আরোই বিরক্ত ফাবিহা। তাই তো বিরক্ত হয়ে বাহিরে হাঁটতে এসেছিল। সে বলল,
“কোথাও যাচ্ছি না। একটু হাঁটতে নেমেছিলাম।আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“আমি যাচ্ছি না। আমি ফিরছি।”
“ওহ আচ্ছা।”
“জি। এত রাতে বাহিরে হাঁটাহাটি করবেন না। রাত জিনিসটা খুব একটা ভালো নয়।”
ফাবিহা মুক্ত আকাশে জড়িয়ে থাকা তারাগুলো দেখল। কেমন ঝলমল করছে। ফাবিহা শান্ত কণ্ঠে বলল, “আমার কাছে তো মন্দের কিছু লাগছে না।”
আরহানের ভাড়ি কণ্ঠের জবাব,
“পৃথিবীতে এমন অনেক দৃশ্য আছে যেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না।”
ফাবিহা বিস্মিত কণ্ঠে শুধায়,
“মানে?”
“মানে খুব জটিল।”
“সহজ করে বলুন।”
“আপনায় বলতে চাচ্ছি না।”
চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল ফাবিহা। এটা কেমন কথা হলো। সে বলল,
“কথাটা বেমানান লাগল না।”
কিছুটা জড়ালো কণ্ঠে আওড়াল আরহান,
“আপনি কি মানবেন— আমি গোটা মানুষটাই বেমানান!”
চমকে উঠল ফাবিহা। এসব কি বলছে আরহান! ফাবিহা বিভ্রান্ত ভরা কণ্ঠে বলল,
“আপনার কি কিছু হয়েছে?”
“হুঁ! খানিকটা মাথা ধরেছে।”
“আজ খুব খেটেছেন না?”
আরহান সরাসরি চাইল ফাবিহার চোখের দিকে। ফাবিহা থমকে গেল। আরহানের চোখ লাল। চুলগুলোও বড্ড এলেমেলো। আরহান বলল,
“পুরুষ মানুষের জীবনটাই খাটুনির রৌদ্রময়ী।”
এ'কথার পিঠে ফাবিহা কি বলবে বুঝতে পারছে না! সে চুপ হয়ে গেল। আরহান এক গলা হেঁসে বলল,
“আপনায় বিভ্রান্তে ফেলতে আমার কেন যেন দারুণ লাগে!”
ফাবিহা চায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। আরহান একটু অদ্ভুতভাবে কথা বলছে না এখন। ফাবিহা বলল, “আপনি নিজেও বিভ্রান্তে ভরা তাই মানুষকে বিভ্রান্তে ফেলতে আপনার দারুণ লাগে।”
আরহান আবারও হাসল। খুবই চমৎকার দেখাল সেই হাসি। আরহান বলল,
“কথাটা মিথ্যে নয় সত্যই। আচ্ছা ভালো থাকবেন। রাতে বেশি হাঁটাহাঁটি করবেন না। ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকুন।”
আরহান চলে গেল। ফাবিহা ঠায় দাঁড়িয়ে। ছেলেটা কি বলে গেল সব যেন মাথার উপর দিয়ে গেল। হঠাৎ পিছন থেকে রাহেলা ডাকে,
“আপা, ও আপা। এদিকে আহেন। রাতবেরাতে কই হাঁটেন। ভূতে ধরবে ভূতে। আপা, ও আপা।”
রাহেলার কথা শুনে চরম বিরক্ত হলো ফাবিহা। তবে কিছু বলল না। দ্রুত ছুটে গেল ঘরে।
•••••••••••••
সকালের তীব্র রোদখানা আচমকা মুখে এসে পড়ল আরহানের। আরহান বিরক্ত হয়ে মুখটা অন্যদিকে ঘুরাল। তার মাথা ব্যাথা খানিকটা সেরেছে। হঠাৎ আবছা আবছা কি যেন ভেসে উঠল চোখের সামনে। কাল রাতে, বাড়ির ফেরার পর হঠাৎ ফাবিহার সাথে সাক্ষাৎ হয়। কি কি যেন বলছিল সে! আরহান ঘুমন্ত বেসে কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করল। না— মনে পড়ছে না। একটু চিন্তা করতেই হাল্কা একটা কথা মনে পড়ল আরহানের। যেখানে সে কিসের ভিত্তিতে যেন বলছিল,
“আপনি কি মানবেন— আমি গোটা মানুষটাই বেমানান!”
কিসের ভিত্তিতে বলেছিল কথাটা। আরহানের মাথায় চাপ পড়ল। কিন্তু না কেন বলেছিল মনে পড়ছে না। কপট চোখজোড়া খুলে ফেলল আরহান। কোথায় আছে, না আছে বোঝার চেষ্টা করল। এরপরই সটান হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। মাথায় আবারও খানিকটা চাপ প্রয়োগ হলো। আরহানের একটা সমস্যা হলো তার মাথা যন্ত্রণা উঠলে মাথার ঠিক থাকে না। কাকে কি বলে খেয়াল আসে না!' কি যেন একটা ভাবল আরহান। ফাবিহাকে রাতে কি বলেছিল সে? কি কি বলেছিল? না মনে পড়ছে না। মাথাটা চেপে ধরল আরহান। ঠিক সেই মুহূর্তে তার সামনে কড়া লিকারের চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল তৌহিদ। বলল,
“এটা খেয়ে নে।”
আরহান মাথা থেকে হাত সরাল। চাইল তৌহিদের দিকে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“কাল রাতে আমি কি ভুলভাল কিছু বলে ফেলেছিলাম?”
“না।”
কিছুটা শান্ত হলো আরহান। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে দ্রুত চায়ের কাপে চুমুক দিল। শান্ত এগিয়ে আসলো তখন। রান্নাঘরে বসে আরহানের জন্য চা'টা সেই বানিয়েছিল। আরহান বলল,
“কাল রাতে আমার মাথা যন্ত্রণা করছিল তাই না?”
তৌহিদ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়,
“হুম।”
“তোদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম?”
“না।”
“মিথ্যে বলছিস?”
“আরেহ না।”
খাটে বসতে বসতে বলল তৌহিদ। আরহান বলল,
“কালকে খাটুনিটা হয়তো একটু বেশি হয়েছিল।”
“হ্যাঁ। আজ আর তোকে কিছু করতে হবে না।”
বিনিময়ে কিছু বলল না আরহান। আবারও চায়ে চুমুক দিল। চুমুক শেষে প্রশ্ন করল,
“খুব জ্বালিয়েছিলাম তোদের?”
শান্ত হাত নাড়াল। যার মানে, “না।”
অসয়হায় বোধ করল আরহান। দুজনেই কথা চাপাচ্ছে। আরহানের অবস্থা বুঝতে পেরে তৌহিদ বলল,
“আরেহ সত্যি বলছি। কাল যখন তুই দরজায় নক করেছিলি। তখন তোকে দেখেই আমি বুঝেছিলাম তোর মাথা ধরেছে। তাই তো জোর জবরদস্তি করে কিছু খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলাম। সঙ্গে দিয়েছিলাম ঘুমের ঔষধ। তারপর সব শান্ত।”
এবার কিছুটা শান্তি শান্তি অনুভব হলো আরহানের। কিছু সময় গেল। হঠাৎই দরজায় খটখট করে আওয়াজ আসে। কে জেনো দরজা ধাক্কাচ্ছে। তৌহিদ বলল,
“কে?”
ওপাশ থেকে মাসুদ উদ্দিনের কণ্ঠ শোনা যায়। তিনি বলেন, “আমি।”
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে দরজা খোলে। তৌহিদ বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রশ্ন করে,
“মাসুদ আঙ্কেল আপনি?”
মাসুদ উদ্দিন এগিয়ে আসলেন। আরহানের তখন এলোমেলো বেশ। মাসুদ উদ্দিন হেঁটে এসে সোজা খাটে বসলেন। মিষ্টি হেঁসে জানালেন,
“তোমাদের সাথে কিছু কথা বলতে আসলাম।”
আরহান চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রাখল। বলল, “জি বলুন।”
মাসুদ উদ্দিন দ্বিধাহীন বলতে লাগলেন,
“আজ তো আমার ছেলে বউ আনতে যাবে। আমি চাচ্ছি তোমরাও বরযাত্রী হিসেবে যাও।”
আরহান কিছুসময় চুপ থেকে বলল,
“আমাদের না গেলে হয় না।”
“কেন কোনো সমস্যা আছে?”
এবার তৌহিদ এগিয়ে এলো। বলল,
“আসলে আঙ্কেল আরহানের শরীরটা একটু খারাপ। আর আমারও মনে হয় আমাদের না যাওয়াটাই ঠিক হবে। আমরা আপনাদের ভাড়াটিয়া বরযাত্রী হিসেবে আমাদের যাওয়াটা কি মানানসই?”
মাসুদ উদ্দিন চুপ থাকলেন না। বললেন,
“তোমরা শুধুমাত্র আমার ভাড়াটিয়া নও তৌহিদ। তোমরা আমার ছেলের মতো। আরহানকে এক সময় আমি পড়িয়েছি। আর আরহান জানে ওর সাথে আমার সম্পর্ক শুধু বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটিয়ার নয়।”
আরহান বলল,
“স্যার রাগ করবেন না। তৌহিদ আর শান্ত যাবে।”
আরহানের কথা শুনে তৌহিদ তাকাল আরহানের দিকে। মনে মনে বলল, “শালায় কি বেয়াদব, নিজের কাজটা আমাদের দিয়ে দিয়েছে?”
মাসুদ উদ্দিন মেনে নিলেন। বললেন,
“ঠিক আছে। তোমার শরীর খারাপ তাই তোমায় জোরও দিতে পারলাম না।”
“কোনো ব্যাপার না আঙ্কেল। আমি বাড়িতে আছি। যতক্ষণে তৌহিদ ওরা বউ নিয়ে আসবে ততক্ষণে আমি সুস্থ হয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।”
কথা শেষে মাসুদ উদ্দিন বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে তৌহিদ শান্তকে বললেন, “ঠিক বারোটার সময় তৈরি হয়ে থাকতে।”
তৌহিদ একপ্রকার বাধ্য হয়ে বলল, “ঠিক আছে।”
মাসুদ উদ্দিন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই আরহানকে বলল, “শালা সব জায়গায় সুযোগ খুঁজিস খালি। কাউকে চিনি না জানি না মাঝখান থেকে বউ আনতে যাব।”
উত্তরে হাসল আরহান। যেন তৌহিদকে বিভ্রান্তে ফেলে তার দারুণ লাগছে। অবশ্য আরহান নিজেও বিভ্রান্তে ভরা মানুষ, তাই তো মানুষকে বিভ্রান্তে ফেলতে তার দারুণ লাগে। আবারও হাসল আরহান। ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুখ কুঁচকে উঠল তার।
.
.
.
চলবে......................................................................