" অপমান করো না নীলি। এই শাহরুখ মার্কা চেহারা দেখেই আমার প্রেমে পড়েছিলে তুমি।"
স্মরণকে আরোও কিছু বলার পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েছিলো নীলিমা। কিন্তু স্মরণের এহেন কথায় থতমত খেলো সে। এখন উপায়? এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলবে সে? কয়েক সেকেন্ড ভেবে অতঃপর বেশ আত্মবিশ্বাসের সহিত তবে খানিক আমতা আমতা করে বললো,
" ও- ওসব ব্রিটিশ আমলের কথা। পুরোনো হয়ে গিয়েছে। "
স্মরণ এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে খানিক হেসে নিলো। ভ্রু নাচিয়ে টিপ্পনী কেটে বললো,
" ব্রিটিশ আমলের প্রেমটা কি তবে স্বাধীন আমলে আসেনি?"
নীলিমা নিশ্চুপ। খানিক জোরপূর্বক নিশ্চুপ সে। কেননা এর জবাব 'না' দিতে গিয়ে এক অদ্ভুত সংকোচে 'না' বলেনি। উল্টো স্মরণকে দ্রুত ফোন ফিরিয়ে দিয়ে হম্বিতম্বি করে বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বললো,
" আম্মু ডাকছে আমাকে। "
নীলিমার এ কান্ডে স্মরণ পিছে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসলো।
স্মরণ ফোন নিয়ে বাড়িতে ঢুকলে নাজমা বেগম দ্রুত সেমাইয়ের বাটিটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
" দ্রুত সেমাইটুকু খেয়েনে। তোর আব্বুর খাওয়া শেষ। এক্ষুণি নামাজের জন্য বের হবে। "
স্মরণ মায়ের কথা শুনে আর দেরি করলো না। দ্রুত সেমাইটুকু খেয়ে নিলো। ততক্ষণে আনিস সাহেব ও আনোয়ার সাহেব, দুই ভাই মিলে বাহাদুর শেখকে রুম থেকে নিয়ে এলো। বাকিরা আগেই বেরিয়ে পড়েছে। বাহাদুর শেখের জন্যই তারা অপেক্ষা করছিলো। তাদের বাড়ি থেকে ঈদগাহ খুব বেশি দূরে না। হেঁটে গেলে সর্বোচ্চ ৭ থেকে ৮ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু ভোরের দিকে হালকা বৃষ্টি হয়েছে বলে পিচ্ছিল রাস্তায় বাহাদুর শেখকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে চাননি কেউ। তাই তাঁর জন্য আলাদাভাবে ভ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাহবুব আগে থেকেই ভ্যান ঠিক করে রেখেছিলো। আনিস সাহেব ও আনোয়ার সাহেব বাহাদুর শেখকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠোন পেরিয়ে ভ্যানে উঠিয়ে দিলো। তাঁর সাথে আনিস সাহেবও উঠলো। আর বাকিরা এক হাতে জায়নামাজ নিয়ে পিচ্ছিল রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো।
-----------
ঈদের নামাজ শেষে আগে পিছে করে সব ছেলেরাই বাড়ি ফিরলো। আসার সময় প্রত্যেকেই প্রায় চানাচুর, পাপড়, খই, বাতাসা, খুরমা, কদমা নিয়ে ফিরলো। বিশেষ করে নীলিমা তার বাবা ইমাদ সাহেবকে বলে দিয়েছিলো তার জন্য গ্রামের ঐ ছোট ছোট প্যাকেটের চানাচুর আনতে। এটা নীলিমার ভীষণ পছন্দের। নানুবাড়ি এলেই বাজার থেকে ঐ চানাচুরগুলো কিনিয়ে এনে খাবে সে।
ইমাদ সাহেব বাড়িতে ঢুকেই নীলিমাকে ডেকে তার হাতে চানাচুরের প্যাকেটগুলো ধরিয়ে দিয়ে বললো,
" এই নে, তোর পছন্দের চানাচুর। তোর জন্য স্পেশালি তিন প্যাকেট। আর বাকিগুলো তুইসহ সবার মধ্যে ভাগ করে দিস। "
ছোট বাচ্চাদের মতো পছন্দের খাবার পেয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত হলো নীলিমা। মাত্রই গোসল করে বেরিয়েছে সে। পরনে শুভ্র রঙা এক থ্রিপিস। বাড়িতে আসার আগে ইমাদ সাহেবের সাথে গিয়ে নিজে পছন্দ করে এই পাকিস্তানি থ্রিপিসখানা কিনেছে। শুভ্র রঙের কাপড়ের উপর ক্রিস্টাল পাথর ও পুথির কাজ করা কামিজটা দেখতে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। ওড়নাটাও তেমনই কাজে পূর্ণ৷ থ্রিপিসটা তার উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের গায়ের রঙে ভীষণ মানিয়েছে। উপরন্তু ভেজা চুলে তাকে স্নিগ্ধ শীতল আবহে মন্ডিত এক রূপসী নারী হিসেবে দেখা যাচ্ছে। তার এ উচ্ছ্বসিত রূপখানা ইমাদ সাহেবের কাঁধ ছাপিয়ে ঠিক পিছন থেকে লক্ষ্য করলো স্মরণ। তার দু হাতে পাপড়ের প্যাকেট। রাফি তার পিছু পিছু এসে বায়না ধরে পাপড়ের সবগুলো প্যাকেট বাগিয়ে নিতে হাত বাড়াচ্ছে। কিন্তু স্মরণের দৃঢ় হাতের বন্ধনে সে প্যাকেট কেড়ে নিতে পুরোপুরি অক্ষম হচ্ছে রাফি। উপরন্তু স্মরণের সকল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু এ মুহূর্তে নীলিমা। তা অবশ্য রাফির অজানা৷ তার সকল মনোযোগ ঐ পাপড়ের প্যাকেটের উপর।
স্মরণের নিষ্পলক দৃষ্টি নিবদ্ধ নীলিমার উপর। নীলিমার এ উষ্ণহীন সৌন্দর্য তার অন্তঃকরণে এক অদ্ভুত অনুভূতির উদগীরণ ঘটালো। মস্তিষ্কের নিউরনের কর্মক্ষমতা ক্ষণিকের জন্য বিরতি নিলো। হৃদস্পন্দনও অস্বাভাবিকহারে স্থিতিশীল হলো। স্মরণ বেশ বোধ করতে পারছে, এ অনুভূতিটা একপ্রকার শীতলতা দিচ্ছে সমস্ত শরীরে। যে অনুভূতিতে আচ্ছাদিত হয়ে ক্ষণিকের জন্য জগৎ-সংসারের সকল চিন্তাভাবনা ভুলে থাকা যায়।
স্মরণ ধীরে ধীরে এগুচ্ছে আর ইমাদ সাহেবের কাঁধ ছাপিয়ে নীলিমাকে দেখছে। এ যেনো সিনেম্যাটিক মুহূর্তের আবহ তৈরী করছে। তা অবশ্য পিছন থেকে একমাত্র মাহবুবই খেয়াল করতে পারছে। সে স্মরণের এ কান্ডে রীতিমতো বিস্মিত ও শিহরিত। সে অবাক হচ্ছে এই ভেবে যে যে স্মরণ নীলিমাকে রিজেক্ট করেছিলো, আজ সেই স্মরণ জগৎ দুনিয়া ভুলে হা করে নীলিমাকে দেখছে। কি আশ্চর্যজনক ব্যাপার!
মাহবুব অবশ্য এ দেখে ভেতরে ভেতরে ভীষণ খুশি হলো। স্মরণকে এবার এ নিয়ে বেশ খোঁচাখুঁচি করা যাবে। জমবে ভালো।
স্মরণ আসার আগেই নীলিমা চানাচুরের প্যাকেট নিয়ে কোমড় অব্দি ছড়িয়ে থাকা ভেজা চুল নিয়ে এক ছুটে রুমে চলে এলো। এখনও ঈদের সাজটা দেয়া বাকি। তবে এর আগে এক্ষুণি সবার কাছ থেকে ঈদ সালামি সংগ্রহ করে নিতে হবে। পরে 'দেরি হয়ে গিয়েছে' বাহানা দিয়ে কেউই সালামি দিবে না। তাই নীলিমা চানাচুরের প্যাকেটগুলো রেখেই রাফাকে নিয়ে সোজা আনিস সাহেবের রুমে অর্থাৎ তার বড় মামার রুমে হামলা চালালো। আনিস সাহেব মেয়ে দুটোকে চাওয়া মাত্রই দুইশো দুইশো চারশো টাকা সালামি ধরিয়ে দিলেন। এভাবে মামা, খালু, বাবাদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার পর নীলিমা ও রাফা এলো সাজিদের কাছে। ঈদগাহ থেকে ফিরে মাত্রই ঈদের পাঞ্জাবি ছেড়ে একটা টিশার্ট গায়ে জড়ালো। আজ কেমন যেনো ভ্যাপসা গরম লাগছে তার। অন্য কারোর অবশ্য এতোটাও গরম লাগছে না, যতোটা না তার গরম লাগছে। সাজিদের শরীরে অবশ্য স্বাভাবিকের চেয়ে গরম একটু বেশিই লাগছে।
রুমে ঢুকেই নীলিমা ও রাফা ৫০০ টাকা ঈদ সালামি দেয়ার বায়না করলো। সাজিদ শালিকাদের জ্বালাতে প্রথম প্রথম একটু মিছে তালবাহান করলো। পরে অবশ্য দুজনের হাতেই ৫০০ করে ১০০০টাকা ধরিয়ে দিলো। দুজনে বেশ খুশি মনে টাকা নিয়ে চলে গেলো। এর দু মিনিটের মাঝে নওরীন রুমে প্রবেশ করলো। সাজিদকে সাধারণ টিশার্টে দেখে নওরীন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
" কি ব্যাপার? এত দ্রুত ঈদের পাঞ্জাবি খুলে ফেললে?"
সাজিদ টিশার্টের কলার ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
" অনেক গরম লাগছিলো। পরে বাইরে গেলে আবার পরবো। "
" উফ তোমার যে কি গরম! আর কারোর এত গরম লাগছে না তো।"
বলেই সে সাজিদের ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো। কণ্ঠে নমনীয়তা এনে শুধালো,
" শোনো না... মোনাজাতে দোয়া করেছিলে তো?"
সাজিদ নওরীনের এমন আকুলতা মিশ্রিত কণ্ঠে আলতো হাসলো। ডান হাত নওরীনের গালে রেখে বললো,
" এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়! দোয়া করেছি আমি। তুমি যেমন মা হতে চাও, আমিও তো বাবা হতে চাই। দেখো, আল্লাহ আমাদের দোয়া নিশ্চয়ই পূরণ করবেন। "
নওরীনের চোখজোড়া এবার ভিজে এলো। আবেগে আপ্লূত হয়ে সাজিদকে জড়িয়ে ধরলো সে। এই ফাঁকে সাজিদ তার হাতে ১০০০টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বললো,
" আমার হবু বাবুর আম্মুর ঈদ সালামি।"
নওরীন এবার খুশি হয়ে সাজিদকে আরোও শক্ত করে জাপটে ধরলো।
নীলিমা ও রাফা এবার স্মরণের কাছে গেলো। স্মরণ তখন ফোনে তার এক কলিগের সাথে কথা বলছিলো। নীলিমাকে দেখা মাত্রই সে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কেননা সে একা নয়, রাফাও আছে তার পাশে। দুজনের চেহারা দেখে স্পষ্ট ধান্দাবাজ মনে হচ্ছে। স্মরণের সন্দেহ হচ্ছে, নিশ্চয়ই দুজন কোনো বড় ধরণের লুটতরাজ চালাতে এসেছে। তাদের মিটিমিটি হাসি দেখে তো এমনটাই মনে হচ্ছে!
স্মরণ ফোন রেখে সন্দেহজনক চাহনিতে চেয়ে শুধালো,
" কী? ব্যাপার কী? দুজন ওভাবে হাসছো কেনো?"
দুজনের কেউই প্রথমে জবাব দিলো না। তবে একে অপরকে গুঁতাতে লাগলো, কে আগে সালামির কথা তুলবে এ নিয়ে। তাদের এ গুতোগুতি স্মরণ দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
" কী হলো? মতলব তো ঠিক লাগছে না তোমাদের। "
রাফা এবার বলেই ফেললো,
" স্মরণ ভাই! ঈদ সালামি দিন। "
রাফার কথা শোনা মাত্রই স্মরণের ভ্রুজোড়া সোজা হয়ে এলো। দুজনের উদ্দেশ্যে জানতে পেরে বললো,
" জানতাম! কোনো না কোনো ধান্দা নিয়ে এসেছো দুজন। চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছি।"
রাফা এবার দাঁত কেলিয়ে স্মরণের সামনে ডান হাত পেতে বললো,
" দিন দিন, আপনিই বাকি আছেন। "
রাফার দেখাদেখি এবার নীলিমাও হাত পেতে আসলো। মিষ্টি আবদারে বললো,
" ঈদ সালামি দিন স্মরণ ভাই। যত দেরি করবেন তত টাকা বাড়বে। "
নীলিমার মিষ্টি আবদারের কাছে স্মরণের হার নিশ্চিত যেনো। স্মরণের অবচেতন মন বললো নীলিমার মিঠা আবদারের কাছে নিজের মানিব্যাগটা উজাড় করে দিতে। কিন্তু তার সচেতন মস্তিষ্ক সজাগ হলো। পকেটের টসটসে মানিব্যাগের করুণ কান্নায় সে চট করে বলে বসলো,
" ঈদের সাজে সজ্জিত ভদ্র পরিবারের দুই ফকির আমার কাছে হাত পাতছে! হোয়াট আ সিন!"
.
.
.
চলবে...................................