রৈনীলের জন্য অপেক্ষা করছি। প্রতিটা সেকেণ্ড কাটছে উৎকণ্ঠায়। সে কীভাবে মনের অনুভূতি জানান দেবে, আমিই বা কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না। দূর হতে যখন দেখলাম রৈনীল আসছে, আমার পক্ষে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো।
সে এসেই মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। সেই হাসি দেখে আমার মুগ্ধতা বেড়ে গেলো হাজারগুণ। আমি হা করে চেয়ে আছি তার দিকে। কখন শুনবো সেই কথাগুলি, যা আমার কাছে কল্পনার চেয়েও মধুর!
রৈনীল একটা বেঞ্চিতে বসলো। আমাকেও বলে দিলো তার পাশে বসতে। আমি নিঃসংকোচে পাশে এসে বসলাম। এখন থেকে আমরা এভাবেই সবসময় পাশাপাশি বসবো, ভেবে আমার বুকে আনন্দের ঢেউ খেলে গেল।
রৈনীল বললো, 'তোমার কি পড়াশোনা করতে ভালো লাগে সরণী?'
'হুম। লাগে তো।'
'তুমি কি কখনো ভেবেছো বিয়ে করবে কবে?'
আমি লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলাম। বিয়ে দিয়ে শুরু করতে হলো! ইশ, এত দ্রুত কি কেউ বিয়ের কথা ভাবে নাকি। অবশ্য রৈনীলের যা বয়স তাতে ওর দুই পুত্রের বাপ হওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে। এখন সে তো বিয়ে নিয়ে সিরিয়াস হবেই।
আমি লজ্জায় তাকাতে পারছি না। রৈনীল নিচু হয়ে ঝুঁকে আমার মুখের দিকে তাকালো। চোখ বুজে ফেললাম আমি।
রৈনীল বললো, 'লজ্জা পাচ্ছো দেখি। আই এম সরি।'
'ইটস ওকে। আমার বিয়ে নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। কখনো ভাবিও নি এসব নিয়ে। আমার ফ্যামিলিতে আগে কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো। বাবা মা সবাইকে বলতো আমার মেয়ে এখনো অনেক ছোট। বিয়ে দিবো না। আর এরপর সায়েমের ব্যাপারে মাকে একটু আগ্রহী দেখা গিয়েছিল কিন্তু বাবা মায়ের এই আগ্রহ দমিয়ে দিয়েছে। আমার কখনোই বিয়ের প্রস্তাব এলে ভালো লাগতো না। রাগ হতো। তবে নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে ভালো লাগবে কিনা এই প্রশ্ন এখনো নিজেকে করে দেখিনি।'
'তুমি যথেষ্ট ম্যাচিউরভাবে উত্তর দিয়েছো। আশাকরি আমার কথাগুলো তুমি সহজেই বুঝতে পারবে।'
'বলুন।'
'তোমার পছন্দের মানুষটা কি আমি?'
আমি আবারও চোখ বন্ধ করে ফেললাম। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো। কোনোমত নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করছি, রৈনীল আমার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিলো।
আমি চোখ মেললাম।
রৈনীল বললো, 'সরি সরণী। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। জানি জীবনের প্রথম ফিলিংসটাকে এড়ানো কঠিন। খুব কষ্ট হবে। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। আই এম রিয়েলি সরি।'
'মানে!'
আমি চোখ বড়বড় করে ওর দিকে তাকালাম। রৈনীল বললো, 'আমি তোমাকে ছোটবোনের চোখে দেখি। তোমার আমার বয়সের ব্যবধান অনেক বেশী। বয়স মানে, মানসিকভাবেও তুমি এখন ভীষণ ছোট। আমাদের লাইফ পার্টনার হবার সুযোগ নেই। দুজনের জগত সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের কখনোই কোনোরকম সম্পর্ক হওয়া উচিৎ না। তুমি কি বুঝতে পেরেছো আমি কি বলছি?'
আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। যেন পুরো পৃথিবীটা আমার দুলে উঠলো। মুহুর্তেই সবকিছু ঝাপসা হয়ে উঠতে লাগলো। টের পেলাম আমার চোখ ভিজে উঠেছে। ভেতর থেকে এক দলা কান্না গলায় এসে আটকে গেলো।
রৈনীল বললো, 'তোমাকে সবকিছু বিস্তারিত বলতে হয় না। তুমি আগেই সব বুঝে ফেলো। এটা ভালো। আশাকরি সব বুঝতে পেরেছো। কষ্ট পেও না। নিশ্চয়ই তোমার জীবনে ভালো কেউ আসবে। তুমি বাকি জীবনে অনেক সুখী হবে সরণী।'
আমি কান্না সংযত করলাম। রৈনীলের সামনে নিজেকে ছোট করতে একদমই ইচ্ছে করলো না। শক্তি সঞ্চয় করলাম ভেতর থেকে। তারপর কয়েকটা বড়বড় শ্বাস নিয়ে বললাম, 'যদি শুধু বয়সের ব্যবধান নিয়ে বলতেন, আমি বলতাম সায়েমের সঙ্গেও আমার এরকমই বয়সের ফারাক ছিলো। আপনি বিয়ে করতে চাইলে আমি নিঃশর্তে রাজি হয়ে যেতাম। যে জিনিসটা ভয়ংকর বিরক্ত লাগতো, সেটাই সবচেয়ে আকাঙ্খিত হয়ে উঠতো আমার কাছে। আপনি আমার বাসায় প্রস্তাব দিলেও আমার ফ্যামিলি অমত করতো না। স্বাগতা আপু আর জুবায়ের ভাইয়ার একটু সাপোর্ট পেলেই কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমরা এক হতে পারতাম। কিন্তু এগুলো সমস্যা নয়। আপনার যখন আমার জন্য কোনো ফিলিংসই নেই, যখন আমাদের মানসিক পার্থক্যই সবচেয়ে বেশী, যখন আপনি আমাকে ছোটবোনের চোখেই দেখেন, তখন আর বাকিসব বিষয় নিয়ে ভাব্বার অবকাশ নেই। আমাকে মাফ করবেন। আপনাকে ভালো লাগার জন্য আমি দুঃখিত।'
রৈনীলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি হাঁটা ধরলাম। সে পেছন থেকে আমার হাত ধরলো। আমি বললাম, এই হাত ধরাটা আপনার কাছে নরমাল ব্যাপার হলেও এটাতেও আমার ফিলিংস জড়িয়ে ছিলো। আমার সঙ্গে আর কক্ষনো কথা বলবেন না। কোনোদিন না।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমি দ্রুতপদে প্রস্থান করলাম। কয়েক মিনিট টানা হেঁটে রিসোর্টের বেশ দূরে একটা লেকের পাড়ে এসে ঘাসের ওপর বসলাম। মাথা নিচু করে হাউমাউ করে কাঁদলাম কিছুক্ষণ। আমি জানি আমি অনেক স্ট্রং। এইটুকু কষ্ট নিশ্চয়ই কাটিয়ে উঠতে পারবো। তবুও প্রত্যাখাত হওয়ার মতো কষ্টের যেন আর কিছুই নেই। নিজেকে বড্ড ছোট মনে হচ্ছে। রৈনীলকে ছাড়া আমি জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়েছি, বাকি জীবনও কাটাতে পারবো। এই অল্প সময়ের স্মৃতির অসুখটা দ্রুত সেরে যাক।
নিজেকে যতই বোঝাতে যাই না কেন, কান্না আটকানো দায়। কতক্ষণ যে এভাবে কাঁদলাম আমি! অন্ধকার হয়ে আসছে। সবাই রওনা দেবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। আমি উঠলাম, ভিলায় ফিরতে হবে।
ফেরার সময় পুরোটা পথ অনেক ভালো থাকার ভান ধরে রইলাম। যেন রৈনীল বুঝতে পারে, সে আমাকে যতটা ছোট ভাবে আমি ততটা ছোট নই। আমি যথেষ্ট ম্যাচিউরড। সবার সঙ্গে হাসাহাসি, গল্প, গান নিয়ে ব্যস্ত রইলাম আমি।
স্বাগতা আপু বাসায় ফিরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, 'রৈনীল ভাইয়া আমাকে বললো তোর দিকে খেয়াল রাখার জন্য। কি হয়েছে তোর? ওনাকে কি কিছু বলেছিস নাকি?'
'না তো।'
'তাহলে? তুই কি ডিপ্রেশনে আছিস?'
'না আপু।'
'ওনার হয়তো মনে হয়েছে তুই স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিস। তাই খেয়াল রাখতে বলেছে।'
'ওনাকে জানিয়ে দিও আমার কোনোই স্ট্রেস নেই। আমি খুবই ভালো আছি। এবং ভবিষ্যতেও ভালো থাকব।'
আপু কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি এমন ভাব করে চলে গেলো রুম থেকে। আমি শুয়ে পড়লাম।
তবে আজকের রাতটা ছিলো আমার জীবনের অতীতে কাটানো সমস্ত বিভীষিকাময় রাতের চেয়েও জঘন্যতম। এতটা কষ্ট, এতটা তীব্র দহন, এতটা মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে আমি কোনোদিন ঘুমাই নি। ঘুম তো দূরের কথা, আমি এক সেকেন্ড শান্ত থাকতে পারছিলাম না। ওয়াশরুমের মেঝেতে বসে বসে চিৎকার করে কান্না করেছি অনেক রাত জুড়ে।
পরেরদিন বাসায় ফিরলাম তীব্র জ্বর নিয়ে। ঠাণ্ডা পানির শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে ভিজেছি বলে এত জ্বর। তবে জ্বর আসায় একটা উপকার হলো। আমি যে ভীষণ কষ্টে আছি সেটা আমার মা ধরতে পারলেন না। মা ভাববেন জ্বরের কারণে আমাকে এমন দেখাচ্ছে।
সুস্থ হয়ে যেদিন ভার্সিটিতে এলাম, ফারাহ এসে আমাকে এক জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গেলো। সে আমার মনের অবস্থা জানে। তাই পুরোটা সময় আমার মন ভালো করে দিতে চেষ্টা করলো।
আস্তে আস্তে নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম। পূর্ণ মনযোগ দিলাম পড়াশোনায়। একদিন মায়ের সঙ্গে খুব মন খারাপ হলো। মা অনেক খারাপ আচরণ করলেন আমার সঙ্গে। আমি নিজেকে শান্ত করতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এরপর হঠাৎ খেয়াল হলো আমি আপন মনেই রৈনীলকে কল্পনা করতে শুরু করেছি। একা একা কথা বলছি রৈনীলের সঙ্গে। এই যেমন,
কল্পনার রৈনীল বললো, সরণী তোমার মন খারাপ কেন?
'মা বকেছে।'
'আরে পাগলী মন খারাপ করোনা। আমি একটা গল্প শোনাই তোমায়।'
'আচ্ছা।'
এরপর রৈনীল গল্প বলতে আরম্ভ করে দিলো। শুনতে শুনতে ওর জগতে হারিয়ে গেলাম আমি। এরপর থেকে যখনই মন খারাপ লাগতো, আমি রৈনীলকে কল্পনায় আনার চেষ্টা করতাম।
একদিন খুব ইচ্ছে করলো রৈনীলের আপডেট জানতে। ফেসবুকে একটা একাউন্ট খুলে ওর নাম লিখে সার্চ দিলাম। তাকে খুঁজে পেলাম না। ফারাহ আমাকে হেল্প করলো ওকে খুঁজে পেতে। আইডিতে ঢুকে ওর পোস্ট গুলো পড়া শুরু করলাম।
শুরু হলো আমার জীবনে আরেক অধ্যায়। লুকিয়ে লুকিয়ে রৈনীলকে রোজ পড়া, ওর ছবি দেখা, আর ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণ ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করা।
একদিন হঠাৎ একটা ভ্লগ দেখে আমার মনে হলো এরকম ছোট ছোট ভ্লগ ভিডিও তো আমিও বানাতে পারি। তেমন কিছু না, শুধুই রেডি হওয়া। ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় সাহস করে একটা ভিডিও বানিয়েই ফেললাম, "গেট রেডি উইথ মি।"
আপলোড করার পরে ফারাহ আমাকে একটা পেইজ ক্রিয়েট করে দিলো। ওর সাহায্যে পেইজে আপলোড করে দিলাম ভিডিওটা। একদিন পরে এটার রেসপন্স দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ফারাহ শেয়ার দিয়েছিলো। এক হাজারের বেশী মানুষ আমার ভিডিওটা দেখেছে।
ফারাহ'র বুদ্ধিতে টানা এক সপ্তাহ ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় ঝটপট "গেট রেডি উইথ মি" বানিয়ে আপলোড দিতে লাগলাম। এবং এক সপ্তাহ শেষে আমার ফলোয়ার্স সং্খ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেলো।
আমার সিম্পল সাজ আর পরিপাটি জামাকাপড় সবাই খুব পছন্দ করেছে। রৈনীলের জগত ভুলে নতুন আরেক জগতে পদার্পণ করলাম আমি। প্রতিটা দিন আমার জীবনে নতুন উন্মাদনা নিয়ে আসছে। সকালে উঠেই সবার এপ্রিশিয়েট করার মতো কমেন্টগুলো পড়ি। মন ভালো হয়ে যায়। এই জগতে এসে আমি বেশ উত্তেজনায় দিন পার করতে লাগলাম।
.
.
.
চলবে.........................................................................