তুমুল রাগ নিয়ে স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তৌহিদ। মেজাজ তার খিটখিটে। রাগে সর্বাঙ্গ কাঁপছে। রাগ করার কারণ হলো তার জুতো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েক মুহূর্তে আগে মাসুদ উদ্দিনের ডাক পেয়ে স্টেজের ওপর উঠেছিল তৌহিদ। জুতো জোড়া রেখে ছিল নিচে। কিন্তু এখন পাচ্ছে না।
কতক্ষণ আগেই কবুল বলার মাধ্যমে বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে আহির আর উর্মির। সবাই আলহামদুলিল্লাহ জানিয়ে মোনাজাতও ধরেছিল। এরপর খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকানো হলো। খাওয়া দাওয়ার পর্বে অরিন, ফাবিহা, তৌহিদ, শান্ত এরা সবাই এক টেবিলে বসেছিল। খাওয়া দাওয়া, পরিবেশন সবই দুর্দান্ত ছিল। তারপরই আসলো বিদায়ের পালা। এরই মধ্যে মাসুদ উদ্দিন স্টেজে ডাকল তৌহিদও গেল। কথোপকথন শেষ করে যেই নামল তখন দেখল তার জুতা নেই। এতটুকু সময়ের মধ্যে কে নিয়ে গেল ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না তৌহিদের। তার চেয়েও বড় কথা তার জুতা নেমে কেন? কোনো ছ্যাচড়া চোর আসছিল নাকি। তৌহিদ জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিল। কি করবে ভাবার প্রচেষ্টা। শান্ত এগিয়ে আসলো তখন। ইশারায় বোঝাল, “কি হয়েছে?”
তৌহিদ তার পা দেখাল। যার মানে তার জুতা নেই। শান্ত অবাক হয়ে গেল। বোঝাল, “দাঁড়া আমি খুঁজে দেখছি।”
বাক্সে ভরে বরের জুতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মোহনা। তার উদ্দেশ্য হলো জামাই বউ যেই মুহুর্তে স্টেজ থেকে নামবে। আহির দুলাভাই জুতা না পেয়ে হাতাহাতি শুরু করবে ঠিক সেই মুহূর্তে তার এন্ট্রি হবে। দুহাজারের নিচে এক পয়সাও কম দিলে জুতা দিবে না। আর এই কাজটা একমাত্র মোহনা আর তার পিচ্চি কাজিন রাজু মিলে করছে। মোহনার দৃষ্টি স্টেজের দিকে। স্টেজের এক কর্ণারে তৌহিদ স্যার দাঁড়িয়ে আছে। লোকটাকে মাশাল্লাহ সেই দেখতে। সাহস করে সামনে যাওয়া যাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু দূর থেকে প্রশংসা করাও ছাড়ছে না।'
দেখতে দেখতে স্টেজ থেকে আহির নামল। মোহনার চোখ সেই মুহূর্তে চড়ুই গাছ হলো যেই মুহুর্তে দেখল আহির তার পায়ে জুতা পড়ে হেঁটে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য! আহিরের কাছে তার জুতা হলে সে হাঁটছে কিভাবে? পরমুহূর্তেই ভাবল তবে কি মোহনা ভুল করে জামাইর জুতার জায়গায় অন্যকারো জুতা নিয়ে চলে এসেছে। হায় রে! এবার কি হবে?"
রাগে ক্ষোভে এখনও দাঁড়িয়ে আছে তৌহিদ। শান্ত এসে নিরাশ কণ্ঠে জানাল, 'সে জুতা খুঁজে পায়নি।'
অতঃপর তৌহিদ সিদ্ধান্ত নিল জুতাহীনই বাড়ি যাবে। এই মুহূর্তে কোনো প্রকার ঝামেলা সে চাচ্ছে না। মেজাজ অতিরিক্ত খারাপ হয়ে গেলে জ্ঞানশূন্য লাগে সবকিছু।'
তুমুল কান্নাকাটি। আর ইমোশনাল পরিস্থিতি শেষ করে গাড়িতে উঠে বসল সবাই। মোহনা আহাম্মকের মতো তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কি হবে ভেবেছিল, আর কি হয়েছে এখনও বুঝতে পারছে না। শেষমেশ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সবাই বউ নিয়ে বাড়ি ফিরল। তৌহিদের জুতা চুরির ব্যাপারটা মানুষের ভিড়ে লুকিয়ে গেল। তবে মোহনা দেখেছে তাকে ঠিক শেষ মুহূর্তে যে মুহূর্তে জুতা ফেরত দেয়ার সুযোগ ছিল না। তার এত খারাপ আর ভয় লাগছিল বলা যাচ্ছিল না।'
বাড়ির এসে আরহানের সে কি হাসি! উচ্চ শব্দের হাসি। কি অবাক কান্ড? বরের জায়গায় তৌহিদের জুতা চুরি করেছে কেউ। তার চেয়েও বিস্ময়ের কান্ড হলো তৌহিদ বিনা বাক্যে নিজের জুতা বিয়ে বাড়ি রেখে চলে এসেছে। আরহান হাসছে। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। তৌহিদ গম্ভীর মুডে বসে বসে আরহানের হাসি দেখছে। শান্ত মাঝে মাঝে মিটমিট হাসছে। তৌহিদ চোখ রাঙাচ্ছে আবার থেমে যাচ্ছে। আবারও আড়ালে হাসছে। এমন বিচ্ছিরি অবস্থা তৌহিদের জীবনে কখনো হয়নি। আরহান হাসতে হাসতে বলল,
“দোস্ত, তুই যে এইভাবে জুতা ফেলে চলে আসবি এটা আমি কল্পনাও করিনি।”
তৌহিদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“শালা তুই তো কোনো কথাই বলিস না— যা হয়েছে সব তোর জন্য।”
আরহান জবাব দিল না। শুধু হাসল। কি এক অবাক কান্ড!
••••••••••••••
“এই মেঘলা দিনে একলা,
ঘরে থাকে না তো মন।
কাছে যাব, কবে পাব?
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।”
“কাছে যাব, কবে পাব? ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।”
শেষের লাইনটায় আরহান কণ্ঠ শোনা গেল। সে মাইক্রোফোনের সামনে ঠোঁট রেখে আরো বলল,
“আজ আকাশটা মেঘলাময় হলে মন্দ হতো না৷ অথচ আজ আকাশটা মেঘলাময় নয়। কেন নয়! আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আকাশটাকে যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম তাহলে বেশ হতো। এই যখন মন খারাপ হবে, তখন ঝমঝম বৃষ্টি নামবে, প্রবল শীতে কটকটা গরম থাকবে, আর প্রবল গরমে মধুময়ী বাতাস। আচ্ছা আকাশ কি বাতাস দেয়? নাকি বাতাস গাছে দেয়। যেখানে গাছ নেই সেখানে কি বাতাস হয় না? প্রশ্নটা কি জটিল! নাকি সাধারণ! আপনাদের কাছে উত্তর থাকলে অবশ্যই আমাকে কল করে জানাতে পারেন 82904 এই নম্বরে। আমি অপেক্ষা বসে। আপনাদের আরজে সাহেব ওরোফে আরজে আরহান।'
ক্রিং ক্রিং কল বাজল। আরহান ফোনটা তুলল। বলল, “আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন?”
“ওলাইকুম আসসালাম। আমি তিথি। সিলেট থেকে বলছি।”
“দারুন। কেমন আছেন আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো তো?”
“জি আমি ভালো। বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“একটা সুন্দর গান শোনাতে পারেন।”
“বলুন কি গান শুনবেন?”
“আমার মনটা খানিকটা খারাপ। মন ভালো হয় এমন টাইপের কিছু একটা শোনান।”
আরহান সরল মনে প্রশ্ন করল,
“নিশ্চয়ই শোনাব। কিন্তু আপনার মন খারাপ কেন কারণটা কি বলা যায়?”
“জি যায়। আজ আমার হাসবেন্ড আকাশের জন্মদিন। ওর জন্য কেক নিয়ে অপেক্ষা করছি। কিন্তু ও এখনও আসছে না। তাই মনটা একটু খারাপ।”
“ওহ আচ্ছা। দুঃখ মনে রাখবেন না হয়তো আকাশ ভাই খানিকটা ব্যস্ত তাই আসতে দেরি করছে। কিন্তু উনি যদি আমাদের শো টা দেখতে বা শুনতে থাকেন তবে আমি অবশ্যই বলব, আকাশ ভাই ভাবি আপনার জন্য কেক নিয়ে অপেক্ষা করছে দ্রুত বাড়ি যান।”
তিথি হেঁসে ফেলল। বলল,
“আপনি মানুষটা মন্দ নন আরহান সাহেব।”
“ধন্যবাদ ভাবি। আপনার আর ভাইয়ের জন্য অসংখ্য দোয়া রইল। সবসময় ভালো থাকবেন। আর হ্যাঁ নেক্সট গানটা আপনার মন ভালো করার জন্য।”
কল কেটে গেল। এর কিছু সময় পরই গান ছাড়া হলো—
❝আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন
আজ ঐ চোখে সাগরের নীল,
আমি তাই কি— গান গাই কি?
বুঝি মনে মনে হয়ে গেল মিল।❞
কানে ইয়ারফুন গুঁজে দোতলার ছোট্ট বারান্দায় বসে আছে ফাবিহা। ইদানীং আরহানের আরজে শো না দেখলেই বুঝি চলছে না। কি অস্থির! অস্থির লাগে চারপাশ। এই যে ছেলেটা তিথির কথা শুনে কি সুন্দর গানটা ছাড়ল। ভালো লাগল ফাবিহার। তার মনে ছোট্ট প্রশ্ন জাগে, আরহান বুঝে কিভাবে কোন সময়ে কোন গানটা ছাড়লে পরিবেশটা দারুণ স্মৃতিময় ও সুন্দর হয়। হেঁসে ফেলল ফাবিহা। চোখ বন্ধ করে তিনবার উচ্চারণ করল, সুন্দর সময়, সুন্দর সময়, নিদারুণ সুন্দর সময়। আকাশ তখন লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। প্রকৃতির আলোকে জানান দিচ্ছে, ' ধরণীতে সন্ধ্যা নামছে।'
•••••••••••••••
আজ আহিরের বউভাত। তুমুল হুল্লোড় চলছে গত তিনদিন যাবৎ। আজকেরটা যেন একটু বেশিই। নাচগান চলছে কাল রাতে থেকে। পরশুর বউয়ের আগমণ বুঝি আরো সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি করল। আরহান, তৌহিদ ব্যস্ত। শান্ত ঘরে। তার বাহিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। কেন যেন অরিনের চাহনি তার পছন্দ হয় না। কেমন করে যেন তাকায় মেয়েটা। মনে হয় ঘৃণার দৃশ্য। যদিও শান্তর বোধগম্যের মতে অরিনের তাকে ঘৃণা করার মতো কোনো কারণ নেই। তবুও কেমন যেন।'
তখন দুপুর। মেয়েপক্ষের অনেকেই বৌভাতের অনুষ্ঠানে চলে এসেছে। অতিথি নিবাসে শান্ত, তৌহিদ, আরহান তৈরি হচ্ছে। আজ আরহান মেরুন রঙের পাঞ্জাবি-পাজামা জড়িয়েছে গায়ে। তৌহিদ আর শান্ত শার্ট পড়েছে। গায়ে হলুদ, বিয়ে দুই অনুষ্ঠানেই তারা পাঞ্জাবি পড়েছিল। এর জন্যই মূলত শার্ট জড়ানো গায়ে। আরহান তার গায়ে পারফিউম মাখতে মাখতে বলল,
“হয়েছে তোদের?”
শান্ত মাথা নাড়াল। আর তৌহিদ বলল, “হুম।”
দরজার বাহিরে বের হতেই একটা জুতার বাক্স নজরে পড়ল আরহান, তৌহিদ আর শান্তর। তৌহিদ কৌতুহলী উঠাল বাক্সটা। বাক্স খুলতেই তিনজনই অবাক হয়ে গেল। কারণ বাক্সের ভিতর তৌহিদের সেদিনকার জুতা। ভিতরে একটা চিরকুট। তৌহিদ চিরকুট খুলে পড়তে শুরু করল। যেখানে লেখা,
“ভুল করে বিয়ের আসরে বরের জুতোর জায়গায় এই জুতো নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি খুবই দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।”
নাম-টাম কিছু নেই। আরহান বলল,
“বাহ্! ব্যাপারটা সেই তো। কে করল বলতো— বিয়ে বাড়িতে তেমন কাউকে লক্ষ্য করেছিলি তুই?"
তৌহিদ অনেক ভেবে মাথা নাড়াল। যার অর্থ, “না।"
.
.
.
চলবে.....................................................................