সূর্য তার স্বাভাবিক গতিতে পশ্চিমে অস্ত গেল। প্রকৃতির অদম্য নিয়মে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এলো ধরণীতে, অমানিশার কালো অন্ধকার যেনো গ্রাস করছে গোটা পৃথিবীকে। পুরো আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের ঝলকানির খেলায় মাঝে মাঝে কাঁপছেন ফারিয়া বেগম। সে অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের মধ্যে কেমন যেনো ধড়ফড় করছে? স্থির হয়ে বসতে পারছেন না। চোখের আড়ালে দুইজন ছেলে মেয়ে তার, হঠাৎ করে সন্তানদেরকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন ফারিয়া বেগম। আরুশিকে বেশ কয়েকবার ফোন করেন কিন্তু আরুশি তার কল ধরেনি। ছেলে তো দূর দেশে, সে-ও ফোন ধরলো না। মায়ের মন হঠাৎ কু ডাকছে, আবার অসময়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল।
ফারিয়া বেগমের বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ বাড়ছে। কয়েক বছর আগে তার মা মারা যাওয়ার সময় তিনি এমনটা অনুভব করেছিল। দুদিন ধরে সে অকারণে অস্থির বোধ করেন। তারপর দুদিন পর চিঠি এলো মা আর নেই। ফারিয়া বেগম মাথায় হাত রেখে আকাশের দিকে বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন। বড় ছেলে, পুত্রবধূ আর নাতনি চোখের সামনে রয়েছে, শুধু মেয়ে আর ছোট ছেলেটা দূরে, সকল দুশ্চিন্তা তাদের ঘিরেই। হুইল চেয়ার ঠেলে রুমে আসেন শফিকুল চৌধুরী। স্ত্রীকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
'কি হয়েছে? কি নিয়ে এতো টেনশন করছ?'
ফারিয়া বেগম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিরক্ত গলায় বললেন,
'বিয়ের পর আমাদের মেয়েটা কেমন বদলে গেছে। আমাদের ছাড়া আগে একটুও থাকতে পারত না। এখন আমি কল করি আর সে রিসিভ করে না। মাঝে মাঝে তো ফোন বন্ধ ও থাকে। যেদিন ফোন করি, তার পরদিন কল ব্যাক করে দুইটা কথা বলে কল কেটে দেয়। আর ছেলেটাও এমন, বিয়ে করেছে কিন্তু তার পুরনো স্বভাব এখনও বদলায়নি। আমাদের একটু খোঁজ নিলে ওদের কি হয়?'
শফিকুল চৌধুরী গম্ভীর গলায় বললেন,
'ছেলে বউকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে এক সপ্তাহ হলো, এখন ওরা নিজ ইচ্ছে মতো সময় কাটাবে। তুমি বারবার কল দিয়ে বিরক্ত করছ কেন?'
ফারিয়া বেগম ফ্যাকাশে গলায় বললেন,
'আমি শুধু শুধু কল করছি না, মনের মধ্যে কেমন অদ্ভুত লাগছে।'
শফিকুল চৌধুরী বললেন,
'ওইসব তোমার মনের ভুল।'
ফারিয়া বেগম নিশ্চুপ। উনি আর কথা বললেন না। মনে মনে বহুবার আল্লাহকে ডাকলেন। উনি আর কাউকে হারাতে চান না। শফিকুল চৌধুরী নীরব স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
'শুনলাম বেয়াই মশাই এসেছিল, কি বলে গেছেন উনি?'
ফারিয়া বেগম মাথা নেড়ে বললেন,
'বেয়াই মশাই বাজার থেকে এই পথে বাড়ি যাচ্ছিলেন তাই আমাদের সাথে দেখা করার জন্য এসেছিলেন আর জোজো উনাকে দেখে অনেক চিৎকার করছিল। তাই কিছু দিনের জন্য জোজোকে ওনার বাড়ি নিয়ে গেছেন।'
শফিকুল চৌধুরী বললেন,
'বেশ ভালো, অনেকদিন পর কুকুরটা তার আপন লোকজনের কাছে থাকবে।'
ফারিয়া বেগম বললেন,
'আমরা কি তার আপন লোক নই?'
'হ্যাঁ, অবশ্যই আমরা তার আপন মানুষ। কিন্তু জোজোর জন্মের পর থেকে রোদেলা মা তাকে লালন-পালন করেছে। রোদেলা মা ও তার মামা হলো জোজোর প্রথম আপনজন। আমরা তো কিছু দিন যাবৎ ধরে তার দায়িত্ব নিয়েছি।'
ফারিয়া বেগম ভারী নিঃশ্বাস ফেললেন। শফিকুল চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন,
'আপনার মাথা ব্যাথা করছে কি? সম্ভব হলে একটু ঘুমাও।'
ফারিয়া বেগম কড়া গলায় বললেন,
'আমি ঘুমানোর পর তখন যদি আমার ছেলে কল দেয়?'
শফিকুল চৌধুরী নরম গলায় বললেন,
'সেহরিশ আর আরুশি যেই কল করবে আমি তোমাকে ডেকে দেবো। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারো।'
ফারিয়া বেগম বললেন,
'ডাকবে কিন্তু।'
শফিকুল চৌধুরী মৃদু হাসলেন। স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে মৃদু স্বরে বললেন,
'তোমার ছেলেমেয়েরা কল করবে আর আমি তোমাকে ডাকব না এটা কি কখনও সম্ভব? চিন্তা করো না আমি এখানেই বসে থাকবো যতক্ষণ না তুমি ঘুম থেকে উঠবে।'
ফারিয়া বেগম ঘুমানোর চেষ্টা করেন।
❐
দুদিন অনবরত বৃষ্টি হওয়ার পর রাস্তা ঘাট সব কাঁদা কাঁদা হয়ে গেছে। বাড়ির আঙিনায় বিশাল বড় গাছটা ভেঙে রাস্তা ব্লক হয়ে গেছে। এই পথে কোথাও যাওয়া সম্ভব না। ভার্সিটি যাওয়ার জন্য অন্য পথ ঘুরে এলো জুবিয়া। বৃষ্টির কারণে রিকশাওয়ালা চড়া ভাড়া চাচ্ছে, জেদ করে অনেকটা পথ হেঁটেই এলো সে। এরপর আর হেঁটে যাওয়া সম্ভব না বাধ্য হয়ে রিকশাতে উঠতে হলো। পুরো আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘের রাজত্ব, দূরেতে গাছপালা হাওয়ায় মৃদু দুলছে। ঠান্ডা হিমশীতল বাতাস এসে গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশটা দেখে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল জুবিয়া। এই অসময়ে বৃষ্টি চায় না সে। ঝরঝরে বৃষ্টিতে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে অনেক বেগ পোহাতে হবে তার। এ নিয়ে টেনশনে পড়ে গেল জুবিয়া।
ব্যাগের মধ্যে ফোনটা হঠাৎ বাজতে লাগল। তাড়াহুড়ো করে ফোন বের করে স্কিনে চোখ রাখল। জুবিয়া ভাবছিল তূর্ণ কিন্তু তার ভাবনা এবারও ভুল, গ্রাম থেকে মা কল দিয়েছে। জুবিয়া কল রিসিভ করলো না। ফোনটা আবার ব্যাগে রেখে দিল। এই সময় মায়ের কল রিসিভ করা মানে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া। আর তার সবকটা প্রশ্ন ঘিরে থাকবে তূর্ণ। তিন দিন হয়ে গেল, তূর্ণ একবারও ফোন করেনি। নিজ স্ত্রীকে ভুলে গেছে। এতই ব্যস্ত সে?
রিকশার পেছন থেকে একটা মাইক্রো গাড়ি এসে রিকশার সামনে থামল। রিকশা থামিয়ে হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন চালক। জুবিয়া বিরক্তিতে কপালে চার ভাজ ফেলল। ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেলল। গাড়ি থেকে দুজন বডিগার্ড নেমে এলো। জুবিয়ার উদ্দেশ্য তারা সালাম জানিয়ে বলল,
'আসসালামু আলাইকুম ম্যাম। আপনি একাই বের হয়েছেন কেন? আপনার আমাদের জন্য অপেক্ষা করা দরকার ছিল। স্যার যদি জানতে পারেন আপনি প্রতিবার একা একা বাড়ি থেকে বের হন আর আমরা সেটা লক্ষ্য রাখি না তাহলে আমার চাকরি থাকবে না। কেনো এই অবুঝ বাচ্চাদের চাকরি নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন?'
জুবিয়া বলল,
'আমার দেরি হচ্ছিল তাছাড়া আমি তোমাদের বলিনি আমাকে ফলো করার জন্য। আমি মানুষ আস্বামী নই সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখতে হবে না।'
প্রথমজন বললেন,
'স্যরি ম্যাম। স্যারের হুকুম। আপনি এখন রিকশা থেকে নামুন আর গাড়িতে উঠুন।'
জুবিয়া বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে বলল,
'মাইক্রো গাড়িতে আমার বমি আসে।'
দ্বিতীয়জন বলল,
'আপনার যেনো সমস্যা না হয় এজন্য অন্য গাড়ি নিয়ে আসছি। আশা করি এই গাড়িতে আপনার মাথা ঘুরবে না আর বমি ও আসবে না।'
জুবিয়া ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
'তবুও যেতে হবে?'
দ্বিতীয়জন জবাব দিল,
'জি ম্যাম। স্যারের হুকুম।'
অন্য সময় হলে জুবিয়া এখন হেসে ফেলত কিন্তু এখন তার হাসি মোটেও পাচ্ছে না। বরং বিরক্ত লাগছে, রাগ হচ্ছে তূর্ণর উপর। সে বডিগার্ডদের তার ওপর এমন ভাবে কড়া নজরদারি করতে বলছে যে জুবিয়া বাড়ি থেকে এক পা বাহিরে রাখলেও দুজন গার্ড ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। সব জায়গায় তাকে ফলো করে। বডিগার্ডদের হাতে বন্দুক দেখে ক্লাসের বন্ধুরা সামনে এসে কথা বলার সাহস পায় না। সবার সঙ্গে কেমন দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে যেন। জানালা ঘেঁসে বসল জুবিয়া। রাজ্যের মন খারাপ এসে ভিড় জমিয়েছে তার ছোট্ট মনে। উমাইয়ার সঙ্গে প্রায় কথা হয়, তার শরীর আজকাল ঠিক থাকে না। জুবিয়া হঠাৎ মৃদু হেসে উঠল। কিছু মাস পরেই খালামনি হবে সে। আর যেন তর সইছে না তার৷ ইচ্ছে করছে ছুটে যেতে উমাইয়ার কাছে আর গলা জড়িয়ে ধরে মা হওয়ার শুভেচ্ছা দিতে ইচ্ছা হচ্ছে। কবে সামনে থেকে দেখবে তাকে? ইশশ, লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল জুবিয়া। ইচ্ছা হলো উমাইয়ার সঙ্গে কথা বলার৷ জুবিয়া তার ফোনটা বুকের সাথে চেপে ধরলো তারপর বিড়বিড় করে নিজেকে প্রশ্ন করলো,
'আচ্ছা, মা হওয়ার অনুভূতি কেমন? সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি, তাই না?'
.
.
.
চলবে.........................................